স্বল্প খরচে বাড়ি নির্মাণ

পৃথিবীতে এমন মানুষ হয়তো খুঁজে পাওয়া যাবে না, যাঁর নিজের বাড়ির সাধ নেই। নিজের বাড়িতে থাকার সুখ ও মানসিক স্বস্তি কোথাও নেই। আর এ জন্যই বুঝি ইংরেজিতে একটা প্রবাদ আছে ‘Home Sweet Home’. বিশেষত রাজধানী ঢাকার মতো বড় বড় শহরে যাঁরা ভাড়া বাড়িতে থাকেন, তাঁরাই জানেন নিজের একটা বাড়ি মানে কী! বাড়িওয়ালার যাচ্ছেতাই ব্যবহার আর বাড়িভাড়া নিয়ে তাঁদের স্বেচ্ছাচারিতা তো রয়েছেই। কিন্তু ইচ্ছা করলেই তো আর নিজের একটা বাড়ি বানানো সম্ভব না। বাড়ি নির্মাণে চাই যথেষ্ট অর্থনৈতিক সচ্ছলতা। দিন দিন বাড়ছে নির্মাণসামগ্রীর দাম, বাড়ছে শ্রমমূল্য, সঙ্গে আনুষঙ্গিক ব্যয় বৃদ্ধির দরুন নিজস্ব একটি বাড়ি নির্মাণের স্বপ্ন মধ্যবিত্তের নাগালের বাইরে থেকে যাচ্ছে। তাই বলে কি হবে না নিজের একটা ছোট্ট নীড়? এত নিরাশার মধ্যে আশার কথা হচ্ছে, সঠিক পরিকল্পনা, তদারকির (সুপারভিশন) পাশাপাশি নির্মাণসামগ্রী ও কাজের গুণগতমান, স্থায়িত্ব এবং বাসিন্দাদের যথাযথ নিরাপত্তা বিধান করেই সম্ভব কম খরচে বাড়ি নির্মাণ। স্বল্পমূল্যের বাড়ি মানেই কিন্তু নিম্নমানের বাড়ি নয়। বাড়ির সঠিক প্ল্যান, ডিজাইন, এস্টিমেট, সয়েল টেস্টের সঙ্গে অভিজ্ঞ প্রকৌশলী, স্থপতি, ঠিকাদার ও দক্ষ কারিগরের সহায়তায় যে কেউ চাইলে শতকরা ২০ ভাগ কম খরচে বাড়ি নির্মাণ করতে পারেন।

ভবন নি‍র্মাণে সাটারিং

নির্মাণ খরচ কমাতে

সঠিক নির্মাণ পরিকল্পনা ও তদারকি (সুপারভিশন)

সঠিক নির্মাণ পরিকল্পনা ও তার বাস্তবায়নের সাহায্যে বাড়ির নির্মাণব্যয় ২০ শতাংশ কমানো সম্ভব।

দেশীয় নির্মাণসামগ্রীর ব্যবহার

বিদেশি নির্মাণসামগ্রীর পরিবর্তে দেশীয় নির্মাণসামগ্রী যথাযথ মান বজায় রেখে ব্যবহার করা হলে নির্মাণব্যয় কমানো সম্ভব।

 সঠিক ভূমির ব্যবহার

প্ল্যান অনুযায়ী ভূমির সঠিক ব্যবহার করা হলে নির্মাণব্যয় অনেকাংশ কমানো সম্ভব।

পরিবেশ নিয়ন্ত্রণে নিরাপত্তার ব্যবস্থা

সঠিক পরিবেশ (সাইট) নিয়ন্ত্রণ এবং নিরাপত্তার মাধ্যমে নির্মাণব্যয় কমানো সম্ভব। সঠিক পরিবেশ বলতে সাইটে বাউন্ডারি ওয়াল তৈরি, জানমালের নিরাপত্তার ও নিয়ন্ত্রণ, নির্মাণকাজের ধারাবাহিকতা বজায় রাখা (কাজের অগ্রগতি), সাইটে পানি সরবরাহ ও নিষ্কাশনের সুব্যবস্থা, বিদ্যুৎ সরবরাহ, সাইটে সহজ প্রবেশপথ তৈরি, টেলি যোগাযোগব্যবস্থা, প্রতিবেশীদের সঙ্গে সম্ভাব বজায় রাখা প্রভৃতি।

৫. প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রতিরোধ

প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেমন- বন্যা ও বন্যার পানি, ঝড়, বৃষ্টি, দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া, ভূমিকম্প ইত্যাদি দিক বিবেচনা নিয়ে নির্মাণ পরিকল্পনা করা হলে ব্যয় অনেকটা কমানো যায়।

দেয়ালের গাঁথুনি ও কংক্রিট মিক্সার

নির্মাণকাজের ব্যয় কমবে যেভাবে

ক. বাড়ির প্ল্যান তৈরি: জমির মাপ অনুযায়ী সঠিকভাবে বাড়ির প্ল্যান তৈরি করা হলে নির্মাণব্যয় কমানো সম্ভব।

