ভবন নির্মাণ এবং মান নিয়ন্ত্রণ – ৫ (কাঁচামাল)

ফার্স্ট ক্লাস ইট

যেকোনো ভবন নির্মাণকল্পে ব্যবহৃতব্য ইটের গুণগত মান নিশ্চিত করার বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নইলে ভবনটি ব্যবহারকালীন দেয়ালে ড্যাম্প দেখা দেওয়াসহ নানা সমস্যার উদ্ভব হতে পারে। তাই নির্মাণকাজের জন্য ফার্স্ট ক্লাস ইট নির্বাচনের ক্ষেত্রে একটি ইটের সার্বিক বৈশিষ্ট্যে যা যা থাকা প্রয়োজন- 

  • রং সর্বসম এবং সেইফ ও সাইজ সঠিক হতে হবে।
  • কম্প্যাকশন ভালো হওয়া জরুরি, যা একটি ইট ভেঙে পরীক্ষা করে নিতে হবে।
  • ইটের গায়ে কোনোরূপ ফাটল, ছিদ্র কিংবা গোটা গোটা দানা থাকা বাঞ্ছনীয় নয়।
  • একটি ইট ২৪ ঘণ্টা পানিতে ভিজিয়ে রাখার পর এর নিজস্ব ওজনের ১/৬ (১৫-২০%) ভাগের বেশি পানি শোষণ করা সঠিক নয়। 
  • কম্প্রেসিভ স্ট্রেইন্থ বা ভারবহনের ক্ষমতা নিম্নে ৫০০০ পিএসআই হতে হবে।
  • ইটের সঙ্গে ইটে আঘাত লাগলে মেটালিক অর্থাৎ ঠনঠনে আওয়াজ হবে। 
  • লবণাক্ততার পরিমাণ ২.৫০ শতাংশের বেশি হওয়া বাঞ্ছনীয় নয়।
  • ইটের অংশবিশেষ কম পোড়া কিংবা বেশি পোড়া হওয়া সঠিক নয়।
  • সঠিক সাইজের একটি ইটের ওজন সাধারণত ৬ পাউন্ড হতে হবে।
  • একটি ফার্স্ট ক্লাস ইট পানিতে ভিজিয়ে রাখলে এর আয়তনের কোনো পরিবর্তন হবে না। 

ইটের উপরোল্লিখিত বৈশিষ্ট্যগুলো যাচাই করার জন্য সরেজমিনে (মাঠপর্যায়ে) এবং ল্যাবরেটরিতে বিভিন্ন প্রকার টেস্ট করা অত্যাবশ্যক। সরেজমিনে টেস্টের বিষয়গুলো সম্পূর্ণভাবে অভিজ্ঞতাপ্রসূত, যার কোনো পরিমাপ নির্ণয় করা যায় না, শুধু অনুমান কিংবা অনুভব করা যায়। যেমন-

  • সেইফ ও সর্বসম রং
  • ঠনঠনে আওয়াজ
  • কম পোড়া বা বেশি পোড়া
  • ফাটল, ছিদ্র কিংবা গোটা গোটা দানা থাকা
  • কম্প্যাকশন সঠিক হওয়া ইত্যাদি।

বৈশিষ্ট্যগুলো যাচাই করার জন্য নির্বাচিত ইট থেকে কিছু স্যাম্পল নিয়ে ল্যাবরেটরিতে টেস্ট করানোর কোনো বিকল্প নেই। ছবি: বন্ধন

এ ছাড়া অন্য বৈশিষ্ট্যগুলো যাচাই করার জন্য নির্বাচিত ইট থেকে কিছু স্যাম্পল নিয়ে ল্যাবরেটরিতে টেস্ট করানোর কোনো বিকল্প নেই। তাই ল্যাবরেটরি টেস্টের বিষয়গুলো উল্লেখ করা হলো-

  • পানিশোষণ ক্ষমতা
  • কম্প্রেসিভ স্ট্রেইন্থ বা ভারবহন ক্ষমতা
  • লবণাক্ততা
  • সাইজ ও ওজন
  • পানিতে ভেজানোর পর আয়তনের পরিবর্তন ইত্যাদি।

নির্মাণ-পূর্ববর্তী এই কাজগুলো সর্বক্ষেত্রে সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করা হয় না। ফলে পরে ভবন ব্যবহারকালীন নানা সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়, যা মানসিক শান্তি বিঘ্নিত করার পাশাপাশি আর্থিক ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। অতএব, যেকোনো ভবন নির্মাণকাজের জন্য ইট নির্বাচন করার লক্ষ্যে উপরিউক্ত বিষয়গুলো সম্পর্কে অধিকতর সচেতন হওয়া জরুরি। অন্যথায় সারা জীবন এর কুফল বয়ে বেড়াতে হয়। 

