সঙ্কট মেটাতে বৃষ্টির পানি

‘রেইন ওয়াটার হারভেস্টিং’ প্রযুক্তিটি নতুন নয়। বিশ্বের অনেক দেশেই এর প্রচলন রয়েছে। বাংলাদেশে এখনও এর ব্যবহার ব্যাপক নয়। মাত্র ৩৫.৫ শতাংশ বাড়িতে সুপেয় পানির উৎস হিসেবে বর্ষার সময় এটার ব্যবহার লক্ষ করা যায়। তাও আবার উপক‚লীয় এলাকায়, যেখানে সুপেয় পানির অভাব কিংবা পানিতে লবণাক্ততার পরিমাণ বেশি।

টিনের বেড়া আর টিনের ছাউনি দেওয়া পাশাপাশি দুটি ঘর। উত্তর পাশের চালার কিনারা বরাবর লম্বা একটি টিনের ডোঙা বাঁধা। ডোঙার এক দিকের প্রান্ত বন্ধ, অন্য প্রান্তে আটকানো একটি বড়সড় চুঙ্গি। নেট দিয়ে মোড়ানো। চুঙ্গি থেকে লম্বা একটি পাইপ এসে ঢুকেছে বাড়ির উঠানে রাখা মুখ বন্ধ ইট-সিমেন্টে তৈরি বাক্সের মধ্যে। বাক্সের নিচের দিকে লাগানো আছে কল (ট্যাপ)। বোঝা-ই যাচ্ছে ব্যাপারটি। বৃষ্টি নামলে টিনের চালা দিয়ে গড়িয়ে আসা পানি ওই ডোঙা দিয়ে পড়বে চুঙ্গিতে। সেখানে একদফা ছাঁকার পর পাইপ বেয়ে পানি এসে জমবে মুখ বন্ধ ইট-সিমেন্টের তৈরি ট্যাঙ্কে। নিচের কল ঘোরালেই পাওয়া যাবে স্বচ্ছ পানি। বরগুনার পাথরঘাটা উপজেলার বাদুরতলা গ্রামের একরাম আলীর বাড়ির উঠানে এই ট্যাঙ্ক বসানো হয়েছে। এই গ্রামের আবদুল মালেক ও সোনা মিয়ার বাড়িতেও আছে বৃষ্টির পানি ধরে রাখার এই ব্যবস্থা। বৃষ্টির পানি ধরে রাখার এই পদ্ধতির নাম ‘রেইন ওয়াটার হারভেস্টিং’।

বৃষ্টির পানি সুপেয়। ধরে রাখার কৌশলটিও এমন জটিল কিছু নয়। পাইপ দিয়ে বৃষ্টির পানি বাক্সের মতো যে আধারটিতে জমা হয়, তার ভেতরে আছে তিনটি খোপ। প্রথমে পানি আসে বালি ভরা খোপে। সেখান থেকে যায় কাঁকর ভরা খোপে। সেখান থেকে বিশুদ্ধ পানি জমা হয় বড় একটি খোপে। ট্যাঙ্কগুলোতে পানি ধরে দুই হাজার ৫০০ থেকে তিন হাজার ২০০ লিটার। বছরে দু’বার ট্যাঙ্কের উপরের মুখ খুলে বিøচিং পাউডার দিয়ে পরিষ্কার করতে হয়।

ভূগর্ভস্থ পানি সঙ্কট বনাম বৃষ্টির পানি 

মেগাসিটি ঢাকাতে প্রায় ১ কোটি ২০ লাখ লোকের বাস, যাদের দৈনিক পানির চাহিদা প্রায় ২১০ কোটি লিটার। এর বিপরীতে ওয়াসা ১৭০ কোটি লিটার পানি সরবরাহ করে থাকে। এর মধ্যে মাত্র ৩০ কোটি লিটার পানি আসে শীতলক্ষ্যা ও বুড়িগঙ্গা নদীর পানি পরিশোধনের মাধ্যমে আর বাকি ১৪০ কোটি লিটার পানি রাজধানীর ৪৮২টি গভীর নলক‚পের মাধ্যমে ভূগর্ভ থেকে উত্তোলন করা হয়। বুড়িগঙ্গা ও শীতলক্ষ্যা নদীর পানি এতটাই দূষিত যে, তা পরিশোধনের পরও পানের অযোগ্য। গড়ে প্রতিদিন ৪০ কোটি লিটার পানির ঘাটতি রেখেই রাজধানীর মানুষ দিন কাটাচ্ছে। পানির চাহিদা মেটাতে সিংহভাগ ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন আমাদের নতুন এক সঙ্কটের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। 

