সুুইমিং পুলের সাত-সতেরো

আমরা কতটুকুই-বা কায়িক পরিশ্রম করি! হয়তো প্রয়োজনের তুলনায় খুবই সামান্যই! এ কারণে বার্ধক্য আসার আগেই আমরা বুড়িয়ে যাই। যাঁরা চেয়ার-টেবিলে বসে কাজ করেন, তাঁদের জন্য সাঁতারের কোনো বিকল্পই নেই। সাঁতারের জন্য সবচেয়ে উপযোগী স্থান নদী কিংবা পুকুর। ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার দেশে পুকুরের সংখ্যা দিন দিন কমছেই। এখন পুকুরগুলো বেশির ভাগই বাণিজ্যিক মৎস্য পুকুর (ফিশারি)। নদীর কথা তো বলাই বাহুল্য। যে হারে নদীদূষণ হচ্ছে এবং নাব্যতা হারাচ্ছে, তাতে নদীর কথা না ভাবাই ভালো। সাঁতার কাটার জন্য নদী ও পুকুরের বিকল্প সুইমিং পুল। সুইমিং পুলের আদ্যোপান্ত জানাচ্ছেন সারোয়ার আলম

সুইমিং পুল-কথন
সুইমিং পুল একটি ইংরেজি শব্দ, যার বাংলা অর্থ সাঁতার পুকুর। এটি এমন এক স্থাপনা যা সাঁতার ছাড়াও গোসল, অবসর বিনোদন বা জলক্রীড়ার মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করা হয়। সুইমিং পুল বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ভূগর্ভে (মাটি খুঁড়ে পুকুরের মতো) নির্মাণ করা হয়, তবে আরও বিভিন্ন ক্ষেত্র যেমন ভবনের ওপরতলায় কিংবা জাহাজেও সুইমিং পুল নির্মাণ করা হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ভূপৃষ্ঠের ওপরে চৌবাচ্চার মতো করে গ্লাস কিংবা প্লাস্টিক দিয়েও সুইমিং পুল বানানো হয়। সুইমিং পুল সাধারণত কংক্রিট, প্রাকৃতিক পাথর, ধাতু, প্লাস্টিক বা তন্তুকাচ (Fiber Glass) জাতীয় উপকরণ দিয়ে নির্মিত হয়। এটি যেকোনো আকার-আকৃতির হতে পারে বা প্রচলিত আকারেও নির্মিত হতে পারে, যার মধ্যে বৃহত্তম ধরনটি হচ্ছে অলিম্পিক-আকারের সাঁতার-পুকুর বা সুইমিং পুল।

সুইমিং পুলে শিশুর দুরন্তপনা

সাধারণত শরীরচর্চা কেন্দ্রগুলোতে সুইমিং পুল থাকে অনুশীলন ও বিনোদনের জন্য। তবে শহরের কোনো কোনো এলাকায় সর্বসাধারণের জন্যও উন্মুক্ত থাকে সুইমিং পুল। হোটেল, রিসোর্ট এবং অবকাশ যাপন কেন্দ্রগুলোতে সুইমিং পুল নির্মাণ করা হয় অতিথিদের বিনোদনের জন্য। অনেক ক্ষেত্রে স্কুল, কলেজ কিংবা বিশ^বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ শিক্ষার্থীদের শারীরিক শিক্ষার পাঠদান, বিনোদন এবং সাঁতার প্রতিযোগিতার জন্য সুইমিং পুল নির্মাণ করে থাকেন।

