জলাভূমি ও জীববৈচিত্র্য বাঁচাতে পরিকল্পিত আবাসন

বাড়ছে নগরায়ণ, বাড়ছে জনসংখ্যা। সেই তুলনায় বাড়ছে না দেশজ ভূমি। স্বল্প জায়গায় বেশিসংখ্যক মানুষের আবাসনের চাহিদা পূরণ করতে ক্রমেই ধ্বংস হচ্ছে জীববৈচিত্র্য। দেশ ক্রমেই পরিণত হচ্ছে ধ্বংসস্তূপে, হারিয়ে যাচ্ছে প্রাকৃতিক পরিবেশ। বৈশ্বিক বাস্তবতায় এককোষী জীবসহ নানা প্রজাতির প্রাণী ও উদ্ভিদের অস্তিত্ব তথা জীববৈচিত্র্য রক্ষা এখন অতীব জরুরি। বিজ্ঞানীদের মতে, বিশ্বের জীবকুলের সংখ্যা ২০ লাখেরও বেশি। এসব নানা প্রজাতির প্রাণীকুল মানুষের পোশাক, খাদ্য ও বাসস্থানসহ প্রাথমিক অনেক চাহিদাই মেটাচ্ছে। মানুষের শরীর ও মনের সুস্থতা বা আনন্দ, অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও মানবসমাজের ক্রমোন্নতি বা বিকাশ- এসবই জীববৈচিত্র্য ছাড়া অসম্ভব। জীবজগতের পরিপূর্ণ বিকাশে সময় লেগেছে কোটি কোটি বছর। কিন্তু বর্তমান প্রকৃতি মানুষের নানা অনাচার ও স্বেচ্ছাচারিতার শিকার। মানুষের এসব অনাচারের ফলে জীববৈচিত্র্য ক্রমেই ধ্বংসের সম্মুখীন। জমির পোকামাকড় ধ্বংসের জন্য রাসায়নিক কীটনাশকের ব্যাপক ব্যবহার, পানি, বাতাস ও মাটি দূষণকারী উপাদান ছড়িয়ে দেওয়ার পাশাপাশি ব্যাপক গাছপালা ধ্বংস করার মাধ্যমে মানুষ প্রাকৃতিক ভারসাম্যকে বিপন্ন করে তুলছে। জীববিজ্ঞানীদের মতে, ঘণ্টাপ্রতি প্রায় আট প্রজাতির প্রাণী বিলুপ্ত হচ্ছে এবং বছরে আমরা হারাচ্ছি ৭০ হাজার প্রজাতির প্রাণী। জীববৈচিত্র্য এমন এক আমানত, যা আমাদের পূর্বপুরুষেরা রক্ষা করে পরবর্তী প্রজন্মকে জীববৈচিত্র্যযুক্ত বিশ্ব উপহার দেওয়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন। কিন্তু বর্তমান জীবকুল ও প্রকৃতির সঙ্গে আমাদের আচরণ অনেকটাই আত্মবিনাশী। জীববৈচিত্র্য ছাড়া মানুষের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা অসম্ভব। তাই পানির জন্য লড়াইয়ের মতো জীববৈচিত্র্য রক্ষা করাও প্রতিটি দেশের জাতীয় নিরাপত্তার অংশ হওয়া উচিত। কিন্ত অত্যন্ত দুঃখের বিষয়, আমরা নগরায়ণের পাশাপাশি আবাসনের বিকল্প ভাবতে গিয়ে এমন সব কাজ করছি, যাতে করে দিন দিন আবাসযোগ্য ভূমির পরিমাণ কমছে, ধ্বংস হচ্ছে জলাভূমি, ভরাট হচ্ছে পুকুর-খাল, বাদ যাচ্ছে না নদীও। এভাবে চলতে থাকলে দিন দিন যে হারে জলাভূমির পরিমাণ কমছে তাতে কয়েক বছর পর রাজধানী ঢাকা ও ঢাকার আশপাশে নাগরিক-সুবিধা নিয়ে টিকে থাকাটাই হবে বিরাট চ্যালেঞ্জ। রাজধানীর আশপাশে যেসব শহর-উপশহর গড়ে উঠছে, এগুলোর বেশির ভাগই জলাভূমি ভরাট করে। এতে করে জলাভূমির পরিমাণ কমায় বন্যা বা পানিজাতীয় দুর্যোগের হুমকিতে রয়েছে রাজধানীবাসী। আর সবচেয়ে বেশি হুমকিতে আছে জীববৈচিত্র্য। কেরানীগঞ্জ, আফতাবনগর, গাবতলীসহ ঢাকার চারপাশের সমানে চলছে জলাশয় আর নদী দখলের মহোৎসব। সবই ঠিক আছে কিন্তু এ নদী আর জলাশয়কে রক্ষা করা না গেলে এর পানিই হবে আমাদের গলার কাঁটা। শুকনো মৌসুমে এটি সমস্যা না হলেও বর্ষা বা দুর্যোগের সময় এটি আরও ভয়াবহ রূপ নিতে পারে। এতে করে সর্বগ্রাসী পানিতে তলিয়ে যেতে পারে আপনার কোটি টাকার আবাস। যে বাড়ি বানিয়েছেন নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য, তা-ই যদি হয় অনাশ্রয়; তবে এর চেয়ে বড় বিপদ আর কী হতে পারে?

