আমাদের এখানে বড় শহরগুলো ছাড়া ছোট ও মফস্বল শহরের অধিকাংশ স্থাপনাই ইটের তৈরি। মূলত নব্বইয়ের দশকের শেষদিকে ইটের বাড়ির পরিবর্তে কংক্রিটের স্থাপনা তৈরির প্রবণতা কয়েকগুণ বাড়তে থাকে। বর্তমানে কংক্রিটের সঙ্গে সঙ্গে স্টিলের স্থাপনা তৈরির হারও বেড়েছে। এর পেছনে মূল কারণ কংক্রিট ও স্টিলের দীর্ঘস্থায়িত্ব। আর ভূমিকম্পের সময় ইটের তৈরি স্থাপনার চেয়ে স্টিল অপেক্ষাকৃত ভালো আচরণ করে। কংক্রিটের স্থাপনায় রিইনফোর্সমেন্ট ব্যবহার করায় ভূমিকম্পের সময় মাটি বা ইটের তৈরি স্থাপনার চেয়ে এটি দৃঢ় ও ভালো। এ ছাড়া স্থাপত্য নকশার সৌন্দর্য ও স্থায়িত্ব বিবেচনা করে স্টিলের কাঠামো ক্রমেই জনপ্রিয়তা পাচ্ছে। কিন্তু আমাদের দেশের স্বল্প আয়ের মানুষের জন্য কংক্রিট কিংবা স্টিল উভয়ই ব্যয়বহুল হওয়ার কারণে এখনো ইটের তৈরি স্থাপনাই প্রথম পছন্দ। যদি সঠিকভাবে ভূমিকম্প প্রতিরোধী কৌশলগুলো ইটের তৈরি স্থাপনায় প্রয়োগ করা যায়, তাহলে খুব সহজেই কম খরচে অল্প থেকে মাঝারি মানের ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলে ইটের তৈরি স্থাপনা ভূমিকম্প সহনশীল হতে পারে। আলোচ্য প্রবন্ধে থাকছে ইটের ভবন কীভাবে শক্তিশালী করা যাবে সেই বিষয়গুলো।
ইটের তৈরির বাড়ির ক্ষেত্রে দেখা যায়, এটি ভূমিকম্পের মতো শক্তিশালী আনুভূমিক বলের সময় অত্যন্ত দুর্বল আচরণ করে। এ কারণে আগে হওয়া ভূমিকম্পের সময় ইটের ভবনগুলো সবচেয়ে বেশি পরিমাণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এর পেছনে মূল কারণ হলো, নির্মাণসামগ্রীর মধ্যে ইট অত্যন্ত ভঙ্গুর নির্মাণ উপকরণ। সাধারণত, ইটের তৈরি ভবনে কয়েকটি বিশেষ দুর্বলতা লক্ষ করা যায়। প্রথমত, ভূমিকম্পের সময় দুটি দেয়ালের সংযোগস্থল বরাবর ফাটলের সৃষ্টি হয়।

এ ক্ষেত্রে যে পথ বরাবর ভূমিকম্প তরঙ্গ সঞ্চালিত হয়, সেই সঞ্চালনের পথের সঙ্গে লম্বভাবে অবস্থিত দেয়ালে ভূমিকম্প সৃষ্ট আনুভূমিক বল অপেক্ষাকৃত বেশি অনুভূত হওয়ায় তা দুর্বল আচরণ করে থাকে (চিত্র : ১, খ দেয়ালের মতো), এ ধরনের দেয়ালে সৃষ্ট বলকে আউট-অব-প্ল্যান-ফোর্স হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। অপর দিকে ভূমিকম্প সঞ্চালনরেখা বরাবর সমান্তরালে থাকা দেয়ালগুলো অপেক্ষাকৃত শক্তিশালী আচরণ করে (চিত্র : ১, ক দেয়ালের মতো), এ ধরনের দেয়ালে সৃষ্ট বলকে ইন-প্ল্যান-ফোর্স বলা হয়। ইটের ভবনে এই দুই ধরনের বাহ্যিক বলের কারণে পাশাপাশি দেয়ালগুলোর সংযোগস্থলে ফাটলের সৃষ্টি হয়। দ্বিতীয়ত, ইটের ভবনে দরজা জানালার ফাঁকা স্থানগুলোর পাশাপাশি ও মাঝামাঝি অংশের দেয়ালে কর্ণ বরাবর চিত্র : ২-এর মতো ফাটল সৃষ্টি হয়ে থাকে। আরও একটি প্রধান দুর্বলতা হছে ভূমিকম্পের সময় দরজা-জানালার ওপরের ও নিচের অংশের দেয়ালের মধ্যে ভূমিকম্পের কারণে সৃষ্ট ভ্রামক বলের সমবিন্যাস না হলে দেয়ালে রকিং ও ক্রাশিং সৃষ্টি হয়, যা চিত্র : ২-এ দেখানো হয়েছে।

