মননে যাঁর প্রকৌশল

প্রকৌশল চর্চা রয়েছে তাঁর মননে। কর্মজীবনের সিংহভাগ সময় পার করেছেন বিভিন্ন দেশের একাধিক মাল্টি বিলিয়ন ডলার প্রজেক্টে। কাজ করেছেন বিশ্বের খ্যাতনামা সব ইঞ্জিনিয়ারিং প্রতিষ্ঠানে। একেকটি প্রকল্পের নির্মাণ সম্পন্ন হলে যে প্রশান্তি উপভোগ করেন, তা বর্ণনাতীত। প্রকৌশল বিষয়ে তাঁর অর্জিত জ্ঞান এখন কাজে লাগাচ্ছেন দেশের নির্মাণশিল্পকে এগিয়ে নিতে। প্রথিতযশা এ প্রকৌশলীর নাম কাজী নাজমুস সাদাত (কবির), পিইঞ্জ। তিনি ব্রাইট ডিজাইন কনসালট্যান্ট অ্যান্ড কনস্ট্রাকশনের সিইও ও এমডি।

বন্ধনের নিয়মিত আয়োজন ‘প্রকৌশলীর গল্প’ পর্বে স্বনামধন্য এ প্রকৌশলীর জানা-অজানা কথা তুলে ধরছেন মাহফুজ ফারুক

প্রকৌশলী কাজী নাজমুস সাদাত ১৯৭৬ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি ঝিনাইদহ জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। বাবা কাজী নাসির উদ্দিন ও মা মোছা. হীরা খানম। তিনি ১৯৯২ সালে বিএমটিএফ হাইস্কুল, গাজীপুর থেকে মাধ্যমিক, ১৯৯৫ সালে ঢাকা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট থেকে ডিপ্লোমা ইন সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং এবং ২০০৩ সালে ঢাকা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (ডুয়েট) থেকে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে বিএসসি সম্পন্ন করেন। ডিপ্লোমা করার পর ট্রায়াঙ্গেল কনসালট্যান্টস নামক একটি ফার্মে যোগ দেন এ প্রকৌশলী। কিন্তু সে চাকরি বেশি দিন করা হয়নি। বিএসসি সম্পন্ন করার তাড়না বোধ করছিলেন। এরপর প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রি গ্রহণ করে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক একটি ইঞ্জিনিয়ারিং ফার্মে যোগ দেন। পরবর্তী সময়ে সুপ্রিম স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ারিং নামে যুক্তরাষ্ট্রের অন্য আরেকটি প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ পান। এরপর বিশ্ব বিখ্যাত প্রতিষ্ঠান শ্যাভরন থেকে নাইজেরিয়ার একটি প্রকল্পে চাকরির অফার পেয়ে ২০০৯ সালে পাড়ি জমান দেশটিতে। তৎকালে এটি ছিল বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অয়েল অ্যান্ড গ্যাস মাইনিং প্রজেক্ট। আড়াই বছর প্রতিষ্ঠানটিতে চাকরির পর আরেকটি বিশ্বখ্যাত প্রতিষ্ঠান শ্যাভরন ফিলিপস (জ্যাকবস)-এ যোগদান করেন সংযুক্ত আরব আমিরাতের একটি পেট্রোকেমিক্যাল প্রকল্পে।