আবাসন ও প্রকৃতির সহাবস্থান প্রকল্প

জলাবদ্ধতার এ হেন অবস্থায় পরিকল্পিত ও পরিবেশগত আবাসনের চিন্তা না করলে এ থেকে বেরিয়ে আসার সহজ কোনো উপায় নেই। এ প্রকল্পটিতে রয়েছে সমস্যাকে প্রাধান্য দিয়ে প্রকৃতির সঙ্গে সখ্যতা গড়ে আধুনিক আবাস গড়ার প্রচেষ্টা। প্রকল্পটির নাম ‘ব্যালেন্সিং ন্যাচারাল প্রসেস অ্যান্ড আরবান ডেভেলপমেন্ট ইন লোল্যান্ড অ্যারাউন্ড ঢাকা সিটি’ অর্থাৎ ঢাকা সিটির আশপাশের প্রাকৃতিক পরিবেশ ও জলাভূমিকে বাঁচিয়ে নগরায়ণ; এমন বিষয় নিয়ে কাজ করা। এ জন্য প্রথমেই গাবতলীর আশপাশের নিম্নাঞ্চলকে প্রকল্প অঞ্চলের জন্য বেছে নেওয়া হয়। কিন্তু ড্যাপ ও অন্যান্য আইনে এ অঞ্চলটিকে বন্যা ও জল দুর্যোগপ্রবণ হওয়ায় এখান থেকে গবেষণার কাজ অন্যত্র সরিয়ে নেওয়া হয়। আবাসনে জীববৈচিত্র্য ও অন্যান্য বিষয় টিকিয়ে রেখে ভালোভাবে বেঁচে থাকা সম্ভব, এ প্রকল্পে এ চেষ্টাই লক্ষণীয়। 

পরবর্তী সময়ে গবেষণা ও প্রকল্প কাজের জন্য ঢাকার নিকটস্থ কেরানীগঞ্জকে বেছে নেওয়া হয়। কেরানীগঞ্জের বেশ কিছু জায়গায় কাজের পর এমনভাবে প্রকল্পটি দাঁড় করানো হয়, যাতে পরিবেশ আর জীববৈচিত্র্যকে টিকিয়ে রাখার সব চেষ্টা করা হয়েছে। আর এতে যুক্ত হয়েছে চলমান বাস্তবতাও। 

কাজের শুরুতে প্রথমে ভাবতে হয়েছে আবাস ভবনের কলামের নিচে পানি বা জলাভূমি থাকতে পারে। এ কারণে ময়লা পানি পরিচালনা ও পরিচ্ছন্নতা খরচ ব্যয়বহুল হওয়ায় এ সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসা। এ প্রকল্পকে ম্যানমেইড ইন্টারফেস ও ন্যাচারাল ইন্টারফেস দুভাবে রাখার চেষ্টা করা হয়েছে। প্রাকৃতিকভাবে জলাশয়গুলোকে টিকিয়ে রাখার প্রচেষ্টাও রয়েছে। জলাশয়ের শেষ প্রান্ত আর ভূমির প্রারম্ভে সবচেয়ে বেশি প্রাণী ও জীববৈচিত্র্য থাকে। এ কারণে আবাসন এ প্রকল্পে এ বিষয়টিকে প্রাধান্য দিয়ে প্রাণীকুলকে রক্ষার চেষ্টা রয়েছে।

