নির্মাণে সাধারণ যত ত্রুটি

মানুষের মৌলিক চাহিদার অন্যতম বাসস্থান। যুগে যুগে মানুষ ছুটছে নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে। ধুলা-মাটির ঘর বানানো মানবশিশুর অবচেতন মনের প্রচ্ছন্ন ইচ্ছার বহিঃপ্রকাশ। আগে মানুষ ঘর বানাত মাটি, বাঁশ, খড় দিয়ে। কখনো বাস করত গাছের সঙ্গে মাচা বানিয়ে। ছিল টিনের ঘরও। এখন ধীরে ধীরে সেসবে এসেছে পরিবর্তন। আজ তৈরি হচ্ছে সুউচ্চ প্রাসাদ, দৃষ্টিনন্দন অট্টালিকা। শুধু তা-ই নয়, সভ্যতা বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে নির্মিত হচ্ছে বিশেষ ধরনের সব স্থাপনা। সভ্যতা হোক অগ্রগামী, বাসস্থান হোক নিরাপদ আর বিশ্ব হোক শান্তিময়- এ আমাদের আজন্ম কামনা। আর চলমান এ সভ্যতারই বড় এক অংশ ভবন বা স্থাপনা নির্মাণ।

একটি ভবনের স্থায়িত্ব, নিরাপত্তা, সঠিক গঠন নির্ভর করে কতগুলো বিষয়ের ওপর। কাঠামোগত নকশা, ব্যবহৃত উপাদানের গুণগত মান ও সঠিক প্রয়োগবিধি এ ক্ষেত্রে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। আমাদের এখানে সঠিক নকশা, গুণগত মানসম্পন্ন নির্মাণ উপকরণের ব্যবহারের নিশ্চয়তা দেওয়া হয়। কিন্তু বাস্তবতা অনেক ক্ষেত্রেই ভিন্ন। ভবনের মালিকেরা নামকরা নির্মাণ প্রতিষ্ঠান থেকে কাঠামোগত নকশা করিয়ে ও গুণগত মানের উন্নত নির্মাণসামগ্রীর সরবরাহ নিশ্চিত করে আত্মতৃপ্তিতে ভোগেন। কিন্তু তাঁদের এ প্রত্যাশা পূরণ হয় না যদি নির্মাণসামগ্রীর ব্যবহার বা প্রয়োগ যথাযথ না হয়। এর কারণ প্রচলিত কিছু ত্রুটি। যার মধ্যে রয়েছে-

ভূমিকম্প সহনীয় বিল্ডিং নির্মাণে কলামের টাই কত ডিগ্রী কোণে ঘুরাতে হবে এবং কলাম যদি বর্গাকার/আয়তাকার আকৃতির হয় তবে কমপক্ষে ৪টি ১৬ মি.মি. রড ব্যবহার করতে হবে

নিরাপত্তা বেষ্টনী
Safety First, নিরাপত্তাই প্রথম। সব ক্ষেত্রে উক্তিটি প্রযোজ্য হলেও ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে একটু বেশিই প্রযোজ্য। আধুনিক যুগে বিশেষত শহরাঞ্চলে জনসমাগম বেশি। এসব জনবহুল এলাকায় ভবন নির্মাণের সময় বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করা প্রয়োজন। ভবনের ওপরের দিকে ইট, কাঠ, বাঁশ, লোহা প্রভৃতির কাজ করা হয়। এসব উপাদানের যেকোনোটি নিচে পড়ে যেতে পারে। আর তা যদি নিচের রাস্তায় চলাচলরত মানুষের ওপর পড়ে, তবে ঘটতে পারে মারাত্মক দুর্ঘটনা। কাজেই এ দুর্ঘটনা রোধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে আগেই। উন্নত বিশ্বে নির্মাণাধীন ভবনে কঠোরভাবে এ নিয়ম মানা হয়। সড়কপথ, নৌপথ, রেলপথ, কলকারখানা, পোশাক কারখানা, ভবন নির্মাণ, সেতু নির্মাণ, বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতির ব্যবহার, বৈদ্যুতিক তারের ব্যবহারে আজকাল প্রায়ই ঘটছে দুর্ঘটনা। অথচ দুর্ঘটনার আগে সম্ভাব্য ত্রুটি ধরতে পারলে খুব সহজেই তা রোধ করা সম্ভব। এ ব্যাপারে প্রয়োজন সবার সচেতনতা। ভবন বা স্থাপনা নির্মাণে চারদিকে নিরাপত্তা বেষ্টনী দিতে হয়। ভবনের ওপর থেকে কোনো কিছু পড়লে যাতে তা কারও গায়ে না পড়ে এ জন্য মাথার ওপরে স্থাপনার চারপাশে আনুভূমিক নিরাপত্তা বেষ্টনী দিতে হবে। ভবন বা স্থাপনা খুব বেশি উঁচু হলে নিরাপত্তামূলক এই আনুভূমিক বেষ্টনী কয়েক স্তরে হতে পারে। সাইটে যাতায়াতকারী সবাইকে হেলমেট, সেফটি শু, সেফটি গগলস, ডিজিবল জ্যাকেট এর মতো নিরাপত্তামূলক পরিচ্ছদগুলো পরতে হবে।