সুইমিং পুলের ধারণা
খ্রিষ্টপূর্ব তৃতীয় সহস্রাব্দে ভারতীয় উপমহাদেশে প্রথম সুইমিং পুল নির্মাণ করা হয়। উপমহাদেশের পাকিস্তানে প্রাচীন মহেঞ্জোদাড়ো নগরীতে ‘মহাস্নানাগার’ হিসেবে এই পুলটি নির্মাণ করা হয়েছিল। এটিই ছিল ইতিহাসের সর্বপ্রথম সাঁতার পুকুর বা সুইমিং পুল। ১২x৭ মিটার (৩৯x২৩ ফুট) আয়তনের এই জলাশয়টি ইট দিয়ে নির্মাণ করা হয়েছিল। সিল্যান্ট হিসেবে এই পুলে ব্যবহার করা হয়েছিল আলকাতরা। প্রাচীন গ্রিক ও রোমান সম্রাটরা তাদের মল্লক্রীড়া বিদ্যালয় ‘পালাইস্ত্রা’গুলোতে সামরিক অনুশীলনের জন্য পুল নির্মাণ করত। ‘পিসকিনা’ নামে রোমান সম্রাটদেরও ছিল ব্যক্তিগত সুইমিং পুল। উনিশ শতকের মাঝামাঝি সুইমিং পুল বিশেষ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে ব্রিটেনের লন্ডন শহরে। ১৮৩৭ সালে সেখানে গড়ে ওঠে বিশ্বের প্রথম সুইমিং ক্লাব। কেন্টের মেইডস্টোন সুইমিং ক্লাবকে ব্রিটেনের প্রাচীনতম সাঁতারু সংঘ বা সুইমিং ক্লাব হিসেবে গণ্য করা হয়।

সুইমিং পুল কেন দরকার
সাঁতার কাটলে শরীরের অনেক রোগ সেরে যায়। আপনি একঘেয়েমির জীবন থেকেও বেরিয়ে আসতে সক্ষম হবেন। কেন সাঁতার কাটবেন? এর উত্তর খুবই সহজ। সাঁতার একধরনের শরীরচর্চামূলক ক্রীড়া। এর ফলে শরীরের প্রতিটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সক্রিয় থাকে। তাই সাঁতারের বহুমুখী উপকারিতা রয়েছে। এ কারণেই সুইমিং পুল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। চলুন দেখে নিই সাঁতার এবং সুইমিং পুল আমাদের কেন প্রয়োজন?

ওভাল আকৃতির সুইমিং পুল

সাঁতার কাটলে শরীরের অনেক রোগ সেরে যায়; মন থাকে ফুরফুরে।
নিয়মিত সাঁতারে ভবিষ্যতে হৃদরোগের সম্ভাবনা ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ কমে যায়।
কমে যায় রক্তচাপও। একই সঙ্গে কমবে কোলেস্টেরল। সাঁতার ডায়াবেটিসের ঝুঁকি ১০ শতাংশ কমিয়ে দেয়। পাশাপাশি ফুসফুসের স্বাস্থ্যও ভালো থাকে।
সাঁতারে আর্থ্রাইটিসের সমস্যা কমে আসে। হাঁটু ব্যথা, পায়ের ব্যথা কমে যায়।
শরীরে উপকারী হরমোন নিঃসরণের জন্য স্ট্রেস কমে যায়। ডিমনেশিয়া জাতীয় নানা মানসিক সমস্যায় সাঁতার খুবই উপকারী।
পাশাপাশি যাদের ঘুমের সমস্যা থাকে, সহজে ঘুম আসে না, সাঁতারে নামলে এই সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়া যায়।
আপনি যদি পুকুর বা নদীতে সাঁতারে নামেন, সে ক্ষেত্রে খুবই ভালো। কিন্তু সুইমিং পুলে নামলে অনেক বিষয় মাথায় রাখতে হবে। বিশেষ করে সুইমিং পুলে যেহেতু পানি ভালো রাখতে ক্লোরিন, ব্রোমিনসহ বিভিন্ন রাসায়নিক ব্যবহার করা হয়, তাই এ ক্ষেত্রে ছাদ দেওয়া সুইমিং পুল এড়িয়ে যাওয়া ভালো।
সুইমিং পুলে নামার ক্ষেত্রে আরও কতগুলো বিষয় মাথায় রাখা উচিত। প্রথমত গোসল করে নামা এবং সুইমিং থেকে উঠে আবার গোসল করা।

