বগুড়া জেলার শেরপুর থেকে ১ দশমিক ৬ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত খেরুয়া মসজিদ। মসজিদটিতে মোগল ও সুলতানি যুগের ঐতিহ্যের প্রতিচ্ছবি ফুটে ওঠে। বগুড়া বাংলার উত্তর দিকে অবস্থিত হওয়ায়, এই গুরুত্ব শের শাহ অনুধাবন করতে পারে। এটিকে তিনি শক্তিশালী সামরিক ঘাঁটিতে পরিণত করতে চেয়েছিলেন। ধারণা করা হয়, শহরটি তাঁর নামানুসারে করতে চেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু তিনি তাঁর প্রকল্পটি সম্পূর্ণ করতে পারেননি। আকবর যখন বাংলায় তাঁর ক্ষমতা সুসংহত করতে শুরু করেন, তখন বাংলার বারো ভুঁইয়ারা এবং মোগল বিদ্রোহীরা শেরপুরকে তাঁদের আশ্রয়স্থল হিসেবে খুঁজে নেয়। এই সময়ে তাঁদের ধর্মীয় রীতিনীতি পালনের জন্য খেরুয়া মসজিদ গড়ে ওঠে।
মসজিদটি একটি আয়তকার স্থাপত্য। এর পরিমাপ ১৭.৬৭ মিটার এবং ৭.৬২ মিটার; দেয়ালের পুরুত্ব ১.৯৫ মিটার। মসজিদটির পূর্বদিকে তিনটি প্রবেশদ্বার রয়েছে; উত্তর ও দক্ষিণ দিকে একটি করে প্রবেশদ্বার রয়েছে। কেন্দ্রীয় প্রবেশদ্বারটি অন্য প্রবেশদ্বারের তুলনায় বড়, প্রশস্ত। প্রতিটি প্রবেশপথ একেবারে সুস্পষ্ট। মসজিদের অভ্যন্তরে পূর্ব দেয়ালের প্রবেশদ্বারের সঙ্গে মিল রেখে তিনটি মিহরাব রয়েছে। আয়তাকার ফ্রেমের মধ্যে অর্ধগোলাকার মিহরাবগুলো স্থাপিত। মিহরাবের কারুকাজগুলো মন ছুঁয়ে যাওয়ার মতোই সুন্দর। মুসলিম স্থাপত্যে মিহরাবের গুরুত্ব বলার অপেক্ষা রাখে না। এটি ছাড়া মসজিদ কল্পনায় করা যায় না। মোগল আমলের বেশির ভাগ মসজিদ স্থাপত্যের বেলায় এই ধরনের নির্মাণশৈলী লক্ষ করা যায়। মসজিদের চতুর্দিকে চারটি অষ্টাভুজ আকৃতির মিনার রয়েছে, যা ছাদ পর্যন্ত উত্থিত। এগুলো মসজিদের কাঠামোকে আরও সুদৃঢ় করেছে। এই মসজিদের কার্নিশগুলো সুলতানি আমলের স্থাপত্যের মতোই বাঁকানো। কার্নিশেও ছোট ছোট পোড়ামাটির তৈরি কারুকার্য লক্ষ করা যায়।
মসজিদের অভ্যন্তরভাগ দুটি খিলানাকৃতি দ্বার দ্বারা সমান তিন ভাগে বিভক্ত করা করা হয়েছে। তিনটি ভাগই অর্ধগোলাকার গম্বুজ দ্বারা আবৃত। মসজিদের খিলানের স্প্র্যান্ডেলের ওপর গোলাপ দ্বারা সজ্জিত। পূর্ব দিকের দেয়ালে কুলুঙ্গিও দেখা যায়। মসজিদের ভেতরে ঢুকে ওপরের দিকে তাকিয়ে থাকলে দেখা যাবে ইটের নান্দনিক কারুকার্য। গাঁথুনি দেখলে মনে হবে খুব যতœ করে নির্মাণকাজ করা হয়েছে। মসজিদের দেয়ালজুড়ে টেরাকোটার কাজ; ফল, লতা-পাতা দিয়ে নকশা করা। লাল এই স্থাপত্যটির সামনেই রয়েছে খোলা সবুজ মাঠ। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন মাঠে কার্পেটের মতো ঘাস শুরুতেই চোখে পড়ে। মসজিদের পাশে নারকেল, তাল, আমগাছের সারি আপনাকে দেবে প্রশান্তি। এই মনোরম দৃশ্য দেখতে এখানে প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মানুষের ভিড় জমে। প্রতি শুক্রবার, এখানে গ্রামের বিভিন্ন জায়গা থেকে মুসল্লিরা নামাজ আদায় করতে আসেন।

মসজিদের ওপরে কুলুঙ্গিতে খোদাইকৃত শিলালিপি থেকে জানা যায়, ১৫৮২ সালের ২০ জানুয়ারি জউহর আলী খান কাগশালের পুত্র মিরজা মুরাদ খান নির্মাণ করে। মুরাদ খান, তিনি মাসুম খান কাবুলি এবং অন্যদের সঙ্গে সম্রাট আকবরের বিরুদ্ধেও বিরোধিতা করেন। সেভাবে বলতে গেলে, এই মসজিদটিও মুরাদ খানের বিদ্রোহী আমলে নির্মিত হয়েছে। কিন্তু মুরাদ খান পরে আকবরের অধীনে চাকরিতে যোগদান করেন। আবুল ফজল নামের ব্যক্তি জানান যে মুরাদ খান কাগশাল মাসুম খান কাবুলির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন ৯৯১ হিজরিতে। স্থাপত্য অধিদপ্তর এই স্থাপত্যটিকে ১৯৫১ সালে নিজেদের আওতায় নেয়।
– বিজয়া চৌধুরী
প্রকাশকাল: বন্ধন ১৬৩ তম সংখ্যা, মার্চ ২০২৪