কলাম রডে ভাঁজ
নির্মাণকাজে এটি মারাত্মক ধরনের ত্রুটি। অনেক সময় দেখা যায়, ছাদ ঢালাইয়ের ক্ষেত্রে কলামের রডের দিকে নজর দেওয়া হয় না। যার ফলে এটা যথাযথ অবস্থান থেকে সরে যায়। ছাদ ঢালাইয়ের পর এমন হলে রাজমিস্ত্রিরা কলামের রড যথাযথ স্থানে আনতে রডকে প্রায় ৯০ ডিগ্রি কোণে ভাঁজ করে। এভাবে ভাঁজ দেওয়া রডযুক্ত কলামের ওপর প্রযুক্ত টান পীড়নে (Tensile Stress) ফেল করে। কোনো কারণে কলামের রড তার অবস্থান থেকে সরে গেলে ওই রডকে ৯০ ডিগ্রি বা কাছাকাছি কোণে না ভেঙে ধীরে ধীরে যথাযথ অবস্থানে আনতে হবে। ACI কোড অনুযায়ী এর সর্বোচ্চ মাত্রা ১ঃ৬। অর্থাৎ প্রতি ছয় ভাগ লম্বিক দূরত্বে এক ভাগ পার্শ্বদূরত্ব অতিক্রম করা যাবে। কলাম রড বেশি সরে গেলে অবশ্যই স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ারের সঙ্গে পরামর্শ করে সমস্যাটির সমাধান করতে হবে। অন্যথায় ঘটতে পারে অনাকাক্সিক্ষত কোনো ঘটনা।

কলামে রডের ভাঁজ

বিমে রডের অবস্থান
বিমের রডকে অবশ্যই কলামের ওপর স্থাপন করতে হবে। যেসব বিম কলাম পর্যন্ত শেষ হয়েছে সেসব ক্ষেত্রে এ বিষয়টি বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে দেখতে হবে। কিছু কিছু জটিল জায়গা; যেমন- লিফট, সিড়িঁঘরের ঊর্ধ্বাংশ বা পানির ট্যাংকের বিমের তদারকি করা তুলনামূলকভাবে কঠিন। অনেক প্রকৌশলী বা পরিদর্শক অন্যান্য জায়গার বিম পরীক্ষা করলেও এসব জায়গায় উঠতে চান না। ফলে এগুলো থেকে যায় দৃষ্টির আড়ালে। আর এ সুযোগটাকেই কাজে লাগায় সাইটের লেবার বা মিস্ত্রিরা। অনেক ক্ষেত্রেই তারা বিমের রডকে কলামের ওপর অবস্থান না করিয়ে কলামের গা ঘেঁষে রাখে। এ অবস্থাতেই করা হয় ঢালাই। এভাবে ঢালাইকৃত কাঠামোর অংশ যেকোনো সময় ধসে গিয়ে ঘটতে পারে মারাত্মক দুর্ঘটনা। এসব জটিল অংশ পরিদর্শনে প্রকৌশলী বা পরিদর্শকদের বিশেষ তৎপর হতে হবে।

পলিথিনের ব্যবহার
অনেক ক্ষেত্রে কাঠের তক্তায় নির্মিত সাটারিংয়ে পলিথিন ব্যবহার করা হয়। পলিথিনগুলো সাধারণত সাটারিংয়ের মধ্যে ফাঁকা অংশগুলো বন্ধের জন্য ব্যবহৃত হয়। যখন এসব পলিথিনের ওপর কংক্রিট ফেলে ভাইব্রেশন বা কমপ্রেশন করা হয়, তখন পলিথিন যত শক্তই হোক না কেন তা ছিঁড়ে ঢালাইয়ের মধ্যে ঢুকে যায়। অনেক ক্ষেত্রে ছেঁড়া এ পলিথিন ভেতরের রড পর্যন্ত পৌঁছে। এভাবে ঢালাইকৃত কাঠামো বা স্থাপনা ধসে পড়ার সমূহ আশঙ্কা থাকে। কাজেই কলাম, বিমসহ অন্যান্য স্থানে পলিথিনের ব্যবহার এড়িয়ে চলা উচিত। এ ক্ষেত্রে বিকল্প হিসেবে বাজারে প্রাপ্ত পাতলা টিনের পাত ব্যবহার করা যেতে পারে।

