ময়মনসিংহে প্রকৌশলী চর্চা করেন তানভীর আহমেদ। শহরে অনেক নান্দনিক ভবনের ডিজাইন করে এখন তিনি পরিচিত মুখ। অথচ এসব কাজ পেতে তাঁকে অনেক সময় দিতে হয়েছে। ব্যক্তিগত পর্যায়ে প্রকৌশল চর্চা শুরুর প্রথম দিকে বছরে দুই-তিনটা কাজ পেতেন। অধিকাংশ মানুষই বলত ময়মনসিংহের মতো জায়গায় টাকা খরচ করে প্রকৌশলীকে দিয়ে কেউ স্থাপনার ডিজাইন করবে না। রাজমিস্ত্রি দিয়েই কাজ মিটে যেত। তবু তিনি নিরাশ হননি। ধৈর্য ধরে নির্মাতাদের কাছে প্রকৌশলীকে দিয়ে কাজ করানোর ভালো দিক তুলে ধরেছেন। রাজমিস্ত্রিদেরও বোঝাতেন, ধারণার ওপর ভিত্তি করে ভবন ডিজাইন করা ঠিক নয়। নানামুখী এমন সচেতনতা কার্যক্রমের ফলে একপর্যায়ে সফল হন। এরপর পৌরসভা যখন বাধ্যবাধকতা আরোপ করে প্রকৌশলীর ডিজাইন ছাড়া কোনো ভবন নির্মাণ করা যাবে না, তখন থেকে ময়মনসিংহ শহরে প্রকৌশলীকে দিয়ে ভবন ডিজাইনের ইতিবাচক চর্চা শুরু হয়। ময়মনসিংহের রামবাবু রোডে অবস্থিত এসআর বিল্ডিং ডিজাইনের স্বত্বাধিকারী প্রকৌশলী তানভীর আহমেদের জানা-অজানা কথা বন্ধনের নিয়মিত আয়োজন ‘প্রকৌশলীর গল্প’ পর্বে তুলে ধরছেন মাহফুজ ফারুক
প্রকৌশলী তানভীর আহমেদ ১৯৮১ সালের ২৮ ফেব্রæয়ারি ময়মনসিংহে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা মো. আব্দুস সালাম ও মা সালমা বেগম। তিনি ময়মনসিংহ জিলা স্কুল থেকে ১৯৯৭ সালে মাধ্যমিক, ময়মনসিংহ পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট থেকে ২০০০ সালে ডিপ্লোমা ইন সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং এবং একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একই বিষয়ে বিএসসি সম্পন্ন করেন। ডিপ্লোমা করার পর জড়িয়ে পড়েন পারিবারিক ফার্নিচার ব্যবসায়। পরবর্তী সময়ে এফএনএফ ফার্মাসিটিউটিক্যালস লি. বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউট ও আকিজ ফুটওয়্যার লি.-এর বিভিন্ন প্রকল্পে চাকরি করেন। ২০১৩ সালে গড়ে তোলেন নিজস্ব কনসালট্যান্সি ফার্ম। বর্তমানে এই ফার্মটির মাধ্যমেই তিনি চালিয়ে যাচ্ছেন প্রকৌশল চর্চা।

বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউটের চাকরিকালীন একজন সিনিয়র প্রকৌশলীর অধীনে তিনি কাজ করতেন। তাঁর সঙ্গে বিভিন্ন নির্মাণসাইটে যেতেন। অনেক বড় বড় প্রকল্পে কাজ করার সুযোগ হয়েছে তাঁর। সব ধরনের ড্রয়িং-ডিজাইনে তাঁর ছিল চমৎকার দক্ষতা। ড্রয়িং বোঝার পারদর্শিতার জন্য সিনিয়র প্রকৌশলী তাঁকে নিজের মতো করে প্রকৌশল চর্চা শুরুর পরামর্শ দেন। ওই প্রকৌশলী তাঁর মধ্যে দেখতে পান দারুণ সম্ভাবনা। তিনি নিজেও সেটা উপলব্ধি করেন। ফিরে যান ময়মনসিংহে। কিন্তু কীভাবে শুরু করবেন তা নিয়ে দেখা দেয় সংশয়। তবে সময় নষ্ট না করে বাবার ফার্নিচার ব্যবসায় নিজেকে সম্পৃক্ত করেন। আধুনিক একটি ফার্নিচার কারখানা গড়ে তোলেন। নতুন নতুন ডিজাইনের ফার্নিচার তৈরি করে তাক লাগিয়ে দেন। একপর্যায়ে তাঁর এক পরিচিতজনের সঙ্গে দেখা হয়। একপর্যায়ে জানতে পারেন তিনি ভবনের ডিজাইন করেন। অথচ তাঁর কোনো প্রকৌশল ডিগ্রি ছিল না। অটোক্যাড শিখেই তিনি ভবনের ড্রয়িং ডিজাইন করেন। একজন প্রকৌশলী না হয়েও শুধু অটোক্যাড জেনেই যদি কেউ কাজটি করতে পারেন, তাহলে তিনি কেন পারবেন না। এই উপলব্ধি থেকে তিনি সিদ্ধান্ত নেন প্রকৌশল চর্চা করবেন।