পানি উন্নয়ন বোর্ডের জরিপে, ঢাকা শহরে প্রতিবছর ৩ মিটার করে পানির স্তর নেমে যাচ্ছে। গত ৫০ বছরে পানির স্তর নেমেছে প্রায় ৫০ মিটার। এর ফলে শুষ্ক মৌসুমে ঢাকা ওয়াসা প্রয়োজনমতো পানি তুলতে ব্যর্থ হচ্ছে। ফলে এটা সহজেই অনুমেয় যে, ভূগর্ভে পানির রিচার্জ হচ্ছে না। এমতাবস্থায় প্রয়োজন বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের। বৃষ্টির পানি প্রথম ৫-১০ মিনিট যদি নাও ধরা হয়। তার পরের পানিটুকু কিন্তু সুপেয়। এই পানির বিশেষ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, ওয়াসার পানি প্রথমে উপরে তুলতে বিদ্যুৎ খরচ হয়, তার পর বিশুদ্ধ করতে সরকারের কেমিক্যালসহ আনুষঙ্গিক অনেক খরচ রয়েছে। যেটা প্রকৃতি প্রদত্ত বৃষ্টির পানির ক্ষেত্রে একেবারেই নেই। সামনে যে পানির সঙ্কট আসছে তা শুধু ভূগর্ভস্থ পানি তুলে মেটানো সম্ভব হবে না। ফলে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ বা ব্যবস্থাপনা দিয়ে একটি বড় সঙ্কট মোকাবেলা করা সম্ভব বলে আশাবাদ বিশেষজ্ঞদের।

ভূগর্ভ থেকে প্রতিবছর যে পরিমাণ পানি উত্তোলন করা হচ্ছে তা বৃষ্টি ও বন্যার মাধ্যমে পূরণ হচ্ছে না বলেই এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হচ্ছে। ওয়াসার সরবরাহ করা পানির ৮৭ শতাংশই তোলা হচ্ছে মাটির নিচ থেকে। ওয়াসা ছাড়াও ভূগর্ভের পানি তোলা হচ্ছে বৈধ-অবৈধ গভীর নলক‚পের মাধ্যমে। ফলে পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে। জলাধার, খাল ভরাট করে ফেলায় ভূগর্ভে পানি আবার ফিরে যেতে পারছে না। কমছে ওয়াসার গভীর নলক‚পগুলোর উত্তোলন ক্ষমতা। তৈরি হচ্ছে পরিবেশগত বিপর্যয়ের আশঙ্কা। এ অবস্থা চলতে থাকলে অদূর ভবিষ্যতে দেখা দেবে সুপেয় পানির তীব্র সঙ্কট।

পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, অস্ট্রেলিয়া, নেদারল্যান্ডসসহ বিশ্বের অনেক দেশে ‘রেইন ওয়াটার হারভেস্টিং’ (বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ) পদ্ধতি চালু থাকলেও বাংলাদেশে এখনও পর্যন্ত এ ব্যবস্থা যথাযথভাবে গড়ে ওঠেনি। একমাত্র ঢাকা ওয়াসা ভবনের ছাদে এই ব্যবস্থা চালু করা হলেও পরবর্তীতে ভবন বৃদ্ধির কারণে তা ভেঙে ফেলা হয়। চট্টগ্রামের কয়েকটি এলাকায় একসময় বৃষ্টির পানি ধরে রেখে সারা বছর ব্যবহার করা হতো। এনজিও ইপসার পরিকল্পনায় ১৯৯৫ সালে সীতাকুন্ডে বৃষ্টির পানি ধরে রাখার একটি প্রকল্প (রেইন ওয়াটার হারভেস্টিং প্লান্ট) স্থাপন করা হয়। ওই প্রকল্পের অধীনে বর্ষা মৌসুমে স্থানীয় ২০টি পরিবারের পানির চাহিদা মেটানো হতো। এ বিষয়ে ইপসার কর্মকর্তা শাহ সুলতান শামীম জানান, ওই প্রকল্পের অধীনে ৫০ হাজার লিটার ধারণক্ষমতার একটি জলাধার (রিজার্ভার) নির্মাণ করা হয়। টিনের চাল থেকে বিশেষ ব্যবস্থায় বৃষ্টির পানি জলাধারে এসে জমত। এর পর বালুস্তর (স্লো স্যান্ড ফিল্টারেশন) পদ্ধতিতে জলাধারের পানি বিশুদ্ধ করা হতো। পুরো প্রকল্পে তখন ব্যয় হয়েছিল ৬৯ হাজার টাকা। কিন্তু পরে যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে প্রকল্পটি বন্ধ হয়ে যায়। ১৯৯৭ সালে বাংলাদেশের প্রত্যন্ত এলাকায় এক হাজার বাড়িতে এ প্রকল্প চালু করা হয়। এ পদ্ধতিতে ৫০০ লিটার থেকে ৩২০০ লিটার বৃষ্টির পানি ধারণের ব্যবস্থা ছিল। এতে পানি ধারণ ক্ষমতাভেদে ব্যয় হয়েছিল ৪০০০-১২০০০০ টাকা। 

উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত বারমুডা

পৃথিবীর অনেক দেশেই বৃষ্টির পানি ধরে রাখা হয় বড় জলাধারের মাধ্যমে। যেমন আছে উত্তর আটলান্টিক মহাসাগরের বুকে ছোট্ট দেশ বারমুডায়। আয়তনে ছোট হলেও সর্বশেষ ২০১২-এর আদমশুমারি অনুযায়ী দেশটির অধিবাসীর সংখ্যা প্রায় ৬৪ হাজার। বারমুডাতে স্বাদু পানির কোনো প্রবাহ বা নদী নেই, সেই সাথে মহাসাগরের বুকে অবস্থিত বলে ছোট আকৃতির এই দ্বীপটিতে ভূগর্ভস্থ পানির একটি বড় অংশ লবণাক্ত। তা হলে এই বিপুল ঘন বসতির দেশটির স্বাদু পানির মূল উৎস কী? উত্তর হচ্ছে বৃষ্টির পানি। বারমুডায় সারা বছর প্রায় একই হারে (মাসে ১২০ মিমি) বৃষ্টিপাত হয়, যার বার্ষিক বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ১৫০০ মিমি। ১৯৫১ সালের জনস্বাস্থ্য আইন অনুযায়ী বারমুডার প্রতিটি বাড়ির ছাদে বৃষ্টির পানি সংগ্রহের জন্য ব্যবস্থা আর সেই সাথে সেই পানি সঞ্চয়ের জন্য ভূগর্ভস্থ বা ভূপরিস্থ জলাধার থাকা বাধ্যতামূলক। তাদের নিত্যপ্রয়োজনীয় গৃহস্থালির জন্য পানির জোগান আসে এই সঞ্চিত পানি থেকেই। 

কিন্তু কিভাবে বারমুডার বাড়ির ছাদগুলো একেকটি বৃষ্টির পানির ধরতি বা ক্যাচমেন্ট হয়ে উঠছে সেই দিকে একটু দৃষ্টি দেওয়া যাক। এখানকার বাড়ির ছাদগুলোতে প্রথমে ঢালু শক্ত কাঠের ফ্রেমের উপরে চুনাপাথরের ব্লক একের পর এক সিঁড়ির মতো করে বিছিয়ে দেওয়া হয়। এর পর সেই চুনাপাথরের ব্লকের উপর দুই পরতের সিমেন্টের আস্তরের পর তাতে সাদা রঙের একটি বিশেষ সিমেন্ট পেইন্টের আবরণ দেওয়া হয়। ছাদের চারদিকে ছোট চ্যানেলের মতো থাকে যাতে ছাদে পতিত বৃষ্টির পানি এসে জমা হয় এবং তা পাইপের মাধ্যমে ভূগর্ভস্থ জলাধারে সঞ্চিত করা হয়। ছাদকে ঢালু এবং সিঁড়ির মতো করার কারণে বৃষ্টির পানি আস্তে আস্তে এসে চারদিকের চ্যানেলে সঞ্চিত হয়। প্রশ্ন উঠতে পারে, এভাবে সংগৃহীত পানির গুণগত মান নিয়ে। জানিয়ে রাখা ভালো, বারমুডার অধিবাসীরা প্রায় সাড়ে তিন শ’ বছর ধরে বৃষ্টির পানি সংগ্রহ করেই তাদের জীবনযাপন করে আসছে। ইদানীংকালে যদিও খাবার পানির ক্ষেত্রে অনেকেই বোতলজাত পানি ব্যবহার শুরু করেছে তার পরও বারমুডার বৃষ্টির পানির গুণগত মান কোনোভাবেই জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকিস্বরূপ নয়।

বারমুডায় বাড়ির ছাদে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের ব্যবস্থা

