আগুন-রাঙা প্রাণবন্ত অন্দর

হে কবি! নীরব কেন- ফাগুন যে এসেছে ধরায়,
বসন্তে বরিয়া তুমি লবে না কি তব বন্দনায়?
বসন্তকে বরণ করে নেওয়ার আকাঙক্ষা কবির থাক বা না থাক, বসন্ত এসেছে। প্রকৃতির চিরারচিত স্বভাব অনুযায়ী বন-বনান্ত জেগেছে নব সাজে। শিমুল, পলাশ, কৃষ্ণচ‚ড়ায় বসেছে আগুন রঙের মেলা। পাতার আড়ালে-আবডালে লুকিয়ে থাকা বসন্তের দূত কোকিলের মধুর কুহুকুহু ডাক ব্যাকুল করে তোলে অনেক বিরহী অন্তর। কবি তাই বলছেন, ‘সে কি আমায় নেবে চিনে/ এই নব ফাগুনের দিনে…।’ কচি পাতায় আলোর নাচনের মতোই বাঙালির মনেও লেগেছে রঙের দোলা, হৃদয় হয়েছে উচাটন। তবে বসন্তের সমীরণ বলছে, এ ঋতু সব সময়ই বাঙালির মিলনের বার্তা বহন করে। কারণ, বসন্তেই ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বাঙালির স্বাধীনতার বীজ বপন করা হয়েছিল। বসন্তেই শুরু বাঙালির মুক্তিযুদ্ধের। বসন্তের পূর্ণতায় এ দোলা ছড়িয়ে পড়–ক বাংলাদেশের সর্বত্র এবং সারা পৃথিবীর সব বাঙালির ঘরে ঘরে। প্রকৃতিতে চলছে মধুর বসন্তের সাজ সাজ রব। ফাগুনের এই আগুন-রাঙা রঙে রাঙিয়ে তুলতে পারেন আপনার সাধের অন্দরমহলও।

বসন্ত তারুণ্যেরই ঋতু, তাই সবার মনে বেজে ওঠে কবির বাণী- বসন্ত ছুঁয়েছে আমাকে, ঘুমন্ত মন তাই জেগেছে উতলা ফাগুনে। ফাগুনের দ্বিতীয় দিনই ভালোবাসা দিবস। এ যেন সোনায় সোহাগা। আজি বসন্ত জাগ্রত দ্বারে। প্রকৃতি প্রেমিক মানুষেরা তাই বসন্ত বরণে উদ্গ্রীব। মিলনের এ ঋতু বাসন্তী রঙে সাজায় মনকে, মানুষকে করে আনমনা, কবিও তাই ব্যক্ত করেছেন- ফুল ফুটুক আর নাই ফুটুক, আজ বসন্ত। কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের অমিয় বাণীটি ঋতুরাজকে আলিঙ্গনের আহ্বান জানায়। রেডিয়েন্ট ইনস্টিটিউট অব ডিজাইনের চেয়ারপারসন গুলশান নাসরিন চৌধুরী যেমনটা বলছিলেন, ‘নগরজীবনে বসন্তের ছোঁয়া পাই বা না পাই, প্রকৃতিতে তার স্পর্শ লেগেছে নিঃশব্দে। ঝরা পাতার ওড়াউড়ি, গাছে নতুন কচিপাতা গজিয়ে ওঠার মাঝেই বসন্তের আগমনী বার্তা। নাগরিক ব্যস্ততা এড়িয়ে একটু নিরালা মিলনেই ভেসে আসে কোকিলের কুহু ডাক, মৃদুমন্দ হাওয়ায় ভেসে আসা ফুলের গন্ধ জানিয়ে দিয়ে যায় ঋতুরাজের আগামনী বার্তা। বসন্ত এলেই কৃষ্ণচূড়া, রাধাচূড়া, নাগলিঙ্গম প্রকৃতির অলৌকিক স্পর্শে জেগে ওঠে। আর একই সঙ্গে শীতের বিদায়ের সুর। বসন্ত মানে তো শুধু পলাশ আর শিমুল ফুলের রং ছড়ানোই নয়; বসন্ত তো ঝরা পাতায়, ঝরা ফুলের আনন্দ গানও। ফাগুনের প্রথম দিন বা বসন্ত এলেই মনে পড়ে রবীন্দ্রনাথের সেই পরিচিত গান- আহা আজি এ বসন্তে, এত ফুল ফোটে, এত বাঁশি বাজে, এত পাখি গায়…। শীতের খোলসে ঢুকে থাকা বন-বনানী নতুন আলো আর বাতাসের স্পর্শে জেগে ওঠে এ সময়। পলাশ, শিমুলগাছে আগুন রঙের খেলা। এই আগুন রঙের খেলায় মাতিয়ে তুলুন আপনার ঘরের প্রতিটি গৃহকোণকে। ভালোবাসার রং ছড়িয়ে দিন সর্বত্র।’

