বাংলার বারো ভুঁইয়ার প্রধান ঈসা খাঁ রাজা মিদার কুইচকে সিংহাসনচ্যুত করে সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন কিশোরগঞ্জে। বাংলার মহান এই বীরকে হত্যা করে এলাকার দখল নিতে ভারতবর্ষের তৎকালীন অধিপতি সম্রাট আকবর তাঁর প্রতাপশালী সেনাপতি মানসিংহকে প্রেরণ করেন। শুরু হয় ভয়াবহ যুদ্ধ। যুদ্ধে পরাস্থ হন সেনাপতি মানসিংহ। বীর মানসিংহ তাঁর জীবনদশায় পরাস্থ করতে পারেননি দুজনকে। একজন চিতরের রানা প্রতাপ সিং, অন্যজন ঈসা খাঁ। সম্রাট আকবর ঈসা খাঁর অসাধারণ বীরত্বের স্বীকৃতিস্বরূপ তাঁকে বঙ্গবীর মসনদ-ই-আলা উপাধিতে ভূষিত করেন। মহান এই বঙ্গবীরের স্মৃতিবিজড়িত হাওরবেষ্টিত ভাটি অঞ্চল কিশোরগঞ্জ। এরই জেলা সরণি মোড়ের একজন সফল নির্মাণপণ্য ব্যবসায়ী মো. সোলায়মান ভূঞা ‘মেসার্স শিমু ট্রেডার্স’-এর স্বত্বাধিকারী। আকিজ সিমেন্ট কোম্পানি লিমিটেডের আঞ্চলিক বিক্রয় কর্মকর্তা শামসুর রহমানের সহযোগিতায় কথা হয় তাঁর সঙ্গে। জানা যায় তাঁর সফলতার রহস্য। বন্ধন-এর ‘সফল যাঁরা কেমন তাঁরা’ পর্বে থাকছে সফল এ ব্যবসায়ীর সাফল্যকাহন।
ব্যবসায়ী মো. সোলায়মান ভূঞার জন্ম ১৯৮৪ সালের ২৫ জুন, কিশোরগঞ্জ জেলার কটিয়াদি উপজেলার বনগ্রাম গ্রামে। বাবা মরহুম মৌলভী আহসান উল্লাহ ভূঞা ও মা সৈয়দা হোসনে আরা বেগম। আরজত আতরজান উচ্চবিদ্যালয় থেকে ১৯৯৯ সালে মাধ্যমিক এবং সরকারি গুরুদয়াল মহাবিদ্যালয় থেকে ২০০১ সালে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এরপর লেখাপড়ার অধ্যায় শেষে নিজের গ্রামে মুরগি ও মাছের খামার গড়ে তোলেন। কিন্তু বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যায় মাছ-মুরগি। এ ছাড়া দেশে তখন বার্ড-ফ্লু আতঙ্ক বিরাজ করায় খামার ব্যবসায় ক্ষতি হয় অনেক। এমন ধাক্কায় হতবিহŸল সোলায়মান আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন ব্যবসার প্রতি। সিদ্ধান্ত নেন বিদেশ যাওয়ার। কিন্তু ওখানে যেতেও লাগবে অনেক টাকা। খামারে অনেক টাকা ক্ষতি হওয়ায় বাধ্য হয়েই কিছু জমি বিক্রি করেন। একমাত্র ছেলে হওয়ায় পরিবারের সবাই চেয়েছিলেন দেশেই কিছু করুক। দুুলাভাইয়ের ছিল নির্মাণপণ্যের ব্যবসা। অন্যান্য ব্যবসায় ব্যস্ততা বেড়ে যাওয়ায় এই ব্যবসায় তিনি ঠিকমতো সময় দিতে পারছিলেন না। এ জন্য সোলায়মানকে প্রস্তাব দেন ব্যবসাটির হাল ধরার। যুক্তিসংগত প্রস্তাবটি তাঁর ভালো লাগে। বিদেশ যাওয়ার জমানো টাকায় ২০০৬ সালে শুরু করেন নির্মাণপণ্য ব্যবসা।