বীমে ঢালাইয়ে পলিথিন

ছাদ পরিষ্কারকরণ
ছাদ ঢালাইয়ের আগে সাধারণত ছাদ পরিষ্কার করা হয়। এ ক্ষেত্রে দেখা যায়, ছাদ ধুয়ে সব ময়লা-আর্বজনা বিমে ফেলা হয়। বিম ধুয়ে আবর্জনাগুলো কলামের মাথায় রাখা হয়। অনেক ক্ষেত্রেই কলামের মাথা থেকে এই ময়লা-আবর্জনাগুলো ঠিকমতো পরিষ্কার করা হয় না। এর ওপরই ঢালাই করা হয়। এভাবে নতুন ও পুরোনো ঢালাইয়ের মধ্যে ময়লাগুলো বিভাজক হিসেবে কাজ করে। ফলে উভয় কংক্রিটের মধ্যে যথাযথ বন্ধন তৈরি হয় না। এভাবে নির্মিত স্থাপনা মারাত্মক ক্ষতিকর। ঢালাইয়ের আগে এ বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে।

রডের স্তর বিভাজক 
ছাদের ক্যান্টিলিভার ও বিমের পার্শ্ববর্তী অংশে সাধারণত দুই স্তরবিশিষ্ট রডের জালি থাকে। এ ক্ষেত্রে ওপরের জালিটি মুখ্য ভূমিকা পালন করে। ওপরের জালিকে ওপরে যথাযথ অবস্থানে রাখতে কংক্রিটের তৈরি ব্লক বা লোহার চেয়ার (Separator) ব্যবহার করা হয়। ছাদ ঢালাইয়ের সময় অনেকের হাঁটাচলায় ব্লকগুলো সরে যায়। ফলে ওপর ও নিচের জালি এক হয়ে যায়। এর ওপরই করা হয় ঢালাই। এটা কিন্তু মারাত্মক ভুল। রডের স্তর বিভাজক রেখে ওপরের জালিকে ওপরে রাখার জন্য অবশ্যই যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে।

কলাম নির্মাণ
ছাদ বা বিমের তুলনায় অনেক ক্ষেত্রে কলামকে বেশি স্ট্রেন্থ বিবেচনায় স্থাপনার ডিজাইন করা হয়। অনেক সময় দেখা যায় কলাম ঢালাই যথাযথ উচ্চতায় পৌঁছে না। অর্থাৎ কলামের ওপরতল বিমের তলা থেকে বেশ কয়েক ইঞ্চি নিচুতে থেকে যায়। এ ক্ষেত্রে সচরাচর বিম বা ছাদ ঢালাইয়ের সময় একই মসলা দিয়ে কলামের ঘাটতি অংশটুকু পূরণ করা হয়। এটা ঠিক নয়। এ ক্ষেত্রে আগে ব্যবহৃত কলামের সমশক্তিসম্পন্ন কংক্রিট দিয়ে কলামের ঘাটতি অংশটুকু পূরণ করা দরকার।

কলাম ঢালাইয়ে উচ্ছিষ্ট পদার্থ ও কলাম ঢালাইয়ে বেরুনো রড

নেগেটিভ জোনের রড
বিমের নেগেটিভ মোমেন্ট এলাকায় ওপরের রডের সঙ্গে সাধারণত আরও অতিরিক্ত রড (Extra Top) দেওয়া হয়। এই Extra Top রডগুলো অনেক সময় যথাযথ স্থানে থাকে না। মিস্ত্রিদের অবহেলায় তা নিচের দিকে নেমে নিউট্রাল জোনের কাছাকাছি চলে আসে। একই অবস্থা দেখা যায়, Extra Bottom Rod-এর ক্ষেত্রে। মিস্ত্রিদের অবহেলা বা অদক্ষতায় এটা ওপরে দিকে উঠে নিউট্রাল জোনের কাছাকাছি চলে যায়। এটা ওই বিম ধসসহ ভয়াবহ বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে।

