বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। কথাটা বেশ পুরোনো। আজকে যদি কথাটাকে নতুন করে বাংলাদেশের ইতিহাসে যোগ করতে হয়, তবে বলতেই হবে বাংলাদেশ বন্যাপ্রবণ দেশ, দেশ জলোচ্ছ্বাসেরও। এ দেশের বিভিন্ন অংশে বছরের একটি বিশেষ সময়ে বন্যা হয়। এরপর বাকিটা সময় থাকে খটখটে খরা। খরাপীড়িত বন্যা উপদ্রুত এলাকায় দেশের প্রায় শতকরা ৪০ ভাগ লোকের বসবাস যাদের মূল জীবিকা কৃষিকাজ। কেউ কেউ করেন ব্যবসাও। তবে ব্যবসাটি কৃষি ও কৃষিজাত পণ্যের। এ কারণেই অত্র এলাকার ১২ মাসের চার মাস কৃষকেরা কাজ করেন মাঠে, চার মাস ঘরে বসে ফসল বিক্রির টাকায় নিজেরা চলেন আর বাকি চার মাস কষ্ট পান বন্যায়। সব দিক বিবেচনা করেই বাংলাদেশের বিভিন্ন সরকারের আমলেই বন্যাপীড়িত অসহায় মানুষগুলোর জন্য পুনর্বাসনের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। কিন্তু সম্প্রতি ২০০৭ সালে গাইবান্ধা অঞ্চলে একটি পুনর্বাসনকেন্দ্র প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, যা এ যাবৎকালের শ্রেষ্ঠ আবাসন প্রকল্প বলা যায়, যা পাখির চোখ করেছে ২০১৫ সালকে।

বাংলাদেশের অতি পুরোনো চিত্র হলো নদীভাঙনে ঘরবাড়ি হারিয়ে ঢাকা শহরে জীবিকার খোঁজে আসে ছিন্নমূল মানুষ। তারপর ঢাকায় এসে অশিক্ষিত এই মানুষগুলো কোনো রকম কাজ না পেয়ে শুরু করে ভিক্ষাবৃত্তি-ছিনতাই-রাহাজানিসহ নানা অপকর্ম। এই মানুষেরা একসময় খুব সুখেই নিজের জমিতে বাস করত, তাদের এখন বাস্তুহারা হয়ে হাত পাততে হয় অন্য মানুষের কাছে। নানা গঞ্জনা সহ্য করে তারা ঢাকা শহরে দিনের পর দিন অপরাধের সাম্রাজ্য বিস্তার করে। গড়ে তোলে বস্তি। বস্তিতেই শুরু হয় মাদকের সাম্রাজ্যবাদ। গোড়াপত্তন হয় সন্ত্রাসের। ঢাকা শহরের সবকটা বস্তি এলাকা জরিপ করে দেখা যায় সেখানে বসবাসকারী মানুষগুলো আসে বিভিন্ন বন্যাপীড়িত অঞ্চল থেকে। এর মধ্যে ময়মনসিংহ, গাইবান্ধা, হাতিয়াসহ বিভিন্ন এলাকা থেকেই আসে শতকরা ৯০ ভাগ মানুষ। এসেই এরা বিভিন্ন বাসাবাড়িতে কাজে লেগে যায়। কেউ রিকশা চালায়। আর যারা কিছুই করতে পারে না, তারা বেছে নেয় ভিক্ষাবৃত্তি। এই বৃত্ত ভাঙার উদ্দেশ্যেই ২০০৭ সালে গাইবান্ধায় শুরু হয় ‘রিহ্যাবিলিটেশন সেন্টার’ তৈরির কাজ। স্থপতি জালাল আহমেদ এবং স্থপতি রেজাউল করিম প্রাকটিক্যাল অ্যাকশন টিমের উদ্যোগে শুরু করেন এর স্থাপত্য ডিজাইন ও মাস্টারপ্ল্যান। একেবারেই স্থানীয় নির্মাণ উপকরণ ইট ও সিমেন্ট দিয়েই প্রস্তুত করে দেওয়ার চিন্তা করেই স্থপতি স্থানীয় বাসিন্দাদের নিয়েই শুরু করেন সেন্টার তৈরির কাজ। প্রতিটি বাড়ির সামনে আবহমানকাল থেকেই একটি পুকুর খনন করে তার মাটির সাহায্যে মূল ভূমি উন্নয়ন করার চল রয়েছে। স্থপতি সেই চলটাকেই কাজে লাগালেন তাঁর স্থাপত্যিক নকশায়।