অন্দর সাজে রঙিন কার্পেট

উজ্জ্বল রং
ঘর সাজাতে রঙের ব্যবহার বিশ্বজুড়ে। তবে ঋতু-বৈচিত্র্যের এ দেশে আমরা বসন্তে উজ্জ্বল রং পছন্দ করি। আমরা যত বেশি ইন্টেরিয়র-সচেতন হচ্ছি, তত বেশি রঙের ব্যবহার বাড়ছে। ঘর সাজাতে হালকা রঙের ব্যবহার স্বীকৃত হলেও উজ্জ্বল রং যে ব্যবহার করা যাবে না, তা কিন্তু নয়। মেজাজ তৈরি বা মেজাজ পরিবর্তনে রঙের যে বিশেষ এক ভূমিকা আছে, তা গবেষণায়ও প্রমাণিত। দেখা গেছে আনন্দ, আশা, হতাশা, আকাক্সক্ষা, দুঃখবোধ ইত্যাদি আবেগের নানা শ্রেণি-বিভাগ জাগিয়ে তুলতে সক্ষম রঙের নানা ব্যবহার। তাই ঘরের ভেতর রং ব্যবহার করতে হলে আবেগের মূল্য দিয়ে তা যাচাই করতে হবে। অন্দরসজ্জার সময় মনে রাখবেন হলুদ রং এবং হলুদের আধিক্য নিয়ে আসে খুশির আমেজ। আর বসন্ত মানেই হলুদ রঙের ছড়াছড়ি চারদিকে। একটি রুমকে সহজেই এবং কম খরচে পরিবর্তন করতে রঙের জুড়ি নেই। লিভিং রুম কিংবা বসার ঘর যেহেতু অতিথি আপ্যায়নের জায়গা, তাই ফাগুনের ছোঁয়া দিতে একটি দেয়ালকে রাঙিয়ে তুলুন হলুদ রঙে। হলুদ রঙের পাশাপাশি হালকা সবুজ লেভেন্ডার, হালকা কমলা এই রংগুলোকেও প্রাধান্য দিতে পারেন বসন্তের আমেজ আনতে। যদি রং করানো সম্ভব না হয়, তাহলে দেয়ালে লাগিয়ে নিন দেয়াল পেপার। তবে পেপার নির্বাচন করার সময় ফ্লোরাল মোল্টিকে গুরুত্ব দিন।