খ. ফাউন্ডেশন নির্মাণকাজ: ফাউন্ডেশন, সলিং এবং ঢালাই বাদ দিয়ে ডিজাইনার কর্তৃক ফাউন্ডেশন ডিজাইন করা হলে নির্মাণব্যয় কমানো যায়।

গ. দেয়াল (ওয়াল) নির্মাণকাজ: প্রথম শ্রেণীর ইট, যথাযথ মানের মসলা (মর্টার) ব্যবহার করে কিউরিং করা হলে ইটের দেয়ালে প্লাস্টারের প্রয়োজন হয় না। এভাবে নির্মাণব্যয় কমানো যায়।

ঘ. লিন্টেল নির্মাণ: অনেক সময় দরজা-জানালার ওপর টানা লিন্টেল না দিয়ে ডিজাইন কর্তৃক খণ্ড বা টুকরা লিন্টেল দিয়ে বা ব্যবহার করে নির্মাণব্যয় কমানো যায়।

ঙ. ছাদ নির্মাণ: ছাদে রুকিং কম্পাউন্ড ব্যবহার করে জলছাদের কাজ সম্পূর্ণ করা যায় এবং তাতে কমে নির্মাণব্যয়।

চ. দরজা-জানালা ব্যবহার: দরজা-জানালায় দামি কাঠের পরিবর্তে বাইরের দিকের দেয়ালে স্টিল, অ্যাঙ্গেল ফ্রেম ও শিট ব্যবহার করা যায়। বাড়ির ভেতরে সব দরজায় হার্ডবোর্ড ব্যবহার করে ব্যয় কমানো যায়।

ছ. ফ্লোর নির্মাণ: অনেক সময় আরসিসি ফ্লোরের পরিবর্তে বালুর মেঝে (ফ্লোরে) ভালোভাবে দুরমুজ করে পলিথিন দিয়ে ইটের সলিং ও মর্টার ব্যবহার করে ফ্লোর তৈরি করা হলে ব্যয় কমানো সম্ভব।

জ. স্যানিটারি কাজ: স্যানিটারি কাজে বিদেশি সামগ্রীর পরিবর্তে দেশীয় সামগ্রী ব্যবহার করে নির্মাণ খরচ কমানো যায়।

ঝ. বিদ্যুতের কাজ: বিদ্যুৎ সরবরাহের কাজে দেয়ালের সারফেসে ওয়ারিং করার জন্য আমাদের এখানে সস্তায় বিদ্যুৎসামগ্রী পাওয়া যায়, যার মাধ্যমে নির্মাণব্যয় কমানো যায়।

বাড়ির অভ্যন্তরিন প্ল্যান

নিজের জন্য সুন্দর ও স্বপ্নের একটি বাড়ি নির্মাণ সবার মনেরই সুপ্ত বাসনা। অনেক সময় শুধু নির্মাণব্যয়ের কথা চিন্তা করে অনেকেই তাঁর স্বপ্ন বাস্তবায়নে এগোতে সাহস পান না। তদুপরি নির্মাণ সম্পর্কিত যথাযথ জ্ঞানের অভাবে অনেক জমির মালিক ভবন নির্মাণে উৎসাহিত হন না। কিন্তু এ সময়ে একটি ভবনের মালিক হওয়া কতটা সৌভাগ্যের ব্যাপার তা বলে বোঝানো যাবে না। আর সেটা যদি হয় ঢাকা বা ঢাকার মতো বড় কোনো শহরে, তবে তো কথাই নেই। সঠিক পরিকল্পনা ও সুপারভিশনের মাধ্যমে নির্মাণকাজে নির্মাণসামগ্রীর গুণগত মান বজায় রেখে স্বল্প খরচে বাড়ির নির্মাণকাজ সম্পন্ন করা সম্ভব। অনেকেই প্রকৌশলী ও স্থপতিদের মাধ্যমে নকশা করে বাড়ি নির্মাণে অনীহা দেখান। কেননা তাঁদের অনেকেই মনে করেন, ভবন নির্মাণে প্রকৌশলী ও স্থপতি নিয়োগ একধরনের বাড়তি খরচ। কিন্তু যদি প্রকৌশলী ও স্থপতিদের দ্বারা যথাযথ প্ল্যান বা নকশা করে বাড়ি নির্মাণ করা হয়, তবে নির্মাণের খরচ শতকরা ২০ ভাগ পর্যন্ত কমে আসে। কাজেই যেকোনো ধরনের নির্মাণকাজের আগে ভালো প্রকৌশলী বা স্থপতির সঙ্গে পরামর্শ করে অতঃপর যথাযথ নিয়মনীতি অনুসরণ করে নির্মাণকাজে এগোনো ভালো। কেননা সঠিক পরিকল্পনা ও সময়োপযোগী পদক্ষেপই পারে স্বপ্নিল নীড়ের বাস্তব রূপ দিতে।

প্রকৌশলী সনজিত সাহা

[email protected]

প্রকাশকাল: বন্ধন ৪৮ তম সংখ্যা, এপ্রিল ২০১৪

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top