বাংলাদেশ গ্রিন বিল্ডিং কাউন্সিল গঠনের প্রয়োজনীয়তা

জলবায়ু পরিবর্তন এ সময়ের একটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ আলোচ্য বিষয়। এই পরিবর্তনকে সঠিকভাবে এবং সুবিবেচ্যভাবে কাজে লাগাতে না পারলে আমাদের অস্তিত্ব ধ্বংসের মুখে পড়বে, এ ব্যাপারে কারও কোনো দ্বিমত নেই। জলবায়ু পরিবর্তন একক কোনো বিষয় নয়, এটি একটি সমন্বিত সমষ্টিগত রূপ। প্রতিটি সেক্টর থেকে জলবায়ু পরিবর্তন রোধে সঠিক ব্যবস্থাপনা গৃহীত না হলে এর বিরূপ প্রভাবে ভেঙে পড়বে সব ধরনের শৃঙ্খলা। এমনি একটি গুরুত্বপূর্ণ সেক্টর আবাসন। ক্রমেই তপ্ত হচ্ছে পরিবেশ। বসবাসের অনুপযোগী হচ্ছে শহরগুলো। দিন দিন ভেঙে পড়ছে যাবতীয় শৃঙ্খলা। কাল যেখানে ছিল সবুজ অরণ্য আজ সেখানে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে সুউচ্চ অট্টালিকা কিংবা ইটের কোনো ভাটা।

আবাসন খাত এখন বাংলাদেশের অন্যতম শক্তিশালী একটি খাত, যার ওপর বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অবস্থা অনেকটা নির্ভরশীল। জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে মানুষের আবাসনসংকট প্রবল হয়ে উঠছে। এ সমস্যা মোকাবিলায় দেশীয় ডেভেলপার কোম্পানিগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। এমতাবস্থায় সরকারের সঠিক পরিকল্পনাহীনতায় দেশের জনবহুল এলাকায় যত্রতত্র গড়ে উঠছে আবাসনসহ বিভিন্ন প্রকল্প। যার দরুন অপরিকল্পিত নগরায়ণের বিস্তার ঘটছে দিনের পর দিন। এমতাবস্থায় দেশের বেশ কিছু আবাসন কোম্পানি গৃহায়ণ নীতিমালা মেনে কাজ করছে- ঠিক এ সময় শুধু লভ্যাংশের কারণে নামে-বেনামে গড়ে উঠছে নানা ধরনের আবাসন প্রতিষ্ঠান। এ কথা অনস্বীকার্য যে আবাসন প্রতিষ্ঠানগুলো আমাদের স্বল্প সম্পদের এ দেশে যেভাবে এগিয়ে চলছে, তা সত্যিই প্রশংসনীয়। তবে পরিবেশকে বাদ দিয়ে নিজস্ব অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা সম্ভব নয়, তাই আবাসন প্রকল্পে ‘পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি’র প্রয়োগের এখনই উপযুক্ত সময়।

সবুজ লতাগুল্মে আচ্ছাদিত ভবন

বর্তমানে দেশের বেশ কিছু আবাসন প্রতিষ্ঠান পরিবেশ বিষয়টিকে আমলে নিয়ে তাদের স্থাপনায় এই দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে সক্ষম হয়েছে। আবাসন খাতের উন্নয়ন করে একে পরিবেশবান্ধব করতে চাইলে আমাদের কিছু প্রকল্পে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা প্রয়োজন, যার দরুন আবাসন খাত থেকে অর্জিত অর্থে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন আরও ত্বরান্বিত হবে। তবে দুঃখজনক হলেও সত্য, আমাদের দেশে কিছু আবাসন প্রতিষ্ঠান ছাড়া অনেককেই এর ব্যতিক্রমী ভূমিকায় দেখা যায়!

প্রথমেই প্রশ্ন রাখা যায়, সেসব ডেভেলপার কিংবা ব্যবসায়ী, যাঁরা পরিবেশ বিপর্যয়কে নিজেদের মুনাফা অর্জনের কাজে ব্যবহার করছেন ‘গ্রিন’ বা সবুজ শব্দটিকে ব্যবহারের মাধ্যমে। আমি হলফ করে বলতে পারি, এদের শতকরা ৯০ ভাগই জানে না আসলে কোন ধরনের স্থাপনাকে ‘গ্রিন বিল্ডিং’ বলা হয়। সহজভাবে বললে এটাকে গ্রিন আই ওয়াশ (Green Eye Wash) বলা যেতে পারে। কারণ, ‘গ্রিন বিল্ডিং’ কিংবা সবুজ স্থাপনা বলতে সেটাকেই বোঝায়, যেখানে স্থাপনা তৈরির স্থানীয় উপকরণ, জায়গার ব্যবহার, অভ্যন্তরস্থ তাপ রোধসহ অনেক বিষয় জড়িত। বিশ্বের উন্নত দেশগুলো এর জন্য নিজস্ব জলবায়ু অনুযায়ী কিছু নীতিমালা প্রণয়ন করেছে। যদিও বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত এ ধরনের নীতিমালা সরকারিভাবে গৃহীত হয়নি। এ কথা বলতে দ্বিধা নেই যে স্থাপনা তৈরির যেসব উপাদান আজ আমরা ব্যবহার করি, তাদের বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই উপকরণটি পরিবেশবান্ধব কি না তা নিরূপণ করার কোনো মাপকাঠি নেই কিংবা তারা ইচ্ছা করলেই পরিবেশবান্ধব উপকরণের জন্য সঠিক দিকনির্দেশনা দেওয়ার মতো প্রতিষ্ঠানের দারস্থ হতে পারছে না। তাহলে যারা এ দেশে স্থাপনাকে ‘সবুজ আবাসন’ হিসেবে দাবি করছেন, সেটা কীভাবে সম্ভব? আর সম্ভব হলেও কোন নীতিমালার মাধ্যমে কিংবা কোন জলবায়ুকে বিবেচনায় নিয়ে?

