৭৫ কিলোমিটার দীর্ঘ এক রেলপথ। এটা বড় কথা নয়। এই রেলপথের কিছু অংশ মাটিতে, কিছু মাটির নিচে, আর বেশিরভাগই বাতাসে…। মানে উড়াল সেতু আর কি! এ আর এমনকি গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ড বুকসে নাম ওঠানোর জন্য। কিন্তু দুবাইয়ের এ মেট্রো রেলপথ কিন্তু ঠিকই নাম লিখিয়েছে গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ড বুকসে। জানতে চান, কিভাবে? তবে খুলেই বলি। সংযুক্ত আরব আমিরাতের প্রাণকেন্দ্র দুবাইয়ের প্রধান প্রধান এলাকা ছুঁয়ে যাওয়া ৭৫ কিলোমিটার দীর্ঘ এই রেলপথে ট্রেন চলে বিরামহীনভাবে; কিন্তু সেসব ট্রেনে নেই কোনো চালক! হ্যাঁ, পাঠক ঠিকই পড়েছেন/বলছি, কোনো চালক ছাড়াই চলছে দুবাইয়ের মেট্রোরেলের ট্রেনগুলো।
শুরুটা যেভাবে
চলুন ফিরে যাই বেশ কিছুটা সময় পেছনে। সময়টা ২০০১ সাল। এ বছর থেকেই দুবাইয়ে প্রায় দেড় কোটি পর্যটক আসছে এ শহরের সৌন্দর্য উপভোগ করতে। এমন তথ্য উপাত্ত পাওয়ার পর দুবাইয়ের শাসক শেখ মোহাম্মদ বিন রশিদ আল মাখতুম এখানকার পর্যটন শিল্পকে আরো শক্তিশালী করার উদ্যোগ নেন। এই দেড় কোটি পর্যটক যাতে স্বচ্ছন্দে সারা বছর দুবাই ঘুরে বেড়াতে পারে সে জন্য বড় পরিসরের পরিবহন ব্যবস্থার কথা চিন্তা করলেন। কিন্তু দুবাইয়ে তো জায়গা খুব কম। নতুন রাস্তা করতেও দরকার যে পরিমাণ ফাঁকা জায়গা তাও পাওয়া যাবে না আর। এ অবস্থায় এগিয়ে এলেন দেশসেরা মেধাবী প্রকৌশলীরা। শেখ মোহাম্মদ বিন রশিদ আল মাখতুমকে তারা শোনালেন এমন এক মেট্রোরেল ব্যবস্থার কথা, যার বেশিরভাগই থাকবে মাটির নিচে, নইলে বাতাসে। অর্থাৎ একটুও জায়গা নষ্ট না করে কাজের কাজ হবে ঠিকই। আমিরাতের খলিফা আল মাখতুম এটুকুতেই সন্তুষ্ট হলেন না। তিনি এতে আরো নতুন চমক যোগ করতে বললেন। আর এ সময়ই শেখের মাথায় এলো নতুন এক চিন্তা। পুরো রেলপথে মিনিটে মিনিটে ট্রেন চলবে। কিন্তু সব ট্রেনই হবে স্বয়ংক্রিয়। মানে কোনো চালক থাকবে না! সময়মতো ট্রেন আসবে আর যাবে। সব সময় নির্দিষ্ট এক গতিতে চলবে, স্টেশনে এলে নিজে থেকেই দরজা খুলে যাবে, আবার ঠিক সময়ে দরজা বন্ধও হবে নিজ থেকেই।
স্বপ্নপূরণের পথে…
কর্মপরিকল্পনার শুরুতে এর নির্মাণ ব্যয় ধরা হয়েছিল ৪.২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। কিন্তু কাজ শুরুর আগ মুহুর্তে এর ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ৭.৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে। তবে খরচ এমনি এমনি বেড়েছে তা বললে ভুল হবে। খরচ বাড়ার কারণ নকশায় আরো নতুন বিষয় যুক্ত হওয়া। যা হোক ২০০৬ সালের ২১ মার্চ শুরু হয় এই মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের কাজ। এরপর ২০০৯ সালে বিশ্ব মন্দার কারণে কিছু দিনের জন্য থমকে দাঁড়ায় এর কাজ। এরপর আবার কাজ শুরু হয়ে উদ্বোধন করা হয় একটা মজার সময়ে। সময়টা হলো ২০০৯ সালের নবম মাস, মানে সেপ্টেম্বরের ৯ তারিখের সকাল ৯টা বেজে ৯ মিনিট ৯ সেকেন্ডে! তবে তখনও/এখনও এর সম্পূর্ণ কাজ শেষ হয়নি। লাইনের কাজ সম্পূর্ণ শেষ হলেও অনেকগুলো স্টেশনের কাজ তখনও/এখনও বাকি। অবশেষে এ বছর তথা ২০১২ সালে এর কাজ শেষ হচ্ছে।

কী রয়েছে এতে
২ লাইন বিশিষ্ট ৭৫ কিলোমিটার দীর্ঘ এ রেললাইনটির বেশিরভাগই উড়ন্ত। এখন যদিও বা দুটি লাইন রয়েছে কিন্তু অদূর ভবিষ্যতে এখানে আরো তিনটি লাইন বাড়ানোর পরিকল্পনা রয়েছে সংশ্লিষ্টদের। কারণ বিশেষজ্ঞদের হিসাবে ২০১৭ সাল থেকে প্রতি বছর দুবাইয়ে ৩ কোটি পর্যটক আসবে! এই রেলপথ আপাতত দুটি অংশে বিভক্ত। একটি রেড লাইন আর অপরটি গ্রীন লাইন। অচিরেই ব্লু লাইন, ইয়েলো লাইন ও পার্পেল লাইন নামে আরো তিনটি লাইনের সাথে যুক্ত হবে। এখন অবধি ৬০টির বেশি স্টেশন চালু হয়েছে এই মহা প্রজেক্টে। সামনে এ সংখ্যা আরো বাড়ানো হবে। এ ভাষ্য এর রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে থাকা দুবাই সড়ক ও পরিবহন কর্তৃপক্ষের (আরটিএ) চেয়ারম্যান মাত্তার আল তায়েরের। আপাতত এ রেলপথে চলছে ৮৭টি মেট্রোরেল। যার প্রত্যেকটিতে রয়েছে পাঁচটি করে বগি। পাঁচটি বগির একেকটি ট্রেন একবারে ৬৪৩ জন যাত্রী পরিবহনে সক্ষম। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ট্রেনের অভিজাত সব বগির নির্মাতা জাপানের কিনকি শারিও কোম্পানি। প্রতি বগির আসন বিন্যাস বিভিন্ন ধাঁচের। যাত্রীরা চলার পথে বিনামূল্যে ওয়াই-ফাইয়ের সাহায্যে ইন্টারনেট ব্যবহার করতে পারবেন। প্রতিবন্ধীদের জন্য প্রত্যেক বগিতেই রয়েছে হুইল চেয়ার। দুবাই মেট্রো রেলপথের প্রতিটি স্টেশনই চমৎকার স্থাপত্যশৈলীতে বানানো। সব স্টেশনই শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত। স্টেশনেও খুব বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হয় না। কেননা সাত মিনিট পর পর দেখা মিলবে মেট্রোরেলের।
টিকিট কাটবেন যেভাবে
