ঢাকার পরিবেশগত অবক্ষয় ও উন্নয়ন (পর্ব-১)

ঢাকা ৪০০ বছরের বেশি পুরোনো ঐতিহ্যময় এক নগর। একসময় এখানে রাজত্ব করতো ঐতিহাসিক সেন-পাল বংশ। ঢাকার অদূরে বিক্রমপুর ছিল রাজা বিক্রমাদিত্যের রাজধানী। ভাওয়ালে ছিল সেনাপতি মানসিংহের রাজধানী আর সোনারগাঁও ছিল ঈশা খাঁর রাজধানী। সেই সময় বুড়িগঙ্গা-ধলেশ্বরী-শীতলক্ষ্যা -বালু-টঙ্গী-তুরাগ নদী পরিবেষ্টিত ব-দ্বীপ বাংলাদেশের ঢাকা শহরের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হতো বহু নদী-উপনদী। শহরজুড়ে চারপাশে নদীর সঙ্গে সংযুক্ত ছিল অনেক খাল। কারও কারও মতে, এর সংখ্যা ৬০-৬৫টির কম নয়। তখন বিভিন্ন জীব-বৈচিত্র্যে পরিপূর্ণ ঢাকার এসব খাল-উপনদীই ছিল শহরের প্রধান পরিবহন পথ। তন্মধ্যে অনেক ক্ষেত্রে খাল-ঝিলের নামেই হয় স্থানীয় জায়গার নাম। মতিঝিল, হাতিরঝিল এর কিছু নমুনা। কিন্তু ইতিহাসের পরিক্রমায় বিভিন্ন সময়ে ওই সব খাল-জলাশয়ের বেশির ভাগ দখল বা ভরাট হওয়ায় আজ তার বেশির ভাগের নামই হারিয়ে গেছে। হারিয়ে গেছে ওসব খালের ওপর নির্মিত পুল বা সেতুগুলোও। যেমন- তেজগাঁও এলাকায় কারওয়ান খালের ওপর ‘আম্বর সেতু’ ছিল। ধোলাই খালের ওপর সুন্দর ডিজাইনের ‘লোহার পুল’ ছিল, যার কোনোটির অস্তিত্ব আজ আর নেই। তবে কিছু বৃহদাকার খালের অবশিষ্টাংশ বা ধ্বংসাবশেষ এখনো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। যেমন-ধোলাই খাল, জিরানি খাল, মান্ডা খাল, ত্রিমোহনী খাল, নর্দা খাল, রামপুরা খাল, বোয়ালিয়া খাল, ইব্রাহিমপুর খাল, কল্যাণপুর, তেজগাঁও-বেগুনবাড়ী-কলাবাগান-ধানমন্ডি-ইব্রাহিমপুর- কল্যাণপুর খাল দিয়ে পশ্চিমে ছিল বালু তুরাগ নদীর সংযোগ। প্রকাশ, ভাওয়াল রাজা ময়মনসিংহ থেকে ধলেশ্বরী-পুংলী-বংশী নদী হয়ে এই খাল-নদী পথে ঢাকায় আসা-যাওয়া করতেন। ঢাকার অভ্যন্তরে তাঁর ছিল বিশাল এস্টেট, হাতিরঝিলে তাঁর ছিল হাতি বহরের আস্তাবল। ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আগমনের আগে পর্তুগিজরাও নাকি ওই নৌ-পথ দিয়েই ঢাকায় প্রবেশ করে। তেজগাঁও এলাকাটি তাদেরই সৃষ্ট বলে মনে করা হয়! সেই সময় এই নৌ-পথটি কত চওড়া ছিল তা আজকের হাতিরঝিল-বেগুনবাড়ী খালের (সোনারগাঁও হেটেলের দক্ষিণে পুনঃউন্নয়নকৃত) অবস্থা দেখলে সহজেই অনুমান করা যায়। 

