কক্সবাজার ইনানি সমুদ্রসৈকত লাগোয়া ‘’ওশান কিচেন’’। এই স্থাপত্যটি নির্মাণ করেছেন স্থপতি আহমেদ সিফাত ও তাঁর সহযোগী স্থপতিবৃন্দ। স্থাপত্য প্রতিষ্ঠান আহমেদ সিফাত আর্কিটেক্টস- এর ত্বত্তাবধানে নির্মিত ওশান কিচেন নির্মাণে আরও ছিলেন স্থপতি মাহবুবা আফরিন ও ফারদুল্লাহ খান মুবিন। এই প্রকল্পটি ছিল আরিফুর রহমানের সঙ্গে আহমেদ সিফাতের তৃতীয় প্রজেক্ট। স্থপতি আহমেদ সিফাত, স্থপতি মাহবুবা আফরিন ও ফারদুল্লাহ খান মুবিন তিনজনই ছিলেন চট্টগ্রাম প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (চুয়েট) শিক্ষার্থী এবং কাজ করছেন একসঙ্গে। ক্লায়েন্ট, নির্মাণশিল্পী এবং স্থপতির চিন্তার মেলবন্ধনের অনন্য এক উদাহরণ ওশান কিচেন। সাইটের মাস্টারপ্ল্যানে আরও নানা কাজ থাকলেও প্রথম ধাপে পূর্ণাঙ্গভাবে একটা রেষ্টুরেন্ট এই রিসোর্টের ভেতর ও বাইরের ব্যবহারকারীদের জন্য নির্মাণ করা হয়েছে।
মূলত এই ওশান কিচেনের কনসেপ্ট ও নির্মাণ বিষয়ে স্থপতির চিন্তাভাবনা ও তার প্রয়োগ সম্পর্কে জানা ও জানানোর চেষ্টা করেছেন স্থপতি সুপ্রভা জুঁই।
আগের প্রকল্প দুটিতে স্থপতি কাঠের কাঠামোর কাজ করেছেন এবং আঞ্চলিক নির্মাণশিল্পীরা কীভাবে কাজ করেন, কাঠের জয়েন্ট পদ্ধতিগুলো কেমন, ডিজাইন কেমন হলে তাদের পক্ষে নির্মাণ সহজ হতে পারে এগুলোর অনুসন্ধান করে স্থাপত্য সম্পন্ন করেছেন। ফলে এই প্রকল্পে এসে সমুদ্রপারের চমৎকার এই সাইটটা দাবি করে নতুন কিছুর। যেহেতু আশপাশে অনেক ফাইভ স্টার হোটেল, তাই সুন্দর প্রকৃতিকে ধারণ করতে একটা সহজ কিন্তু চমকপ্রদ স্থাপনা এখানে ভাবা যেতে পারে। স্থপতির বরাবর পছন্দ রিসাইকেল ম্যাটেরিয়াল ব্যবহার করা। পাশাপাশি তাঁর কাজে প্রাকৃতিক উপকরণের প্রাধান্য বিশেষভাবে লক্ষণীয়। ফলে অর্থনৈতিক, পরিবেশগত এবং নান্দনিক সব বিষয় এই চিন্তাদর্শনে অর্জিত হয়।
ওশান কিচেনের ঠিকানা সমুদ্র, তাই সমুদ্রের বহুমাত্রিক জায়গাটাকে স্থাপত্যের মাঝেও ধারণ করার ইচ্ছা স্থপতির মনে থেকেছে। সাগরের ঢেউয়ের যে উচ্ছলতা, সেটিকে কনসেপ্টের মূলে ভাবতে চেয়েছেন স্থপতি। ঢেউয়ের বহমানতাকে রেস্টুরেন্টের ভেতরে যেন ব্যবহারকারীরা বোধ করতে পারেন সে রকম একটা ডিজাইন ভাবনাকেই যুক্তিসংগত মনে করা হয়েছে, যাতে সমুদ্রের আমেজটা থাকে। এতে মানুষজন এমনিতেই বুঝতে পারে এই রেস্টুরেন্টে সি ফুড পাওয়া সম্ভব বা সমুদ্রের সঙ্গে এর একটা নিবিড় সম্পর্ক আছে।

কতগুলো বিষয় স্থপতির ডিজাইন দর্শনে সরাসরি ভূমিকা রেখেছে। যেমন-
- রিসাইকেল ম্যাটেরিয়ালের ব্যবহার
- উড জয়েনারি ও মেটাল ওয়ার্ক
- রেষ্টুরেন্ট কম্পাউন্ডটা উন্মুক্ত হবে
- একটা বড় ক্যান্টিলিবার ছাদ, যাতে যথেষ্ট ছায়া আসে
- কোনো এসি বা দেয়াল ও ফলস সিলিং থাকবে না
