শহরের যান্ত্রিকতার মাঝে একটু মুক্তির স্বাদ, প্রজাপতির পেছনে অকারণে ছুটে যাওয়া অথবা নাম না জানা পাখির ডাক অনুকরণের ব্যর্থ চেষ্টা কিংবা গল্পের বইটা হাতে নিয়ে গাছের নিচেই ঘুমিয়ে পড়া।
এ কি কোনো কল্পনার রাজ্যের গল্পকথা, নাকি বাস্তবের স্পর্শ পাওয়া?
না, কল্পনায় দেখা এ স্বপ্নটাকে বাস্তব রূপ দিতে ‘ডিজাইন অব এ চিল্ড্রেন রিসোর্স সেন্টার’ তৈরি করেছে একটি প্রজেক্ট বা প্রকল্প। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে কাজ করছে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩য় বর্ষের শিক্ষার্থী নূসরাত জাহান মিম। তাকে সহযোগিতা করছেন একই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. জেবুন নাসরীন আহমদ, ড. জাকিউল ইসলাম, খায়রুল এনাম, শেখ আহসানউল্লাহ মজুমদার।
ইট, কাঠ আর পাথরের আড়ালে বেড়ে ওঠা ছোট ছোট শিশুর মাঝে একটু ভালো লাগা ছড়িয়ে দেওয়াই প্রকল্পটির মূল উদ্দেশ্য।
এই প্রকল্পটি নিয়ে ‘ডিজাইন অব এ চিল্ড্রেন রিসোর্স সেন্টার’ অংশগ্রহণ নেয়/করে আর্কেচিয়া স্টুডেন্টস আর্কিটেকচারাল ডিজাইন কমপিটিশনে; যেখানে এশিয়ার মধ্যে প্রকল্পটির স্থান হয় তৃতীয়।
প্রকল্পটির লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য সঠিকভাবে বাস্তবায়নের চেষ্টা করে যেতে চান প্রকল্পের পরিকল্পনাকারী। যে কোনো প্রকল্পের কাজ সঠিকভাবে পরিচালনা করতে প্রয়োজন সঠিক পরিকল্পনা এবং প্রয়োজনীয় স্থান নির্বাচন।
প্রকল্পটির শুরুতে ঢাকার শ্যামলী পার্কে একটা জায়গা বেছে নেওয়া হয়। পার্কটি বর্তমানে ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। মাঠটি ঘিরে রয়েছে ১৮০টির মতো মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবার। প্রতিদিন বিকেলে এলাকার ছেলেরা এখানে আসে ক্রিকেট খেলতে।

প্রকল্পের মূল ভাবনায় রয়েছে পরিত্যক্ত এ মাঠটি। পরিত্যক্ত মাঠটিকে কাজে লাগিয়ে গড়ে উঠেছে প্রকল্পটি। প্রকল্প পরিকল্পনাকারীরা মাঠটিতে একটি ডিজাইনড স্পেসের মধ্যে নিয়ে খেলার ছলেই চারপাশের পরিবেশ, প্রকৃতি আর ইকোলজি নিয়ে ভাবতে থাকেন।
নকশার বিবেচ্য বিষয়সমূহ
১.লার্নিং ফরম/ফ্রম নেচার
২.স্পেস ফর সেল্ফ এক্সপ্লোরেশন
৩.এ প্লেস অব ফ্রিডম
কনটেক্সটের সাথে মিল রেখে বিল্ড স্পেস যতটা সম্ভব কম করে সাইডের বাকিটা বাচ্চাদের জন্য ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। ঢোকার দিক থেকে শুধুমাত্র রিসার্চ রুম আর একটা কাঠের পাটাতন চোখে পড়বে সবুজের মাঝে। ভেতর দিকে একটু হাঁটলেই চোখে পড়বে কাঠের পাটাতনটি; যেখানে পৌঁছলে পাওয়া যাবে একটি সিঁড়ি যা নেমে গেছে ঢালু একটা খোলা স্পেস বেয়ে। তার একপাশে ঢাল বেয়ে নেমে আসা অংশের ভেতরে রয়েছে পার্মানেন্ট এক্সজিবিশন স্পেস। আর অন্য পাশে ওয়ার্কশপ যেখানে বাচ্চারা ছবি আঁকতে পারবে। এখানে ওরা যা খুশি যেমন খুশি তেমন ক্রিয়েটিভ সব কাজ করতে পারবে। মাঝের ওপেন টু কি স্পেসটাতে বসে কবিতা, ছড়া কিংবা গানের আসরের মতো আড্ডাও দেওয়া যাবে। পরবর্তী স্পেসটা ফ্লাইং, যার ফলে কোথাও যেতে বাচ্চারা কোনো বাধার সম্মুখীন হবে না। আবার কোনো জায়গা অব্যবহৃত হিসেবে পড়েও থাকবে না।
সোলার প্যানেলের ব্যবহার কিংবা বৃষ্টির পানি দিয়ে কিভাবে আবার গ্রাউন্ড ওয়াটার লেভেল রিচার্জ করা যায়, এ বিষয়গুলোও ওদের শেখানো যাবে এ স্ট্রাকচার থেকেই এমনই মন্তব্য প্র্রকল্পে অংশগ্রহণকারী বুয়েট শিক্ষার্থী নূসরাত জাহান মিমের। সকলের নিরাপদ এবং সুন্দরভাবে বসবাসের এই ছোট ছোট ধারণাও ছড়িয়ে দেওয়া যেতে পারে ওদের মধ্যে। তা হলে ওরাই পারবে আগামী দিনে ওদের জন্য সহনশীল পরিবেশবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টি করতে।
বাচ্চারা খুব সামান্য কিছুতেই কল্পনার রঙ জড়িয়ে তাকে অসামান্য করে তুলতে পারে। তাই খুব সাধারণ বিষয়গুলোর মধ্য দিয়েই তাদের মধ্যে যদি প্রকৃতির জন্য ভালোবাসা, এগুলোর সংরক্ষণ ভাবনা, সংস্কৃতিবোধ, সামাজিক দায়বোধ কিছুটা হলেও গড়ে তোলা যায় তো মন্দ কী?

স্বল্প পরিসরে অতিযত্নে কম খরচে গড়ে তোলা যেতে পারে এমন আরো অনেক চিলড্রেন রিসার্চ সেন্টার। এটি হতে পারে তাদেরই প্রতিনিধি কিংবা রোল মডেল। আমরা চাইলেই পারি পরিত্যক্ত জায়গাগুলো সুন্দর ও মনোরম নকশা করে আমাদের বাচ্চাদের একটা চমৎকার আবাসের ব্যবস্থা করতে। যেটা হতে পারে ওদের স্বপ্নময় আগামীর জন্য দারুণ কার্যকর। এ প্রকল্পটি বাস্তব রূপ পেলে বাচ্চাদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে বলে জানান প্রকল্পের জুরি বোর্ডের বিচারকরা।
তাসমিয়া আফরিন ইভা
প্রকাশকাল: বন্ধন ২৪ তম সংখ্যা, এপ্রিল ২০১২