রাতের মায়াবী আলোয় হাতিরঝিল
রাতের মায়াবী আলোয় হাতিরঝিল

ইতিহাসবিদদের মতে, হাতিরঝিল-তেজগাঁও এলাকাটায় তৎকালীন ঢাকা দ্বিখন্ডিত ছিল। বুড়িগঙ্গা-তুরাগ-বালু নদী থেকে বিভিন্নগুচ্ছে খাল প্রবাহিত হয়ে শহরের মধ্যখানে এই জায়গায় এসে মিশতো। অনুরূপ ঢাকার উত্তর পশ্চিম-পূর্ব-পশ্চিম থেকেও কয়েকগুচ্ছে খাল-ডোবা এই জায়গায় এসে মিলিত হয়েছিল। ব্রিটিশ-পাকিস্তান আমলে ওই নগর সীমানার (হাতিরঝিল-বেগুনবাড়ী খাল) উত্তরে নৌ-পথভিত্তিক তেজগাঁও শিল্প এলাকা এবং পশ্চিমে রায়ের বাজারে  শিল্প এলাকা গড়ে উঠেছিল (যা কালক্রমে ট্যানারি শিল্প এলাকায় পরিণত হয়)। সে সময় এই খাল-নদী পথের দুই ধারে বিভিন্ন পেশার লোকজনের বসতি ও ব্যবসা-বাণিজ্য গড়ে উঠেছিল। তন্মধ্যে মগবাজার, উলন, মালিবাগ, রামপুরা, দাসপাড়া, কামারপাড়া প্রভৃতি নামের জায়গাগুলো এখনো স্বমহিমায় দাঁড়িয়ে, যদিও এসব জায়গায় এখন আর সেসব বসতবাটির চিহ্ন নেই। দৃশ্যত, তখন অনেক মহল্লার নামও স্থানীয় খাল-ঝিলের নামে হয়েছিল। নিশ্চয় ওই রকম কোনো এক বাড়ি বা মহল্লার লোকজনের ‘বেগুন’ চাষকে কেন্দ্র করে হয়তো ‘বেগুনবাড়ী’ খালের নামকরণ করা হয়েছিল! পাকিস্তান আমলে তৎকালীন ‘শহর ঢাকা’র পশ্চিমে ধানখেতের জমিতে ‘ধানমন্ডি’ এলাকাটির পরিকল্পনা করা হয় এবং ধানমন্ডি খালের শাখা-প্রশাখার ওপর নির্মিত হয় ‘ধানমন্ডি লেক’। একইভাবে ভোলা খালের উপকণ্ঠে গুলশান-বনানী মডেল টাউন প্রতিষ্ঠা করা হয় এবং খালটির শাখা-প্রশাখায় গড়ে ওঠে গুলশান-বনানী-বারিধারা লেক। প্রথমদিকে এসব লেকসমূহ ছিল অনেক চওড়া, কিন্তু আমরা তা রাখতে পারিনি। এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে যদি তখন ঢাকার এসব খাল-নদীগুলোর ধারে সড়ক বা ফুটপাত এবং খালের ওপর ব্রিজ কিংবা সেতু নির্মাণ করে যোগাযোগব্যবস্থার সম্প্রসারণ ও রক্ষণাবেক্ষণ করা হতো, তাহলে আজ ঢাকা হয়তো কম-বেশি প্রাচ্যের ‘ভেনিস’ শহরের মতো সুন্দর হতো।