- খাবার উপভোগের পাশাপাশি যেন সমুদ্র দেখা ও ঢেউয়ের শব্দ শোনা যায়
- সমুদ্রের বাতাস যেন আগতদের শরীর ও মন ছুঁয়ে যায়।
এই চিন্তাদর্শনকে একত্রীভ‚ত করার জন্য স্থপতি ঠিক করলেন কলামের সংখ্যা যতটা সম্ভব কম করা, যাতে একটা উন্মুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করা যায়। সেই সঙ্গে হালকা উপকরণের ব্যবহার করা যেন কংক্রিটের ভাবটা ভবনে না থাকে। এমনকি কলামগুলো স্টিলের না করে ন্যাচারাল ম্যাটেরিয়াল হিসেবে কাঠকে বাছাই করা হয়েছে যেন সমগ্র ব্যাপারটা আরোপিত না হয়ে যায়। মেরিন ড্রাইভ থেকে যত পেছনের দিকে ভবনটা যাচ্ছে, ততই একটু একটু করে ওপরের দিকে উঠে গিয়েছে। রেষ্টুরেন্টের প্রতিটা কোনা থেকে যেন সমুদ্রকে সম্পূর্ণ উপভোগ করা যায়, সে জন্য এই সিদ্ধান্তটিকে কার্যকর করা হয়েছে। একটা ঢালাও সমান্তরাল পাটাতনে এই বিষয়টা নিশ্চিত করা সম্ভব হতো না। তাই তিন রকমের উচ্চতার যে তিনটি স্পেস তৈরি করা হয়েছে, এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং স্থপতি যে তার চাওয়া-পাওয়া সম্পর্কে নিশ্চিত ও তা হাসিল করতে চান, সে বিষয়টি আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ফলে চিন্তার সততার প্রকাশ ডিজাইন আসার মধ্য দিয়ে এক অনবদ্য সৌন্দর্য প্রকাশ পায়।
ভবনের অভ্যন্তরীণ বিষয়গুলোও স্থপতি সম্পন্ন করেছেন। সেখানে হস্তশিল্পের নানা পণ্য দিয়ে সাজানো হয়েছে। তবে ডাইনামিক এই ছাদটা করা হয়েছে মেটাল দিয়ে। কাঠের ট্রাস বিমের ওপরে মেটাল রিব দিয়ে ডিজাইন করে কাঠামোটা নির্মাণ করা হয়েছে। ম্যাটেরিয়ালে কাঠের পরিমাণ বেশি যেহেতু বিশাল ট্রাস বিম এবং কলাম পুরোটাই কাঠের তৈরি। মাঝখানে কেবল দুই রো কলাম, এ ছাড়া দুই পাশে ১২ ফুটের বিশাল ক্যান্টিলিবার। ফলে এই বিশাল ছাদটা এই কাঠামোর ওপরেই দাঁড়িয়ে আছে এবং কাঠের এই স্ট্রাকচারে কিছু ধাতব কাঠামো জুড়ে দিতে হয়েছে, যেটা কাঠামোকে আরও শক্ত করে। ট্রাস বিমের ক্ষেত্রে রেস্টুরেন্টে খাবার জায়গায় এবং রান্নাঘরের জায়গায় আলাদা ডিজাইন করা হয়েছে প্রয়োজন অনুসারেই। খাওয়ার অংশের বিমে ক্যান্টিলিবার বেশি দেখা যায়। এখানে বিমের মোট ৫টা সেকশন ডিজাইন করা হয়েছে। আঞ্চলিক নির্মাণশিল্পী যারা আছেন, তারা যেহেতু এমন কাঠামো বানাতে অভ্যস্ত নন, তাই গাণিতিক সঠিক মাপ অনুযায়ী এই ডিজাইনটা করা হয়েছে, যেটা দেখে এবং বুঝে ঠিক এই মাফিক বিম ও কলাম বানিয়ে তারা নির্মাণকাজটি সম্পন্ন করেছেন। যেহেতু ৫টা সেকশনই বারবার রিপিট হয়েছে উঁচু-নিচুর মধ্য দিয়ে, ফলে ঢেউতোলা ছাদটি যেমন সুনিশ্চিত হয়েছে তেমনি নির্মাণকর্মীদের জন্যও কাজটি বোঝা সহজতর হয়েছে। ফলে নির্মাণকর্মী সামগ্রিক ঘটনা না বুঝলেও ড্রয়িংটা দেখে বানিয়ে ফেলতে পেরেছে বলেই কাজটা করা গেছে আর ছাদের পাশাপাশি স্ট্রাকচারটিও বহুমাত্রিক হতে পেরেছে।