সুইমিং পুলের রকমফের
সুইমিং পুলের ধরন বলতে বিশেষ কিছু নেই। দেখতে সব পুলই প্রায় একই রকম, পানিও একই রকম, সাঁতার কাটতেও একই রকম লাগে। তবে পানির ধরনের ভিত্তিতে তিন ধরনের সুইমিং পুল দেখতে পাওয়া যায়। এ ছাড়া প্রকৃতি ও ব্যবহারের ভিত্তিতে অনেক ধরনের সুইমিং পুল আমরা দেখি, তার কিছু উদাহরণ নিচে উল্লেখ্য।

বাণিজ্যিক সুইমিং পুল
আবাসিক সুইমিং পুল
প্রতিযোগিতার পুল
ভূপৃষ্ঠের ওপরের পুল
ভূগর্ভস্থ পুল
ইনডোর সুইমিং পুল
আউটডোর পুল
কংক্রিটের সুইমিং পুল
ফাইবারগ্লাসের পুল
ভিনাইল লাইনার সুইমিং পুল
নরম ওয়ালবিশিষ্ট সুইমিং পুল
অস্থায়ী পুল
কিডিং পুল (শিশুদের জন্য)
ব্লো আপ পুল (প্লাস্টিকে বাতাসভর্তি পুল)
স্পাস
জ্যাকুজিস
গরম টব
কাস্টম সুইমিং পুল
ইনফিনিটি পুল
অলিম্পিক সুইমিং পুল
ল্যাপ পুল
হোটেল সুইমিং পুল

সুইমিং পুলের পানি কত ধরনের
আগেই বলেছি সুইমিং পুল অনেক ধরনের হয়। নির্মাণের ক্ষেত্রে ধরাবাধা নিয়ম না থাকলেও পুলের পানি ব্যবহারে বাধ্যবাধকতা মানা স্বাস্থ্যের জন্য জরুরি। একই পুলের সীমিত পানিতে অনেক মানুষ একসঙ্গে সাঁতার কাটে এবং গোসল করে বিধায় এর বিশুদ্ধতা নিশ্চিত করতে হবে। আমাদের জানা উচিত সুইমিং পুলের পানি কেমন হয়ে থাকে এবং কেমন হওয়া উচিত। স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিবেচনায় সুইমিং পুলের পানিতে মেশাতে হয় বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক। সুইমিং পুলের পানিকে তিনটি ভাগে ভাগ করা হয়। সেগুলো হচ্ছে-

ক্লোরিন ওয়াটার
ক্লোরিন এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ রাসায়নিক যা সুইমিং পুলের পানি সেনিটাইজ করার জন্য অনেক আগে থেকেই ব্যবহার করা হয়ে আসছে। ক্লোরিন পানিতে থাকা যেকোনো ব্যাকটেরিয়া ধ্বংস করতে পারে, সে কারণেই সুইমিং পুলে ব্যাকটেরিয়ার প্রতিষেধক হিসেবে ক্লোরিনের ব্যবহার করা হতো। এই রাসায়নিক শুধু পানিতে ঢেলেই ব্যবহার করা হয় না। পুল পরিষ্কার করার সময়ও ক্লোরিন ব্যবহার করা হয়। এটি সাধারণ তিনটি অবস্থায় বাজারে পাওয়া যায়। কঠিন, স্ফটিকাকার এবং তরল এই তিন অবস্থায় বাজারে ক্লোরিন পাওয়া যায়। এটির কার্যকারিতা দীর্ঘসময় থাকে এবং খরচও তুলনামূলক কম। তাই সুইমিং পুলে ক্লোরিনের ব্যবহার সবচেয়ে বেশি হয়।