পাখির চোখে ঢাকার বিজয় সরনী
পাখির চোখে ঢাকার বিজয় সরনী

ঢাকার উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ
মূলত চতুর্দিকে নদী পরিবেষ্টিত ঢাকার বুড়িগঙ্গা নদীর ধারে ‘আদি ঢাকা’, টঙ্গী-তুরাগ নদীর ধারে টঙ্গী-মিরপুর-রায়ের বাজার, বালু ও শীতলক্ষ্যা নদীর ধারে নারায়ণগঞ্জ-ডেমরা-কাঁচপুর এবং উত্তর-পশ্চিমে বংশী নদীর পাশে সাভার-গাজীপুর এলাকা গড়ে ওঠে, এবং পর্যায়ক্রমে এসব জনবসতির সম্প্রসারণ ঘটতে থাকে। পুরান ঢাকা-তেজগাঁও-মিরপুর-সাভার-টঙ্গী-গাজীপুর ও উত্তর-পূর্বে মধুপর ট্রাস্টের প্রবাহিত কিছু এলাকা ব্যতীত সমগ্র ঢাকা অঞ্চল ছিল সার্বিকভাবে একটা নিচু এলাকা এবং খাল-নালা ও বিভিন্ন ধরনের জলাশয়ে পূর্ণ। এসব এলাকায় স্থানে স্থানে টিলা ও উঁচু জমিতে বিভিন্ন ধরনের পেশাভিত্তিক জনবসতি ও গ্রাম-মহল্লার সমন্বয়ে স্বতঃস্ফূর্তভাবে নগরায়ণের ব্যুৎপত্তি ঘটে। আর পুরান ঢাকা গড়ে ওঠে আঁকাবাঁকা এবং সরু রাস্তা ও অলিগলির মাধ্যমে। এ জন্য পর্যটকেরা ঢাকাকে ‘বায়ান্ন বাজার তেপ্পান্ন গলির শহর’ বলত, যে অবস্থা এখনো পুরান ঢাকায় বেশির ভাগ এলাকায় দৃশ্যমান। সে সময় ঢাকায় ছিল না কোনো যান্ত্রিক বাহন ও পাকা রাস্তা। নৌ-পথই ছিল প্রধান পরিবহন পথ। অবশ্য অবস্থাসম্পন্ন বাসিন্দারা ক্ষেত্রমতো গরু-ঘোড়ার গাড়ি বা হাতি দিয়ে চলাচল করত। ব্রিটিশ শাসনামলে শাসকশ্রেণীর পদস্থ কর্মকর্তা এবং তাঁদের সহযোগী ও ঢাকার নবাব পরিবারের লোকজনের পরিবহনের জন্য প্রথম ঢাকায় গাড়ি আসে। এ সময় থেকেই ঢাকায় নির্মিত হতে থাকে পাকা রাস্তা।

অন্যদিকে মোগল আমলে যুদ্ধবাজ শাসকদের যুদ্ধ-বিগ্রহের মধ্যে ঢাকা শহর উত্তর দিকে সমতল ও উঁচু ভূমিতে সম্প্রসারিত হতে শুরু করে। নবাব ইসলাম খাঁ কর্তৃক ঢাকায় বাংলার রাজধানী স্থাপন করার পর বুড়িগঙ্গা নদীর ওপারে জিনজিরা-কেরানীগঞ্জ এলাকায়ও শহরের সম্প্রসারণ ঘটে। কিন্তু বুড়িগঙ্গা নদীর ওপারে যাতায়াতে সমস্যা এবং শহরের পূর্ব-পশ্চিমে বিস্তীর্ণ নিচু জলাশয় ও বন্যা ঝুঁকির কারণে ঢাকার উত্তর দিকেই ঘটেছে বেশি বিস্তার। সেই সময়কার ঢাকার বিভিন্ন ধরনের তাঁত ও কারুশিল্প (মসলিন ইত্যাদি) বিশ্ববাজারে ব্যাপক আলোড়িত হয় এবং সমুদ্র-নদীপথে বহির্বিশ্বের সঙ্গে ঢাকার ব্যবসা-বাণিজ্যেরও ব্যাপক প্রসার ঘটে। ১৭০০ শতাব্দীর প্রথম দিক পর্যন্ত কম-বেশি ঢাকার ওই সমৃদ্ধ ধারা অব্যাহত ছিল। ঢাকার ওই সমৃদ্ধিতে মুগ্ধ হয়ে বিদেশি পর্যটক ও বণিকেরা তখন দেশটির প্রতি আকৃষ্ট হয়। এভাবে ইতিহাসের কালচক্রে ঢাকা একপর্যায়ে বিদেশি শাসকদের কব্জায় চলে যায়। মোগলদের হটিয়ে দেওয়ার পর দীর্ঘদিন (প্রায় দেড়শ বছর) ঢাকায় কোনো ধরনের উন্নয়ন হয়নি, তখন ঢাকা একটা জরাজীর্ণ ও রুগ্ণ শহরে পরিণত হয়। রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে মোগল আমলে নির্মিত ইমারত ও স্থাপনাগুলোর ধসে পড়তে শুরু করে।