কিউরিং
আরসিসি ঢালাইয়ের পর ওটাকে পানি দিয়ে নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত ভিজিয়ে রাখাকে কিউরিং (Curing) বলে। কিউরিং করলে সিমেন্টের শক্তি বৃদ্ধি পেয়ে এটি পূর্ণতা লাভ করে। সাধারণত ২৮ দিন পর্যন্ত কিউরিং করতে হয়ে। প্রায়শই দেখা যায়, ছাদ ঢালাইয়ের পর কলামের চারপাশ বাদ দিয়ে ছাদের অবশিষ্ট অংশে পানি জমিয়ে কিউরিং করা হয়। এতে ছাদের কিউরিং প্রাপ্ত অংশ শক্ত হলেও কলামের যে অংশ কিউরিং থেকে বাদ পড়ে তা দুর্বল রয়ে যায়। অথচ নিয়ম অনুসারে কলামের অংশটুকু বেশি শক্তিশালী হওয়া প্রয়োজন। নির্মাণের সময় এ বিষয়টি অবশ্যই সতর্কতার সঙ্গে দেখতে হবে।

ক্লিয়ার কভার
আরসিসি ঢালাইয়ে রড ব্যবহার করা হয়। ঢালাইয়ের বহিঃস্থ পৃষ্ঠ থেকে রড পর্যন্ত ন্যূনতম দূরত্বকে ক্লিয়ার কভার বলা হয়। বিম, ছাদ, কলাম সব জায়গাতেই ক্লিয়ার কভার রাখা হয়। সাইটে মিস্ত্রিদের অবহেলার কারণে অনেক সময়ই দেখা যায় কোথাও মাত্রার চেয়ে অনেক বেশি ক্লিয়ার কভার রাখা হয়েছে, কোথাও আবার খুবই কম রাখা হয়েছে। অনেক জায়গায় এমনো হয় যে ক্লিয়ার কভার মোটেই নেই। এ ধরনের অবহেলা একেবারেই গ্রহণযোগ্য নয়। নির্মাণ কোডে প্রতিটি আইটেমের জন্য নির্দিষ্ট মাত্রার ক্লিয়ার কভারের বিধান রয়েছে। এসব নিয়মাবলি অবশ্যই অনুসরণ করতে হবে।

কলামের রডের মাথায় ক্যাপ ও কলামের রডে প্লাস্টিক টেপ

রুফ হোয়েস্ট
উঁচু ভবনের ওপরের দিকে মালামাল ওঠাতে সাধারণত রুফ হোয়েস্ট মেশিন ব্যবহার করা হয়। আমাদের দেশে এটার যথেষ্ট প্রচলন রয়েছে। রুফ হোয়েস্টের পেছনের মই যত লম্বা হবে, ঝুঁকি তত কম হবে। এই মেশিন দিয়ে যখন নিচ থেকে ওপরের দিকে মালামাল উঠানো হয়, তখন মালামালের ভারে মেশিনটি উল্টে যেতে চায়। মেশিনের পেছনে লাগানো মইটি এই পড়ে যাওয়াকে রোধ করে। এই মইয়ের দৈর্ঘ্য যত বেশি হবে, প্রতিরোধক্ষমতাও তত বেশি হবে, যা নিরাপত্তার জন্য জরুরি। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, অনেকেই বিষয়টিতে নজর দেয় না। এ সুযোগে হোয়েস্টের প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান কম দৈর্ঘ্যবিশিষ্ট মই লাগিয়ে মুনাফা অর্জনের চেষ্ঠা করে। আমাদের দেশে রুফ হোয়েস্ট ভেঙে পড়ার বহু নজির রয়েছে। প্রকৌশলীদের এ বিষয়টি বিশেষ বিবেচনায় রাখতে হবে।