রকিং হচ্ছে দেয়ালের বিভিন্ন অংশে মোচড়ের সৃষ্টি হওয়া এবং ক্রাশিং হচ্ছে সৃষ্ট মোচড়ের কারণে দেয়ালের বিভিন্ন অংশের প্রান্তে ক্ষয় হয়ে যাওয়া বা ভেঙে পড়া, চিত্রে বৃত্তের মধ্যে ক্রাশিং দেখান হয়েছে। এ ছাড়া ভবনের দেয়ালের পুরুত্ব উচ্চতা ও দৈর্ঘ্যরে তুলনায় যথেষ্ট না হলেও তা ভূমিকম্পের সময় দুর্বল আচরণ করে থাকে। এ কারণে অতীতের ভূমিকম্পের সময় গির্জা, মন্দির বা মসজিদের মতো স্থাপনায় দেয়ালের পুরুত্বের তুলনায় উচ্চতা বেশি হওয়ায় কারণে সাধারণ ভবনের চেয়ে প্রার্থনালয়গুলো বেশি পরিমাণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
ইটের ভবনে যদি উপরিউক্ত এই কয়েকটি প্রধান দুর্বলতা কাটিয়ে তোলা সম্ভব হয় তবে খুব সহজেই ইটের তৈরি ভবন নিরাপদ ও গ্রহণযোগ্য হবে। এখনো পৃথিবীর অধিকাংশ পুরোনো শহরগুলোতে দেখা যায় ইটের তৈরি স্থাপনার সংখ্যাই বেশি। এমনকি ইউরোপের মতো উন্নত দেশগুলোতে ইটের স্থাপনা হাজার বছর ধরে টিকে আছে কোনো ধরনের ক্ষতি ছাড়া। এ জন্য প্রয়োজন যথাযথ পরিচর্যা, এসব দেশে নির্দিষ্ট সময় অন্তর ভবনগুলোর সংস্কারকাজ করা হয়। যদি নিয়মিতভাবে কয়েক বছর পরপর সংস্কারকাজ করা যায়, ভবনগুলো থাকে দীর্ঘস্থায়ী ও নিরাপদ। নিয়মিতভাবে সংস্কার করতে খরচও হয় কম। এ ধরনের ভবন নিয়ে গবেষণায় সবচেয়ে এগিয়ে আছে পর্তুগাল ও ইতালি। পরীক্ষাগারে ভবনগুলোর ছোট ছোট মডেল করে কৃত্রিম উপায়ে ভূমিকম্প তৈরি করে দেখা গেছে, ইটের তৈরি সাধারণ ভবনের চেয়ে ‘কনফাইন্ড ম্যাসোনারি’ ভবন ভালো আচরণ করে। এমনকি ভূমিকম্পের পরে এ ধরনের বাড়ির ক্ষেত্রে পাওয়া গেছে ভালো ফল। আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের বিভিন্ন শহরেও আজকাল এ ধরনের বাড়ি তৈরি করা হচ্ছে। আমাদের দেশেও কম খরচে দেশীয় কাঁচামাল ব্যবহার করে এ ধরনের ভবন তৈরি করা সম্ভব। এর জন্য প্রয়োজন সুদক্ষ মিস্ত্রি দিয়ে সঠিকভাবে ভূমিকম্প সহনশীল কৌশলসমূহ প্রয়োগ করা।
এবার আসা যাক ‘কনফাইন্ড ম্যাসোনারি’ ভবন বলতে আসলে কি বোঝানো হয়! ইটের তৈরি ভবনের পাশাপাশি দেয়ালগুলোকে যদি একে অপরের সঙ্গে যুক্ত করে দেওয়া যায় তাহলে ভূমিকম্পের সময় দুর্বল দেয়ালে সৃষ্টবল অপেক্ষাকৃত শক্তিশালী দেয়াল কর্তৃক শেয়ার করবে। এভাবে ভবনের সব প্রান্তের পাশাপাশি দেয়াল যদি যুক্ত করে দেওয়া যায়, তবে ভবনটি একটি বাক্সের মতো আচরণ করবে (চিত্র : ৩)।