নির্মাণাধীন ফ্লাইওভার
নির্মাণাধীন ফ্লাইওভার

তবে ব্রিটিশ শাসনামলের শেষদিকে দুটি বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে সেনাদের চলাচলের জন্য ঢাকায় নতুন রাস্তাঘাট ও অন্যান্য স্থাপনা নির্মাণ করা হয়। মোগল ও নবাব পরিবারের বিভিন্ন স্থাপনায় ব্যবস্থা করা হয় সরকারের উচ্চপদস্থ ব্যক্তিদের দপ্তর ও আবাসনের। দিলকুশার নবাববাড়ীতে পূর্ব বাংলার লর্ডসের দপ্তর কাম বাসস্থান করা হয় (যা আজকের বঙ্গভবন)। নগরের প্রতিরক্ষাব্যুহ সুদৃঢ় করার জন্য পর্যায়ক্রমে রাজারবাগে পুলিশ বাহিনী, পিলখানায় রাইফেলস বাহিনী, তেজগাঁও বিমানবন্দর ও বিমানবাহিনী, ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট এবং উত্তরে কুর্মিটোলা অ্যারোড্রাম প্রতিষ্ঠা করা হয়। পাশাপাশি তখন কিছু আবাসিক এলাকারও বিন্যাস ঘটে। ওয়ারী-স্বামীবাগ-গোপীবাগ, রমনা-পল্টন-ইস্কাটন ও মিন্টু-বেইলি রোড প্রাঙ্গণ এর অন্যতম। প্রসঙ্গত, ওয়ারীই ঢাকার প্রথম পরিকল্পিত আবাসিক এলাকা। এসব বিভিন্ন এলাকায় শহরের সামর্থ্যবান বাসিন্দাদের প্লট বরাদ্দসহ সেখানে পর্যায়ক্রমে সরকারি কর্মকর্তাদের জন্য আবাসন, প্রশাসনিক ভবন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা মেডিক্যাল হাসপাতাল, আহসানউল্লাহ সার্ভে ও ইঞ্জিনিয়ারিং স্কুল (আজকের বুয়েট) গড়ে ওঠে। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের তান্ডব ও ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে ঢাকার উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হয় আবারও।