শাটারিং
কলাম, বিম, ছাদ ঢালাইয়ের জন্য কাঠ, বাঁশ, লোহার শিট, খুঁটি ইত্যাদি দিয়ে যে ফ্রেম বা ফর্মা তৈরি করা হয়। নির্মাণের এ অংশই শাটারিং। ঢালাইয়ের সময়ে বা পরে শাটারিং ভেঙে পড়ার বহু ঘটনা প্রায়শ ঘটে। বিশেষ করে বিম ও স্লাব ঢালাইয়ের সময় শাটারিংয়ের যে খুঁটি ব্যবহার করা হয়, তার আনুভূমিক সাপোর্ট থাকা দরকার। আনুভূমিক সাপোর্ট কম থাকলে অথবা যথাযথভাবে না থাকলে স্লাবের শাটার একদিকে হেলে পড়ে। স্টিল শাটারের ক্ষেত্রে এটা করা হয় আনূভূমিক রডের টানা দিয়ে। কিন্তু বাঁশের খুঁটি শাটারিংয়ে ব্যবহারের সময় তার আনুভূমিক টানা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেওয়া হয় না। এ ক্ষেত্রে খাড়া খুঁটির মাঝে মাঝে কিছু খুঁটিকে সামান্য হেলানো অবস্থায় রাখতে হয়। একটি খুঁটি যেদিকে হেলানো থাকবে অন্য খুুঁটিটি তার বিপরীত দিকে হেলানো থাকবে। হেলে থাকা খুঁটি স্লাবের শাটারকে হেলানোর বিপরীত দিকে পড়ে যাওয়া রোধ করে।

কলাম কিকার
কলামের এলাইনমেন্ট ঠিকঠাকমতো বসানোর জন্য মূল কলাম ঢালাইয়ের আগে অনেক সময় ওই কলামের কয়েক ইঞ্চি উচ্চতাসম্পন্ন অংশ বিশেষ ঢালাই করা হয়। এটাকে কলাম কিকার বলে। মূল কলামের শাটার আটকানোর জন্যও কলাম কিকার ব্যবহার করা হয়। এই কিকার কলামেরই অংশ। এটাকেও কলামের মতো গুরুত্ব দিয়ে ঢালাই ও কম্পাকশন করা উচিত। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, মিস্ত্রিরা মাল-মসলা কলামের মতো ব্যবহার করলেও কম্পাকশন কলামের মতো হয় না। ফলে এটা দুর্বল থেকে যায়। এ ধরনের কাজ অবশ্যই পরিহার করতে হবে। ঢালাই করতে হবে কিকারকে সমান গুরুত্ব দিয়ে।

অসম কিউরিং

ঢালাইকরণ
সাধারণত খোয়া, বালু, সিমেন্ট ও পানি মিশিয়ে ঢালাই করা হয়। এই ঢালাই কংক্রিট। ঢালাই কাজের কতগুলো ধাপ আছে। প্রতিটি ধাপই খুব গুরুত্বপূর্ণ। যেমন- বালু, খোয়া, সিমেন্ট, পানি ইত্যাদি উপাদান নির্দিষ্ট অনুপাতে মিশানো, মিক্সার মেশিন বা হেন্ড মিক্সিংয়ের মাধ্যমে যথাযথভাবে মেশানো, এই মিশ্রণকে যথাস্থানে ফেলা, কম্পাকশন করা প্রভৃতি। এসব ধাপের কোনোটিতে ত্রুটি থাকলে কংক্রিটের শক্তি যথাযথ হয় না। স্থাপনার জন্য সেটা কিন্তু মোটেই ভালো না। ঢালাইয়ের উপাদানগুলোর মিশ্রণের কথাই ধরা যাক। বালু ও খোয়া যেসব টুপরি দিয়ে নেওয়া হয় সেখানে দেখা যায় যে খোয়া টুপরির ওপরে খুব বেশি উঁচু করে নেওয়া সম্ভব হয় না। গড়িয়ে পড়ে যায়। কিন্তু বালু অনেক উঁচু করে নেওয়া সম্ভব। সাইটের লেবার, মিস্ত্রিরা সাধারণত তাড়াতাড়ি কাজ শেষ করার জন্য মাপজোকের তোয়াক্কা করে না। এক টুপরিতে সর্বোচ্চ যতটুকু বালু বা খোয়া ধরে, সে পরিমাণ তারা নিয়ে নেয়। এ ক্ষেত্রে ঢালাইয়ের শুরুতে প্রকৌশলীকে মিশ্রণের অনুপাত নির্ধারণের সময় এ বিষয়টিকে মাথায় রাখতে হবে। এরপর কত বস্তা সিমেন্টের সঙ্গে কত টুপরি বালু, পাথরশ্রমিকেরা মিশ্রিত করছে তা সঠিকভাবে সুপারভাইজার কর্তৃক হিসাব করতে হবে। তা না হলে উপাদানের অনুপাত হেরফের হয়ে কংক্রিটের মান নষ্ট হতে পারে।

