বিংশ শতাব্দীর শুরুতে স্থাপত্য বিকাশের নতুন একটি ধারা সূচিত হয়। সমাজের ক্রাইম (অপরাধ) রোধকল্পে স্থান বিন্যাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পরিলক্ষিত হয়। সমাজ ব্যবস্থাপনায় যেমন জনগোষ্ঠী, ঘরবাড়ি, অবকাঠামো ইত্যাদির প্রয়োজন অনস্বীকার্য, যার দরুন একটা উপদানের সঙ্গে অন্য উপাদানের সম্পর্ক স্থাপিত হয়। ঠিক তেমনি মাঝেমধ্যে দেখা যায় সামাজিক অরাজকতা কিংবা যেখানে ঠাঁয় নেয় বিভিন্ন অসামাজিক কর্মকাণ্ড। উদাহরণ হিসেবে দেখা যায়- একটি প্রতিষ্ঠিত সমাজব্যবস্থায় সর্বক্ষেত্রে সব জায়গায় জনমানুষের চলাচল বেশি থাকে। কোথাও হাটবাজার তৈরি হয় কোথাও আবার বসবাসের জন্য ঘরবাড়ির সংখ্যা থাকে কম, যাকে জনহীন এলাকা বলে চিহ্নিত করতে হয় কিংবা এমন কোনো কোনো স্থান থাকে, যেখানে দিনের বেলায়ও সাধারণ মানুষের চলাচল থাকে প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। এসব ক্ষেত্রে সামাজিক বিভিন্ন গঠনতন্ত্রের সঙ্গে স্থাপত্যিক একটি শক্তিশালী ভাবনা ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। যাকে আমরা সাধারণত অবহেলিত রেখে দিই বিভিন্ন সময়। আর এভাবেই তৈরি হয় ‘অনিরাপদ স্থান’ হিসেবে। কোনো একটি নির্ধারিত স্থানকে ল্যান্ডস্কেপের মাধ্যমে কিংবা পার্কিং ধরন পরিবর্তনের মাধ্যমে এবং দৃশ্যমান স্পেস ডিজাইনের মাধ্যমে খুব সহজে পরিবর্তন করতে পারি। অনিরাপদ স্থান থেকে নিরাপদ স্থানে ক্ষেত্রে স্থপতি এবং নগর পরিকল্পনাকারীকে একত্রে কাজ করতে হবে।
প্রথমেই যদি চোখ ফেরানো যায় আমাদের দেশের দিকে, একটু ভালো করে খেয়াল করলে দেখা যাবে বিশেষ বিশেষ স্থানে অপরাধ সংগঠনের হার তুলনামূলকভাবে বেশি-
১। প্রধান সড়ক
২। সাবরোড, যার সঙ্গে অল্প দূরেই প্রধান সড়কের সংযোগ রয়েছে
৩। বস্তি কিংবা বস্তির কাছাকাছি এলাকা, যেখানে অলিগলিতে পরিপূর্ণ এবং সাধারণ জনগোষ্ঠীর যাতায়াত তুলনামূলক কম
৪। অপরিকল্পিত প্রকল্প এবং এর আশপাশ
৫। নোংরা জলাধার এবং এর আশপাশ
৬। অন্ধকারাচ্ছন্ন জায়গা, যা দৃষ্টিগোচর হয় না।

আমাদের দেশের বিভিন্ন পাবলিক পার্কের দিকে খেয়াল করলে দেখা যাবে, অপরাধ সংঘটনের মাত্রা সেখানে নেহাত কম নয়। সেই সব পাবলিক পার্কেই বেশির ভাগ অপরাধ সংঘটিত হয়, যেখানে সহজেই দৃষ্টি যায় না। চারপাশ পুরু দেয়াল দিয়ে পরিবেষ্টিত কিংবা যা কর্মব্যস্ত লোকালয় থেকে বিচ্ছিন্ন।
একটু ভালো করে খেয়াল করলে দেখা যাবে যে সাবরোডের তুলনায় প্রধান সড়কে কিংবা যেসব সাবরোডে ছিনতাই কিংবা অন্যান্য অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে, সেই সাবরোডের অল্প কিছু দূরেই তার সঙ্গে কোনো না কোনো প্রধন সড়কের সংযোগ আছে, যার দরুন খুব সহজেই একজন অপরাধী অপরাধ ঘটিয়ে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়।
