ইমারত নির্মাণ এবং ফ্লোর ফিনিশিংয়ের কাজ সম্পর্কে পূর্বপ্রকাশিত বিষয়গুলো আরও বিস্তারিত জানা দরকার। তাই ফ্লোর ফিনিশিংকাজের প্রতিটি উপকরণের গুণগত মান, স্থায়িত্ব, সৌন্দর্য, আভিজাত্য, খরচের পার্থক্য এবং সুবিধা-অসুবিধা সম্পর্কে বিস্তারিত তুলে ধরা হলো। এই পর্ব থেকে সাধারণ পাঠক ফ্লোর ফিনিশিংকাজ সম্পর্কে বাস্তব একটি ধারণা পেতে পারেন।
ফ্লোর ফিনিশিংয়ের উপকরণ হিসেবে প্রথমে প্যাটেন্ট স্টোন ফ্লোরিংয়ের বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে। এই উপকরণটি সর্বনিম্ন খরচে বাস্তবায়ন করা সম্ভব। প্যাটেন্ট স্টোন ফ্লোর ফিনিশিং আদি ও অকৃত্রিম একটি আইটেম, যা আগে অধিকাংশ আবাসিক ভবনসহ অন্য নানাবিধ ফ্লোর ফিনিশিংয়ের কাজে ব্যবহার করা হতো। প্যাটেন্ট স্টোন ফ্লোর ফিনিশিংয়ের কাজে ব্যবহৃত সব মালামালই সহজলভ্য এবং কাজের পদ্ধতিও সহজ। ফলে ইট-বালির কাজের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট যেকোনো মিস্ত্রি দিয়ে এই কাজটি সম্পন্ন করতে পারে। যুগের চাহিদা এবং মানুষের আর্থিক সচ্ছলতার কারণে প্যাটেন্ট স্টোন ফ্লোর ফিনিশিংয়ের কাজটি বিলুপ্তপ্রায়। ইদানীং নিতান্তই নিম্ন শ্রেণির আবাসিক ভবন এবং স্টোরেজের জায়গা ছাড়া অন্য কোথাও প্যাটেন্ট স্টোন ফ্লোর ফিনিশিংয়ের কাজ করা হয় না। এই কাজটি সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করা হলে দীর্ঘস্থায়ীভাবে ব্যবহার করা যায়। কম খরচে এবং স্বল্প সময়ের মধ্যে ব্যবহৃত কোনো আবাসিক ভবন বা সাধারণ অন্যান্য ফ্লোরিংয়ের কাজ দ্রুত শেষ করার ক্ষেত্রে প্যাটেন্ট স্টোন ফিনিশিং অগ্রগণ্য।
মানুষের রুচির পরিবর্তন এবং আর্থিক সংগতি বৃদ্ধি পাওয়ায় আবাসিক ভবনে প্যাটেন্ট স্টোন ফ্লোর ফিনিশিংয়ের পরিবর্তে একসময় অধিকাংশ ক্ষেত্রে মোজাইক ফ্লোর ফিনিশিংয়ের প্রবর্তন ঘটেছিল। এটা তুলনামূলক ব্যয়বহুল হলেও কাজের মান, দীর্ঘস্থায়িত্বতা, সৌন্দর্য এবং আভিজাত্যের দিক দিয়ে প্যাটেন্ট স্টোন ফ্লোর ফিনিশিংয়ের চেয়ে গ্রহণযোগ্যতা অনেক বেশি। কিন্তু কাজটির বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া অনেক দীর্ঘ ও জটিল। ফলে সিরামিক টালির উদ্ভাবন, টালির সহজলভ্যতা এবং চাকচিক্যের কারণে মোজাইক ফ্লোর ফিনিশিংয়ের কাজটিও বিলুপ্ত হয়েছে। তবে অল্পদিনের মধ্যেই টালি ব্যবহারের যেসব অসুবিধা দেখা দিয়েছে, তাতে অদূর বা দূরভবিষ্যতে টালির পরিবর্তে মোজাইক ফ্লোর ফিনিশিংয়ের কাজ আবার ফিরে আসতে পারে বলে আমার ধারণা। বর্তমানে বহুল ব্যবহৃত এই সিরামিক টালি একসময়ে বিদেশ থেকে আমদানিনির্ভরশীল একটি পণ্য ছিল। ইদানীং আমাদের দেশে অনেক ধরনের টালি উৎপাদিত হচ্ছে।

