বুড়িগঙ্গা ইকোপার্ক

যে বুড়িগঙ্গাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল আজকের এই রাজধানী ঢাকা, সেই বুড়িগঙ্গা এখন সবার চোখের সামনেই ধীরে ধীরে মরে যাচ্ছে। নদী খেকোদের থাবা কেড়ে নিয়েছে তার আগেকার স্রোতধারা। তার বুকের একাংশ ভরাট করে গড়ে তোলা হয়েছে বসতবাড়ি, শিল্প-কারখানা। সর্বোপরি দখল ও দূষণে প্রায় স্তিমিত হয়ে পড়েছে ঢাকার প্রাণপ্রবাহ এই বুড়িগঙ্গা। বুড়িগঙ্গা নিয়ে সুখবর কোথায়? বুড়িগঙ্গার হাজারো নেতিবাচক খবরের ভিড়ে সাম্প্রতিক সময়ের একটি ইতিবাচক সংবাদ কিছুটা হলেও স্বস্তি দেয়। ইটপাথরের ব্যস্ত নগরীর মানুষকে একটু প্রশান্তি আর প্রকৃতির ছোঁয়া দিতে দখলদারদের হটিয়ে রাজধানীর উপকণ্ঠে শ্যামপুর ইউনিয়নে বুড়িগঙ্গার তীরে গড়ে তোলা হয়েছে একটি নানন্দিক ইকোপার্ক। 

প্রকল্পের উদ্যোক্তা

কিছুদিন আগেও জায়গাটি পূর্বপুরুষের ভিটার মতো ব্যবহার করত স্থানীয় ভূমিদস্যুরা। কাউকে তারা জমাখরচ দিত না। এখানে ইট ওখানে বালি ফেলে রেখে সারাবছর ব্যবসা করত। বাজে লোকদের আড্ডা, হুল্লোড় চলত রাত অব্দি। পুরো এলাকার পরিবেশ এভাবে দারুণ বিচ্ছিরি হয়ে উঠেছিল। এ জায়গার মালিক বিআইডব্লিউটিএ। সরকারি সংস্থাটি নীরবে সব সহ্য করেছে- এমন নয়, মাঝে মধ্যেই তারা দখলবাজদের উচ্ছেদ করেছেন। কিন্তু কিছুদিন যেতে না যেতেই ফের সেখানে ঘাঁটি গেড়েছে দুর্বৃত্তরা। হ্যাঁ, এ পর্যায়ে হাল ছেড়ে দেওয়াই সাধারণত নিয়ম। কিন্তু সেটি না করে এবং একটু ভিন্নভাবে আমূল পাল্টে দিয়েছে। একই জায়গায় গড়ে তুলেছে অদ্ভুত সুন্দর এক ইকোপার্ক। বুড়িগঙ্গা নদীর তীরভূমি থেকে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করে অবমুক্তকৃত ৭ একর জায়গার উপর এই ইকোপার্ক নির্মাণ করা হয়েছে। ‘বুড়িগঙ্গা নদী ও নদীর তীর দখলমুক্ত করার লক্ষ্যে বন্দর ও অন্যান্য সুবিধা নির্মাণ’ ও রাজধানীর নৌ-পর্যটন সুবিধা বাড়ানো এবং নদীর তীরে স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশ গড়ে তোলার লক্ষ্যে অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) এই ইকোপার্ক প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে।

বিশ্রাম ছাউনি

প্রকল্প বাস্তবায়ন

নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান গত ৭ অক্টোবর আনুষ্ঠানিকভাবে এই পার্কের উদ্বোধন করেন। কাজ শুরু হয় গত বছরের পহেলা আগস্ট। আর চলতি বছরের ৩০ জুন প্রথম পর্যায়ের নির্মাণ কাজ শেষ হয়। প্রথম পর্যায়ে নির্মাণ ব্যয় হয়েছে ১ কোটি ৪৭ লাখ টাকা। বর্তমানে পুরো এলাকাটি নয়নাভিরাম সবুজে ঢাকা। এমনটা সম্ভব হয়েছে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগের সুবাদে। বিআইডব্লিউটিএ’র ব্যবস্থাপনায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ‘বুড়িগঙ্গা ইকোপার্ক’। আর তাতেই বদলে গেছে পুরো এলাকার দৃশ্যপট। তবে ইকোপার্কে প্রবেশের জন্য দর্শনার্থীদের টিকিট কিনতে হবে বলে বিআইডব্লিউটিএ সূত্র জানায়।