তবে বিপত্তি হয়ে দাঁড়ায় অটোক্যাড সফটওয়্যার দিয়ে ডিজাইনে তাঁর সীমাবদ্ধতা। ড্রয়িং খুব ভালো বুঝলেও নিজে ডিজাইন করতেন না। এই প্রতিবন্ধকতাকে দূর করতে অটোক্যাড শেখার উদ্যোগ নেন। তবে ময়মনসিংহে তেমন কোনো প্রতিষ্ঠান ছিল না। অনেক খুঁজে একটি প্রতিষ্ঠান পান, যারা অটোক্যাড শেখায়। তাঁর একান্ত আগ্রহে মাত্র দুই মাসের মধ্যে ডিজাইন সফটওয়্যারটির কাজ শিখে নেন। তবে এরচেয়েও বড় চ্যালেঞ্জ ছিল কাজ পাওয়া। যেখান থেকে তিনি ড্রয়িং প্রিন্ট করতেন, তারাই তাঁকে একটি মসজিদের ডিজাইন করে দেওয়ার প্রস্তাব দেন। তানভীর আহমেদ রাজি হয়ে যান। এ ছাড়া তিনি স্থানীয় হওয়ায় অনেক পরিচিতরা তাঁকে ভবন ডিজাইন করতে দেন। তিনি যেসব ভবনের ডিজাইন করেন খুব যত্ন নিয়ে। ফলে সেসব ভবনের ডিজাইন দেখে আরও অনেকেই তাঁর কাছে আসেন স্বপ্নের আবাসন ডিজাইন করাতে। এভাবেই কাজ আসতে থাকে তাঁর প্রতিষ্ঠানে।
একের পর এক প্রকল্প ডিজাইন করলেও তা বাস্তবায়নে দেখা দেয় ভিন্ন প্রতিবন্ধকতা। ভবন নির্মাণের সময় মিস্ত্রিরা তাদের কাজের সুবিধার্থে ডিজাইন কিছুটা পরিবর্তন করে ফেলে। অনেক সময় বেইজের সাইজ কমিয়ে ফেলতে চায়। মালিকদের বোঝায়, কলামে-বিমে এত রড দরকার নেই, আবার কোথাও বেশি দিয়ে দেয়। এই কাজটি যে ভুল তা বোঝাতে তাঁকে অনেকবার মিস্ত্রিদের বোঝাতে হয়েছে। ফলে এখন সবাই সচেতন হচ্ছে।
প্রকৌশলী তানভীর আহমেদ নির্মাণ বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধিতেও কাজ করেন। ভবন নির্মাতাদের সব সময় বোঝান তাঁরা যেন সয়েল টেস্ট সঠিকভাবে করেন। কারণ এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অদক্ষ কারও মাধ্যমে কাজটি না করিয়ে একজন অভিজ্ঞ প্রকৌশলীর মাধ্যমে করানো উচিত। কারণ সয়েল টেস্টের ফলাফলের ওপর নির্ভর করে স্ট্রাকচারের স্থায়িত্ব। এ ছাড়া আর্কিটেকচারাল ও স্ট্রাকচারাল ডিজাইন যথাযথভাবে অনুসরণ করা বাঞ্ছনীয়। আর্কিটেকচারাল ডিজাইনে কিছুটা পরির্তন করলেও স্ট্রাকচারাল ডিজাইনে কোনোভাবেই পরিবর্তন করা যাবে না। তা ছাড়া অল্প কিছু টাকা বাঁচাতে নিম্নমানের নির্মাণসামগ্রী ব্যবহার করা ঠিক নয়। বিশেষ করে রড-সিমেন্টের ক্ষেত্রে। রাজমিস্ত্রিও হওয়া চাই দক্ষ। কারণ একজন প্রকৌশলী ডিজাইন করলেও নির্মাণকাজ শুরু হয় অদক্ষ মিস্ত্রিদের হাত ধরে। মিস্ত্রিরা যেন সঠিক অনুপাত মেনে মসলা প্রস্তুত করে তা নিশ্চিত করা দরকার। এ জন্য কোনো সাইটে নির্মাণ শুরু হলে তিনি নিজে থেকে ঢালাই প্রস্তুত করার কৌশল শিখিয়ে আসেন। কংক্রিট তৈরিতে ভালো মানের অ্যাডমিক্সারও ব্যবহার করা উচিত। এতে কংক্রিট ভালো থাকবে।

প্রকৌশলী তানভীর আহমেদ বিয়ে করেন ২০০৫ সালে। স্ত্রী মনোয়ারা নাসরিন। এ দম্পতির দুই মেয়ে। বড় মেয়ে তাসফিয়া বিনতে আহমেদ ময়মনসিংহ বিদ্যাময়ী সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ে ৮ম শ্রেণিতে পড়ছে, ছোট মেয়ে তাসনিয়া বিনতে আহমেদ, বয়স ৩ বছর। তিনি প্রকৌশলী প্ল্যানার্স আন্ড ডিজাইনার্স অ্যাসোসিয়েশন, ময়মনসিংহ-এর কার্যকরী পরিষদের সদস্য।
স্থপতি ও প্রকৌশলী মিলে সাতজনের একটি টিম রয়েছে প্রকৌশলী তানভীর আহমেদের ফার্মে। তিনি আবাসিক ভবনের কাজই বেশি করেন। ময়মনসিংহের প্রতিটি থানা ও পাশ্ববর্তী কয়েকটি জেলায় রয়েছে তাঁর ডিজাইন করা ভবন। তাঁর প্রত্যাশা এই কনসাল্ট্যান্সি ফার্মের মাধ্যমে নান্দনিক সব স্থাপনা ডিজাইন করে শহরের সৌন্দর্য বাড়িয়ে তোলা।
প্রকাশকাল: বন্ধন ১৬৭ তম সংখ্যা, জুলাই ২০২৪