এ প্রকল্পের ভবনগুলোয় কোনো সীমানা বা বাউন্ডারি রাখা হয়নি। এতে করে প্রাকৃতিক আলো-বাতাস আর উজ্জ্বলতা পাওয়া সম্ভব এবং দিনের বেলায় বৈদ্যুতিক বাতি জ্বালিয়ে রাখার প্রয়োজন নেই। এতে বাঁচবে খরচও। এখানকার ভবনগুলোর বারান্দা ও আশপাশের জানালাগুলো এমনভাবে বানানো যাতে করে দিনের বেলায় প্রাকৃতিক আলো-বাতাস খুব সহজেই ঘরের ভেতর প্রবেশ করতে পারে। আর দুর্যোগকালীন কিংবা বড় ধরনের জলাবদ্ধতা হলে এ ভবনেই থাকতে পারবে বাসিন্দারা। এ ধরনের আবাসনকে বলা হচ্ছে ‘পরিবেশবান্ধব সামাজিক আবাসন’। এখানের জলাশয়ের ধারে বা কিনারে রাস্তা থাকবে তবে সেখানে গাড়ি চলাচলের জন্য থাকবে না কোনো পাকা রাস্তা। হাঁটাপথ বা খুব বড়জোর ইটের খোয়া বিছানো রাস্তা থাকবে। সবাই এখানে হাঁটাহাঁটি করবে, থাকবে উদ্যানের মতো জায়গা। তবে কোনো কিছুই করা হবে না হার্ড সারফেসে। 

এখানকার জলাশয়গুলো এমনভাবে ভবনের পাশ ঘেঁষে থাকবে, যাতে বর্ষা বা দুর্যোগের সময় ধীরে ধীরে পানি ভবনের কাছাকাছি এলেও উদ্যানের খোলা জায়গা থাকায় সমস্যা হবে না। আর পানি যদি বেশিও হয় তখন বাচ্চারা বিশেষভাবে নির্মিত বারান্দার প্রাকৃতিক আলোতেই খেলতে পারবে। যদি আবাসন প্রকল্পের মধ্যে কোনো বড় জলাশয় ও খোলা জায়গা থাকে, তাহলে সেখানে কোনো আবাসন না গড়ে প্রাকৃতিক পরিবেশ ধরে রাখতে খেলার মাঠ বা খোলা জায়গা রাখা যেতে পারে। জলপ্রবাহের কারণে এখানে খুব বেশি সেতু বানানো যাবে না। বড়জোর দুটি বা তিনটি। আর পুরো আবাসন প্রকল্পের বড় রাস্তা হবে একটি বা দুটি।

আবাসনের পরিকল্পনায় কিছু প্রস্তাবনা

আবাসন পরিকল্পনার প্রধান বিবেচ্য বিষয় বিভিন্ন আবাসন প্রকল্পের মধ্য জলাভূমিকে যথাসম্ভব কানেকটিং করা। এতে করে ওই এলাকার জীববৈচিত্র্য টিকে থাকবে এবং আবাসন সমস্যার সমাধান হবে অনেকটাই প্রাকৃতিকভাবে। 

যে জায়গায় আবাসন ব্যবস্থা গড়ে উঠবে, সেখানকার উন্নয়নের আগে বন্যার পানি পৌঁছাতে পারবে না এমন জায়গা বেছে নিতে হবে। এতে করে আবাসন প্রকল্প এলাকা বন্যার কবল থেকে মুক্ত থাকবে। 

আবাসন প্রকল্প এলাকাকে দুই ভাগে ভাগ করা যেতে পারে। একটি প্রাকৃতিক অঞ্চল ও অপরটি মানবসৃষ্ট অঞ্চল। এ দুই ধরনের জায়গা নির্ধারণের মাধ্যমে আবাসন গড়ে তোলা গেলে জীববৈচিত্র্য ও অন্যান্য বিষয়ে প্রাকৃতিক সাহায্য পাওয়া অনেক সহজ হবে।

আবাসন প্রকল্পের মধ্যে ন্যূনতম ৩০ শতাংশ প্রাকৃতিক পরিবেশ, খোলা মাঠ ইত্যাদি রাখতে হবে। এসব অবশ্য রাজউকের ইমারত নির্মাণ বিধিমালায় স্পষ্ট করে বলা আছে।  

আবাসন প্রকল্পের সব জায়গায় হার্ড সারফেস ব্যবহার না করে সফট সারফেস বা মাটির রাস্তা করা যেতে পারে। যেখানে ইটের বা পিচের রাস্তার বদলে মাটির রাস্তা বা শুধু হাঁটাপথ থাকবে।

