কোনো নিয়মকানুন বা পদ্ধতি ছাড়া এলোমেলোভাবে ইট বা পাথর গেঁথে দেয়াল বা অন্য কোনো কাঠামো তৈরি করলে তা টেকসই হয় না। এ জন্য একই আকার-আকৃতির ইট দ্বারা নিয়ম অনুযায়ী গাঁথুনি করা হয়, যাতে তা শক্ত এবং টেকসই হয়। এ জন্য ইটকে একের পর এক সাজিয়ে শৃঙ্খলাবদ্ধ করে অবিচ্ছিন্ন দেয়ালে পরিণত করার পদ্ধতিকে বন্ড (Bond) বলে। অন্য কথায়, একটি ইটের সঙ্গে অপর একটি ইটের জোড়া লাগানোর পদ্ধতিই বন্ড। ইংরেজিতে বলা হয়, ‘Bond is the method of arranging stones or bricks in masonry work, so that they are tied together to form a solid mass with proper cohesion.’ গাঁথুনির সময় পর পর দুই কোর্সের খাড়া জোড়াগুলো বাদ দেওয়া হয়।
ভালো বন্ডিং বা ইট সাজাতে লক্ষণীয় বিষয়সমূহ
- ইটের আকার, আয়তন সুষম হবে। ইটের দৈর্ঘ্য=2xইটের প্রস্থ+মসলার জয়েন্টের পুরুত্ব। অর্থাৎ ইটের দৈর্ঘ্য (২৪১)=2x১১৪+১৩। ফলে সুষম ল্যাপ পাওয়া যাবে।
- কমপক্ষে ইটের এক-চতুর্থাংশ ল্যাপ হবে।
- কম সংখ্যক ব্যাট বা আধলা ইট ব্যবহার করা উচিত।
- অলটারনেট কোর্সে হেডারের সেন্টার লাইন এবং স্ট্রেচারের সেন্টার লাইন একই উলম্ব রেখায় ছেদ করবে।
- অলটারনেট কোর্সের খাড়া জয়েন্টগুলো একই খাড়া লাইনে থাকবে।
- ফেসিংয়ে স্ট্রেচার এবং হার্টিংয়ে হেডার ব্যবহার করা উচিত।
গাঁথুনির কাজে বন্ডের প্রয়োজনীয়তা
- দেয়াল বা কাঠামোর শক্তি এবং স্থায়িত্ব বৃদ্ধি করার জন্য।
- খাড়া জোড়া পরিহার করতে।
- দেয়ালের উপর আপতিত লোডকে সুষমভাবে বণ্টন করার জন্য।
- শিয়ার প্রতিরোধের জন্য।
- সৌন্দর্যবৃদ্ধি এবং নির্মাণ কাজ দ্রুত করতে।
- ইটের পারস্পরিক ইন্টারলকিং সৃষ্টি করার জন্য।
ইটের গাঁথুনির সঠিক পদ্ধতি
ইটের গাঁথুনি করার মধ্যে ইট স্থাপনই সবচেয়ে বড় কৌশল। ভালো ইট, সঠিক সিমেন্ট-বালি বা চুন-সুরকির মসলা ব্যবহার করেও ইটের কাজ খারাপ কিংবা কমজোরি হতে পারে। কেননা সঠিকভাবে ইট স্থাপন, কোর্স সাজানো, বন্ড, জোড়, ওলন ঠিক রাখা প্রয়োজন। তাই সঠিকভাবে কাজ করতে হলে নিম্নলিখিত পদ্ধতি অনুসরণ করা উচিত

ইট বাছাই
দেয়ালের বিভিন্ন অংশ, যেমন- ফেসিং, ব্যাকিং এবং হার্টিং ইত্যাদির জন্য ইট বাছাই করতে হবে। দেয়াল কত পুরু হবে তার উপর নির্ভর করে ইট বাছাই করা প্রয়োজন। ফেসিং কাজের জন্য ভালো এবং সমান মাপের ইট নির্বাচন করা উচিত।
ইট সাজানো
কাজের জায়গায় ইট ঠিকভাবে সাজিয়ে রাখতে হবে। এক হাজার কিংবা দুই হাজার করে ইট একটি স্টকে রাখতে হবে। এটা সাজানো থাকলে ইটের কোনাগুলো বা ধারগুলো সহজে নষ্ট হয় না।
ইট ভেজানো
শুকনো ইটের পানি শোষণের প্রবণতা সবচেয়ে বেশি। তাই ইটকে কাজে লাগানোর পূর্বে পানিতে ভিজিয়ে রাখতে হবে। এজন্য চৌবাচ্চা তৈরি করে ইট ভিজানোর ব্যবস্থা করতে হয়। একে ‘তাগাগ’ দেওয়া বলে। প্রতিদিনের কাজের শেষে পরের দিনে যত ইট কাজে লাগানো হবে তা চৌবাচ্চায় ডুবিয়ে রাখতে হবে।
