প্রতিটি সৃষ্টিকে ঘিরেই থাকে প্রত্যাশা, সে প্রত্যাশার প্রাপ্তি সব সময় ঘটে না। ১৯৭১-এ জন্ম নেওয়া সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশ নিয়েও সকলের প্রত্যাশা ছিল। প্রত্যাশা আর প্রাপ্তির মেলবন্ধন হয়নি। কিন্তু থেমে থাকেনি এ দেশের মানুষ। প্রতি মুহূর্তে লড়াই করে চলেছে বাস্তবতার সাথে। দারিদ্র্যমুক্ত, সবুজ বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন নিয়ে এগিয়ে চলেছে এ দেশের স্বপ্ন কারিগররা। এমনই কারিগরের ভূমিকায় এবার বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের শিক্ষার্থীরা। মানুষের জন্য কাজ করাকে লক্ষ্য ধরে নানামুখী প্রকল্প নিয়েছে তারা। ওদের তেমনি এক প্রকল্প বা প্রজেক্ট ‘নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য আবাসন পরিকল্পনা।’ বুয়েটের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের শিক্ষক ড. ইশরাত ইসলামের তত্ত্বাবধানে এই প্রকল্পের স্টাডি এরিয়া বা এলাকা হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছে ‘সাতারকুল’কে।
বর্তমান অবস্থায়, ঢাকাতে নিম্ন আয়ের মানুষদের জন্য আবাসন সুবিধা খুবই অপ্রতুল। এরা ঢাকাতে নানামুখী পেশার সাথে জড়িত। প্রতিদিন এরা ঢাকাতে আসে রাজধানীর আশপাশের বিভিন্ন এলাকা থেকে। এ ধরনের কিছু এলাকার মধ্যে সাতারকুল অন্যতম। বাড্ডার দক্ষিণে এবং ঢাকা ডিএমডিপি এরিয়ার ইস্টার্ন ফ্রিঞ্জে অবস্থিত সাতারকুল এলাকার পশ্চিমে বয়ে গেছে বালু নদী। অন্য সব জায়গার মতো এখানেও রয়েছে আবাসনের তীব্র সঙ্কট। এখানে গার্মেন্টসকর্মী, রিকশাচালক, দিনমজুর, ছোটখাটো ব্যবসাসহ অন্যান্য অনেক পেশার সাথে জড়িত স্বল্প আয়ের মানুষের বাস। দেখা গেছে, এদের দৈনন্দিন আয় সর্বনিম্ন ৫০০০ থেকে সর্বোচ্চ ১৩০০০ টাকা। এরাই এই প্রকল্পের টার্গেট গ্রুপ।

পেশা আয়
ভ্রাম্যমাণ বিক্রেতা, কুলি, দিনমজুর ৫০০০-৭০০০
গার্মেন্টস শ্রমিক, গৃহকর্মী, ঠেলাগাড়ি চালক. ৭০০০-১০০০০
রিকশাচালক, ভ্যানচালক, অটোচালক, ছোট ব্যবসায়ী. ১০০০০-১৩০০০
এই আবাসন প্রকল্পটির প্রধান উদ্দেশ্য হলো, এ ধরনের স্বল্প আয়ের মানুষদেরকে তাদের কর্মস্থলের পাশেই সামর্থ্য অনুযায়ী আবাসন দেওয়া এবং এটা নিশ্চিত করা যেন তারা বিকল্প আয়ের পথ হিসেবে প্রকল্প এলাকাতেই বিভিন্ন ধরনের কর্মকান্ডে জড়িত হতে পারে। সর্বোপরি, তারা যেন আত্মনির্ভরশীল হয় এবং তাদের বাসস্থানের নিশ্চয়তা অর্জিত হয়। সাতারকুলের প্রায় সাড়ে পাঁচশ একর এলাকাজুড়ে প্রকল্পটি পরিকল্পনা করা হয়েছে। যে কোনো প্রকল্পের সার্থকতা অনেকটাই নির্ভর করে এর