ফেব্রিক্সে ফ্লোর মোল্টি
বাড়িতে ঢুকতেই যদি চোখে পড়ে নান্দনিক কিছু, তাহলে কার না ভালো লাগে। যেহেতু বসন্ত, তাই আপনার ঘরের পর্দা, কুশন কভার, সোফা কভার থেকে শুরু করে সব জায়গায় উজ্জ্বল রঙের সঙ্গে ফ্লোর মোল্টিকে গুরুত্ব দিন। পুরোনো মসলিন শাড়ি কেটে তাতে অ্যাপলিক, সুতার কাজ, বøক প্রিন্ট, স্কিন প্রিন্ট ইত্যাদির মাধ্যমে তৈরি করে নিন নান্দনিক পর্দা। একটু ভিন্নতা আনতে দু-তিনটা রঙের সমন্বয়ে পর্দা তৈরি করতে পারেন। শোবার ঘরে বিছানা থাকবে এ তো জানা কথা। বিছানার চাদর নির্বাচন করুন ঘরের পর্দার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে। বিছানার ওপর ছোট-বড় বিভিন্ন আকৃতির কুশন রাখুন। কুশন কভার রঙিন হলে বিছানার চাদর হালকা রঙের এবং কুশন কভার হালকা রঙের হলে বিছানার চাদর গাঢ় রঙের নির্বাচন করুন। ঘরে সোফা, ডিভান- এসব জায়গায় কিন্তু কুশন রাখলে বসে বা শুয়ে দারুণ আরাম পাওয়া যায়। আর এই কুশনে যদি থাকে চমৎকার সব কভার, তাহলে তো কথাই নেই। কুশন কভারের সাজসজ্জায় ফুটে উঠবে উৎসবের আমেজ। হঠাৎ করে যদি ডাইনিং রুমের চেহারাটাই বদলাতে চান, তাহলে শুধু বুদ্ধি করে সাজসজ্জা পরিবর্তন করে দেখতে পারেন। এ ক্ষেত্রে ডাইনিংয়ের চেয়ারের ব্যাক কভারের সঙ্গে ম্যাচিং ডাইনিং টেবিল ক্লথ এবং টেবিলের রানার ব্যবহার করে ডাইনিং রুমের সৌন্দর্য বাড়ানো যেতে পারে। উৎসব-পার্বণে অনেক মেহমান আসে বেড়াতে, তাদের জন্য ডাইনিং টেবিলে কালারফুল প্লেট, গøাস ইত্যাদি দিয়ে সাজিয়ে রাখা যেতে পারে।

ছিমছাম সাজানো বসার ঘর

বসন্তের সব ফুলের শুভেচ্ছা
আমাদের দেশে বসন্ত নিয়ে নানা কবিতা, গান, ছড়া রয়েছে। বসন্তকে নিয়ে যেসব গীত বাংলার মানুষকে মোহিত করেছে তার মধ্যে রয়েছে- আসল ফাগুন/ লাগল আগুন/ কৃষ্ণচূড়ার ডালে ডালে। কথায় আছে যে ফুল ভালোবাসে না, সে নাকি মানুষও খুন করতে পারে। তাই আপনার অন্দরমহলের প্রতিটি জায়গায় ছড়িয়ে দিন ফুলের সুরভী সৌরভ। প্রধান ফটক থেকে শুরু করে সেন্টার টেবিল, ডাইনিং টেবিল, বেডরুম এমনকি বাথরুমে রেখে দিন কিছু তাজা ফুল। অতিথি আপ্যায়নে ফুলের চেয়ে দামি উপহার আর কী হতে পারে! ঘরের এক কর্নারে মাটির চাড়িতে পানি দিয়ে ছিটিয়ে দিন ফুলের পাপড়ি ও কিছু তাজা ফুল। সন্ধ্যায় জ্বালিয়ে দিন ভাসমান মোমবাতি। দেখবেন মুহূর্তেই বদলে যাবে আপনার অন্দরমহল। রহস্যময় অন্দর উৎসের আমেজ বাড়িয়ে দেবে দ্বিগুণ। অনেকের আবার তাজা ফুলে অ্যালার্জি হওয়ার আশঙ্কা থাকে। সে ক্ষেত্রে আর্টিফিশিয়াল ফুল নির্বাচন করতে পারেন। ঋতুরাজ বসন্তে বন-বনান্তে, কাননে-কাননে পারিজাতের রঙের কোলাহলে ভরে ওঠে চারপাশ। সেই ফুল এবং ফুলের রং ছড়িয়ে দিন আপনার অন্দরে।

