টপ-ডাউন কনস্ট্রাকশন সিস্টেম

টপ-ডাউন কনস্ট্রাকশন সিস্টেম এমন একটি নির্মাণকৌশল, যা সচরাচর গভীর ভিত্তিবিশিষ্ট ভবন নির্মাণে ব্যবহৃত হয়। এ ধরনের নির্মাণপদ্ধতি শুরু হয়েছিল ষাটের দশকের প্রথম দিকে কিন্তু এখন এ ধরনের নির্মাণকৌশলের প্রচলন রয়েছে বিশ্বের বহু দেশে। বর্তমানে বড় শহরগুলোর জনসংখ্যার ঘনত্ব যেমন বাড়ছে, তেমনি বাড়ছে বড় শহরতলিতে জমির মূল্যও। যার ফলে শহরগুলোয় আকাশচুম্বী বহুতল ভবনের চাহিদা এবং প্রয়োজনীয়তা বেড়েছে সমানুপাতিক হারে। যদিও বহুতল ভবন নির্মাণের জন্য টপ-ডাউন কনস্ট্রাকশন সিস্টেম অনুসারে ভবনের ভিত্তি নির্মাণে খরচ হয় অনেক বেশি। কিন্তু পার্কিং, সংরক্ষণ, মালামাল লোড এবং বহুতল বাণিজ্যিক ভবনের সৌন্দর্যবর্ধনের জন্য এ ধরনের ভিত্তি কিন্তু দারুণ কার্যকর। বহুতল ভবনের গভীর ভিত্তি নির্মাণপদ্ধতিকে বিভিন্ন পর্যায়ে ভাগ করা যায়। যেমন: উন্মুক্ত পদ্ধতিতে মাটি খননের পরে ভিত্তি নির্মাণ, বটম-আপ নির্মাণ, টপ-ডাউন কনস্ট্রাকশন সিস্টেম এবং টপ-ডাউন কনস্ট্রাকশন সিস্টেম ও বটম-আপের মিলিত বা মিশ্র পদ্ধতির নির্মাণ।

টপ-ডাউন কনস্ট্রাকশন সিস্টেমে ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে সাধারণত প্রথমে ভবনের চারপাশের দেয়াল (Perimeter Wall) নির্মাণ করা হয় এবং ভবনের পাইল এবং কলাম সাধারণত ভূমি থেকে স্থাপন কাজ শুরু হয়। একই সঙ্গে নিম্নমুখী নির্মাণপদ্ধতির সাহায্যে ভবনের জন্য ভিত্তি নির্মাণ করা হয়।

নিচতলা (Ground Floor)-এর স্ল্যাব স্থাপন এবং ভবনের ভিত্তির (Basement) জন্য খননকাজ স্ল্যাবের মাঝে মাঝে যে ফাঁকা জায়গা থাকে, সেখান থেকে পরিচালিত হয়। টপ-ডাউন কনস্ট্রাকশন সিস্টেমে ভবনের ভিত্তি (Basement) এবং ভবনের ওপরকাঠামো বা পরিকাঠামোর (Superstructure) নির্মাণকাজ একই সঙ্গে সম্পন্ন করা সম্ভব।

প্রকল্পের বহুমুখী নির্মাণ

টপ-ডাউন কনস্ট্রাকশন সিস্টেমে ভবনের নির্মাণকাজ পরিচালনার জন্য কিছু ক্রম বা অনুক্রম মেনে নির্মাণকাজ সম্পন্ন করা হয়।

যেমন-

এই নির্মাণপদ্ধতিতে ভবন নির্মাণের জন্য প্রথমে ভবনের চারপাশের দেয়াল নির্মাণ করা হয় এবং এই দেয়াল Cast-in-Situ অথবা Precast কংক্রিটের উভয়ই হতে পারে।

ভেতরের সব ধরনের ভিত্তির নির্মাণকাজ সাধারণত বিদ্যমান Ground Level থেকে শুরু করা হয়। এ ধরনের নির্মাণে ভবনের ভেতরের কাঠামো Steel Stanchion অথবা পাইল (Pile)-এর হয়ে থাকে। টপ-ডাউন কনস্ট্রাকশন সিস্টেমে ভবন নির্মাণের সময় অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে ভবনের একটি কলামের জায়গায় শুধু একটি পাইল থাকতে পারে এবং এ ধরনের নির্মাণকাজে কখনো Pile-Cap-এর দ্বারা একাধিক পাইল ব্যবহার সম্ভব নয়।