ছাদের ওপরে নির্মিত সুইমিং পুল

পুলে ক্লোরিন ব্যবহার করার অনেক সুবিধার পাশাপাশি কিছু অসুবিধাও রয়েছে। ক্লোরিনভিত্তিক সুইমিং পুলের অনেক রক্ষণাবেক্ষণ প্রয়োজন হয়। এই রাসায়নিক কী কী প্রতিক্রিয়া হতে পারে, তা আগেই ধারণা করা সম্ভব নয়। পুলে বিদ্যমান অনেক ধরনের অণুজীবের সঙ্গে অনেক ধরনের অপ্রত্যাশিত বিক্রিয়াও করে থাকে। ক্লোরিন পানির সঙ্গে মিশে ‘ক্লোরামাইন’ নামের একটি পদার্থ তৈরি করে, যার ফলে পুলের পানিতে দুর্গন্ধ সৃষ্টি হয়। ভুল ব্যবহার কিংবা সংরক্ষণের কারণে সুইমিং পুলে যেকোনো দুর্ঘটনাও ঘটতে পারে। তাই ব্যবহার করার সময় কিংবা সংরক্ষণ করার সময় খুব সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে।

সল্টওয়াটার পুল
সল্টওয়াটার পুল হলো নোনা পানির সুইমিং পুল। এ ধরনের সুইমিং পুলে ক্লোরিনের পরিবর্তে পানিতে লবণ প্রয়োগ করতে হয়। পরে ক্লোরিন জেনারেটরের মাধ্যমে লবণকে ক্লোরিনে পরিণত করা হয়। উচ্চমাত্রায় লবণ প্রয়োগ করায় এ ধরনের পুলে পানি অনেক বেশি সিস্কি থাকে। পানিতে লবণের গুণগত মান ৫০০০ পিপিএম হলে খারাপ মানের পানি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। সাধারণত পিপিএম এর মাত্রা ৩০০০-৪০০০ পর্যন্ত হলে স্বাভাবিক বলে ধরে নেওয়া হয়। সল্টওয়াটার পুলে লবণাক্ততার মাত্রা সমুদ্রের পানির লবণাক্ততার ১০ ভাগের ১ ভাগ থাকে।

মিনারেল ওয়াটার পুল
দিন দিন সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় হওয়া পুলের মধ্যে মিনারেল ওয়াটার পুল শীর্ষে। মিনারেল ওয়াটার পুলের এ জনপ্রিয়তার কারণ হলো এটিই একমাত্র পুল, যা সবচেয়ে বেশি স্বাস্থ্যসুরক্ষা নিশ্চিত করে। মিনারেল ওয়াটার পুল ম্যাগনাপুল হিসেবেও পরিচিত, যা প্রিমিয়াম কোয়ালিটির সুইমিং পুল। ম্যাগনাপুলের পানিতে প্রচুর ম্যাগনেসিয়াম থাকে, যা স্বাস্থ্যের জন্য খুবই উপকারী। এই পানি ত্বককে রাখে নরম ও চুলকে সিল্কি। অপর দিকে সাধারণ সল্টওয়াটার বা ক্লোরিনওয়াটার পুলের পানিতে গোসল করলে ত্বক খসখসে হয়, চুলও হয় খড়খড়ে। ম্যাগনেসিয়াম পানিকে অনেক বেশি স্বচ্ছ রাখে। এতে লবণাক্ততা না থাকায় ত্বককে শুষ্কতার হাত থেকে রক্ষা করে।

গোলাকার সুইমিং পুল

আপনি যে ধরনের পুলই ব্যবহার করুন না কেন, পুল ব্যবহারের আগে অবশ্যই স্বাস্থ্য সুরক্ষার কথা মাথায় রাখতে হবে। তবে ঝুঁকিপূর্ণ পুলে সাঁতার কেটে শারীরিক ক্ষতি যেন না হয় সে বিষয়টি আগে বিবেচনা করা উচিত। যারা কখনো সুইমিং পুলে সাঁতার কাটেননি, ভাবছেন কাটবেন, তাঁদের জন্য ওপরের তথ্যগুলো অনেক কাজে লাগবে। যাঁরা নিয়মিত সাঁতার কাটেন, তাঁদের জন্যও অবশ্যই কাজে আসবে।

[email protected]

প্রকাশকাল: বন্ধন ১৬৪ তম সংখ্যা, এপ্রিল ২০২৪

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top