অন্যদিকে ১৯০০ শতাব্দীর প্রথম দিকে ঢাকার সার্বিক পরিবেশের চরম অবক্ষয়ের মুখে ঢাকার পরিবেশগত উন্নয়নে সুপারিশ করার জন্য বিশিষ্ট ব্রিটিশ জীববিজ্ঞানী ও পরিকল্পনাবিদ স্যার প্যাট্রিক গ্যাডেসকে নিয়োগ দেয়া হয়। ১৯১৭ সালে তাঁর রচিত প্রতিবেদনে ঢাকার ভৌগোলিক ও সামাজিক পরিপ্রেক্ষিত, নগরের মহল্লাসমূহের উন্নয়ন, শিল্পায়ন সম্ভাবনা, খাল-নালা আর উন্মুক্ত স্থানাদি সংরক্ষণ প্রভৃতি বিষয়ে অনেক সুপারিশ ছিল। কিন্তু এসব সুপারিশমালার তেমন কোনো বাস্তবায়ন হয়নি। এর পেছনে অন্যতম কারণ ছিল প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো ও সমন্বয়ের অভাব। তখন শহরের উন্নয়ন, রাস্তাঘাট ইত্যাদির নির্মাণ করা হতো কেন্দ্রীয় সরকারের C&B Dept.-এর আওতায়, আর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নকরণসহ ড্রেনেজের দায়িত্বে ছিল স্থানীয় পৌর কমিটি ও জনস্বাস্থ্য বিভাগের ওপর। ১৯৬২ সালে ঢাকা ওয়াসা প্রতিষ্ঠার আগ পর্যন্ত ঢাকার খাল-নালা সংরক্ষণ বা সংস্কার কাজের জন্য সুস্পষ্টভাবে কারও দায়বদ্ধতা ছিল না। এর আগে ১৯৫৬ সালে পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকার নগর পরিকল্পনা প্রণয়ন ও উন্নয়ন নিয়ন্ত্রণের জন্য ঢাকা ইমপ্রæভমেন্ট ট্রাস্ট (ডিআইটি) প্রতিষ্ঠা করা হয়। সে অনুসারে ১৯৫৯ সালে ডিআইটি ঢাকার একটি মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন করে। কিন্তু তখনকার দেশের অস্থিতিশীল রাজনীতিতে ডিআইটির ওই মহাপরিকল্পনার বাস্তবায়ন ও ঢাকা ওয়াসার পক্ষে নগরের বেদখল ও মজে যাওয়া খাল-নালাগুলোর উদ্ধার ও সংস্কার করা সম্ভব হয়নি। অতঃপর স্বাধীনতার পর দীর্ঘদিন ধরে ঢাকায় খাল-নালা-জলাশয় দখলের মচ্ছব চলে। ওই অবস্থায় ঢাকায় সৃষ্টি হয় চরম জলাবদ্ধতা। ১৯৮৮ সালের ভয়াবহ বন্যার পর নগরের পয়োনিষ্কাশন ও ড্রেনেজ ব্যবস্থার সমন্বিত দায়িত্ব দেওয়া হয় ঢাকা ওয়াসার ওপর। নদী ও Regulating Ponds সংরক্ষণের দায়িত্ব পানি উন্নয়ন বোর্ডের ওপর, আর নৌ-পথ ড্রেজিং ও পরিচালনার দায়িত্ব বিআইডব্লিউটিএর ওপর। অন্যদিকে বরাবর দেশের খাল-নদীর পাড় বা জলাশয় বন্দোবস্ত প্রদান করে আসছে জেলা প্রশাসন। তথ্য মতে, বর্তমানে ঢাকার বিভিন্ন ধরনের উন্নয়নের সঙ্গে ৫৫টি সংস্থা বা প্রতিষ্ঠান ও মন্ত্রণালয় জড়িত, যার প্রেক্ষিতে ঢাকার পরিকল্পনা ও উন্নয়নে আজকের এই দুরবস্থা। এত সব সংস্থা বা মন্ত্রণালয়ের মধ্যে কোনো সমন্বয়ক বা Apex Body নেই। ফলে শুরু থেকে ঢাকার উন্নয়নে অসমন্বয় ও পরস্পরের মধ্যে দোষারোপের (Blame Game) অপসংস্কৃতি চলে আসছে।

লেক সিটি, খিলক্ষেত
লেক সিটি, খিলক্ষেত

ঢাকার পরিবেশগত অবক্ষয়
আগে ঢাকায় বসবাসরত অধিবাসীরা সরাসরি শহরে পুকুর-নদী-ঝিল-ডোবার পানি পান ও তা গৃহস্থালির কাজে ব্যবহার করত। ‘বন্যার সঙ্গে বসবাস’ অর্থাৎ Live with Floods ছিল নাগরিকদের জীবনদর্শন। নগর এলাকায় খাল-ঝিল-ডোবাগুলো ছিল মানুষের চিত্তবিনোদনের স্থান। খাল-নালা-নদী দিয়ে Gravity Flow শহরের বর্জ্য ও পয়োনিষ্কাশন হতো। প্রায় প্রতিবছর ঢাকায় বন্যা হতো, যাতে অনেকটা সহজেই শহরের ময়লা-আবর্জনা পরিষ্কার ও বিধৌত করা যেত। কিন্তু জনবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে অপরিকল্পিত বসতবাটি তৈরির আগ্রাসনে ময়লা-আবর্জনায় স্তূপ ও খাল-নালা-জলাধারগুলো ভরাট হয়ে বেদখল হচ্ছে। যার প্রেক্ষিতে নগরে উত্তরোত্তর সৃষ্টি হচ্ছে পরিবেশগত অবক্ষয় ও নগরবাসীর স্বাস্থ্য বিপর্যয়। বিভিন্ন সময় দেশের খাল-নদীর সংরক্ষণ ও পরিবেশগত উন্নয়নে অনেক আইন ও পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে, কিন্তু এসব আইন ও পরিকল্পনা বাস্তবায়নে যথাযথ কার্যকর ব্যবস্থা গৃহীত না হওয়ায় কাঙ্খিত ফল পাওয়া যায়নি। তন্মধ্যে Bengal Canal Act, Bengal Pond Act, ইমারত নির্মাণ আইন, পরিবেশ সংরক্ষণ আইন, জলাধার সংরক্ষণ আইন ইত্যাদির যথাযথ ব্যবহার করা গেলে ঢাকার আজকের এই অবস্থা হতো না।  