নিচতলা (Ground Floor)-এর স্থাপন সরাসরি মাটির ওপরে করা হয়, ফলে এাঁ স্ল্যাব (Slab)-এর ফ্রেমওর্য়াক (Framwork) হিসেবে কাজ করে। ফ্লোর স্ল্যাবটি (Floor Slab) চারপাশের দেয়ালে এবং আগেই নির্মিত কলামের সঙ্গে যুক্ত করে রাখা হয়। ফ্লোর স্ল্যাব এবং চারপাশের দেয়ালের সংযোগস্থলে চারপাশের দেয়ালের কিছুটা অংশ ভেঙে রিইনফোর্সমেন্ট (Reinforcement) বের করে স্ল্যাবের রিইনফোর্সমেন্টের সঙ্গে Lapping করে সংযোগ স্থাপন করা হয়। স্ল্যাব নির্মাণ বা স্থাপনের সময় স্ল্যাবের মধ্যে কিছু ফাঁকা জায়গা রাখা হয়, যার মধ্যে দিয়ে বিভিন্ন নির্মাণসামগ্রীর স্থানান্তর এবং প্রথম বেসমেন্টের নির্মাণকাজ পরিচালনা করা হয়।

নির্মাণকাজের পরবর্তী ধাপে, ওপরকাঠামোর নির্মাণ কাজ প্রথাগত নির্মাণপদ্ধতি অনুযায়ী করা হয় এবং ভিত্তির নির্মাণকাজ একই সঙ্গে পরিচালনা করা হয়। ধীরে ধীরে নিচতলা (Ground Floor)-এর নিচে প্রথম ভিত্তি (Basement) পর্যন্ত খননকাজ সম্পন্ন করা হয়, কিন্তু খননকাজ পরিচালনা করার সময় পানি অপসারণ করার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিতে পারে কিন্তু চারপাশের দেয়াল Cut-Off দেয়াল হিসেবে কাজ করে এবং পানির প্রবেশ অনেকাংশে কমিয়ে দেয়।

অতঃপর এই নির্মাণপদ্ধতির পুনরাবৃত্তি করে ধীরে ধীরে নিচের ভিত্তি (Basement)-এর কাজ সম্পন্ন করা হয়। সবশেষে Final Basement Floor-এর নির্মাণের সময় এটা পানি-নিরোধক করে নির্মাণ করা হয় এবং সঙ্গে সঙ্গে নিষ্কাশন-প্রক্রিয়া যুক্ত করে নির্মাণকাজ সম্পন্ন করা হয়।

রড বাইন্ডিং

টপ-ডাউন কনস্ট্রাকশন সিস্টেমে নির্মাণকাজ পর্যালোচনা করলে যে ধাপগুলো পাওয়া যায়। তার সংক্ষিপ্ত রূপ-

  • Diaphragm Wall.

Piles ও Steel Stanchion.

ওপরের ভিত্তি (Basement Floor)

প্রথম ভিত্তি (First Basement) এবং ওপরকাঠামো (Super-Structure)

দ্বিতীয় ভিত্তি (Second Basement)

চূড়ান্ত ভিত্তি (Final Basement)

সাধারণ প্রথাগত নির্মাণপদ্ধতি বা বটম-আপ নির্মাণপদ্ধতির সঙ্গে টপ-ডাউন কনস্ট্রাকশন সিস্টেমের মধ্যে কিছু পার্থক্য রয়েছে। টপ-ডাউন কনস্ট্রাকশন সিস্টেমে নির্মাণকাজ পরিচালনা করার কিছু সুবিধা রয়েছে। যেমন-

যেহেতু টপ-ডাউন কনস্ট্রাকশন সিস্টেমে নির্মিত রিটেনিং (Retaining) কাঠামোগুলো স্থায়ীভাবে বিল্ডিং কাঠামো হিসেবে নির্মিত হয়। তাই এটা প্রথাগত নির্মাণকাজের জন্য যে অস্থায়ী রিটেনিং দেয়াল তৈরি করা হয়, তার খরচ বাঁচিয়ে দেয়। তা ছাড়া এই পদ্ধতিতে বহুতল ভবন নির্মাণের প্রথাগত নির্মাণের তুলনায় সময় Settlement ও অনেক কম লাগে। তা ছাড়া এ ধরনের নির্মাণে আশপাশের যেসব ভবন রয়েছে, তার হওয়ার ঝুঁকি অনেকাংশে কমিয়ে দেয়। তাই যেসব প্রজেক্টের পাশে ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ ভবন রয়েছে, সেখানে এই পদ্ধতিতে বহুতল ভবন নির্মাণ অনেক বেশি গ্রহণযোগ্য।