আমাদের দেশে উৎপাদিত টালির পাশাপাশি বিদেশ থেকে আমদানি করা টালির পরিমাণও একেবারে কম নয়। বিদেশ থেকে আমদানি করা এসব টালির গুণগত মান তুলনামূলকভাবে অনেক ভালো এবং দাম বেশি। তবে দেশে উৎপাদিত টালির দাম তুলনামূলক কম হলেও গুণগত মান খারাপ নয়। বর্তমান বাজারে দেশে উৎপাদিত বিভিন্ন সাইজ এবং গুণগত মানসম্পন্ন টালি পাওয়া যায়। সাইজ ও মানের ওপর নির্ভর করে এসব টালির দামের পার্থক্য হয়ে থাকে। ফলে মানুষ তার নিজের চাহিদা, রুচি এবং আর্থিক সংগতি কাজে লাগাতে পারে।
টালি ব্যবহারে যেসব সমস্যা দেখা যায়, তার মধ্যে টালি ডিবন্ডেড হওয়া কিংবা ফ্লোর থেকে উঠে যাওয়ার সমস্যাটি অন্যতম। এটা নিয়ে ব্যবহারকারীকে প্রায়ই বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়। এ ছাড়া টালি ভেঙে যাওয়া, দাগ পড়া অর্থাৎ স্ক্র্যাচ পড়া, অসাধানতাজনিত কারণে পিছলে পড়া বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এসব অসুবিধার মধ্যে টালি ডিবন্ডেড হওয়া বা ফ্লোর থেকে উঠে যাওয়ার বিষয়টিই অন্যতম, যা নানাবিধ কারণে ঘটে থাকে। প্রধান কিছু কারণ নিচে উল্লেখ করা হলো:
কাজের ত্রুটিজনিত কারণ
টালি বসানোর কাজে ব্যবহৃত মর্টারের গুণগত মান সঠিক না হওয়া। অর্থাৎ বালি-সিমেন্টের অনুপাত ঠিক না হওয়া, কিংবা বালি-সিমেন্টের গুণগত মান ভালো না হওয়া।
মর্টারের ময়েশচার কনটেন্ট সঠিক না হওয়া। অর্থাৎ মসলা মেশানোর জন্য পানি কম ব্যবহার করা। আমার দেখা মতে, ইদানীং প্রায় ক্ষেত্রেই বালি-সিমেন্টের মর্টার তৈরিতে পানি কম ব্যবহার করা হয়ে থাকে।
টালি বসানোর আগে ফ্লোর ও টালি ঠিকমতো ভিজিয়ে না নেওয়া।

আবহাওয়ার তারতম্যজনিত কারণ
আবহাওয়ার তারতম্যের কারণে কংক্রিটের এক্সপানশন ও কনট্রাকশন সংঘটিত হয়ে থাকে। কংক্রিটের এই এক্সপানশন ও কনট্রাকশন অত্যন্ত বাস্তবসম্মত একটি বিষয়, যা মানুষের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। এর বাস্তবতা এটা যে তুলনামূলকভাবে টালি অনেক ডেন্সড, নন-ফ্লেক্সিবল এবং অনেক শক্ত একটি সামগ্রী। অন্যদিকে টালি বসানোর জন্য প্রস্তুতকৃত কংক্রিট ফ্লোর টালির তুলনায় অনেক ফ্লেক্সিবল ও পোরাস। বিশেষ করে আমাদের দেশের কংক্রিট অন্যান্য দেশের কংক্রিটের তুলনায় নাজুক।
দেশের এই নাজুক কংক্রিট এবং এর ফ্লেক্সিবিলিটির কারণে ফ্লোরের কনট্রাকশনের দাম টালির তুলনায় অনেক বেশি হয়ে থাকে। ফলে টালি ও কংক্রিটের কনস্ট্রাকশন দামের অধিকতর তারতম্যের ফলে আপ-ওয়ার্ড প্রেশারে টালি কংক্রিট থেকে ডিবন্ডেড হয়ে যায়। প্রসঙ্গত, নিম্ন তাপে কংক্রিট সংকুচিত (কনট্রাকশন) হয় এবং উচ্চ তাপে সম্প্রসারিত (এক্সপানশন) হয়। যার ফলে শীতকালে টালি উঠে যাওয়ার প্রবণতা বেশি দেখা যায়।