ঢাকার এই ভয়াবহ পরিবেশগত অবক্ষয়ের আরেকটি বড় কারণ, দেশের সবকিছু তত্ত্বা‘ঢাকামুখী’ হয়ে যাওয়া বা করে ফেলা। প্রথমত, বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের পর ভারত থেকে আগত উদ্বাস্তু ও সারা দেশ থেকে রাজধানীমুখী মানুষের স্রোতে রাতারাতি ঢাকার জনসংখ্যা দ্বিগুণ-ত্রিগুণে উন্নীত করে। ওই অবস্থায় যুদ্ধবিধ্বস্ত অর্থনীতিতে বঙ্গবন্ধু ও তৎপরবর্তী সরকারসমূহের আমলে ঢাকার পরিকল্পিত উন্নয়নে কিছু চেষ্টা চালালেও তেমন লাভ হয়নি। বরং পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে (১৯৭৫-এর আগস্টে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর) ‘নতুন রাজনৈতিক সমীকরণে’ ঢাকায় ভূমি দখলদারদের দৌরাত্ম্য অত্যধিক বেড়ে যায়। তার সঙ্গে ১৯৮৮ সালের বন্যার পর ঢাকাকে বন্যামুক্ত করতে গিয়ে সামরিক শাসক এরশাদের এক ‘তোঘলকি পরিকল্পনা’য় ঢাকার পরিবেশের ঘটে চরম বিপর্যয়। বন্যার পর পর ডিপ্লোমা প্রকৌশলীদের প্রস্তাবিত ‘স্বল্প খরচে বন্যা নিয়ন্ত্রণ’ প্রস্তাবের তড়িঘড়ি বাস্তবায়নের মাধ্যমে বুড়িগঙ্গা-বালু ও তুরাগ নদীর পাশ দিয়ে কোনো জায়গায় বন্যা নিয়ন্ত্রণ দেয়াল ও কোনো জায়গায় বাঁধ নির্মাণ করে চরম বিপর্যয়ের সৃষ্টি করা হয়। বলা যায়, সে থেকে শুরু হয় ঢাকার পূর্ব-পশ্চিমে বিস্তীর্ণ নিচু ও জলাভূমি দখলের মহোৎসব।

বেড়ি বাঁধ, আশুলিয়া
বেড়ি বাঁধ, আশুলিয়া

প্রসঙ্গক্রমে, ওই সময় আন্তর্জাতিক সহায়তায় প্রণীত জাতীয় Flood Action Plan-G ঢাকার বন্যা নিয়ন্ত্রণ পরিকল্পনাটি ছিল FAP-8. ওই পরিকল্পনায় ঢাকাকে পূর্ব-পশ্চিমে FAP-8A ও FAP-8B-তে বিভক্ত করে বিভিন্ন ধরনের সুপারিশ করা হয়। তন্মধ্যে   FAP-8B-এর পরিকল্পনাটির বাস্তবায়ন ঘটে। কিন্তু ওই পরিকল্পনার আত্মঘাতী কাজটি ছিল নগরের অভ্যন্তরে বিদ্যমান খালগুলো ভরাট করে বক্স কালভার্ট নির্মাণ করা। কাঁঠালবাগান-কলাবাগান খাল ও সেগুনবাগিচা খাল ভরাট করে বক্স কালভার্ট ও তার ওপর সড়ক নির্মাণ করা হয়। অন্যদিকে FAP-8A-এর আওতায় নগরের পূর্ব পাশে প্রস্তাবিত বাঁধের ভেতর তিন-চারটি Retention Basin স্থাপন বা নির্মাণের সুপারিশ ছিল। কিন্তু ঢাকার উত্তর-পশ্চিমে ‘গোরান চাঁদবাড়ি’ এলাকা ব্যতীত আর কোনো স্থানে Retention Basin করা হয়নি। অতঃপর সময়ের প্রেক্ষাপটে Retention Basin-এর জন্য সুপারিশকৃত নগরের পূর্বাংশের প্রায় জায়গা ভূমিদস্যুদের কবলে চলে যায়। এসব লোকজন এত প্রভাবশালী যে আজ অবধি তাঁদের এই অপকর্ম থেকে গণতান্ত্রিক সরকারকেও বিরত করতে বা রাখতে পারেনি। আবার কিছু ক্ষেত্রে এদের সঙ্গে যোগ হয় কিছু সরকারি প্রতিষ্ঠান ও তাদের ছায়া সংগঠন, যাতে গড়ে ওঠে বিভিন্ন সরকারি কর্মকর্তাদের আবাসন প্রকল্প। 