নান্দনিক এক গার্ডেন

বিআইডব্লিউটিএ সূত্রে জানা যায়, ইকোপার্ক নির্মাণের আগেই এ জায়গায় ৬০ থেকে ৭০টি গাছ লাগানো হয়েছিল। এগুলো এখন পরিণত। এ ছাড়াও পার্কজুড়ে নতুন করে বহু গাছ লাগানো হয়েছে। গার্ডেনিং করা হয়েছে। পার্কের ভেতর রয়েছে চমৎকার ওয়াকওয়ে। শ্যামপুর থেকে ফতুল্লা অভিমুখী প্রায় ৫ দশমিক ৫ কিলোমিটার হাঁটার পথ (ওয়াকওয়ে); যা পরিবেশসহায়ক বলে বিবেচিত হচ্ছে এবং বর্তমানে জনগণ ব্যবহার করছে। আর একটু জিরিয়ে নেবেন? সে ব্যবস্থাও আছে। তৈরি করা হয়েছে বেশ কিছু বিশ্রাম শেড। রঙিন এসব শেডের নিচে বসে দেখা যাবে চারপাশ। বিশাল বিশাল ছাতাও আছে। এখানে ওখানে পাতা আছে কংক্রিটের চেয়ার। হাত-পা ছড়িয়ে বসতে পারবেন। দিনের আলো নিভে গেলেও ভয় নেই। জ্বলে উঠবে বৈদ্যুতিক বাল্ব। খাবার পানির ব্যবস্থা, টয়লেট কমপ্লেক্স, গার্ড শেড ইত্যাদি সুবিধাও ইতোমধ্যে নিশ্চিত করা হয়েছে। তবে বিশেষ করে বলতে হবে বুড়িগঙ্গা নদীর সঙ্গে যুক্ত অংশটির কথা। নদীর সঙ্গে শহুরে মানুষের সম্পর্কটিকে নিবিড় করতেই যেন পার্কের এই অংশে চমৎকার গ্রিল, শ্যামপুর ও পাগলা এলাকায় তীর রক্ষা ও নদী ভরাট রোধকল্পে প্রায় ৬০০ মিটার ভার্টিক্যাল ওয়াল ইত্যাদি নির্মাণ করা হয়েছে। এখানে বসে দেখা যাবে বুড়িগঙ্গার রূপ।

ইকোপার্কের ওয়াকওয়ে

পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা জানান, অনেকেই বলবেন, বুড়িগঙ্গার আর রূপ কী! কিন্তু না, এখানে ড্রেজিং করা হয়েছে। ফলে যথেষ্টই নদী হয়ে ধরা দেবে বুড়িগঙ্গা। আর ভরা বর্ষায় তো কথাই নেই, স্বচ্ছ পানি ছুঁয়ে দেওয়া যাবে পা দিয়ে। এখানেই শেষ নয়।

গত ৭ অক্টোবার বিকেলে নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান প্রধান অতিথি হিসেবে ইকোপার্ক উদ্বোধন করতে গিয়ে বলেন, আবহমান বাংলার ঐতিহ্যকে সযত্নে ধারণ করার লক্ষ্যে এ ইকোপার্কের অভ্যন্তরে দেশের প্রথম নৌ-জাদুঘর স্থাপনের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। বলা বাহুল্য, এটি হলে অনেক বেশি উপভোগ্য হয়ে উঠবে ইকোপার্ক। একই সাথে পার্কটিকে আকর্ষণীয় করতে কাছাকাছি দূরস্লি অবস্থিত পর্যটন কর্পোরেশনের মেরিন অ্যান্ডারসন রেস্তোরাঁটিকে এখানে স্থানান্তর করা হবে বলে জানান সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। দর্শনার্থীদের সুবিধার্থে নদীতে ভ্রমণের জন্য এ পার্কে একটি জাহাজের ব্যবস্থা করা হবে বলে ঘোষণা দেন নৌমন্ত্রী।

অত্যন্ত প্রশংসনীয় এ উদ্যোগ সম্পর্কে বিআইডব্লিউটিএ’র চেয়ারম্যান ড. মোঃ শামছুদ্দোহা খন্দকার বলেন, ঢাকা শহরের নৌ-পর্যটন সুবিধাদি বৃদ্ধি এবং নদীর তীরে স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশ গড়ে তোলার লক্ষ্যে আমরা কাজ করছি। এরই অংশ হিসেবে এই ইকোপার্ক গড়ে তোলা হয়েছে। এটি অভিনব উদ্যোগ কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটি আসলে শুভবুদ্ধির ফসল। এর ফলে জায়গাটি দখলের পথ স্থায়ীভাবে বন্ধ হয়েছে। একইভাবে একে জনগণের জন্য ব্যবহার করা সম্ভব হয়েছে। তিনি বলেন, আমরা নদীর জায়গা নদীকে ফিরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছি। ভবিষ্যতেও এমন আরো উদ্যোগ নেওয়া হবে বলে জানান তিনি।