টালির ভঙ্গুরতা
মোজাইক ফ্লোরের তুলনায় টালির ফ্লোর অধিকতর ভঙ্গুর এবং সংবেদনশীল। ফলে টালি দিয়ে তৈরি ফ্লোরে ভারী ও শক্ত কোনো জিনিস পড়লে সহজে ফেটে বা ভেঙে যায়।
টালির ওপর আলাদা কোটিং থাকা
কোনো কোনো ক্ষেত্রে নন-হোমোজিনিয়াস টালির ওপর পাতলা গ্লেইজড কোটিং দেওয়া থাকে। অত্র কোটিং দীর্ঘ ব্যবহার বা সময়ের পরিক্রমায় উঠে গিয়ে টালির নান্দনিকতা লোপ পায়।
ওপরে উল্লেখিত বিষয়গুলো বিবেচনায় আনা হলে টাইলস ফ্লোর ফিনিশিংয়ের তুলনায় মোজাইক ফ্লোর ফিনিশিং অনেক নির্ভরযোগ্য একটি আইটেম, যার নান্দনিকতা এবং দীর্ঘস্থায়িত্ব অনেক বেশি। মোজাইক ফ্লোরের বিশেষ আরেকটি সুবিধা আছে, তা হলো অনেক পুরোনো মোজাইক ফ্লোর মেশিনে কেটে নিয়মানুযায়ী ফিনিশিং দিলে আবার নতুনের রূপ ধারণ করতে পারে। ফলে মোজাইকের মান আমার মতে টালির তুলনায় অনেক বেশি। এই কারণেই মোজাইক ফ্লোর ফিনিশিংয়ের কাজ আবার ফিরে আসতে পারে বলে আমার ধারণা।

তবে অধিকতর আভিজাত্য এবং মানসম্পন্ন কাজের জন্য মার্বেল বা গ্রানাইট ফ্লোর ফিনিশিংয়ের কাজ চিরন্তর। মার্বেল বা গ্রানাইট ফ্লোর ফিনিশিংয়ের কাজ এখনো বিলুপ্তি হয়নি বলে আমি মনে করি না। মার্বেলের কাজে আমার জানা মতে, বিশেষ কোনো ত্রুটিবিচ্যুতি নেই। মার্বেল দ্বারা নির্মিত ফ্লোর মোজাইক ফ্লোর ফিনিশিংয়ের মতো পুরোনো হলে আবার মেশিনে কেটে নিয়মমতো ফিনিশিং দিলে নতুনের রূপ ধারণ করে। তাই আমি মনে করি, কারও সংগতি থাকলে টালি কিংবা মোজাইক ফ্লোর ফিনিশিংয়ের পরিবর্তে মার্বেল ফ্লোর ফিনিশিংয়ের কাজকে বেছে নেওয়া উত্তম।
যাই হোক, ফ্লোর ফিনিশিংয়ের কাজে বিভিন্ন রকম উপকরণের কর্মপদ্ধতি, সুবিধা-অসুবিধাসহ ভালো-মন্দ দিকগুলো তুলে ধরা হলো। এখন মানুষ যে যার নিজের চাহিদা, রুচি এবং আর্থিক সংগতি অনুসারে ফ্লোর ফিনিশিংয়ের কাজের সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন। প্রয়োজনে আরও কিছু জেনে নিয়ে নিজের বুদ্ধি-বিবেচনাকে কাজে লাগানোর চেষ্টা করবেন। ফ্লোর ফিনিশিংয়ের কাজ যা-ই করা হোক না কেন, কাজের গুণগত মান রক্ষা করার বিষয়টি অবশ্য নিশ্চিত করতে হবে। তাই অভিজ্ঞ লোকদের দিয়ে কাজ করানো এবং পরামর্শ নেওয়া অত্যন্ত জরুরি।
ইমারতে ফ্লোর ফিনিশিং – ১ম পর্ব
ইমারতে ফ্লোর ফিনিশিং – ২য় পর্ব
ইমারতে ফ্লোর ফিনিশিং – ৪র্থ পর্ব
– প্রকৌশলী মো. হাফিজুর রহমান
পিইঞ্জ, চিফ ইঞ্জিনিয়ার (অপারেশন)
এনা প্রপার্টিজ লি.
প্রকাশকাল: বন্ধন ১৬১ তম সংখ্যা, জানুয়ারি ২০২৪