একটি দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের মূল মাপকাঠি সে দেশের শিল্প-কলকারখানা। এক সময় ধারণা ছিল শিল্প-কলকারখানা স্থাপনার ক্ষেত্রে সাধারণত বড় একটা জায়গাকে চারপাশ থেকে আচ্ছাদিত করে শেড নির্মাণ করাই যথেষ্ট। কিন্তু সময়ের সাথে বেড়ে চলছে অভাব আর মানুষের চাহিদা। তাই এসব শিল্প-কলকারখানা তৈরিতেও এসেছে প্রযুক্তির ছোঁয়া। অন্য প্রকল্পগুলোর চাইতে শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোতে সাধারণত অতিমাত্রায় শক্তি প্রয়োজন। তাই এখন এখানে প্রয়োজন সুপরিকল্পিত ব্যবস্থাপনা। স্থপতিরা বেশ কিছুদিন আগেও কলকারখানার নকশা প্রণয়নের দিকে সেভাবে নজর দেননি। কিন্তু প্রাকৃতিক সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার আয়োজন অনুযায়ী বর্তমানে এর নকশা প্রণয়নের ক্ষেত্রে বিশেষভাবে গুরুত্ব আরোপ করছেন। বিশেষ করে দেশীয় প্রেক্ষাপটে জলবায়ু পরিবেশকে কাজে লাগিয়ে কীভাবে একটি কারখানার অভ্যন্তরীণ পরিবেশকে কর্মক্ষেত্রের অনুকূলে রাখা সম্ভব হয় সেদিক বিবেচনা করে এর জন্য বিশেষ গবেষণা পরিচালিত হচ্ছে। কারণ একটি কারখানা শুধু একটি উৎপাদনশীল এলাকা কিংবা শেডেড এরিয়া নয় বরং এখানে কাজ করে যাচ্ছে হাজার হাজার কর্মী, যাদের স্বাস্থ্য উক্ত স্থান ও পরিবেশ ব্যবস্থাপনার উপর নির্ভরশীল।

আমাদের দেশে মূলত যে সকল শিল্প কারখানা বিদ্যমান সেগুলো বিচার করলে নিম্নবর্ণিত সমস্যাগুলো চোখে পড়ে।
১. কারখানা স্থাপনের জমিগুলোর কোনো নির্দিষ্ট রূপরেখা নেই, সে কারণে কারখানার আশপাশে অব্যবহৃত পুকুর-নদী কিংবা জলাশয়গুলোতে বিষাক্ত বর্জ্যরে মাধ্যমে সেখানকার পারিপার্শ্বিক পরিবেশ ও প্রতিবেশ বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছে।
২. বেশির ভাগ কারখানাতে বর্জ্য ব্যবস্থাপনার প্রক্রিয়া পরিবেশবান্ধব নয়।
৩. উৎপাদন স্থানের ক্ষেত্রে বেশিরভাগ কারখানায় মূল ভবনের দৈর্ঘ্য-প্রস্থের কোনো নির্দিষ্ট মাপকাঠি থাকে না। ফলে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায় মূল উৎপাদনস্থলের মধ্যবর্তী স্থানে রয়েছে অতিরিক্ত গরম কিংবা আলোর স্বল্পতা।
৪. কারখানাগুলোর উচ্চতা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ৪০-৪৫ ফুট দেওয়া হয়ে থাকে এবং উপকরণ হিসেবে প্রি-ফেব্রিকেটেড মেটালশিট এবং ৫-১০ ইঞ্চি ইটের দেয়াল ৭-১০ ফুট পর্যন্ত তোলা হয়ে থাকে। উচ্চতা বেশি হওয়ার দরুন পুরো জায়গার তাপমাত্রা অনুকূল রাখার জন্য উচ্চমাত্রার HVAC সিস্টেম প্রয়োগ করতে হয়। এ কারণে অধিক শক্তির অপচয় হয়।
৫. নির্দিষ্ট Sustainable Lighting System এবং ধারণা না থাকার কারণে সারিবদ্ধ উঠের লাইট ঝুলানো হয়ে থাকে- যার দরুন কৃত্রিম আলোকসম্পাতের কারণে শক্তির অপচয় অধিক মাত্রায় হয়ে থাকে।
৬. কারখানাগুলোতে মূলত উৎপাদনের দিকে বেশি নজর দেওয়া হয়। সে ক্ষেত্রে এর অভ্যন্তরে কোনো Recreation Space-এর ব্যবস্থা নেই বললেই চলে।
৭. আলো-বাতাস চলাচলের জন্য সাধারণত জানালা বা Louver থাকলেও অতি উচ্চতায় থাকার কারণে সেগুলোকে পর্যাপ্ত পরিমাণে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা সম্ভব হয় না- যার ফলে একটি অস্বস্তিকর পরিবেশের জন্ম হয়।
৮. ছাদ থেকে আলো আনার ব্যবস্থা থাকলে সরাসরি আলো চোখ এবং কাজের জন্য অনুকূল নয়। সাধারণত কোনো যথোপযুক্ত শেডিংয়ের ব্যবস্থা থাকে না, তাছাড়া অতি উচ্চতা থেকে আলো আনার দরুন সেই আলো পর্যাপ্ত পরিমাণে কাজের টেবিলে পড়ে না।