সাধারণত এমন স্ট্রাকচার নিয়ে কাজ করতে স্থপতিদের দেখা যায় না। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে স্থপতি আহমেদ সিফাত বলেন, শিক্ষাজীবন থেকেই তিনি স্ট্রাকচার এবং স্থাপত্যের মেলবন্ধন করে চিন্তা ও কাজ করতেন। যেহেতু তিনি ঠিক করেছিলেন যে ছাদে একটা ডাইনামিক ব্যাপার আনবেনই, ফলে সেটা গাণিতিকভাবে এবং নির্মাণকৌশল দিয়েও সমাধান করেছেন। অর্থাৎ যা এখানে হওয়ার কথা বা সাইট ও প্রকল্প যেটা ডিমান্ড করছে, সেটার বাস্তবায়নে তিনি কোনো আপস করেননি। স্থপতি হিসেবে নির্মাণের এই দিকটিতে যে আলাদা ঝোঁক তিনি তৈরি করেছেন, এটা আগামীর স্থপতিদের জন্য একটা বিশেষ ঘটনা হয়ে থাকবে। হলফ করেই বলা যায়, একাডেমিক শিক্ষার বাইরে তাঁর নিজস্ব আগ্রহের কারণেই বিষয়টা সম্ভব হয়েছে। ডিজাইনকে আরও কমপ্লেক্স ও ডাইনামিক করে কাজ করা সম্ভব ছিল কিন্তু তার জন্য যে দক্ষ নির্মাতা প্রয়োজন, সেটি তাদের ছিল না। পাশাপাশি এর জন্য মেটাল ফ্যাক্টরির সঙ্গে যে লিয়াজোঁ রেখে লম্বা সময় ধরে কাজ করতে হতো তাতে খরচ ও সময় বৃদ্ধি পাচ্ছিল। ফলে ক্লায়েন্টের সঙ্গে আলাপ করে বাস্তব অবস্থা বিবেচনা করে বর্তমান ডিজাইনকে ধরেই নির্মাণের চিন্তা করেছেন।
গোটা রিসোর্টে কিছু বিল্ট এরিয়া আছে এবং ক্লায়েন্টের একটা ভিশনও আছে। কিন্তু এই মুহূর্তে রেষ্টুরেন্টটা সচল রাখার মাধ্যমে জায়গাটিকে ভাইব্রেন্ট রাখা ও পরিচিতি বাড়ানোর পরিকল্পনা করা হয়েছে। তা ছাড়া এটি লাভজনক একটি উদ্যোগও বটে। পরবর্তী সময়ে এই রিসোর্টের মাস্টারপ্ল্যান নিয়ে কাজ করবেন স্থপতি। রেস্টুরেন্ট অংশটি ডিজাইনের জন্য তারা মাত্র তিন মাস সময় পেয়েছিলেন। নির্মাণকর্মী এবং ক্লায়েন্টদের সঙ্গে রসায়ন ভালো থাকায় কাজটির শেষ চেহারা সুন্দর হয়েছে। স্থপতিও দাবি রাখেন যে ভাষার অবদান এখানে সর্বাপেক্ষা বেশি। তাই আঞ্চলিক ড্রয়িং রীতি ও মুখের ভাষার প্রয়োগ করার মাধ্যমে তারা কাজটাকে যেভাবে ডিজাইন করা হয়েছে ঠিক সেটাই ডেলিভার করতে পেরেছেন। রান্নাঘরের অংশটুকু সব থেকে বেশি উচ্চতায় আছে। এই অংশটা ইটের কাঠামো কিন্তু মেঝেতে কাঠের পাটাতন রয়েছে। যেখানে প্রয়োজন সেখানে টাইলস করা আছে, যেহতু কিচেনে আবশ্যিকভাবেই পানি ব্যবহার করতে হয়। কিচেনের নিচের অংশটায় আছে স্টোর।
ডিজাইন চলাকালীন ষ্টুডিওতে স্থপতি ও তার দল কিছু মডেল করে স্ট্রাকচারটাকে প্রাথমিকভাবে বোঝার চেষ্টা করেছেন এবং পরে থ্রিডি সফটওয়্যার ব্যবহার করে জিনিসটার চূড়ান্ত রূপদানের জন্য কাজ করেছেন। ডিজাইনের সময় বিশেষভাবে খেয়াল রাখতে হয়েছে বৃষ্টির ব্যাপারটা। যেহেতু এই অঞ্চলে বৃষ্টি হয় অনেক এবং কাঠের কাঠামোতে বৃষ্টি লাগলে সেটা দ্রুত নষ্ট হয়ে যাবে তাই এ ক্ষেত্রে খুব সচেতন