ব্যবসায় নবীন হওয়ায় শুরুতেই অনেক বাধার সম্মুখীন হতে হয় তাঁকে। শুরুতে তেমন কেউ চিনত না, অথচ পরিচিতিটাই এ ব্যবসার প্রাণ। তা ছাড়া তরুণ ব্যবসায়ী বলে অন্য ব্যবসায়ীরা ভাবতেন কিছুদিন পর লস করে ব্যবসা থেকে বিদায় নেবেন। কিন্তু ব্যবসায়ী সোলায়মান তাঁদের সব শঙ্কা মিথ্যা প্রমাণ করে নিজেকে একজন সুব্যবসায়ী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন। নিজের মেধা, বুদ্ধি, পরিশ্রম আর ঐকান্তিক চেষ্টায় ক্রমেই চাঙা হতে থাকে ব্যবসা। প্রথমেই তিনি সবার সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে গুরুত্ব দেন; গড়ে তোলেন সুসম্পর্ক। মানুষের সঙ্গে সহজেই মেশার সহজাত ক্ষমতা রয়েছে তাঁর। তুলনামূলকভাবে কম মুনাফায় গুণগত মানের পণ্য বিক্রি করেন। এ কারণেই সবাই তাঁর কাছ থেকে পণ্য কেনেন। খুচরা ও পাইকারি উভয়ভাবেই পণ্য বিক্রি করেন তিনি। সিমেন্ট দিয়ে শুরু করলেও এখন এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে রড, ইট, বালু। সাফল্যের স্বীকৃতিস্বরূপ পেয়েছেন স্বনামধন্য স্টিল কোম্পানির পরিবেশক স্বত্ব। আকিজ সিমেন্ট বিক্রিতে কিশোরগঞ্জে সেরা তিনি। কয়েক মাস ধরে রেখেছেন সফলতার এ ধারাবাহিকতা। সাফল্যের স্বীকৃতিতে উপহার হিসেবে পেয়েছেন ফ্রিজ, ল্যাপটপ, ওয়াশিং মেশিন, টেলিভিশন, ট্যাব, ডিজিটাল ক্যামেরা, মোবাইল, স্বর্ণালংকার, ডিনার সেট, ঘড়ি, নগদ টাকাসহ নানা সামগ্রী। এ ছাড়া আকিজ সিমেন্ট কোম্পানির পক্ষ থেকে ঘুরে এসেছেন মালয়েশিয়া ও নেপাল। অফার পেয়েছেন থাইল্যান্ড, ভুটান ও ভারত ভ্রমণের। কয়েক দিন বাদেই যাচ্ছেন সিঙ্গাপুর। বর্তমানে স্থানীয় বাজারে তাঁর পাঁচটা গোডাউন, একটা শোরুম। নির্মাণপণ্য গ্রাহকের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে দিতে রয়েছে দুটি নিজস্ব ট্রাক। তাঁর বিভিন্ন ব্যবসায় সম্পৃক্ত প্রায় ৫০ জন কর্মচারী।

ব্যবসায়ী সোলায়মান বিয়ে করেন ২০১৩ সালে। সহধর্মিণী পিনা আক্তার। সুখী এ দম্পতির দুটি সন্তান। বড় মেয়ে তাসমিয়া আক্তার, বয়স প্রায় দুই বছর। ছোট ছেলে তাহসান হাবিব, বয়স মাত্র দুই মাস। তিনি কিশোরগঞ্জ জেলা চেম্বার অব কমার্স ও পরিবহন মালিক সমিতির সম্মানিত সদস্য। ব্যবসায়ী সোলায়মান তরুণ ব্যবসায়ী হলেও তাঁর মামা শোয়েব ও দুলাভাই হাবিবুর হকের সহযোগিতায় সফলভাবে ব্যবসা পরিচালনা করছেন। এ ছাড়া জুনায়েদ, হাবিল ও ফারুক নানাভাবে ব্যবসায় তাঁকে সহযোগিতা করছেন।
কিশোরগঞ্জ ঐতিহ্যবাহী জনপদ হলেও দীর্ঘদিন থেকেছে উন্নয়নবঞ্চিত। তবে দিন বদলের সঙ্গে সঙ্গে এখানেও লেগেছে উন্নয়নের ছোঁয়া। তাই নির্মাণপণ্য ব্যবসার পরিসরও বেড়েছে বহুগুণে, যা ক্রমেই বাড়ছে। ব্যবসায়ী সোলায়মানের ইচ্ছে এ ব্যবসাটিকে স্বয়ংসম্পূর্ণ করতে আরও কিছু নির্মাণপণ্য যুক্ত করার পাশাপাশি কয়েকটি কোম্পানির পরিবেশক হওয়া।
মাহফুজ ফারুক
প্রকাশকাল: বন্ধন ৭২ তম সংখ্যা, এপ্রিল ২০১৬