ছেলেবেলায় অরিগামি (কাগজ তৈরির শিল্প) করেনি এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া সত্যিই দুষ্কর। কাগজের জটিল নকশার কিছু বানাতে না পারলেও নৌকা বা বিমানের মতো সহজ নকশার খেলনা কমবেশি আমরা সবাই বানিয়েছি। তবে এই অরিগামির আদলে সত্যিকারের কোনো স্থাপনা বানানোর কথা কেউ কখনো ভেবেছি কি না বলা মুশকিল। কানাডীয় বংশোদ্ভূত আমেরিকান স্থপতি ফ্রাঙ্ক ওয়েন গেহরি ঠিক এ রকম নকশায় রীতিমতো বানিয়ে ফেলেছেন একটি জাদুঘর। পানামা শহরের অ্যামাডর কজওয়ে দ্বীপে সাগরের কোলঘেঁষে গড়ে ওঠা বাহারি উজ্জ্বল রং আর এর বিচিত্র নকশা অঙ্কিত ছাদের এই জাদুঘরটি দেখে আপনার প্রথমেই অরিগামির ধারণাটি মনে আসাটাই স্বাভাবিক। ফ্রাঙ্ক গেহরি এই নকশা নিয়ে ভেবেছিলেন ১৯৯৯ সালের শুরুতে। পানামা শহরের জামাই ফ্রাঙ্ক (গেহেরির স্ত্রী পানামার অধিবাসী) ২০০৪ সালের দিকে সিদ্ধান্ত নেন তাঁর সৃষ্ট এই নকশাটি পানামাবাসীকে উৎসর্গ করার।
পানামা শহরের এই অসাধারণ জাদুঘরের নির্মাণকাজ শুরু হয় ২০০৪ সালের শেষের দিকে। প্রায় এক দশক ধরে নির্মিত এই স্থাপনাটি দর্শকদের জন্য উন্মুক্ত করা হয় ২০১৪ সালে। ৬০ মিলিয়ন ডলারের এই প্রকল্পের প্রাথমিক নির্মাণকাল ধরা হয়েছিল সাত বছর। অর্থাৎ ২০১১ সালের মধ্যে এটি সম্পন্ন হওয়ার কথা। পরে সেটি সম্ভব না হওয়ায় এর নির্মাণব্যয় ও অন্যান্য আনুষঙ্গিক বিষয় আবার নতুন করে নির্ধারণ করা হয়। পানামা সরকারের পাশাপাশি আরও শতাধিক এলাকাবাসীর আর্থিক সহায়তায় ২০১২ সালের মাঝামাঝি জাদুঘরের নির্মাণকাজ শেষ হয়। ২০১৪ সালে জাদুঘরটি সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করা হয়।

পানামা বায়োমিউজিয়ামটি কজওয়ে দ্বীপের একেবারে শেষ প্রান্তে অবস্থিত। প্রশান্ত মহাসাগরের দিকে মুখ করা এই অদ্ভুত দর্শন সুন্দর মিউজিয়ামের মনোরম দৃশ্য চোখে পড়বে পানামা খালে প্রবেশের মুখেই। পানামা খাল দিয়ে যাতায়াতকারী জাহাজ বা কার্গোর ডেক থেকেই দেখা যায় এর বাহ্যিক সৌন্দর্য। এই মিউজিয়ামটির নির্মাণকাজ ছিল কিছুটা জটিল। পানামার আবহাওয়ার কথা মাথায় রেখেই তৈরি করা হয় এর নকশা। আর সে জন্যই এর নিজস্ব আকৃতি, কৌণিক অবস্থান, বিশেষ নির্মাণ উপাদানের জন্য প্রয়োজন হয় নতুন ধরনের প্রযুক্তির। পানামা বায়োমিউজিয়ামে যে ধরনের উপাদান, নকশা আর প্রযুক্তির ব্যবহার করা হয়েছে, তা পানামার কোনো স্থাপনাতেই এর আগে করা হয়নি। সব মিলিয়ে পানামা বায়োমিউজিয়াম যেন শিল্প ও বিজ্ঞানের এক অনবদ্য মিশেল। চার হাজার বর্গমিটারের এই প্রকল্পে আছে আটটি স্থায়ী প্রদর্শনী গ্যালারি। আর এই গ্যালারির নকশা প্রণয়নের সময়ও নিকটস্থ স্মিথসোনিয়ান