যোগাযোগ ব্যবস্থার উপর। প্রকল্পটিকে বাড্ডার সাথে সংযুক্ত করেছে বাড্ডা-বেরাইদ রাস্তা এবং ডিটেইলড এরিয়া প্ল্যানে (ড্যাপ) এই প্রকল্পের পশ্চিম অংশে দুইশ ফুট প্রশস্ত রাস্তার কথা বলা হয়েছে। প্রকল্পটিতে সহজ যাতায়াত ব্যবস্থা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বাড্ডা-বেরাইদ ও দুইশ ফুট প্রশস্ত রাস্তাকে যুক্ত করে ৬০ ফুট প্রধান সড়কের কথা বলা হয়েছে।

তা ছাড়া প্রকল্পের খালগুলোকে ব্যবহার করে একটি ওয়াটার রুটের চিন্তা করা হয়েছে, যা প্রকল্পের বিভিন্ন কৃষিজ পণ্যের সরবরাহকে নিশ্চিত করতে সাহায্য করবে। প্রকল্পটিতে তিন ধরনের হাউজিং ব্লক রাখা হয়েছে। তিন ধরনের আয়ের মানুষের জন্য। প্রতিটি ব্লকে বিল্ডিং সংখ্যা ৪টি এবং প্রতিটি বিল্ডিংয়ের উচ্চতা ৫০ ফুট। প্রতিটি ব্লকের মাঝে রাখা হয়েছে খোলা জায়গা, যেখানে বসবাসকরীরা নিজেদের প্রয়োজনমতো বিভিন্ন ধরনের সবজি চাষ করতে পারবে।
এখানে সর্বমোট ১,৪১,৪০০ জন মানুষের আবাসনের ব্যবস্থা করার পরিকল্পনা করা হয়েছে। অন্য আবাসিক সুবিধাসমূহ যেমন স্কুল, কলেজ, পার্ক, মসজিদ ইত্যাদির মাধ্যমে এই প্রকল্পটিকে নিম্ন আয়ের মানুষদের সুন্দরভাবে থাকার উপযোগী করে গড়ে তোলা হচ্ছে।
প্রকল্পটি বাস্তবায়নের জন্য কিছু পলিসির কথা পরিকল্পনাটিতে রয়েছে। কীভাবে প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হবে, এ ক্ষেত্রে কারা কী ধরনের ভূমিকা পালন করবে, এসব বিষয়েও কিছু সুনির্দিষ্ট নীতিমালার কথা এই পরিকল্পনাটিতে বলা হয়েছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে উদ্যোগী ভূমিকা অবশ্যই সরকারকে নিতে হবে। প্রকল্পটি পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপের মাধ্যমে হবে। সরকার যথাযথ পদ্ধতিতে প্রাইভেট ডেভেলপারদেরকে প্রকল্পের ব্যাপারে আহ্বান জানাবে। অর্থ এবং অন্যান্য সহায়তা সরকার তাদেরকে উপযুক্ত শর্ত অনুযায়ী দেবে। এই প্রকল্পে লাভের পরিমাণ ধরা হয়েছে ২০ শতাংশ। প্রকল্পের সামগ্রিক খরচ ধরা হয়েছে ১৬৫০,৩৯,৯৮,৫৪০ টাকা। ২০ শতাংশ লাভসহ প্রকল্পের মোট খরচ হবে ১৯৮০,৪৭,৯৮,২৫০ টাকা। প্রকল্পটির জন্য সরকার বিভিন্ন আন্তর্জাতিক অর্থদাতা প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে অর্থ সহযোগিতা নিতে পারে।
প্রাথমিকভাবে ২০ শতাংশ খরচ তুলে নেওয়া হবে ইউনিট বিক্রি করে, বাকি অর্থ ভাড়ার মাধ্যমে তুলে আনা হবে।