এ ধরনের নকশার ভবনকে ‘কনফাইন্ড ম্যাসোনারি’ বলা হয়। দেয়ালগুলোর মধ্যে আনুভূমিক রেইনফোর্সমেন্ট ব্যবহার করে যুক্ত করা হয়। সাধারণত, দেয়ালের প্রান্ত থেকে তিন থেকে চার ফুট পর্যন্ত ইংরেজি ‘খ’-এর মতো রেইনফোর্সমেন্ট ব্যবহার করা হয়। এমনকি রেইনফোর্সমেন্টের বিকল্প হিসেবে কাঠও ব্যবহার করা যায়। এ ক্ষেত্রে দরজা-জানালা ভবনের দেয়ালের প্রান্তে রাখা হয় না। এ ধরনের সংযোগ স্থাপন করায় দুই দেয়ালের মধ্যে ফাটল সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা অনেকাংশে কমে। দেয়ালে সৃষ্ট রকিং ও ক্রাশিং প্রতিরোধে ফাঁকা স্থানের পাশে ও দেয়ালের প্রান্তে উলম্বভাবে এবং জানালার ওপর-নিচ বরাবর আনুভূমিকভাবে রেইনফোর্সমেন্ট ব্যবহার করা হয় (চিত্র : ৪)।

স্বাভাবিকভাবে এই দুই ধরনের রেইনফোর্সমেন্ট ব্যবহারের কারণে দেয়ালের মধ্যে কর্ণ বরাবর ফাটল সৃষ্টি হওয়া রোধ করা যায়। কংক্রিটের ছাদ ব্যতীত ভবনের ক্ষেত্রে টিনের তৈরি ছাদ ও দেয়ালের মধ্যে লিংটেলের মতো ব্যান্ড ব্যবহার করতে হবে, যাতে ভূমিকম্পের সময় ভবনের ওপরের অংশ সুদৃঢ় আচরণ করে। এ ছাড়া ভবনের ফাউন্ডেশন ও দেয়ালের মধ্যে একই রকমের ব্যান্ড ব্যবহার করলে ভবন অধিকতর শক্তিশালী হয়। আমরা যদি উল্লেখিত কৌশলসমূহ আমাদের দেশে নতুন ভবনের জন্য প্রয়োগ করতে পারি, তাহলে খুব সহজে ও কম খরচে অপেক্ষাকৃত শক্তিশালী এবং ভূমিকম্প সহনীয় ইটের ভবন বানানো সম্ভব। এমনকি এই ধরনের ‘কনফাইন্ড ম্যাসোনারি’ দুর্বল ডিজাইনের কংক্রিটের ভবন অপেক্ষা শ্রেয়।
রামকৃষ্ণ মজুমদার বর্তমানে চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের নবগঠিত ভূমিকম্প প্রকৌশল ও গবেষণা ইনস্টিটিউটে গবেষণা প্রভাষক পদে কর্মরত। তিনি শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পুর ও পরিবেশকৌশল বিভাগ থেকে ২০০৯ সালে বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারিং পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর এশিয়ান ডিজাস্টার প্রিপেয়ার্ডনেস সেন্টার এ স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ার পদে ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা প্রকৌশলী পদে ভূমিকম্পবিষয়ক গবেষণা কাজে নিয়োজিত ছিলেন। পরবর্তী সময়ে ইউরোপিয়ান কমিশনের বৃত্তি নিয়ে ইতালির ইউনিভার্সিটি অব রোম ‘লা সাপিএন্সা’ থেকে ভূমিকম্প প্রকৌশলে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। স্নাতকোত্তর কোর্সে তাঁর গবেষণার বিষয় ছিল ইটের ভবনে দেয়ালের ওপর ভূমিকম্প সৃষ্ট বলের ফলে প্রকৃত আচরণ যাচাই করা ও তার মান উন্নীতকরণে প্রয়োজনীয় উপায় নিরূপণ করা।

রামকৃষ্ণ মজুমদার, গবেষণা প্রভাষক, ভূমিকম্প প্রকৌশল ও গবেষণা ইনস্টিটিউট, চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ।
প্রকাশকাল: বন্ধন ৪১ তম সংখ্যা, সেপ্টেম্বর ২০১৩