একবিংশ শতাব্দীর একটি শহর যোগাযোগ ব্যবস্থায় কতটুকু উন্নত তা বুঝতে হলে প্রথমেই লক্ষ্য করতে হবে তার গণপরিবহণ ব্যবস্থার দিকে। কেবলমাত্র গণপরিবহণই সবচেয়ে কম সময়ে সবচেয়ে বেশি যাত্রী পরিবহনে সক্ষম। আর নিঃসন্দেহে সড়কভিত্তিক গণপরিবহনের সবচেয়ে বড় ও দক্ষ মাধ্যম হলো বাস। ঢাকা শহরের বাসভিত্তিক গণপরিবহন দৃশ্যত যানজট, অতিরিক্ত যাত্রাসময়, অনিয়ন্ত্রিত ট্রাফিক ব্যবস্থা, নিরাপত্তাহীনতা, সড়ক দুর্ঘটনা, যত্রতত্র যাত্রী উঠানামাসহ বহুবিধ সমস্যায় জর্জরিত। কিন্তু এসবের মূল কারণ কিন্তু আমাদের সম্পদের অপর্যাপ্ততা নয়; বরং সঠিক ব্যবস্থাপনার অভাব। সুতরাং এই সমস্যাগুলো সমাধান করতে হলে প্রথম কাজই হলো বর্তমান পরিবহন ব্যবস্থার সামগ্রিক চিত্র বের করে আনা। এ লক্ষে গবেষকদ্বয় কর্তৃক বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে ভিডিও ক্যামেরা বসিয়ে তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। পাশাপাশি মাঠপর্যায়ে সরেজমিনে তথ্য সংগ্রহ ও একাধিক জরিপ (Questionnaire Survey) চালানো হয়েছে। এই গবেষণা প্রবন্ধের মাধ্যমে বিদ্যমান সমস্যাসমূহ চিহ্নিত করার পাশাপাশি এগুলো সমাধানের লক্ষ্যে কিছু পদক্ষেপ গ্রহণের কথা উল্লেখ করা হয়েছে, যা বিদ্যমান পরিবহন অবকাঠামো ও মানবসম্পদ দিয়েই অর্জন করা সম্ভব।
ভূমিকা
ঢাকা শহরের একমাত্র গণপরিবহন বাস যা ধারণক্ষমতা, সেবা প্রদান ও নিরাপত্তা এই তিনটি মৌলিক গুণাবলী অর্জনে আপাতদৃষ্টিতে ব্যর্থ। ঢাকা শহরের পরিবহন ব্যবস্থা মূলত সড়কভিত্তিক। যার একটি বড় অংশ জুড়ে আছে রিকশা (NMV=Non-Motorized Vehicle)। স্ট্র্র্র্যাটেজিক ট্রান্সপোর্ট প্ল্যান, ২০০৪ অনুযায়ী ঢাকা শহরের ৫১ শতাংশ যাতায়াতই হয় অযান্ত্রিক যানবাহনের মাধ্যমে। যার মধ্যে ২৯ শতাংশ হয় রিকশার মাধ্যমে এবং বাকি ২২ শতাংশ যাতায়াত করা হয় পায়ে হেটে। বিআরটিএ এর ২০০৯-১০ এর তথ্যানুযায়ী ঢাকা শহরে নিবন্ধিত বাস, কার ও রিকশার সংখ্যা যথাক্রমে ১২৪৩, ১৯৫৫৭ এবং ২১৬৯৮৫। সুতরাং মাত্র ১২৪৩টি নিবন্ধিত বাস দিয়ে এই শহরের ২ কোটি লোকের যাতায়াত সুবিধা দেয়া সম্ভব নয়। একদিকে যেমন বাসের কৌশলগত ব্যবস্থাপনা (Technical Operation) বাড়ানো উচিত, অন্যদিকে মাত্রাতিরিক্ত ব্যক্তিগত পরিবহনের (কার) ব্যবহারকে নিরুৎসাহিত করা উচিত।

তথ্য সংগ্রহ ও বিশেষণ
গবেষণার স্থান
গবেষণার জন্য ঢাকা শহরের অন্যতম ব্যস্ত আসাদগেট-মতিঝিল করিডোরকে বেছে নেয়া হয়েছে। এছাড়াও বিভিন্ন ইন্টারসেকশন পয়েন্ট এ উঁচু স্থান হতে ভিডিও করা হয়েছে।
যাত্রাসময় (Travel Time)
আসাদগেট-মতিঝিল করিডোরে ৪ সপ্তাহব্যাপী দিনে ও রাতে সর্বোচ্চ যাত্রাসময় (Peak Travel Time) নির্ণয় করা হয়েছে। এরপর এসব সময়ের গড় বের করা হয়েছে। দিনে ও রাতে সর্বোচ্চ যাত্রাসময় যথাক্রমে গড়ে ৬৬ মিনিট ও ৯০ মিনিট পাওয়া গিয়েছে। অন্যদিকে গড় বেগ (Space Mean Velocity) সকালে ও বিকেলে যথাক্রমে ৬.৫ কিমি/ঘণ্টা ও ৫.০ কিমি/ঘণ্টা পাওয়া গিয়েছে। প্রকৃতপক্ষে বাসের এই শ্লথগতি ও দীর্ঘভ্রমণ সময়ই ঢাকা শহরের গণপরিবহনের করুন চিত্র ফুটিয়ে তোলার জন্য যথেষ্ট।