দেশের ধারাবাহিক রাজনৈতিক অস্থিরতা ও বিভিন্ন সংস্থা বা মন্ত্রণালয়ের মধ্যে সমন্বয়হীনতার সুযোগে এক শ্রেণীর প্রভাবশালী মহল কর্তৃক উল্লেখিত খাল-বিল বা প্রস্তাবিত Retention Basin এমনকি অনেকে নদী দখল করেও সেখানে হাউজিং প্রকল্প ও বড় বড় ইমারত নির্মাণ করছে। একদা হাজারীবাগে যেসব ছোট ছোট শিল্পস্থাপনা ছিল, সেখানে এখন দেশের সর্ববৃহৎ ট্যানারি শিল্প গড়ে উঠেছে, যার সব বর্জ্য সরাসরি তুরাগ ও বুড়িগঙ্গা নদী পড়ছে। এভাবে সময়ের প্রেক্ষাপটে ঢাকার নদী চতুষ্টয়ের ধার কিংবা  জমি দখল করে নির্মিত হয়েছে বিভিন্ন ধরনের শিল্প, যার একটিতেও Effluent Treatment Plant (ETP) বা অন্য কোনো দূষণ নিরোধক ব্যবস্থা নেই। ফলে বর্তমানে ঢাকার চারপাশের নদীগুলোর পরিবেশ বিশেষত তুরাগ, বুড়িগঙ্গা ও বালু নদীর অবস্থা ভয়াবহ। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে বিগত এক দশকের বেশি সময় ধরে হাজারীবাগের ট্যানারি শিল্পগুলো সাভারে স্থানান্তরের উদ্যোগ নেওয়া হলেও অদ্যাবধি তা সরানো যায়নি। সব মিলে বর্তমানে পুরো ঢাকাই এক ভয়াবহ পরিবেশদূষণের কবলে। ফলে ওয়াসার পক্ষে আশপাশের নদীসমূহ থেকে পানি সংগ্রহ ও Treatment করে তা নগরবাসীকে সরবরাহ করা সম্ভব হচ্ছে না, নিতে হচ্ছে বহুদূরের মেঘনা-পদ্মা নদী থেকে পানি সংগ্রহের পরিকল্পনা। পাশাপাশি নগরবাসীকে ঘরে ঘরে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ (Rainwater Harvesting) করার জন্যও বলা হচ্ছে, যদিও বর্ষাকালে বাড়ির পানির ট্যাংকে বৃষ্টির পানি সংগ্রহ ও ধারণ করে তা সারা বছর ব্যবহার করা যাবে কি না, তা বরাবরই একটা বিতর্কিত বিষয়! অনুরূপভাবে খুবই খারাপ অবস্থা ঢাকার পয়োনিষ্কাশনের। অদ্যাবধি সমগ্র নগরজুড়ে ঢাকা ওয়াসার পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থার বিস্তার ও সংযোগ প্রদান সম্ভব হয়নি। ফলে নগরের অনেক জায়গা সারা বছরই পয়ো ও বর্জ্য পানিতে ডুবে থাকে। 