অনেক স্থপতি স্থাপত্যের দিক থেকে চারটি উপাদানকে সমাজের অপরাধ প্রতিরোধের কৌশল হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। এগুলো হলো-
১। সাধারণত সমাজের সকল স্তরের বসবাসকারী যেন সর্বস্তরের সাধারণ জনগণ নিরাপত্তা পায়, সে ব্যবস্থা তৈরি করা।
২। সমাজে বা নির্দিষ্ট স্থানে বসবাসকারীদের মধ্যে নিজস্ব চিন্তাধারার এবং পরিচয়ের ভাবধারা গঠন, যেন বাইরের কোনো অপরিচিত সহজেই কোনো কিছু করার চিন্তা থেকে বিরত থাকে।
৩। কমিউনিটি তৈরি করা এবং এর সব উপাদানের সুশৃঙ্খল বলেই যার দরুন সামাজিক অদৃশ্যতা পরিহারকরণ।
৪। নির্দিষ্ট সমাজের জন্য গন্তব্য দুর্নীতি চিহ্নিত এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ।
এ ক্ষেত্রে জেন জ্যাকবসের একটি তত্ত্ব বিশেষ উল্লেখযোগ্য। তিনি বলেছেন, ‘Eye on the street’ এমন অনেক রাস্তা আছে, যা সাধারণত ছবি সীমার বাইরে অর্থাৎ সেক্ষেত্রে সাধারণত কেউ দেখতে পারে না কিংবা কোনো আবাসন দোকানপাট, লোকালয় থেকে সেই রাস্তাটি সহজেই দৃষ্টিগোচর হয় না। এ ক্ষেত্রে দেখা যায়, এমন সব রাস্তায় বিভিন্ন অপরাধ বেশি সংঘটিত হয়।
আমরা যদি ‘বস্তি’ কিংবা দুপাশে কোনো অবকাঠমো নেই এমন রাস্তার কথা চিন্তা করি তাহলে দেখা যাবে, এমন রাস্তায় দিনেদুপুরে ছিনতাইসহ অন্যান্য অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে দিনের বেলায়ও।

আবাসন প্রকল্পের দিকে চোখ ফেরালে পরিলক্ষিত হয় যে বর্তমানে অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিংগুলোতে বিভিন্ন প্রকার অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে। এর প্রধান কারণ, আমাদের বর্তমান সমাজব্যবস্থা এবং সম্পর্ক। একটা সময় ছিল যেখানে একই সমাজব্যবস্থায় একে অপরকে সবাই সবাইকে চিনছে, জানছে কিন্তু বর্তমানে পাশের ফ্ল্যাটে কে থাকে ঠিকমতো জানা হয় না। তাই কারও পক্ষে সম্ভব হয় না পাশের স্থাপনায় কী ঘটছে কিংবা কোনো অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে কি না। এর অন্যতম কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা যায় স্থাপত্য নকশা প্রণয়ন। বর্তমানে বেশির ভাগ আবাসিক প্রকল্পে দেখা যায় কেন্দ্রীয় শীতাতপ নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা করতে এবং যার দরুন অ্যাপার্টমেন্টের দরজা-জানালা সব সময় বন্ধ রাখতে হয়। তাই দৃশ্যমান ক্ষমতা কমে যায় এবং বাইরে ও ভেতরের আন্তসম্পর্ক নিস্তেজ হয়ে পড়ে। তা ছাড়া ঘনবসতি হওয়ার দরুন পাশের স্থাপনা থেকে গোপনীয়তা সৃষ্টির লক্ষ্যে বিভিন্ন প্রকার সরু কিংবা অপ্রশস্ত জানালা কিংবা উন্মুক্ত জায়গা তৈরি করা হয়, যা শুধু সামান্য আলো-বাতাসের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়, যা প্রয়োজনের তুলনায় অপর্যাপ্ত এবং সহজেই অনিরাপদ দৃষ্টিসম্পন্ন স্থাপনার জন্ম দেয়।