‘ভালোবাসি, ভালোবাসি, ভালোবাসি; সেই সুরে কাছে দূরে জলে স্থলে… ইন্দ্রানী সেনের গাওয়া এই গানটি শুনলে ভালোবাসার জন্য কার না মন ব্যাকুল হয়ে ওঠে! ভালোবাসার মানুষের জন্য এমন আবেদন থাকবে, এটাই তো স্বাভাবিক। ভালোবাসার মানুষদের জন্য রয়েছে একটি বিশেষ দিনও। ফেব্রুয়ারির ১৪ তারিখ সারা বিশ্বে পালিত হয় দিনটি। হ্যাঁ পাঠক, পয়লা ফাল্গুনের পরের দিন বিশ্ব ভালোবাসা দিবসের কথাই বলছি। যদিও ভালোবাসার মানুষের প্রতিক্ষণের ভালোবাসা এক দিনে সীমাবদ্ধ রাখার পক্ষপাতী নন অনেকেই। তারপরও বিশেষ দিনকে বিশেষভাবে স্মরণ করা বা ভালোবাসার অবিচ্ছেদ্য বন্ধনে ভালোবাসার মানুষকে আরও আপন করে দিতে সাজিয়ে তুলুন আপনার অন্দরমহল।

ভালোবাসার বিশেষ এই দিবসে পাল্টে দিন ঘরের আবহ। লাল রঙের ছোঁয়ায় আপনার ঘরকে ভরিয়ে তুলুন ভালোবাসার আমেজে। পয়লা ফাল্গুনের সঙ্গে ভালোবাসা দিবসের সংমিশ্রণ করতে নানা রঙের জুড়ি নেই। হলুদ রঙের সঙ্গে যুক্ত করুন লাল আর সাদা রংকে, পর্দা, কুশন কভার, বেড কভার, সোফা কভার, টেবিল ম্যাট ও টেবিল রানার- সব জায়গাতেই ছড়িয়ে দিন ভালোবাসার রং লালকে।

সিঁড়িঘর ও প্রবেশঘরে খানিকটা ফাঁকা জায়গা রাখতে পারেন। থাকতে পারে ছোট-বড় কয়েকটি পটারি। একই রকম পটারির ছোট-বড় সেট কিংবা ভিন্ন ধরনের পটারিও রাখা যেতে পারে। মাটির চাড়িতে পানি দিয়ে তাতে গোলাপের পাপড়ি রেখে দিন। গোলাপের সুরভিত সুগন্ধ ঘরে ছড়িয়ে দেবে রোমান্টিক আবহে পয়লা ফাল্গুন আর ভালোবাসা দিবস দুটি দিন আনন্দে ভরে উঠুক আপনার সাধের অন্দরমহল।

শিশুদের বর্ণিল ঘরে বসন্তের আমেজ

টিপস

  • পয়লা ফাল্গুনে অতিথি আপ্যায়নে মাটির গ্লাস, বেতের ঝুড়ি, বাঁশের ট্রে ইত্যাদি ব্যবহার করে ঘরে আনুন দেশীয় আমেজ।
  • বাচ্চাদের ঘরে মাটির ফুলদানি বা শোপিসের ব্যবহার না করাই ভালো। ভালোবাসা দিবসে শোবার ঘরে বিছিয়ে দিন লাল রঙের চাদর। সঙ্গে হাট শেপের কুশন। আপনার ভালোবাসার মানুষটিকে ভালোবাসা নিবেদন করতে ড্রেসিং টেবিলে ফুলদানিতে রেখে দিন কিছু গোলাপ।
  • বাচ্চাদের ঘরে রেখে দিন নানা রকম সফট টয়েস। আপনার ভালোবাসা প্রমাণ করবে সফট টয়েসের হার্ট চিহ্ন।
  • পয়লা ফাল্গুনে গাদা ফুলের ব্যবহার বেশি হয়। তা ছাড়া পলাশ ও শিমুল ফুলেও সাজিয়ে নিতে পারেন আপনার প্রিয় গৃহকোণ।
  • ভালোবাসা দিবসে মাটির জিনিসের পরিবর্তে ব্যবহার করতে পারেন ক্রিস্টালের ফুলদানি ও শোপিস।
  • ভালো তাক ছবির ফ্রেমে পুরোনো ছবি সরিয়ে নতুন ছবি সংগ্রহ করুন। আপনার প্রিয় মুহূর্তে তোলা ছবিও ভালোবাসার দারুণ বহিঃপ্রকাশ।

ফারজানা গাজী, চিফ অপারেটিং অফিসার, ইকো ইনোভেটরস
[email protected]

প্রকাশকাল: বন্ধন ৭০ তম সংখ্যা, ফেব্রুয়ারি ২০১৬

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top