চিত্র: দিন ও রাতের যাত্রাসময়ের তুলনা (মাঠপর্যায় জরিপ)

চিত্র: দিন ও রাতের গড় বেগের তুলনা (মাঠপর্যায় জরিপ)
বাসের সাথে অন্যান্য বাহনের ধারণ ক্ষমতার তুলনা
বাসের সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো এর ধারণ ক্ষমতা। প্রাইভেট কারের সংখ্যা অতিরিক্ত বেড়ে গেলে সড়ক যতই প্রশস্থ হোক যানজট তখন অনিবার্য হয়ে পড়ে। নিম্নোক্ত টেবিল-১ হতে এটি স্পষ্ট যে যদিও প্রাইভেটকারের সংখ্যা বাসের তুলনায় ২.১৪ গুণ যাত্রী ধারণা ক্ষমতা ভিত্তিতে বাস ১৫ গুণ বেশি যাত্রী পরিবহন করতে পারে। সুতরাং কেবল বাসের সংখ্যা বৃদ্ধি করে ও কারের ব্যবহার নিরুৎসাহিত করেই যানজট অনেকাংশে কমানো সম্ভব।

চিত্র: প্রতি ঘণ্টায় পরিবহনকৃত যাত্রী সংখ্যা (মাঠপর্যায় জরিপ)

চিত্র: যাত্রী ধারণ ক্ষমতা (মাঠপর্যায় জরিপ)
সার্ভিসের ধরন
গবেষকদ্বয় কর্তৃক উল্লিখিত করিডোরে অনেক ধরনের বাস সার্ভিসের অস্তিত্ব লক্ষ্য করা গেছে। এগুলোর মধ্যে গেট লক, সিটিং সার্ভিস, টিকিট সার্ভিস, লোকাল সার্ভিস উল্লেখযোগ্য। প্রকৃতপক্ষে একটি আদর্শ গণপরিবহনের অন্যতম শর্ত হল সব বাসস্ট্যান্ড হতে সমানভাবে যাত্রী ওঠানামার ক্ষমতা। কিন্তু নিম্নোক্ত টেবিল হতে এটি স্পষ্ট যে ঢাকার বাস সার্ভিসগুলো কোনো পরিকল্পনা ও নিয়মনীতি ছাড়াই গড়ে উঠেছে। এছাড়া অনিয়ন্ত্রিত ভাড়া, মহিলাদের ওঠানামার সমস্যা ও যত্রতত্র যাত্রী ওঠানামা এক্ষেত্রে মূল সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। নিম্নোক্ত টেবিলে ঢাকা শহরের বিভিন্ন বাস সার্ভিসের একটি তুলনামূলক চিত্র দেয়া হলো।

বিভিন্ন বাস সার্ভিসের বৈশিষ্ট্যগত তুলনা (মাঠপর্যায় জরিপ)
ওঠানামার সময় (Boarding Alighting Time)
ঢাকার শহরের অধিকাংশ বাসই এক দরজাবিশিষ্ট। ফলে খুব স্বাভাবিকভাবেই যাত্রী ওঠানামার জন্য বাড়তি সময়ের প্রয়োজন হয়। অন্যদিকে অধিকাংশ বাস ড্রাইভারই চায়, যে বাসস্টপেজ হতে বাস ছেড়ে যাবে সেখান থেকেই যাত্রীবোঝাই করে নিতে। ফলে মাঝামাঝি বাসস্ট্যান্ড হতে যাত্রীরা উঠতে পারে না। নিম্নোক্ত চিত্র হতে এটি পরিষ্কার যে আজিমপুর-মালিবাগ রুটে ৩০০ সেকেন্ড (৫০ শতাংশ) সময়ই বাস আজিমপুর হতে যাত্রী উঠিয়েছে। ফলে মাঝামাঝি স্টপেজে শিশু, বৃদ্ধ ও মহিলাদের জন্য বাসে ওঠা খুবই কষ্টকর।