মূলত বন্যার সময় মানুষগুলোকে একটু উঁচু জমিতে বসবাস করার ব্যবস্থা ও তাদের জীবিকা নির্বাহ করার ব্যবস্থাই এই সেন্টারের মুখ্য উদ্দেশ্য নয়। এর সঙ্গেই আছে বিভিন্ন সময় মানুষের প্রয়োজনীয় চাহিদা পূরণ করার জন্য সার্বিক ব্যবস্থাপনা। এ জন্য এখানে করা হয়েছে নানা ধরনের সেটেলমেন্ট।
যেমন –
- চার কক্ষবিশিষ্ট ঘর
- দুই কক্ষবিশিষ্ট ঘর
- কমিউনিটি হল
- স্কুল
- মসজিদ
- দোকান
- গরু-ছাগলের খামার
- সম্মিলিত স্নানাগার
- সম্মিলিত শৌচাগার
- প্রবেশপথ।
এখানে একসঙ্গে বন্যার সময় ৫০-১০০টি পরিবার পাবে সব সুযোগ-সুবিধা। এ ছাড়া এখানে করা হয়েছে বায়োগ্যাস প্ল্যান্ট, জ্বালানি অপব্যবহাররোধী চুল্লি ও বিভিন্ন আধুনিক সবুজ স্থাপনাসংশ্লিষ্ট ব্যবস্থাপনা।

সেন্টারের একটা বিষয় বিশেষভাবে লক্ষণীয়, বন্যা-পূর্ববর্তী সময় থেকেই এখানে মানুষ আসতে শুরু করে এবং এখানকার নির্দিষ্ট ঘরে ওরা উঠে-পড়ে এবং এখানে বিভিন্ন ধরনের কার্যক্রম আগে থেকেই করে অভ্যস্ত বলে ওদের কোনো বিশেষ কারণ ছাড়া এই এলাকা ছেড়ে চলে যাওয়ার কোনো উদ্দেশ্যই সৃষ্টি হয় না। উপরন্তু এই ঘরগুলোকে ওরা নিজেদের মতো করেই সাজিয়ে নেয়। এখানে সুযোগ সৃষ্টি করা হয়েছে নানামুখী স্ব-কর্মসংস্থানের। মহিলাদের জন্য আছে সেলাই করা, পিঠা বানানো, গরু-বাছুর পালন কিংবা হাঁস-মুরগি পালনের ব্যবস্থা। পুরুষদের জন্য আছে বিভিন্ন ফসল ফলানোর ব্যবস্থা। আছে খণ্ডকালীন বিভিন্ন রকমের কাজের ব্যবস্থা, ভাসমান শাকসবজির আবাদ, মাটির হাঁড়িপাতিল বানানোর ব্যবস্থা, হাল চাষ, গরু পালনের ব্যবস্থা ইত্যাদি। এখানে করা হয় বিভিন্ন ভেষজ ও ফলদগাছের রোপণ, যার ফলে গ্রাম্য পরিবেশ ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য ওই প্রজেক্ট বিশেষভাবে সহায়তা করবে, বলেই ধারণা বিশেষজ্ঞদের।

এই প্রজেক্টের সব স্থাপনার কাজ শেষ হতে হতে ২০১৫ সাল লেগে যাবে। কিন্তু এর মাঝেই কাজের জন্য ব্যয় করা টাকা উঠে আসতে শুরু করেছে। স্থানীয় বন্যাপীড়িত মানুষগুলোই এখানের নির্মাণ ব্যয়ের ৩০ শতাংশ ইতিমধ্যেই তুলে এনেছেন নিজেদের উৎপাদিত পণ্য বিক্রির মাধ্যমে। ২০১৫ সালের মধ্যেই এখানে বসবাসকারী মানুষগুলো ওদের জন্য নির্মাণ করা এই প্রজেক্টের পুরো টাকাই উৎপাদনশীলতার মাধ্যমে তুলে আনতে পারবে। এটাই এই প্রজেক্টের সার্থকতা প্রমাণ করে। আশা করা যায়, বাংলাদেশে কোনো বন্যাপীড়িত অঞ্চল থেকে মানুষ আর ঢাকা শহরে ভিক্ষাবৃত্তি করতে আসবে না। রিহ্যাবিলিটেশন সেন্টারে নিজেদের ভবিষ্যতের চারা বুনবে নিজেদের পরিশ্রমেই।
স্থপতি রাজীব চৌধুরী
প্রকাশকাল: বন্ধন ৪১ তম সংখ্যা, সেপ্টেম্বর ২০১৩