মোগল স্থাপত্য রীতি অনন্য নিদর্শন সোনাকান্দা দুর্গ

সৃষ্টির শুরু থেকেই মানুষ প্রকৃতি ও প্রতিপক্ষের কাছ থেকে নিজেকে রক্ষা করার জন্য প্রতিরোধের ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। এরই অনিবার্যতায় পত্তন ঘটে দুর্গব্যবস্থার। প্রত্নতাত্ত্বিক দৃষ্টিতে দুর্গ ব্যবস্থা হলো প্রতিরোধের আয়োজন। পরিখা বা গর্তের মাধ্যমে অথবা অন্য কোনোভাবে বসতিকে ঘিরে রাখার ব্যবস্থা থেকেই দুর্গ ধারণার উৎপত্তি।

নারায়ণগঞ্জ শহর থেকে মাত্র আড়াই কিলোমিটার দূরে সোনাকান্দা দুর্গের অবস্থান। মূলত দুর্গের নামানুসারে ওই এলাকার নামকরণ করা হয় সোনাকান্দা। সোনাকান্দা নামের চমৎকার একটি জনশ্রুতি রয়েছে, তবে ঐতিহাসিক কোনো ভিত্তি নেই তাতে। জনশ্রুতিটা হচ্ছে : বার ভূঁইয়াদের অধিপতি ঈশা খাঁ বিক্রমপুরের জমিদার কেদার রায়ের বিধবা কন্যা সোনাবিবিকে জোরপূর্বক বিয়ে করে এই দুর্গে নিয়ে আসেন। বিষয়টা মেনে নিতে পারেননি সোনাবিবি। তিনি নিরবে-নিভৃতে দুর্গে বসে রাত-দিন কাঁদতে থাকেন। সেই থেকে দুর্গের নামকরণ হয় সোনাকান্দা। 

মূলত দুর্গের নামানুসারে ওই এলাকার নামকরণ করা হয় সোনাকান্দা। ছবি: উইকিপিডিয়া

সোনাকান্দা দুর্গ নিয়ে প্রচলিত রয়েছে আরো একটি মর্মস্পর্শী কাহিনী জানা যায় সাংবাদিক ওহিদুল হক খানের কাছ থেকে, প্রথমে সোনাকান্দা ছিল ঈশা খাঁর কেল্লা। জমিদার কেদার রায়ের মেয়ে স্বর্ণময়ী এসেছিলেন লাঙ্গলবন্দে পুণ্যস্নান করতে। একদল ডাকাত স্বর্ণময়ীর বজরায় হানা দেয়। প্রচুর স্বর্ণালংকারসহ স্বর্ণময়ীকে অপহরণ করে। পরে ঈশা খাঁ তাঁকে উদ্ধার করে কেদার রায়ের কাছে ফেরত পাঠাতে চান; কিন্তু মুসলমানের তাঁবুতে রাত কাটানোয় জাত গেছে এ অভিযোগে কেদার রায় স্বর্ণময়ীকে আর ফেরত নেননি। এ খবর শুনে স্বর্ণময়ী কেল্লার তাঁবুতে দিনের পর দিন কেঁদে কেঁদে কাটিয়েছেন। আর তাই এর নাম হয় সোনার কান্দা বা সোনাকান্দা।

তবে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড. এ কে এম শাহনাওয়াজের মতে, কেল্লার সঙ্গে স্বর্ণময়ীর কাহিনীর কোনো প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ পাওয়া যায়নি। এর নির্মাণশৈলী দেখলে বোঝা যায় এটি মোগল আমলের। আর ঈশা খাঁর শাসনকাল ছিল এটি নির্মাণের বেশ আগে। 

এই দুর্গের স্থাপত্যকাল ১৭ শতকের মাঝামাঝি সময়। মূলত জলদস্যুদের আক্রমণ প্রতিহত করার উদ্দেশে ইদ্রাকপুর, সোনাকান্দা ও হাজীগঞ্জ এই তিনটি দুর্গ নির্মাণ করেছেন বাংলার সুবেদার মীর জুমলা। এগুলো মূলত জলদুর্গ, প্রসাদ দুর্গ নয়। ইটের তৈরি এ দুর্গের দৈর্ঘ্য প্রায় ৮৬ মিটার, প্রস্থ ৫৮ মিটার। দুর্গটি মোগল স্থাপত্যরীতিতে তৈরি। এর উত্তর দিকে রয়েছে একটি প্রবেশ তোরণ। এটি চওড়া পাঁচ মিটার। দুর্গের দেয়ালের পুরু দেড় মিটার। আর দেয়ালের উচ্চতা সাড়ে তিন মিটার হলেও বর্তমানে উচ্চতা অনেকখানি কমে গেছে। দুর্গের পশ্চিমাংশে রয়েছে সিঁড়িযুক্ত খিলান পথ ও উঁচু বেদি। সেখান থেকে নদীর দিকে মুখ করে কামান বসানো থাকত। উল্লেখ্য, এতদঞ্চলের তিনটি জলদুর্গের মধ্যে সোনাকান্দা দুর্গটি সর্ববৃহৎ। সোনাকান্দা দুর্গের একটু ভিন্ন বৈশিষ্ট্য রয়েছে, যা অন্য দুটি দুর্গের মধ্যে নেই। এ দুর্গটি দুটি অংশে বিভক্ত। একটি হলো বুরুজবিশিষ্ট আয়তকার ফোকরযুক্ত অংশ আর অন্যটি পশ্চিম দিকে সিঁড়িপথ খিলানযুক্ত উঁচু বেদি। অন্য দুটিতে এমন খিলানসহ প্রবেশপথ নেই। সোনাকান্দা দুর্গের প্রতিরক্ষা প্রাচীরের চূড়ায় মার্লন নকশা এবং বুরুজ রয়েছে। উঁচু প্রাচীর থেকে বন্দুকের গুলি ও কামানের গোলা ছোঁড়ার জন্য নির্মিত ফোকরও রয়েছে, যা সুদৃঢ় প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য জানান দেয়। 

সোনাকান্দা নামের চমৎকার একটি জনশ্রুতি রয়েছে, তবে ঐতিহাসিক কোনো ভিত্তি নেই তাতে। ছবি: উইকিপিডিয়া

সোনাকান্দা ও হাজীগঞ্জ দুর্গ দুটি ১৯৫০ সালে জাতীয় প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের আওতায় নিয়ে সংস্কার করা হয়। দুর্গ দুটির বর্তমান অবস্থা ভালো নয়। দ্রুত সংস্কার না হলে এগুলো ধ্বংসের দিকে ধাবিত হবে। অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে দুর্গগুলো সংস্কার করতে হবে, না হলে মূল স্থাপনার সঙ্গে অমিল ঘটতে পারে। ১৮৯৬ সালে প্রকাশিত গ্রন্থ ‘লিস্ট অব অ্যানসিয়েন্ট মনুমেন্টস ইন বেঙ্গল’ সূত্রে জানা যায়, একসময় হাজীগঞ্জ দুর্গটি প্রায় ধ্বংস হয়ে যায়। পরে সংস্কার করতে গিয়ে এর অনেক রদবদল করা হয়। কাজেই বিষয়টির প্রতি যথাযথভাবে নজর দিয়ে এর সঠিক সংস্কার করতে হবে। না হলে দুর্গের বিকৃত রূপ দেখা দেবে। এমনটি কোনোভাবেই কাম্য নয়।

মেহেদী হাসান

প্রকাশকাল: বন্ধন ২৫ তম সংখ্যা, মে ২০১২

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top