সাউথ ভিউ, পালার মাট, গাজীপুর

এভাবেই সুনামের সঙ্গে প্রকৌশলী কাজী নাজমুস সাদাত তাঁর প্রকৌশল চর্চা করতে থাকেন। প্রতিষ্ঠানটি থেকে একপর্যায়ে বদলি হন সৌদি আরবের আরেকটি প্রকল্পে। কিন্তু ভিসা জটিলতায় দেশটিতে যাওয়া হয়নি; ফিরে আসেন দেশে। তবে অভিজ্ঞ এই প্রকৌশলী দ্রুতই কাজ পেয়ে যান ইতালিয়ান প্রতিষ্ঠান টোটাল অয়েল অ্যান্ড গ্যাসের আওতাধীন সাইপেম নামক ফার্মে। এভাবে পরপর তিনটি মাল্টি বিলিয়ন ডলার প্রজেক্টে কাজ করার বিরল অভিজ্ঞতা লাভ করেন। ২০১৫ সালে বিশ্বব্যাপী জীবাশ্ব জ্বালানির মূল্য হ্রাস পাওয়ায় এই প্রকল্পগুলো জৌলুশ হারায়। তাঁর প্রতিষ্ঠান থেকে প্রায় ৮ হাজার কর্মী ছাঁটাই করা হয়। তিনিও ছিলেন তাঁদের একজন। বাধ্য হন দেশে ফিরতে। আবার নতুন কোনো প্রজেক্টে যোগ দেবেন, নাকি দেশে কিছু করবেন তা নিয়ে দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়েন। সাত-পাঁচ ভেবে; সবকিছু বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নেন দেশেই স্থায়ী হবেন, গড়ে তুলবেন নিজস্ব কনসালট্যান্সি ফার্ম। ভাবনার বাস্তবায়নে ২০১৬ সালে গড়ে তোলেন ব্রাইট ডিজাইন কনসালট্যান্ট অ্যান্ড কনস্ট্রাকশন। আর এই ফার্মটির মাধ্যমেই তিনি চালিয়ে যাচ্ছেন বর্তমান নির্মাণ কর্মকান্ড।

কর্মজীবনের দীর্ঘ সময় প্রবাসে অবস্থান করায় এ দেশে কাজ পাওয়া ও প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা ছিল অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং এই প্রকৌশলীর জন্য। ইঞ্জিনিয়ারিং কনসালট্যান্সি জগতে নতুন মুখ হওয়া সত্ত্বও নিজের কর্মদক্ষতাকে মেলে ধরতে সক্ষম হন তিনি। এ জন্য শুরুতে বড় প্রকল্পের পরিবর্তে ছোট ছোট আবাসন প্রকল্প ডিজাইন ও নির্মাণে মনোযোগী হন। বিভিন্ন দেশে কাজ করার সুবাদে অর্জিত অভিজ্ঞতাও হয়েছে বেশ সহায়ক। তবে ছোট হোক বা বড় প্রতিটি প্রজেক্টে তিনি পরিদর্শন ও কাজ তদারকি করেন যেন যেভাবে ক্লায়েন্টের সঙ্গে চুক্তি হয় সেভাবেই কাজ বুঝিয়ে দিতে পারেন। ফলে নির্মাণকাজের গুণগতমান ও নান্দনিকতা ডিজাইনের সঙ্গে অভিন্ন থাকায় অর্জন করতে সক্ষম হন ক্লায়েন্টের আস্থা। আর এই ক্লায়েন্ট সন্তুষ্টিই আরও বেশি কাজ পেতে হয় সবচেয়ে বড় সহায়ক। এভাবে অনেক দেশি-বিদেশি ক্লায়েন্টের কাজ যেমন পেয়েছেন, তেমনি সুযোগ এসেছে দেশের প্রথম সারির কিছু ডেভেলপার ও কোম্পানির সঙ্গে কাজ করার। আবাসন প্রকল্প, বাণিজ্যিক ভবন, জিমনেশিয়াম, ইন্ডাস্ট্রিয়াল বিল্ডিং, ব্রিজ ডিজাইনসহ বিভিন্ন প্রকল্পের ডিজাইন, নির্মাণ ও ইন্টেরিয়রের কাজ করেছেন এরই মধ্যে।