থাকতে হয়েছে। তার ওপরে ছাদটা যেহেতু বাঁকানো এবং টু ওয়ে কার্ভড হবে, তাই ছাদের ওপর থেকে যেন পানির ফোঁটা নিচের অংশে চলে গিয়ে বাইরে পড়ে, সেটিও ডিজাইনে নিশ্চিত করতে হয়েছে। ডিজাইনের সময় স্থপতি তার দলের সদস্যদের সঙ্গে আলাপ করে একটা সহজ উপায় বের করেন এবং সেখান থেকে প্রথমে কাগজ ভাঁজ করে করে সমুদ্রের ঢেউটাকে ম্যানিফেস্ট করার প্রচেষ্টা করতে থাকেন। ৫টা সেকশন প্রথমে অটোক্যাডে ড্রাফট করে নিয়ে পরে সেগুলোকে থ্রিডি সফটওয়্যারে ডেভেলপ করে নেন। এভাবে নান্দনিক বোধকে মিলিয়ে ছাদের যে ঢেউ, সেটার ডিজাইনকে সম্পন্ন করা হয়।

যেহেতু কোনো এসি ব্যবহার করা হয়নি এবং আমাদের ক্লাইমেটে উন্মুক্ত রেস্টুরেন্ট অনেকেরই পছন্দের জায়গায় না হতে পারে। এই নিয়ে স্থপতি আহমেদ সিফাত বলেন, আমাদের সমুদ্রের যে ভিউটা বেশির ভাগ পেয়ে থাকি, সেটা পশ্চিম দিকের বলে রোদ ও তাপের প্রসঙ্গটা এসে যাবেই। তাই ব্যাম্বু চিক ব্যবহার করা হয় শেডিং ম্যাটেরিয়াল হিসেবে। যেটা আসলে আঞ্চলিক ভাষায় বলে বাঁশের দইরজা। তবে ব্যাম্বু চিক বলতে আমরা যেমন পলিশড একটা ম্যাটেরিয়াল বুঝি এটা তেমন নয়। এই অঞ্চলের পানের বরজগুলোতে বাঁশের দইরজা দিয়ে শেড দেওয়া হয়। সেটাকেই স্থপতি একটা পর্দার মতো ডিজাইন করেছেন যেটা দুপুরে দুই ঘণ্টার জন্য ব্যবহার করা হবে। এটা অনেকটা দড়ি দিয়ে টানানো পর্দার মতো। অর্থাৎ দড়ি হালকা করলে পর্দাটা রোল হয়ে নেমে যায় এবং আবার রোল করে উঠেও যায়। স্থপতি এই পদ্ধতির প্রয়োগ করেছেন ক্লায়েন্টের অন্য প্রকল্পে যেগুলো উপক‚লেই ডিজাইন করা হয়েছে। কিন্তু ওশান কিচেন প্রকল্পটিতে পশ্চিমের প্রভাবটা কম আছে। তাই ক্যান্টিলিবার ছাদ হওয়ায় বৃষ্টি বা রোদ ভেতরে আসতে পারে না। তবে এই প্রকল্পে ব্যাম্বু চিক ব্যবহার করা হবে কেবল বর্ষার মৌসুমকে মাথায় রেখে। বর্তমান কাঠামোকে শ্রদ্ধা করেই সেই ইনস্টলমেন্টটা ঘটানো হবে।
এ ছাড়া রেষ্টুরেন্টের ভেতরে ফ্যান ব্যবহার করা হয়েছে। ইন্টেরিয়রের কাজগুলোও যেহেতু স্থপতি ও তার দল করেছেন, তাই তারা ভেতরের স্পেসের কোয়ালিটির বেলায়ও ভেতরের ট্রাসের স্ট্রাকচারের যে আবেদন, সেটাকেই উদযাপন করেছেন। ফলে এটার সঙ্গে যায় এমন বাঁশ ও কাঠের ব্যবহার করে অন্দরসজ্জার কথা ভাবছেন তারা। কিন্তু কোনো প্রকার ফলস সিলিং বা অন্য কিছুর ব্যবহার তারা করবেন না। রিসোর্টের ভেতর দিয়ে যেমন রেষ্টুরেন্টে প্রবেশ করা যাবে আবার রিসোর্টের একদম বাইরের মানুষেরাও এখানে আসতে পারবেন। পরের ধাপে এই রেষ্টুরেন্টের পাশে বাচ্চাদের খেলার ব্যবস্থা করা হয়েছে, সেই সঙ্গে পুরো সাইটের উন্নয়ন সাধন হবে। তবে তখনো ওশান কিচেনকে ঘিরেই পুরো রিসোর্টের কাজ হবে তা এখনই দাবির সুরে বলা যায়।
প্রকাশকাল: বন্ধন ১৬৫ তম সংখ্যা, মে ২০২৪