ওঠানামার সময় (Boarding Alighting Time)
বহুসংখ্যাক সিঁড়িবিশিষ্ট বাস (Multistep Boarding)
গবেষণায় দেখা গেছে, ঢাকার অধিকাংশ বাসই ২-৪টি সিঁড়িবিশিষ্ট। এই বাড়তি সিঁড়ি যাত্রীদের উঠানামায় সমস্যা সৃষ্টির পাশাপাশি দুর্ঘটনার সম্ভাবনাও বাড়িয়ে দেয়। সুতরাং একদিকে যেমন সমতল উঠানামার ব্যবস্থা করতে হবে অন্যদিকে ২ দরজাবিশিষ্ট বাস ক্রয় করার প্রতি ব্যবসায়ীদের উৎসাহ দিতে হবে।

সুপারিশ (Recommendation)
গবেষণায় দেখা গেছে, যে ঢাকাতে একটি রুটেই ৫-১০টি বাস কোম্পানিৎকে রুট পারমিট দেয়া হয়। ফলে তৈরি হয় অসুস্থ প্রতিযোগিতা। তাই নির্দিষ্ট ২-৩টি বাস কোম্পানিকে দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে রুট পারমিট দিলে তাদের সেবার মান বৃদ্ধি করার পাশাপাশি প্রাতিষ্ঠানিক দায়বদ্ধতার মধ্যে আনা সম্ভব হবে।
গণপরিবহনের সংজ্ঞানুযায়ী সব বাসস্ট্যান্ড হতেই যাত্রীরা বাসে ওঠানামার সুযোগ পাবে। কিন্তু ঢাকার শহরের যত্রতত্র অনিয়ন্ত্রিত যাত্রী উঠানামার ফলে গণপরিবহন হারাচ্ছে তার আকর্ষণ। তাই প্রতি বাসস্ট্যান্ডেই উঠানামার সময় ৩০ সেকেন্ড থেকে ১ মিনিট করা উচিত।
সমতল উঠানামা (Flat Boarding) বিশিষ্ট বাসের প্রচলন করা উচিত যা উন্নত বিশ্বে বহুল ব্যবহৃত।

গবেষণা হতে এটি স্পষ্ট যে, সকালের যাত্রাসময় অপেক্ষা রাতের যাত্রাসময় প্রায় ২০ মিনিট বেশি। এই যাত্রাসময় কমাতে হলে অফিস, ব্যাংক ও বৈকালীন স্কুলগুলোর ছুটির সময়ে কমপক্ষে এক ঘণ্টা করে পার্থক্য (Interval) রাখা উচিত।
গেট লক, সিটিং সার্ভিস, টিকিট সার্ভিস, লোকাল সার্ভিস প্রভৃতি বাস জনগণের কাছে ধুম্রজালের মতো। একদিক দিয়ে যেমন এগুলোর ওপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ নেই, অন্যদিকে এদের মূল উদ্দেশ্যই হলো ব্যবসা এবং কোনোভাবেই জনগণকে সেবা দেয়া নয়। তাই গণপরিবহনের উন্নতিকল্পে অবশ্যই পৃথক প্রতিস্থান (Authority) গঠন করতে হবে।
গণপরিবহনকে জনপ্রিয় করতে হলে এর সুবিধা বৃদ্ধির পাশাপাশি ব্যক্তিগত গাড়িৎর ব্যবহারকেও নিরুৎসাহিত করতে হবে। পার্কিং চার্জ বৃদ্ধি, যত্রতত্র কার পার্কিং এ নিষেধাজ্ঞা প্রদানের মাধ্যমে গণপরিবহনকে জনপ্রিয় করা সম্ভব।
ঢাকা শহরের গণপরিবহন ব্যবস্থা মহিলা, শিশু, বৃদ্ধ ও প্রতিবন্ধীদের জন্য কোনোভাবেই অনুকুল নয়। তাই সরকারকে অবশ্যই এই বিশেষায়িত শ্রেণীর জন্য গণপরিবহনে বিশেষায়িত সুবিধা প্রদান করতে হবে।

সমগ্র বিশ্বেই গণপরিবহন বলতে বোঝায় আপামর জনসাধারণের পরিবহন। কিন্তু সঠিক পরিকল্পনা, নিয়ন্ত্রণ ও সেবা প্রদানের ব্যর্থতার কারণে আমাদের দেশের গণপরিবহন দিন দিন আকর্ষণ হারাচ্ছে। সরকারি, বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতার পাশাপাশি সঠিক ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহনণ করা প্রয়োজন। সুতরাং গণপরিবহনে গণজাগরণই পারে ঢাকাকে যানজটমুক্ত একটি অত্যাধুনিক নগরী হিসেবে গড়ে তুলতে।
মো: সামি হাসনাইন
স্নাতক (শেষ বর্ষ), পুরকৌশল বিভাগ
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়
প্রকাশকাল: বন্ধন ২৬ তম সংখ্যা, জুন ২০১২