একজন দক্ষ ও অভিজ্ঞ প্রকৌশলীর সাহায্যে ভবন নির্মাণের চর্চা এখনো দেশে তেমনটা দেখা যায় না বলে মনে করেন প্রকৌশলী কাজী নাজমুস সাদাত। বিশেষ করে ছোট আবাসন প্রকল্পের জন্য ক্লায়েন্টরা মিস্ত্রি বা ঠিকাদারদের ওপরেই ভরসা করে। নির্মাতারা ভাবেন প্রকৌশলীর মাধ্যমে নির্মাণ করলে খরচ বাড়বে। অথচ কেউ যদি ৩ কোটি টাকা ব্যয়ে একটি স্থাপনা নির্মাণ করে তাহলে তার কাগজপত্র অবশ্যই আইনসংগত ও নির্মাণ বিধিমালা মেনে হতে হবে, যেন ভবনটি হয় টেকসই। কিন্তু ১০-১৫ হাজার টাকার ডিজাইনের মান কখনোই ভালো হবে না। ডিজাইনে অনেক কিছু অনুপস্থিত থাকবে। সয়েল টেস্ট, লোড টেস্ট, ম্যাটেরিয়াল টেস্ট এসব কিছুই থাকবে না। তাই সঠিক গুণগত মানের কাজ পেতে কিছু ব্যয় করতেই হবে। তবে এখন সচেতনতা বাড়ছে। কারণ, অনেকেই ভুক্তভোগী হচ্ছে। একটি ভবনে যেসব সুবিধা থাকা দরকার, তা তারা পায়নি। তা ছাড়া সবাই এখন আধুনিক ডিজাইন চাচ্ছে। ইন্টেরিয়রের ব্যাপারেও এসেছে সচেতনতা।

টিএম হ্যাভেন, ছায়াতরু, গাজীপুর

আরও ভয়াবহ ব্যাপার অনেকে স্থাপত্য বা প্রকৌশল পাস না করেও ডিজাইন করছে। অথচ একটি ডিজাইন করার জন্য যে জ্ঞান দরকার, তা একজন শিক্ষার্থী বা ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারের থাকে না। ফলে ডিজাইনে ত্রুটি থেকে যায়। ডিপ্লোমা পাস করলেই একজন ভালো প্রকৌশলী হতে পারবে না। তাকে অন্তত ৫ বছর বিভিন্ন সাইটে ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে হবে, শিখতে হবে বিশেষজ্ঞ ও অভিজ্ঞ ইঞ্জিনিয়ারদের সঙ্গে থেকে। এ ছাড়া ধারণা থাকতে হবে নির্মাণ বিধিমালা ও সফটওয়্যার সম্পর্কে। ডিজাইন করার আগে তাকে অবশ্যই আইইবির মেম্বার হতে হবে; থাকতে হবে পেশাগত নিষ্ঠা বলে মনে করেন এ প্রকৌশলী।

প্রকৌশলী কাজী নাজ মুছ শাদাৎ-এর স্ত্রী মনোয়ারা খাতুন মিনু। এ দম্পতির একমাত্র সন্তান কাজী ফারিয়া তাসনিম, বয়স প্রায় ৩ বছর। এ প্রকৌশলী দ্য ইনস্টিটিউশন অব ইঞ্জিনিয়ার্স, বাংলাদেশ (আইইবি)-এর একজন ফেলো। বিদেশে অনেক বড় বড় প্রতিষ্ঠানে আকর্ষণীয় সম্মানিতে চাকরি করেছেন কিন্তু এ দেশে সাফল্য পেতে তাঁকে অনেক বেশি পরিশ্রম করতে হয়েছে। মুখোমুখি হতে হয় নানা চ্যালেঞ্জের। বিশেষ করে সময়মতো কাজের সম্মানি পাওয়া। তারপরও প্রশান্তি বোধ করেন, নিজ দেশের উন্নয়নে কাজ করতে পারছেন এই ভেবে।

ব্রাইট ডিজাইন কনসালট্যান্ট অ্যান্ড কনস্ট্রাকশন যেসব সেবা প্রদান করে থাকে-
আর্কিটেকচারাল ডিজাইন
স্ট্রাকচারাল ডিজাইন
ইলেকট্রিক্যাল ডিজাইন
এক্সটেরিয়র, ইন্টেরিয়র ডিজাইন ও কনস্ট্রাকশন
সয়েল টেস্ট
ডিজিটাল সার্ভে
থ্রি-ডি ভিউ
এস্টিমেট কস্ট
মাস্টার প্ল্যান
বিল্ডিং ইন্সপেকশন অ্যান্ড টেস্টিং
ইন্ডাস্ট্রিয়াল বিল্ডিং
এস্টিমেশন প্রভৃতি

প্রকাশকাল: বন্ধন ১৬৫ তম সংখ্যা, মে ২০২৪

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top