৯. অনেক ক্ষেত্রে বাতাস চলাচলের জন্য Evaprorative Cooling System-এর ব্যবস্থা করা হয়। তবে কাজের জায়গা থেকে এর দূরত্ব কম হলে শব্দদূষণ থেকে শুরু হয়ে কাজের অবনতি ঘটতে পারে।
১০. উপকরণের ক্ষেত্রে মেটালশিট বা ধাতব পাত ব্যবহারের দরুন অভ্যন্তরের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পায় এবং রাতের বেলা সে ক্ষেত্রে ভিন্ন চিত্র দেখা যায়। মেটালশিট বিকিরণের মাধ্যমে অত্যধিক ঠান্ডা পরিবেশের জন্ম দেয়। উভয় পরিস্থিতি কাজের ক্ষেত্রে অনুকূল নয়।
১১. স্থাপনা নির্মাণের অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় মেটালশিট ব্যবহার করে এর উপরে তাপ-নিরোধক Foil বা Insulation ব্যবহার করতে। সে ক্ষেত্রে Insulation-এর Thickness কী হবে সেটার নির্দিষ্ট কোনো মাপকাঠি নেই।
১২. অনেক কারখানার অভ্যন্তরে Warm Collar ব্যবহার করা হয়ে থাকে। এ ক্ষেত্রে গাঢ় বা Warm রঙ কাজের এবং চোখের প্রশান্তির অসুবিধা তৈরি করে।
১৩. কারখানার Paving System অতিগুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায় এদিকে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। তাছাড়া Landscaping-এর ক্ষেত্রে দেখা যায় Local Tree-এর ব্যবস্থাপনা না করে ভিনদেশি অধিক পানি ব্যবহারযুক্ত Plantation করতে।
১৪. তাছাড়া আমাদের দেশে শিল্প-কারখানাগুলোতে Energy Monitoring System-এর স্বল্পতা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। যার দরুন কারখানার অভ্যন্তরীণ আলো, তাপমাত্রা, আর্দ্রতা, বিকিরণ সঠিকভাবে নিরূপণ করা সম্ভব হয় না।
১৫. কারখানাতে সাধারণত তিনটি উপায়ে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পায়-
ক. কারখানায় ব্যবহৃত যন্ত্রাংশ দ্বারা নিঃসৃত তাপমাত্রা।
খ. স্থাপনার বহিঃআবরণ দ্বারা তাপমাত্রা বৃদ্ধি।
গ. মানুষের শরীরের তাপমাত্রা।
সুতরাং যে কোনো শিল্প-কারখানার নকশা প্রণয়নের ক্ষেত্রে সর্বপ্রথম এই বিষয়টিকে জোর দিতে হবে। স্থান ও মানের অবস্থান অনুযায়ী সেখানে উৎপাদন চেইনের ব্যবস্থাপনা করতে হবে। এ ক্ষেত্রে নকশা প্রণয়নের ক্ষেত্রে ফ্যাক্টরির উৎপাদন চেইনের উপর বিশেষভাবে গুরুত্ব আরোপ করতে হবে।
গবেষণায় দেখা গেছে, সাধারণত সঠিকভাবে আলো-বাতাস চলাচলের জন্য কোনো কারখানার প্রস্থ ৭০-৮০ ফুট হলে ভালো হয় এবং উত্তর-দক্ষিণমুখী হতে হবে। আর উচ্চতার ক্ষেত্রে ১৫-২৫ ফুট হলে অভ্যন্তরীণ তাপমাত্রার ক্ষেত্রে সব থেকে বেশি সুফল পাওয়া সম্ভব।

কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রয়োজন অনুযায়ী উৎপাদন স্থান অনেক বড় হলে মধ্যবর্তী স্থানে Natural Ventilation-এর জন্য Void Space তৈরি করা যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে সেখানে Landscaping-এর মাধ্যমে Recreational Space হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে। তদংশে পর্যাপ্ত আলো প্রস্তুতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
বড় বড় জানালা থাকলে পর্যাপ্ত পরিমাণে Shading (সর্বনিম্ন ১৮ ইঞ্চি শেডেড) কিংবা আনুভূমিক কাভার ব্যবহার করা যেতে পারে।
ছাদে পর্যাপ্ত পরিমাণ জায়গা থাকলে সবুজায়নের মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ তাপমাত্রা কমিয়ে কর্মক্ষেত্রের জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরি করা সম্ভব।
প্রকাশকাল: বন্ধন ৩২ তম সংখ্যা, ডিসেম্বর ২০১২