কৃষিকাজ বা এ ধরনের প্রাকৃতিক বিষয়কে যদি প্রাধান্য দেওয়া সম্ভব হয়, তাহলে আবাসন প্রকল্পের প্রাকৃতিক পরিবেশ নষ্ট না হয়ে বরং আরও সতেজ থাকবে। এ ক্ষেত্রে সম্ভব হলে গাছপালা বা সবুজায়ন করার চেষ্টা করা যেতে পারে। যতটা সম্ভব খোলামেলা জায়গা রাখতে হবে।

আবাসন করতে গিয়ে যদি একেবারেই জমি ভরাট না করে উপায় না থাকে তবে একটি বিশেষ পদ্ধতি অবলম্বন করা যেতে পারে। এ পদ্ধতিতে আবাসনের যেখানে উঁচু জমি থাকবে সেখানে আরও উঁচু করে আবাসনের ব্যবস্থা করা যাবে। তবে কোনোভাবেই জলাভূমি বা ওয়াটারল্যান্ডকে নষ্ট করা যাবে না। প্রয়োজন হলে নিচু জলাভূমি থেকে আরও মাটি খনন করে আবাসস্থলের উঁচু স্থানকে আরও উঁচু করে দিতে হবে। এতে করে জলাভূমি যেমন নষ্ট হবে না তেমনি আবাসনের ভূমি আরও শক্তিশালী হবে। এতে করে খুব বেশি দুর্যোগ বা বন্যা হওয়ার সুযোগ থাকবে না। 

সম্ভব হলে আবাসন প্রকল্পের সঙ্গে মিল রেখে কিছু জলাভূমি বা সবুজ বনায়নের সংযোগ ঘটানো যেতে পারে। এতে করে আবাসন প্রকল্প নষ্ট হয়ে গেলেও এখানকার জীববৈচিত্র্য টিকে থাকবে এবং আশপাশের আবাসন প্রকল্পে স্থানান্তরিত হয়ে নিজেদের বেঁচে থাকা নিশ্চিত হবে।

ডিটেইল্ড এরিয়া প্ল্যান (ড্যাপ) অনুযায়ী, ঢাকার ৮১০২৪ দশমিক ২১ একর এলাকা বন্যাপ্রবণ। এর জন্য দায়ী গুটি কয়েক ভূমিদস্যু ও সরকারের কিছু অসাধু কর্মকর্তা। নগরায়ণের নামে ভূমিদস্যুরা একের পর এক পুকুর, ডোবা, খাল-বিল, নদী-নালা, জলাধারগুলো ভরাট করছে। তাদের দৌরাত্ম্যে বিপর্যয়ের মুখে শহর ঢাকা। আর তাই বাস্তবায়িত হচ্ছে না একটি সুষ্ঠু পরিকল্পনাও।

বর্ষায় নিম্নাঞ্চলের জলাবদ্ধতা

অপরিকল্পিত উন্নয়ন যদি চলতে থাকে তবে ঢাকা মহানগর বসবাসের অযোগ্য জঞ্জালে পরিণত হবে। আমাদের এখনই সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা ও পরিকল্পিত উন্নয়নের দিকে এগিয়ে যেতে হবে। এ ক্ষেত্রে এ প্রকল্পটি রাখতে পারবে বিশেষ ভূমিকা। 

এখানকার ভবনগুলো চার থেকে ছয় তলার বেশি হবে না। এতে করে যদি কখনো বন্যা বা জলগত দুর্যোগে পানি বেড়ে যায়, তাহলে পানি চলে যাওয়ার পর জায়গাটি স্যাঁতসেঁতে থাকবে না এবং প্রাকৃতিক আলো-বাতাস চলাচলের কারণে তাড়াতাড়ি আগের অবস্থায় ফিরে যাবে। 

দিন দিন যেহেতু প্রাকৃতিক পরিবেশ কমায় আমরা আমাদের নিজস্ব অস্তিত্ব নিয়ে হুমকির সম্মুখীন, তাই আমাদের ঘুরে দাঁড়াতেই হবে। এ ক্ষেত্রে পরিবেশের যে পরিমাণ ক্ষতি হচ্ছে তা পূরণের সঙ্গে সঙ্গে ফিরিয়ে দিতে হবে। তবেই বাঁচবে পরিবেশ, বাঁচবে ধরিত্রী, বিশেষত এ নগরী ঢাকা। 

লাবিব হোসাইন, প্রভাষক, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়

অনুলিখন : জিয়াউর রহমান চৌধুরী

প্রকাশকাল: বন্ধন ৪০ তম সংখ্যা, আগস্ট ২০১৩

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top