গ্রিন বিল্ডিং ধারণাটির সূত্রপাত যুক্তরাষ্ট্রে; এরপর অন্যান্য দেশে শুরু হয়েছে এর যাত্রা। ওই দেশগুলোতে সবুজ আবাসন প্রকল্পকে সার্টিফাইড করার জন্য লিড সার্টিফিকেশন (LEED Certification) প্রচলিত। এমনকি পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে ‘ইন্ডিয়া গ্রিন বিল্ডিং কাউন্সিল’ তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে বেশ জোরেশোরে। এমন পরিপ্রেক্ষিতে আমরা কিন্তু এখনো অনেকটা পিছিয়ে। কারণ আর কিছু নয়, সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে না পারা, সমন্বয়হীনতা কিংবা কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা। কেননা রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ বা রাজউক এখন শুধু ফ্লোর এরিয়া রেসিওর (FAR) ভিত্তিতে খোলা জায়গার পরিমাণভেদে ভৌত অবকাঠামোকে বিবেচনা নিয়ে নকশা পাস করে। যেখানে নেই পরিবেশ ও জলবায়ুবিষয়ক মাপকাঠির জোরালো অবস্থান। এর কারণ আর কিছু নয়, সংশ্লিষ্ট বিষয়ে গবেষণার কিংবা দক্ষ স্থপতি-প্রকৌশলীর অভাব। এ জন্য শুধু স্থপতি কিংবা প্রকৌশলীদের এককভাবে দোষারোপ করে লাভ নেই। কারণ, সরকার এ সম্পর্কে উদাসীন, নেই কোনো অর্থায়ন, অথচ যুক্তরাষ্ট্র শুধু গ্রিন বিল্ডিং প্রকল্পের মাধ্যমে আবাসন খাত থেকে শতকরা ৪০ ভাগ শক্তি অপচয় কমিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে।

একটি আধুনিক গ্রিন বিল্ডিং এর মডেল

কোন স্থাপনা কতটা শক্তি অপচয় করতে পারে, এ ধারণা কিংবা হিসাব খুব সহজেই বের করে আনা সম্ভব। যদি স্থাপনাগুলোর জন্য এনার্জি মনিটরিং সেল (Energy Monitoring Cell)-এর মতো কিছু প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়। উল্লেখ্য, সর্বপ্রথম বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট)-এর স্থাপত্য বিভাগ ২০০৯ সালে এমন একটি প্রকল্প হাতে নেয়। প্রকল্পটির নাম ‘গ্রিন আর্কিটেকচার সেল’। যার মূল উদ্দেশ্য ছিল স্থাপনার ক্ষেত্রে নকশা প্রণয়নের মাধ্যমে শক্তির অপচয় রোধ করে এ সম্পর্কিত নতুন গবেষণার ক্ষেত্র তৈরি করা। এ ক্ষেত্রেও সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার ঘাটতি রয়েছে।

গবেষণার মাধ্যমে দেশকে এগিয়ে নিতে হবে। এর জন্য চাই গবেষণায় অর্থের জোগান, চাই ‘বাংলাদেশ গ্রিন বিল্ডিং কাউন্সিল’ এবং এনার্জি মনিটরিং সেল। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে চলতে হবে বর্তমান সময়ের সঙ্গে। পরিবর্তন আনতে হবে সনাতন ধ্যান-ধারণায়। গঠন করতে ‘বাংলাদেশ গ্রিন বিল্ডিং কাউন্সিল’-এর মতো গবেষণাধর্মী প্রতিষ্ঠান, যাতে সুযোগ পাবে নবীন গবেষকেরা। আর নতুন বছরের এই চাহিদার সঙ্গে যুক্ত হবে পরিবেশরক্ষার সংকল্পটিও।

সজল চৌধুরী

শিক্ষক ও পরিবেশবিষয়ক গবেষক, স্থাপত্য বিভাগ, চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম

[email protected]

প্রকাশকাল: বন্ধন ৪৫ তম সংখ্যা, জানুয়ারি ২০১৪

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top