অনেক স্থাপনাতেই দেখা যায় লিফটের অবস্থান ভেতরের দিকে, যা কয়েকটি অপ্রশস্ত করিডর দিয়ে পরিবেষ্টিত এবং যেখান থেকে ঢোকার রাস্তা চোখে পড়ে না, যেখানে যেকোনো সময় বিভিন্ন ধরনের অপরাধের তৈরি হয়। এ ক্ষেত্রে লাইটওয়ে একটি বহুল গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, যা ডিজাইন করার ক্ষেত্রে স্থপতিকে অবশ্যই বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।
সাধারণত সেই একই ফুটপাতে বেশির ভাগ অপরাধ সংঘটিত হয়, যেখানে ফুটপাতের সীমানা প্রাচীর এবং মূল বাড়ির অবস্থানের প্রতিটির মধ্যে একটি বড় অংশ অপরিকল্পিত অব্যবহারযোগ্য ফাঁক থাকে। গাছপালা অনেক সময় অপরাধ সংঘটনে ভূমিকা পালন করে। যদি সেটি সঠিকভাবে বপন করা না হয় যেমন বাগানে গাছ আছে অথচ এই গাছগুলোর জন্য বাসার দোতলা কিংবা তিনতলা থেকে বাইরের ফুটপাত কিংবা রাস্তা সঠিকভাবে পরিলক্ষিত হয় না। অথবা এই গাছপালার জন্য ল্যাম্পপোস্টের আলো সঠিকভাবে বিস্তৃত হতে পারে না, সেক্ষেত্রে অপরাধ সংঘটিত হওয়ার প্রবণতা বেশি। আবার অনেক ক্ষেত্রে প্রয়োজনের তুলনায় অধিকমাত্রার ঔজ্জ্বল্যে কিংবা ইলিউশন তৈরি করে, যার দরুন সামনে কিংবা আশপাশের বিভিন্ন জিনিস সঠিকভাবে অবলোকন করা সম্ভব হয় না এবং অপরাধ সংঘটিত হয়। তাই শুধু লাইটওয়ের ব্যবস্থা করলে হবে না, সেটি হতে হবে সঠিকমাত্রায় স্থানভেদে ভিন্নতর।

গবেষণায় দেখা যায়, যেসব স্থানের নিজস্ব গতি কিংবা নির্দেশনা নেই, বেশির ভাগ অপরাধ সেখানে সংঘটিত হয় এবং এমন সমাজব্যবস্থায় নিজস্ব সম্প্রদায় তৈরি হয়নি কিংবা সম্প্রদায়ের সদস্যদের মধ্যে বিশ্বাস আস্থা নেই, সেখানে অপরাধ সংঘটিত হওয়ার হার বেশি। আমরা যদি পুরান ঢাকার রাস্তার দিকে খেয়াল করি দেখা যাবে, মূল রাস্তার দুই পাশ দিয়ে বিভিন্ন গলি ভেতরের দিকে চলে গেছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে রাস্তাগুলো (গলি) শেষ হয়েছে কয়েকটি বাড়ির মুখে। এ ক্ষেত্রে এসব রাস্তায় অপরাধ সংঘটিত হওয়ার সুযোগ তুলনামূলকভাবে কম। কারণ, এসব গলির পাশের স্থাপনাগুলো একে অপরকে চিনতে সক্ষম হয় এবং নতুন কোনো আগন্তুক এলে খুব সহজে সবার চোখে পড়ে। মার্কেট আবাসন প্রকল্পের ক্ষেত্রে সিঁড়ি একটি বিশেষ ভূমিকা রাখে অপরাধপ্রবণতার কারণ হিসেবে। অপ্রশস্ত সিঁড়ি অনেক অপরাধের জন্মদাতা।
আর এই জন্য একজন স্থপতি ও নগর পরিকল্পনাবিদকে কোনো নকশা প্রণয়ন করার ক্ষেত্রে অবশ্যই এ বিষয়গুলো সঠিকভাবে খেয়াল করতে হবে। কারণ, সঠিক অবকাঠামোগত পরিকল্পনাহীনতার জন্য অনেক সামান্য ব্যবস্থা নিঃশেষ হওয়ার উদাহরণ আমাদের সামনে দৃশ্যমান।
স্থপতি সজল চৌধুরী
শিক্ষক, স্থাপত্য বিভাগ, চট্টগ্রাম প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়।
প্রকাশকাল: বন্ধন ৩৬ তম সংখ্যা, এপ্রিল ২০১৩