ট্রপিক্যাল রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (Smithsonian Tropical Research Institute) বিজ্ঞানীদের সঙ্গে আলোচনা করেই ঠিক করা হয়। এই আটটি গ্যালারিতে মূলত যে ধরনের প্রদর্শনী হয়, তা মূলত পানামা বিশ্ববিদ্যালয় এবং স্মিথসোনিয়ান ট্রপিক্যাল রিসার্চ ইনস্টিটিউটের তত্ত্বাবধায়নে আয়োজন করা হয়। স্থায়ী গ্যালারির পাশাপাশি এখানে রয়েছে অস্থায়ী গ্যালারি, পাবলিক আর্টিয়াম, একটি মিউজিয়াম শপ আর ক্যাফে। এ ছাড়া এর বোটানিক্যাল গার্ডেনে বিভিন্ন ধরনের আউটডোর প্রদর্শনীরও সুব্যবস্থা রয়েছে। এখানে প্রায় সারা বছরই বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান যেমন মিউজিক কনসার্ট, বিজ্ঞান মেলা ও প্রদর্শনী এমনকি ব্যক্তিগত অনুষ্ঠানেরও আয়োজন করা হয়। গেহরির এই নকশার পেছনে পর্যটকদের আকর্ষণ করা ও পানামার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে ছড়িয়ে দেওয়ার ইচ্ছেটা ছিল প্রবল।
প্রকল্পের একেবারে কেন্দ্রে আছে একটি উন্মুক্ত পাবলিক আর্টিয়াম। এই আর্টিয়ামের ছাদ বা আচ্ছাদন হচ্ছে উজ্জ্বল রঙিন ধাতবের, যার মূল কাজ এর দর্শনার্থীদের প্রশান্ত মহাসাগরের ঢেউয়ের বর্ষণ থেকে রক্ষা করা। এই বাহারি রঙের কৌণিক ছাদগুলো বেশ সহজেই দূর থেকেও মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এর প্রতিটির আকার ও আকৃতি একটি থেকে অন্যটি একেবারেই আলাদা। এ জন্যই মিউজিয়ামটিকে রঙিন কাগজের নকশা বলে ভ্রম হয়। এখানকার আর্টিয়ামটি সবার জন্য উন্মুক্ত। অর্থাৎ এখানে প্রবেশ করতে আপনার কোনো টিকিট লাগবে না। এই প্রাঙ্গণেই একটি মিউজিয়াম শপ, ক্যাফে আর অস্থায়ী প্রদর্শনীর জন্য রয়েছে গ্যালারি। এর পাশেই মিউজিয়ামের মূল প্রদর্শনী গ্যালারি, যেখানে প্রবেশ করতে হলে আপনাকে টিকিট কাটতে হবে। আর্টিয়ামের ওপরতলায় রয়েছে সিঁড়ি দিয়ে ওপরে ওঠার ব্যবস্থা। এখান থেকে পানামা খাল আর শহরের মনোরম দৃশ্য উপভোগ করা যায় সহজেই।

ফ্রাঙ্ক গেহরির সঙ্গে মূল প্রদর্শনী গ্যালারির নকশা করেছিলেন ব্রুস মাও এবং স্মিথসোনিয়ানের একদল বিজ্ঞানী। এই গ্যালারি মূলত এর দর্শনার্থীদের পানামা শহরের জীববৈচিত্র্য ও এর ভৌগোলিক অবস্থানের প্রভাব সম্পর্কে ধারণা দেয়। এখানকার প্রদর্শনীর বিষয়বস্তু, উপস্থাপন কৌশল সবকিছু মিলিয়ে আপনাকে পৃথিবীর জৈব জগৎ অর্থাৎ এর প্রাণী ও উদ্ভিদের বিকাশ এবং মানুষের জীবনযাপন ও সংস্কৃতি কীভাবে পরিবেশের কারণে প্রভাবিত হয়, সে সম্পর্কে সুন্দর ধারণা দেবে। পানামা বায়োমিউজিয়াম যেন বৈশ্বিক জৈবজগৎ ও পানামার ক্ষুদ্র এক সংস্করণ।
মহুয়া ফেরদৌসি
প্রকাশকাল: বন্ধন ৭১ তম সংখ্যা, মার্চ ২০১৬