টিকিট কেনাটাও খুব সহজ। একটু চিন্তা করলেই বুঝবেন, যে ট্রেনে কোনো চালক নেই, সব কিছুই হয় স্বয়ংক্রিয়ভাবে সেখানে নিশ্চয় টিকিটিং ব্যবস্থাও হবে স্বয়ংক্রিয়। ঠিক তাই! দুবাই মেট্রোতে ভ্রমণের জন্য আপনার একটি নিও কার্ড থাকতে হবে। এই কার্ড স্টেশনের দরজায় ছোঁয়ালেই দরজা খুলে যাবে আর আপনার নিও কার্ডের তথ্য জমা হবে কেন্দ্রীয় সার্ভারে। তারপর সোজা উঠে যাবেন ট্রেনে। এরপর ট্রেন থেকে স্টেশনে নেমে স্টেশনের দরজায় আবার ছোঁয়াতে হবে কার্ড। তা হলেই স্বয়ংক্রিয়ভাবে আপনার ভাড়া কেটে রাখবে কম্পিউটার। আর এমন যদি হয় ট্রেন ধরতে হবে অথচ আপনার নিও কার্ডে টাকা নেই। তা হলেও কোনো সমস্যা নেই। কারণ প্রতি স্টেশনেই রয়েছে কার্ডে টাকা তোলার স্বয়ংক্রিয় যন্ত্র।
মেট্রোরেল চলে যেভাবে
স্বয়ংক্রিয় মেট্রোরেলগুলো চলে বিদ্যুতে। এতে নেই কোনো চালক কিন্তু তবুও এগুলো দুর্ঘটনার ঝুঁকিমুক্ত। কারণ ট্রেনগুলো সব সময় নিজেদের মধ্যে নির্দিষ্ট দূরত্ব রেখে চলে। একই লাইনে দুটি ট্রেনের মধ্যবর্তী নিরাপদ দূরত্ব কমে এলে পেছনের ট্রেনটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে থেমে যায়। আর যে কোনো ধরনের বিপদ মোকাবেলায় পুরো মেট্রোরেল ব্যবস্থায় রয়েছে প্রায় ৩ হাজার ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরার নিরাপত্তা জাল। কোথাও কোনো অনিয়ম ধরা পড়লেই ছুটে যায় নিরাপত্তা বাহিনী।
কিছু নিয়ম-কানুন
দুবাই মেট্রোরেলে কিছু নিয়ম-কানুন মেনে চলতে হয়। যেমন কোনো পোষা প্রাণী নিয়ে ওঠা যাবে না এতে। বহন করা যাবে না অস্ত্র। চুইংগাম বা পানীয় বহন নিষিদ্ধ। এসব করতে গিয়ে ধরা পড়লে রয়েছে চড়া জরিমানা।
শেষের আগে
ধারণা করা হচ্ছে, পরের ১০ বছরে এ রেলপথ থেকে প্রায় ৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় হবে কর্তৃপক্ষের। তবে দুবাই শাসক শেখ মোহাম্মদ বিন রশিদ আল মাখতুম জানিয়েছেন, দুবাই মেট্রো থেকে কোনো ধরনের আর্থিক লাভের পরিকল্পনা তাদের নেই; কেননা এটি পর্যটকদের সুবিধার জন্য বানানো হচ্ছে। আর প্রতি বছরই এতে ভর্তুকি দেবে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। দুবাই মেট্রোরেলের সব চাইতে সুবিধাজনক দিক হচ্ছে এর প্রতিটি স্টেশনের সাথে যুক্ত রয়েছে বাস ও ট্যাক্সিস্ট্যান্ড। মানে রেল থেকে নেমেই যে কোনো প্রান্তে ছুট দেওয়া যাবে। দুবাই শহরকে যদি কেউ একটু অন্যভাবে দেখতে চায় তা হলে তাকে অবশ্যই এই মেট্রোরেলে চড়তেই হবে। কারণ দুবাইয়ের সব চাইতে সুন্দর সুন্দর অংশের দেখা মিলবে এ রেলপথে।
এক নজরে দুবাই মেট্রো
দৈর্ঘ্য- ৭৪.৬ কিলোমিটার
লাইন- ২টি
ট্রেন সংখ্যা- ৮৭টি
বগি (প্রতি ট্রেনে)- ৫টি
এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে যেতে সময় লাগে- ১ ঘণ্টা ২৫ মিনিট
নির্মাণ ব্যয়- ৭.৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।
ফয়সাল হাসান সন্ধীই-মেইল : [email protected]
প্রকাশকাল: বন্ধন ২৪ তম সংখ্যা, এপ্রিল ২০১২