বটম-আপ পদ্ধতিতে স্টিলের ব্লাক রিটেনিং দেয়ালকে ঠেকিয়ে রাখার জন্য ব্যবহার করা হয়। কিন্তু টপ-ডাউন কনস্ট্রাকশন সিস্টেমে নির্মাণকাজে চারপাশের দেয়ালকে বিভিন্ন লেভেলে স্থায়ী স্ল্যাবের দ্বারা ঠেকিয়ে রাখা হয়। এ ধরনের Support System অন্যান্য ব্যবস্থাপনার থেকে অনেক বেশি গ্রহণযোগ্য এবং এটা সব ধরনের শর্তপূরণেও সক্ষম। তা ছাড়া এরা স্টিল ব্লাকের চেয়ে অনেক বেশি দৃঢ় বা শক্তিশালী।

বটম-আপ নির্মাণপদ্ধতিতে স্ল্যাবকে ধরে রাখার জন্য যে খুঁটি বা ঠেকনা ব্যবহার করা হয়, তা নির্মাণসামগ্রী এবং নির্মাণকাজের জন্য ব্যবহৃত ভবনস্থ যন্ত্রের মধ্যে পরিবহনে বাধা সৃষ্টি করে। কিন্তু টপ-ডাউন কনস্ট্রাকশন সিস্টেমে ফ্লোর স্ল্যাব মাটির ওপর স্থাপন করা হয়। যার ফলে স্ল্যাবকে ঠেকিয়ে রাখার জন্য কোনো খুঁটি বা ঠেকনার প্রয়োজন হয় না। স্ল্যাবের নির্মাণকাজ সম্পন্ন হলে এর মাঝে ফাঁকা (Openning) থাকে, এর মধ্যে দিয়ে নির্মাণসামগ্রী এবং নির্মাণকাজে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি খুব সহজে ভবনের মধ্যে স্থানান্তর করা যায়।

টপ-ডাউন কনস্ট্রাকশন সিস্টেমে স্ল্যাবগুলো নির্মাণ বা স্থাপন করা হয়, কোনো ধরনের খননকাজ পরিচালনার আগেই। তাই নির্মাণ সাইটে বিদ্যমান ভূমি ফ্রেমওর্য়াক (Framework) হিসেবে ব্যবহার করা হয়। যার ফলে স্ল্যাবের ফ্রেমওয়ার্ক (Framework) নির্মাণের জন্য কোনো অতিরিক্ত অর্থ খরচ করতে হয় না। তা ছাড়া এর ফলে ফ্রেমওয়ার্ক (Framework) নির্মাণে যে সময় প্রয়োজন হয় তারও আর প্রয়োজন হয় না।

ডাউন কনস্ট্রাকশন

এই নির্মাণশৈলীতে নিচতলার (Ground Floor) নির্মাণকাজ সম্পন্ন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ভবনের ওপরিকাঠামোর (Super-Structure) নির্মাণকাজ শুরু করা হয় এবং তা সাধারণত ভবনের ভিত্তি (Basement) নির্মাণের অনেক আগেই করা হয়ে থাকে। যার ফলে ভবন নির্মাণের জন্য যে সময়সূচি নির্ধারণ করা হয়, তার কয়েক মাস আগেই ভবনের নির্মাণকাজ সম্পন্ন করা সম্ভব হয়। আর ভবনের নির্মাণকাজ যত আগে সম্পন্ন হয়, তত আগে এর থেকে অর্থ উপার্জন সম্ভব এবং ভবন নির্মাণকারী নতুন ভবনের নির্মাণকাজ শুরু করতে পারেন। যদিও এই পদ্ধতিতে Diaphragm Wall-এর নির্মাণ খরচ কিছুটা বেশি হয় কিন্তু ভবনের নির্মাণকাল অনেক কম হওয়ায় নানা ধরনের খরচ সাশ্রয় হয়।

এই পদ্ধতিতে ভবনের নির্মাণকাজ সম্পন্ন হওয়ার আগেই মালামাল সংরক্ষণের জন্য নির্দিষ্ট জায়গা পাওয়া যায়। যার ফলে নির্মাণের জন্য গুরুত্বপূর্ণ সকল যন্ত্রপাতি এবং নির্মাণসামগ্রী সংরক্ষণের সমস্যার সমাধান হয়ে যায়। এ ছাড়া Ground Level সব সময় মালামাল রাখা এবং ব্যবহারের উপযোগী থাকে।

এ ধরনের নির্মাণে শব্দের দূষণও অনেকাংশে কম হয়। তা ছাড়া গভীর ভিত্তির খননকাজের জন্য যে অতিরিক্ত আবর্জনার সৃষ্টি হয়, তাও এ ক্ষেত্রে অনেকাংশে কম। কেননা এর বেশির ভাগ খননকাজ পরিচালনা করা হয় Basement Floor-এর নিচে।