যে কোনো আবাসন প্রকল্প পরিকল্পনার ক্ষেত্রে প্রথমেই মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বা তাদের সাধ্যের কথা মাথায় রাখতে হয়। এই প্রকল্পটির প্রধান উদ্দেশ্যই মানুষের সাধ্যের মধ্যে আবাসন নিশ্চিত করা। বাস্তবায়নের ক্ষেত্রেও যে সব পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়েছে তাও মানুষের কথা মাথায় রেখেই করা হয়েছে। প্রাথমিকভাবে ২০ শতাংশ খরচ তোলার জন্য টাইপ বি-এর ১০০ শতাংশ এবং টাইপ সি-এর ৬০ শতাংশ বিক্রির কথা বলা হয়েছে। এসব ইউনিট বিক্রি করা হবে তাদের কাছে, যাদের আয় ১০০০০ থেকে ১৩০০০ টাকা পর্যন্ত। যেহেতু স্বাভাবিকভাবেই একেবারেই সব টাকা পরিশোধ করা সম্ভব না, তাই তাদের জন্য সরকারের সহায়তায় সরকার কর্তৃৃক নির্ধারিত ব্যাংকের কাছ থেকে স্বল্প সুদে ঋণ সহায়তা পাবে। এভাবে টাইপ বি-এর জন্য ২৯০০ টাকা এবং টাইপ সি-এর জন্য ৩৫০০ টাকা কিস্তিতে ১০ বছরের মধ্যে তারা সব টাকা পরিশোধ করতে পারবে। শর্ত অনুযায়ী সময় পরিবর্তন করা যাবে। টাইপ এ-এর ১০০ শতাংশ এবং টাইপ বি-এর বাকি ৪০ শতাংশ ভাড়ার আওতায় আসবে। সে ক্ষেত্রে ৫০০০ থেকে ৭০০০ টাকা আয়ের মানুষদের জন্য টাইপ এ ও ৭০০০ থেকে ১০০০০ টাকা আয়ের মানুষদের জন্য টাইপ বি-কে প্রাধান্য দেওয়া হবে।
হিসেব করে দেখা গেছে, টাইপ এ-এর জন্য ১৫০০ টাকা ও টাইপ বি-এর জন্য ২০০০ টাকা ভাড়া নির্ধারণ করলে বাকি ৮০ শতাংশ খরচ তুলতে ৩৫ বছর সময় লাগবে। এ ছাড়াও অর্থ উপার্জনকারী কর্মকান্ডের মধ্যে রয়েছে কৃষিজ কর্মকান্ড। এর জন্য সরকার জমি লিজ দেবে। দীর্ঘমেয়াদে ৬ মাসের ভিত্তিতে লিজ এগ্রিমেন্ট হবে। বসবাসকারী মানুষেরা সমবায়ী সমিতি গঠনের মাধ্যমে বিভিন্ন কৃষিজ কর্মকান্ডে জড়িত হবে। এভাবে প্রায় ১৭৪টি পরিবারের জীবিকা নির্বাহের ব্যবস্থা করা যাবে। একইভাবে মৎস্য প্রকল্পের মাধ্যমে ৬০টি ও হাঁস-মুরগি পালন কর্মসূচির মাধ্যমে ৫০টি পরিবারের আয়ের ব্যবস্থা করা যাবে।

সাতারকুল আবাসন প্রকল্পটি হতে পারে নিম্নবিত্ত মানুষদের জন্য এক স্বস্তির ঠিকানা। বাংলদেশের দারিদ্র্য সমস্যা হতে উদ্ভূত হয়েছে অভিবাসী নামক আরেক সমস্যার। কাজের খোঁজে মানুষের ঢাকায় আসা এবং তারপর ক্রমাগত জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়া এক নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে। এই সংগ্রামকে আরো কঠিন করে তোলে আবাসন সঙ্কট। এসব মানুষের জীবনকে কিছুটা হলেও আলোর পথ দেখানোর ইচ্ছা থেকেই এই প্রকল্পের সৃষ্টি। আর এই সৃষ্টির সাথেও আছে এক বুক প্রত্যাশা, মানুষকে মুক্ত এক জীবনে প্রবেশের স্বাদ দেওয়ার।
ফেরদৌস ফারহানা হক
নুসরাত ফারহানা মেঘনা
শিক্ষার্থী, নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগ, বুয়েট
প্রকাশকাল: বন্ধন ৩৩ তম সংখ্যা, জানুয়ারি ২০১৩