বুড়িগঙ্গার তীরে গড়ে ওঠা দর্শনীয় ইকোপার্কের দৃশ্যপট

এলাকাবাসী যা বলেন

বুড়িগঙ্গা ইকোপার্ক নিয়ে স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যেও দারুণ আনন্দ-উচ্ছ্বাস পরিলক্ষিত হয়েছে। আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের আগে থেকেই কৌত‚হল নিয়ে এখানে আসতে শুরু করেছেন অনেকে। পার্ক এলাকা ঘুরে দেখতে এসেছিলেন আশিক আহমেদ নামের এক সরকারি চাকুরে। স্ত্রী এবং দুই ছেলে-মেয়ে নিয়ে আসা স্থানীয় এই বাসিন্দা বাড়ির কাছে এমন একটি পার্ক পেয়ে দারুণ উচ্ছ¡সিত। উদ্যোগটির প্রশংসা করে তিনি বলেন, ঢাকা দিন দিন ছোট হয়ে আসছে। ইট-পাথরের এই শহর আমাদের জীবনকে অস্বাভাবিক করে তুলছে। এ অবস্থায় বুক ভরে নিশ্বাস নেওয়ার একটু জায়গার খুব দরকার ছিল। এ পার্ক সে প্রত্যাশা পূরণ করবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি। তবে হাবিব আলম নামের আরেক তরুণ জোর দিলেন অন্য জায়গায়। বললেন, পার্ক শুধু করলেই হবে না, এর রক্ষণাবেক্ষণ করতে হবে। তা না হলে জায়গাটি আবারও সেই নষ্টদের দখলে চলে যাবে। সংশ্লিষ্টদের এদিকটি গুরুস্লির সঙ্গে ভাববার পরামর্শ দেন তিনি।

এলাকার আরেক বাসিন্দা সুমন পাটোয়ারী বলেন, গত বছরও এ জায়গাটি ভূমিদস্যুদের দখল আর নষ্টদের দখলে ছিল। এখন সব কিছুই স্বপ্নের মতো মনে হয়। এত দ্রুত এত পরিবর্তন হবে, ভাবতেও পারিনি।

ইকোপার্কে বিশ্রামরত দর্শনার্থী

পার্কের পাশের চা দোকানি মোঃ মাওলা বক্স জানালেন, ‘এখানে এক সময় মাদকসেবী ও ব্যবসায়ীদের অত্যাচার ছিল। প্রায় সময় এখানে লাশ পাওয়া যেত। এখন পার্কটি হওয়ায় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন, সুন্দর আর এলাকার জনগণের জন্য এটি নিঃসন্দেহে স্বর্গে পরিণত হয়েছে। 

‘কী ছিল, আর কী হয়েছে। এলাকার চেহারাটাই পাল্টে গেছে। এখান দিয়ে হাঁটলে মনে হয় এটা পুরান ঢাকার সবচেয়ে ভালো জায়গা। বুড়িগঙ্গার পানি পরিষ্কার আর গন্ধমুক্ত হলে এটিই পুরাতন ঢাকাবাসীর প্রিয় জায়গায় পরিণত হবে’- কথাগুলো বলছিলেন শ্যামপুর ইউনিয়নের বাসিন্দা সোলায়মান আহমেদ জিসান। এমন বক্তব্যের সঙ্গে এখন একমত পোষণ করেন এলাকার আরো অনেকেই। 

প্রকল্পের প্রধান উদ্দেশ্য

কামরাঙ্গীরচর থেকে ফতুল্লা অভিমুখী (পূর্ব তীর) ফোরশোর ভূমি স্থায়ীভাবে দখলমুক্ত রাখার জন্য ওয়াকওয়ে, কি-ওয়াল নির্মাণ ও বৃক্ষরোপণ কাজ; সদরঘাট টার্মিনালের আধুনিকায়নসহ প্রকল্প এলাকায় বিভিন্ন ল্যান্ডিং স্টেশনে বন্দর ও অন্যান্য সুবিধা নির্মাণের মাধ্যমে সদরঘাটের ট্রাফিকগুলো বিতরণ করা; বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে সৌন্দর্য বৃদ্ধি ও পরিবেশগত উন্নয়নের জন্য বিনোদন সুবিধাদি নির্মাণ। প্রকল্প বাস্তবায়নে সব মিলিয়ে খরচ ধরা হয়েছে প্রায় ৩৫ কোটি টাকা।

পরিশেষ

ইট-পাথরের এই শহর আমাদের জীবনকে অস্বাভাবিক করে তুলছে। এ অবস্থায় বুক ভরে নিশ্বাস নেওয়ার একটু জায়গার খুব দরকার ছিল। এ পার্ক সে প্রত্যাশা পূরণ করবে। পার্ক শুধু করলেই হবে না, এর রক্ষণাবেক্ষণ করতে হবে। তা না হলে জায়গাটি আবারও ভূমিদস্যু আর সেই নষ্টদের দখলে চলে যাবে।

ইকোপার্কের পায়ে হাঁটা পথ

এক নজরে

প্রকল্পের নাম : বুড়িগঙ্গা ইকোপার্ক।

প্রকল্প বাস্তায়নকারী সংস্থা : অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ)।

প্রকল্প তত্ত্বাবধানকারী সংস্থা : অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ)।

মোট জমির পরিমাণ : ৭ একর।

মোট বাজেট : ১ কোটি ৪৭ লাখ টাকা।

প্রকল্পের কাজ শুরু : গত বছরের ১ আগস্ট।

প্রকল্পের কাজ শেষ : চলতি বছরের ৩০ জুন প্রথম পর্যায়ের নির্মাণ কাজ শেষ হয়।

মেহেদী হাসানই-মেইল- [email protected]

প্রকাশকাল: বন্ধন ৩১ তম সংখ্যা, নভেম্বর ২০১২

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top