নিম্নলিখিত কারণে ইট ভিজানো প্রয়োজন-
- (ক) ইটের গায়ে সহজেই সমানভাবে মসলা লাগানো যায়।
- (খ) শুকনো ইট মসলা থেকে পানি শোষণ করে। ফলে সিমেন্টের রাসায়নিক ক্রিয়া সম্পন্ন হতে পারে না। যার কারণে ইটের গাঁথুনি দুর্বল বা ব্যর্থ হতে পারে।
- (গ) চুল্লির ময়লা, আবর্জনা বা লবণ জাতীয় পদার্থ ইটের গায়ে থাকলে তা পরিষ্কার হয়ে যায়। ফলে উত্তম জোড়া ও বন্ড উৎপন্ন হয়।
ভিত্তির উপর মসলা বিছানো
ভিত্তির ঢালাইয়ের উপর কমপক্ষে ১.৫ সেন্টিমিটার গভীরতা করে মসলা বিছিয়ে দিতে হবে। প্রথমে দুই দেয়ালের জোড়া যেখানে পড়বে সেখানে মসলা বিছিয়ে গাঁথুনির কাজ আরম্ভ করতে হয় অর্থাৎ কর্নার থেকে গাঁথুনির কাজ শুরু করতে হয়।
কর্নার তৈরি
রাজমিস্ত্রি প্রথমে কর্নারে ইট বসাবে। বেডের উপর যে মসলা বিছানো আছে, তার উপর ইটকে আস্তে আস্তে চাপ দিয়ে বসাবে। চাপার পরে কংক্রিট এবং ইটের মধ্যে ১ সেন্টিমিটার মসলা থাকবে। পরবর্তী ইটের মধ্যবর্তী খাড়া জোড়া যেন ১ সেন্টিমিটার হয় সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে।
গাঁথুনির লাইন সোজা রাখা
দেয়ালের দুই প্রান্তে প্রথম কোর্স ইটের গাঁথুনি করে তার উপর সুতা দ্বারা ইট দিয়ে সুতার দুই প্রান্তে ঝুলিয়ে দিলে সুতা টান টান হয়ে থাকবে। এখন মাঝের অংশে ইটের গাঁথুনি সুতা বরাবর করলে গাঁথুনির লাইন ও মাথা সুতার লাইনের মতো সমানই হবে।

দ্বিতীয় কোর্স স্থাপন
প্রথম স্তরের উপর কমপক্ষে ১.৫ সেন্টিমিটার পুরু করে মসলা বিছিয়ে দিতে হবে। প্রান্তে স্ট্রেচার ইট, মর্টারের উপর এমনভাবে বসাতে হবে যেন ১ সেন্টিমিটার পুরু জোড়া থাকে। খাড়া পাশে মর্টার চেপে দিয়ে দ্বিতীয় স্ট্রেচার বসাতে হবে। লেভেলের সাহায্যে সমতল এবং প্লাম্বের সাহায্যে খাড়া পরীক্ষা করতে হবে।
আনুষঙ্গিক টিপস
- দেয়ালের উচ্চতা ১ থেকে ১.৫ মিটার হলে রাজমিস্ত্রিরা মাটিতে দাঁড়িয়ে গাঁথুনি করতে পারে না। তাই কাজ করার জন্য প্লাটফর্মের প্রয়োজন, যাকে স্কেফোল্ডিং বলে।
- যতদূর সম্ভব সমস্ত দেয়ালকে সমউচ্চতায় গাঁথুনি করা উচিত। তবে দুই দেয়ালের উচ্চতার পার্থক্য ১ মিটারের বেশি না হওয়াই ভালো।
- অলটারনেট কোর্সের ভার্টিক্যাল জয়েন্ট অর্থাৎ পারপেন্ড একই লাইনে হওয়া উচিত। স্ট্রেট এজ এবং স্কোয়ারের সাহায্যে এটা পরীক্ষা করা উচিত।
- ইটের ফ্রগ পৃষ্ঠকে উপরে রেখে গাঁথুনি করতে হবে এবং গাঁথুনির সময় মর্টার দিয়ে পূর্ণ করে দিতে হবে।
- প্রত্যেক দিন কাজ শেষে সব জয়েন্ট পরিষ্কার এবং শেষ করে দেওয়া উচিত।
- পুরু দেয়ালের ক্ষেত্রে প্রথমে মসলাকে দেয়ালের বেড বরাবর বিছিয়ে দিতে হবে। তার পর ফেসিং ইট স্থাপন করে ব্যাকিংয়ের ইটকে চাপের সাহায্যে বসাতে হবে।
প্রকৌশলী সুবীর সাহা
প্রকাশকাল: বন্ধন ২৯ তম সংখ্যা, সেপ্টেম্বর ২০১২