টপ-ডাউন কনস্ট্রাকশন সিস্টেমে যেমন কিছু সুবিধা রয়েছে, ঠিক তেমনি এই পদ্ধতিতে নির্মাণকাজের কিছু সীমাবদ্ধতা বা অসুবিধাও রয়েছে। সেগুলো হলো-

টপ-ডাউন কনস্ট্রাকশন সিস্টেম পদ্ধতিতে স্ল্যাবের নিচে খননকাজ পরিচালনা করা কঠিন কাজ। তা ছাড়া সেখানে খনন শ্রমিকদের কাজের যথাযথ পরিবেশ নিশ্চিত করাও দুরূহ হয়ে পড়ে।

তদুপরি খননকাজে যেকোনো সময় অপ্রত্যাশিত অবস্থার মুখোমুখি হওয়ার আশঙ্কাও রয়েছে। যেমন : খননকাজের যেকোনো মুহূর্তে কোনো ধরনের সমাধি ভিত্তি পাওয়া যেতে পারে। সেক্ষেত্রে খননকাজ চালিয়ে যাওয়া অনেক কঠিন হয়ে পড়ে।

এই নির্মাণপদ্ধতিতে খননকাজে যে মাটির সৃষ্টি হয় তা নির্মাণ সাইট থেকে অপসারণ প্রক্রিয়া প্রথাগত নির্মাণ অপসারণ থেকে ধীরগতি সম্পন্ন হয়।

এই পদ্ধতির নির্মাণের জন্য নির্মাণশ্রমিক ও নির্মাতার মধ্যে ভালো সমন্বয় থাকা একান্ত জরুরি। তাই নির্মাণের কার্যপদ্ধতি, নির্মাণসামগ্রী সংরক্ষণ পদ্ধতির পাশাপাশি এদের পরিবহন এবং নির্মাণকাজের সঙ্গে যুক্ত সব বিষয় নির্মাণ শুরুর আগে থেকেই যথাযথভাবে পরিকল্পনা করে নিতে হয়।

এ ধরনের নির্মাণপদ্ধতিতে ফ্লোর স্ল্যাব স্থাপনের পরপরই খননকাজ পরিচালনা সম্ভব নয়। কারণ স্ল্যাব স্থাপনের পরে এর যথাযথ শক্তি অর্জনের জন্য কিছুটা সময়ের প্রয়োজন হয়।

টপ-ডাউন কনস্ট্রাকশন সিস্টেমে শুধুম Pile Foundation ব্যবহার করা হয়। যদিও কিছু কিছু ক্ষেত্রে Raft Foundation ব্যবহার করা যায় কিন্তু তা কিছু শর্ত সাপেক্ষে।

যদিও এর মধ্যকার বেশ কিছু সীমাবদ্ধতা স্ল্যাবের নকশায় ফাঁকার সংখ্যা বৃদ্ধির মাধ্যমে দূর করা সম্ভব। টপ-ডাউন কনস্ট্রাকশন সিস্টেম সেই সব এলাকার জন্য বেশি উপযোগী, যেখানে অবকাঠামো উন্নয়ন খুব দ্রুতগতিতে হচ্ছে। তাই দ্রুতগতির উন্নয়নশীল ঢাকা শহরের জন্য টপ-ডাউন কনস্ট্রাকশন সিস্টেম অনেক বেশি সময়োপযোগী ও কার্যকর। তা ছাড়া ঢাকা শহরে নির্মাণসামগ্রী রাখার জন্য যে সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়, তা এই নির্মাণপদ্ধতি দ্বারা সমাধান সম্ভব। যদিও বাংলাদেশে এর তেমন প্রচলন এখনো শুরু হয়নি। তবে সার্বিকভাবে বিচার করলে এই নির্মাণপদ্ধতি বাংলাদেশের বড় বড় শহরে বহুতল ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে যেসব সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়, তার সমাধান করতে সক্ষম। তবে এ ধরনের নির্মাণপদ্ধতি অনুসরণের আগে প্রকল্পটির সব ধরনের খরচ এবং এর সঙ্গে যুক্ত সম্ভাব্য বিষয়সমূহ খুব ভালো করে বিবেচনায় নিয়ে তারপর সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত।

প্রকৌশলী সনজিত সাহা

[email protected]

[email protected]

প্রকাশকাল: বন্ধন ৪০ তম সংখ্যা, আগস্ট ২০১৩

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top