অবিশ্বাস্য মনে হলেও সত্য যে মাত্র কয়েক দশক আগেও তেজগাঁও-বেগুনবাড়ী খাল ও হাতিরঝিলের সঙ্গে ভোলা খালের শাখা-প্রশাখার মাধ্যমে শাহজাদপুর-কুড়িল এলাকার বিস্তীর্ণ জলাভূমি দিয়ে বোয়ালিয়া খাল হয়ে বালু নদীর যোগাযোগ ছিল। ওই পথ দিয়ে প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ায় আশপাশের পয়ো ও বর্জ্য পানি নিষ্কাষিত হতো। কিন্তু আজ বোয়ালিয়া খালটি অস্তিত্বহীন। আশির দশকে চোখের সামনে তখনকার বিশিষ্ট শিল্পপতি জহুরুল ইসলাম কর্তৃক গুলশানের দক্ষিণ-পশ্চিমে বিস্তীর্ণ জলাভূমি ভরাট করে ‘নিকেতন’ এলাকাটি গড়ে ওঠে। ‘নিকেতন’ এলাকা প্রতিষ্ঠার পর ক্যান্টনমেন্ট-মহাখালী এলাকাসহ আরও অনেক এলাকার পয়োনিষ্কাশন হয় বাধাগ্রস্ত। তথাপি ওই ধারাবাহিকতায় জহুরুল ইসলাম কর্তৃক ‘বনশ্রী-আফতাবনগর’ গড়ে তোলা হয়। ফলে ঢাকার পূর্বদিকের অনেক খালই বিলীন হয়ে যায়। অনুরূপ বোয়ালিয়া খালসহ নগরের উত্তর-পূর্বদিকের অন্য খালগুলো ভরাট করে প্রভাবশালী ভূমিদস্যু কর্তৃক ‘বসুন্ধরা’ প্রকল্পটি গড়ে তোলা হচ্ছে। এভাবে এলোপাতাড়ি উন্নয়নের কারণে নগর অভ্যন্তরে কংক্রিট জঙ্গলের সৃষ্টি হয়ে ঢাকায় পানির লেভেল অস্বাভাবিকভাবে নিচে নেমে যাচ্ছে। পয়োনিষ্কাশনব্যবস্থাও এক ভয়াবহ পরিণতির দ্বারপ্রান্তে। ফলে ঢাকায় এখন বৃষ্টি না হতেই সৃষ্টি হচ্ছে জলাবদ্ধতা, ভয়াবহ যানজটের।

বেহাল দশায় বাকল্যান্ড বাঁধ
বেহাল দশায় বাকল্যান্ড বাঁধ

অথচ গুলশান-বনানী মডেল টাউন প্রতিষ্ঠাকালে এর লেকগুলো ছিল অনেক চওড়া। আর সামরিক শাসক এরশাদের আমলের ঘটে এর সর্বনাশ। ওই ধারাবাহিকতায় নগরের উত্তর দিকে সেনাবাহিনী কর্তৃক বিস্তীর্ণ জলাভূমি ভরাট করে ‘বারিধারা ডিওএইচএস’ আবাসিক এলাকাটি প্রতিষ্ঠা করা হয়। যখন নগরের পরিকল্পক ও নিয়ন্ত্রক সংস্থা খোদ রাজউকও বিমানবন্দর সড়কের পশ্চিমে জোয়ার সাহারার নিচু এলাকাটি ভরাট করে সেখানে ‘নিকুঞ্জ’ উপশহর প্রতিষ্ঠা করেছে। এভাবে সরকারি-বেসরকারি উভয় পর্যায়ে অনেকটা প্রতিযোগিতা দিয়েই নগরের আবাসন সমস্যা নিরসনের নামে নতুন নতুন শহর-উপশহর নির্মাণ করে ঢাকাকে আজকের অবস্থায় আনা হয়েছে। তবে সম্প্রতি বেগুনবাড়ী খালের অংশবিশেষসহ হাতিরঝিলের পরিকল্পিত উন্নয়নের মাধ্যমে নগরবাসীর বিনোদনের জন্য একটা দারুন স্পেস তৈরি করা হয়েছে। এভাবে আরও কিছু প্রকল্প গ্রহণের মাধ্যমে এখনো ঢাকার পরিবেশের চরম অবক্ষয় রোধ করা সম্ভব।  

মো. এমদাদুল ইসলাম
প্রধান প্রকৌশলী, রাজউক।

প্রকাশকাল: বন্ধন ৫৩ তম সংখ্যা, সেপ্টেম্বর ২০১৪

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top