ফার্স্ট ক্লাস ইট সাধারণত ভবনের দেয়াল গাঁথুনি, ফাউন্ডেশন ও ফ্লোর-অন-গ্রেড (গ্রাউন্ড ফ্লোর স্ল্যাভ)-এর সোলিং করার কাজে ব্যবহৃত হয়। এ ছাড়া, কংক্রিট ঢালাই করার জন্য প্রয়োজনীয় খোয়া তৈরি করতে পিক্ড ঝামা ইট সংক্ষেপে পিকেট ব্যবহার করা হয় এবং অন্যান্য কম গুরুত্বপূর্ণ কাজের জন্য অবস্থাভেদে দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণির ইট ব্যবহার করা হয়ে থাকে।  

আমাদের দেশে ভবন নির্মাণকল্পে কংক্রিট তৈরির কাজে এখন পর্যন্ত অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ইটের খোয়া ব্যবহার করা হয়ে থাকে এবং একটি ভবনের গুরুত্বপূর্ণ স্ট্রাকচারই (কাঠামো) নির্মিত হয় কংক্রিট দ্বারা। ফলে, নির্মাণকাজের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবার জানা থাকা দরকার, যেকোনো স্ট্রাকচারের স্থায়িত্বতা ও গুণগত মান কংক্রিটের গুণগত মানের ওপর নির্ভরশীল। আর এই কংক্রিটের মান সঠিক রাখতে খোয়ার মানের ভূমিকাই অগ্রগণ্য।

অতএব, খোয়া তৈরির জন্য পিক্ড ঝামা ইট বা পিকেট নির্বাচনের গুরুত্বও অনেক বেশি, যেখানে ফার্স্ট ক্লাস ইট নির্বাচনের জন্য প্রতিষ্ঠিত সব নিয়মনীতি মেনে চলার কোনো বিকল্প নেই। একটি পিক্ড ঝামা ইট ফার্স্ট ক্লাস ইটের সব গুণাগুণসম্পন্ন হওয়া অত্যাবশ্যক। সেই সঙ্গে অতিরিক্ত একটি বিষয় লক্ষ রাখতে হবে, পিক্ড ঝামা ইট কোনোভাবেই মাত্রাতিরিক্ত পোড়ার কারণে মৌচাক সাদৃশ্য হওয়া বাঞ্ছনীয় নয়। 

পাথর

উন্নত বিশ্বের মতো আমাদের দেশেও এখন ভবন নির্মাণকল্পে কংক্রিট তৈরির কাজে পাথরের ব্যবহার বেড়েছে। তাই গুণগত মানসম্পন্ন পাথর নির্বাচনের জন্য এর গুণাগুণ সম্পর্কেও সংশ্লিষ্ট সবার সম্যক জ্ঞান থাকা অপরিহার্য। ভবন নির্মাণকাজে সাধারণত তিন ধরনের পাথর ব্যবহৃত হয়ে থাকে- 

  • নুড়ি পাথর (প্রকৃতি থেকে পাওয়া ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পাথর)
  • শিংগল (অপেক্ষাকৃত ছোট ও ক্ষুদ্র পাথরের সংমিশ্রণ)
  • স্টোন চিপস (বড় পাথর ভাঙা)

নুড়ি পাথর কখনো কখনো ‘ফ্লোর-অন-গ্রেড’ অর্থাৎ গ্রাউন্ড ফ্লোরের ফ্লোর স্ল্যাব ঢালাইয়ের কাজে ব্যবহার করা হয়ে থাকে। শিংগল ‘কাস্ট-ইন-সিটু পাইল’ ঢালাইয়ের কাজে ব্যবহৃত হয়। এ ছাড়া, অন্যান্য সব স্টাক্চারাল এলিমেন্ট তৈরির লক্ষ্যে ব্যবহৃত কংক্রিটে সর্বদাই স্টোন চিপস (পাথর কুচি) ব্যবহার করা হয়। নির্মাণকাজে ব্যবহৃতব্য এসব পাথর নির্বাচনের ক্ষেত্রেও  নির্দিষ্ট কিছু নীতিমালা আছে, যা মেনে চলা জরুরি।