বেশির ভাগ ঢালাই মিক্সার মেশিনে করা হয়। বালু, খোয়া, সিমেন্ট, পানি ইত্যাদি মিক্সার মেশিনে ফেলার পর তা পর্যাপ্ত বা নির্দিষ্টসংখ্যক বার ঘোরাতে হয়, যাতে উপাদানগুলো একে অপরের সঙ্গে খুব ভালোভাবে মেশে। অন্যথায় কংক্রিট মানসম্পন্ন হয় না। সিমেন্টের বস্তা খুলে মেশিনে ঢালার সময় অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় বস্তার কাগজের ছেঁড়া অংশ, সুতা ইত্যাদি সিমেন্টের সঙ্গে গিয়ে মিক্সার মেশিনে পড়ে। এটা রোধ করতে হবে। ঢালাইয়ের যথাস্থানের স্থাপনকে সহজ করার জন্য শ্রমিকেরা বেশির ভাগ সময়ই মাত্রার চেয়ে বেশি পানি ঢালাইয়ে দিয়ে থাকে। এতে ওয়াটার সিমেন্ট রেশিও বিঘ্নিত হয়ে কংক্রিটের মান নষ্টের সাথে সাথে শক্তিও হ্রাস পায়। এ বিষয়টি অবশ্যই নির্মাণ প্রকৌশলী তথা সংশ্লিষ্ট সবাইকে লক্ষ রাখতে হবে। কংক্রিটের মিশ্রণ কলাম, বিম বা ছাদ যেখানেই ঢালা হোক না কেন খেয়াল করতে হবে তার কম্পাকশন যেন ঠিকমতো হয়। মেকানিক্যাল ভাইব্রেটরের মাধ্যমে কম্পাকশন করার সময় দেখা যায় শ্রমিকেরা একটি নির্দিষ্ট অংশ কম্পাকশনের পরও সেখানে নজেল ধরে রাখে। এতে মিশ্রণের উপাদানগুলো আলাদা হয়ে যেতে পারে, যা ঢালাইয়ের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। এ বিষয়টি দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রকৌশলী বা সুপারভাইজারকে খেয়াল রাখতে হবে। এ কথা অপ্রিয় হলেও সত্য যে শ্রমিকেরা সেভাবে কোনো দায়িত্ব নিয়ে কাজ করে না অথবা তাদের এ সম্বন্ধে তেমন কোনো ধারণা নেই। সুতরাং ঢালাইয়ের ভার শুধু শ্রমিকদের ওপর দিয়ে রাখলে ও যথাযথ সুপারভিশন না করলে স্থাপনায় ঘটতে পারে যে কোনো ধরনের অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা।

অপরিসম ক্লিয়ার কভার (কোথাও বেশি আবার কোথাও মোটেও নেই)

টাইলস 
ভবনের ফিনিশিং পর্যায়ে টাইলস লাগানো হয়। ভবন অভ্যন্তরভাগে সৌন্দর্যবর্ধনসহ মেঝেকে ব্যবহারযোগ্য করার জন্য টাইলস অধুনা ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। আগে অবশ্য মেঝেকে মোজাইক করা হতো। বর্তমানে মোজাইক প্রায় উঠেই গেছে। সে স্থান দখল করেছে টাইলস। মেঝের টাইলস লাগানোর সময় মেঝের সঙ্গে মিল রেখে কয়েক ইঞ্চি উচ্চতার টাইলস দেয়ালের গায়েও লাগানো হয়। এটা স্কার্টিং টাইলস নামে পরিচিত। এই স্কার্টিং টাইলস দু’ভাবে লাগানো যায়। একটি দেয়াল ফ্লাশ করে। অপরটি  দেয়াল ফ্লাশ না করে। এ ক্ষেত্রে টাইলসের পৃষ্ঠতল দেয়ালের পৃষ্ঠ থেকে একটু বাইরে থাকে। দেয়াল ফ্লাশে টাইলস লাগাতে গিয়ে অনেক মিস্ত্রি দেয়ালের উভয় পাশ থেকে খানিকটা অংশ কেটে ফেলে। এতে দেয়াল দুর্বল হয়ে পড়ে। অবশ্য কর্তিত অংশে টাইলস লাগানোর সময় মসলা দিয়ে তা ভরাট করা হয়। তবে তা আগের মতো শক্তিসম্পন্ন হয় না। কাজেই টাইলস লাগানোর সময় দেয়াল কাটা পরিহার করতে হবে। 

প্রকৌশলী কামরুল হাসান
ই-মেইল:enkamrul@gmail.com

প্রকাশকাল: বন্ধন ৫৩ তম সংখ্যা, সেপ্টেম্বর ২০১৪

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top