নুড়ি পাথর

এই পাথর নদীর তলদেশ থেকে উত্তোলন কিংবা পাহাড় কেটে ছোট-বড় মিশ্রিত আকারে আহরণ করা হয়। ফলে, এই পাথরের মধ্যে কাদামাটি বা অন্যান্য পদার্থ যেমন- ঘাস, পাতা, কাঠ, কয়লা ইত্যাদি মিশ্রিত থাকতে পারে, যা কাজের আগে অবশ্যই পরিষ্কার করে নেওয়া দরকার। প্রয়োজনে পানি দিয়ে ধুয়ে নেওয়া জরুরি। নুড়ি পাথর আকারে ছোট, তাই কোনো রকম ভাঙাভাঙি ছাড়াই সরাসরি কাজে ব্যবহার করা হয়। তবে প্রাথমিক অবস্থায় এর মধ্যে অপেক্ষাকৃত ছোট-বড় পাথরের সংমিশ্রণ থাকে বিধায় কাজের আগে প্রয়োজন অনুসারে চালনি দিয়ে চেলে নিতে হয়।      

শিংগল

অপেক্ষাকৃত ছোট ও ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পাথরের সংমিশ্রণ, যা ‘কাস্ট-ইন-সিটু পাইল’ ঢালাইয়ের কাজে সরাসরি ব্যবহার করা হয়। এই পাথরের মধ্যেও কাদামাটি বা অন্যান্য পদার্থ যেমন- ঘাস, পাতা, কাঠ, কয়লা ইত্যাদি মিশ্রিত থাকতে পারে, যা কাজের আগে অবশ্যই পরিষ্কার করে নেওয়া অপরিহার্য। প্রয়োজনে পানি দিয়ে ধুয়ে নেওয়া জরুরি। শিংগল আকারে ছোট, তাই কোনো রকম ভাঙাভাঙি ছাড়াই সরাসরি কাজে ব্যবহার করা হয়। 

উন্নত বিশ্বের মতো আমাদের দেশেও এখন ভবন নির্মাণকল্পে কংক্রিট তৈরির কাজে পাথরের ব্যবহার বেড়েছে। ছবি: টুইস্টেডনেইল

স্টোন চিপস

স্টোন চিপস সাধারণত বড় পাথর বা বোল্ডার ভেঙে কাজের ধরন অনুযায়ী নির্দিষ্ট একটি আকারে তৈরি করা হয়। যেহেতু বড় পাথর ভেঙে স্টোন চিপস তৈরি করা হয়, তাই এ ক্ষেত্রে পাথরের গায়ে শুধু আলগা কাদামাটি লেগে থাকা ছাড়া অন্যান্য কোনো পদার্থের সংমিশ্রণ থাকে না। ফলে, পাথর ভেঙে চিপস তৈরি করার আগে পাথরের বৈশিষ্ট্য বা নিজস্ব গুণগত মান ঠিক থাকার বিষয়টি যাচাই করে নেওয়া অত্যাবশ্যক। 

পাথর প্রাকৃতিক নিয়মে সৃষ্ট একটি পদার্থ বিধায় গঠনগতভাবে স্থান-কালভেদে এর অভ্যন্তরীণ গুণাগুণের পার্থক্য দেখা যায়। সেক্ষেত্রে, ভবন নির্মাণকাজে ব্যবহৃতব্য পাথরের বৈশিষ্ট্যগুলো সংক্ষিপ্ত আকারে তুলে ধরা হলো-

  • অ্যাপিয়ারেন্স ও কালার
  • স্ট্রাক্চার বা গড়ন
  • টেক্সার বা গঠন বিন্যাস
  • ছিদ্রতা বা ঘনত্ব
  • পানিশোষণ ক্ষমতা
  • স্ট্রেইন্থ বা ভারবহন ক্ষমতা
  • ক্ষয়রোধ ক্ষমতা ইত্যাদি। 

এর মধ্যে শুধু ১ নম্বরে উল্লেখিত বৈশিষ্ট্যটিই সরেজমিনে যাচাইযোগ্য। বাকি বৈশিষ্ট্যগুলো মান যাচাইয়ের জন্য নির্বাচিত পাথরের স্যাম্পল নিয়ে ল্যাবরেটরিতে টেস্ট করাতে হবে। নির্মাণসংক্রান্ত সব কাজ সম্পাদন করণার্থে অভিজ্ঞতার কোনো বিকল্প নেই, তাই সব কাজেই অভিজ্ঞ লোকবল নিয়োগ দেওয়া নিশ্চিত করতে হবে।

– প্রকৌশলী মোঃ হাফিজুর রহমান পিইঞ্জ, ভাইস চেয়ারম্যান,
লাইফ ফেলো, দি ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন, বাংলাদেশ
লাইফ সদস্য-বিএসটিকিউএম, বিএএএস, এওটিএস (জাপান)
লিড অডিটর, আইএসও-৯০০১:২০০৮ অ্যান্ড ২০১৫ (কিউএমএস)

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top