উপরের উদাহরণটির মাঝে পানিসঙ্কট প্রবল। তবে সেই সঙ্কট অনেকটা সমাধান করা হয়েছে ঐতিহাসিকভাবে বৃষ্টির পানির উপর নিজেদের নির্ভরশীলতা বাড়িয়ে। তবে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে বারমুডায় বৃষ্টিপাত হয় সারা বছর একটি নির্দিষ্ট হারে আর ঢাকায় বৃষ্টিপাতের শতকরা ৮০ ভাগই হয় বর্ষা মৌসুমে (জুন-অক্টোবর)। তাই এটি আশা করা উচিত নয় যে, বারমুডার মতো ঢাকাতেও বৃষ্টির পানি সংগ্রহ করে পানির চাহিদা পুরোপুরি মেটানো সম্ভব। তবে নিঃসন্দেহে কয়েকটি বিকল্প চিন্তাভাবনার অবকাশ রয়েছে। 

দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমী বায়ুর প্রভাবে বাংলাদেশে এপ্রিল থেকে অক্টোবর পর্যন্ত প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়। এ সময়ে ১ বছরের জন্য ‘রেইন ওয়াটার হারভেস্টিং’ পদ্ধতিটি ব্যবহার করা যায়। ঢাকায় ১৯৭৫-১৯৯৫ সালের বৃষ্টিপাতের পরিমাণ নিচের ছকে দেয়া হলো :

ছাদ হবে বৃষ্টির পানির আধার

বাংলাদেশে ছাদ তৈরিতে মূলত সিমেন্ট কংক্রিট, টাইলস, সি. এ/মেটাল শিট, পলিথিনযুক্ত কিংবা বিযুক্ত খড়, বাঁশ ব্যবহার করা হয়। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর এক হিসাব মতে, প্রায় ৪৮% গ্রামীণ গৃহ অবকাঠামোয় টাইলস, সি. এ, ধাতব শিট ছাদের উপকরণ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। বৃষ্টির পানি ধরে রাখার জন্য ছাদের এই উপকরণগুলো দারুণ কার্যকর। এর মধ্যে গ্রামাঞ্চলের বাড়িগুলোতে বেশি ব্যবহার করা হয় ধাতব শিট।

বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ ব্যবস্থা

রেইন ওয়াটার হারভেস্টিং সফল করার জন্য যে পদ্ধতি আমাদের দেশে ব্যবহার করা হয় সেটা মূলত গ্রামভিত্তিক। গ্রামের বিভিন্ন এনজিও এ ব্যাপারে কাজ করছে। তারা ছাদের উপর থেকে বৃষ্টির পানি সংগ্রহ করার পদ্ধতি প্রয়োগ করছে। এ ক্ষেত্রে টিনের চাল খুব উপযোগী, বিশেষ করে পরিষ্কার টিনের চাল। তারা চালের দু’পাশে হাফ কাট পাইপ গাটারের সাথে ব্যবহার করে এবং পাইপটা আরো নিচের দিকে নিয়ে এসে একটা স্টোরেজ ট্যাঙ্কে পানি ধারণের ব্যবস্থা করে। বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন ধরনের স্টোরেজ ট্যাঙ্ক ব্যবহৃত হয়। সবচেয়ে সস্তা হচ্ছে মটকা। এটা সহজলভ্য এবং সস্তা। কুমারদের সাহায্যে এটা খুব সহজে তৈরি করা যায়। অনেকে ফিরোসিমেন্ট/ ফেরোসিমেন্ট, আরসিসি অথবা ব্রিক ট্যাঙ্ক ব্যবহার করছে। কেউ কেউ প্লাস্টিক ট্যাঙ্ক ব্যবহার করছে।

ঢাকা শহরে বৃষ্টির পানিকে যথাযথভাবে সংগ্রহ করতে পাইপ নেটওয়ার্কের মাধ্যমে উন্মুক্ত স্থানে ক‚প খনন করে এক্যুইফারে প্রবেশ করাতে হবে। ঢাকা শহরের প্রত্যেকটি বাড়ির ছাদ হতে পারে এক একটি বৃষ্টির পানির ধরতি। ঢাকা শহরকে কয়েকটি জোনে ভাগ করে বৃষ্টির সময় সেই জোনের অন্তর্ভুক্ত সব বাসার ছাদ থেকে পানি যথাযথভাবে সংগ্রহ করে একটি কেন্দ্রীয় স্থানে কৃত্রিমভাবে তা এক্যুইফারে প্রবেশ করানো যেতে পারে। আরেকটি বিকল্প সম্ভাবনা হতে পারে, বর্ষা মৌসুমে বৃষ্টির পানিকে গৃহস্থালির কাজে লাগানো। সে ক্ষেত্রে ছাদ থেকে পানি সংগ্রহ করে তা ভূগর্ভস্থ জলাধারে সঞ্চয় করে রাখা যেতে পারে। ঢাকা শহরের অধিকাংশ বহুতল ভবনেই এখন গ্যারেজ থাকে, সে ক্ষেত্রে প্রত্যেকটি গ্যারেজের নিচে থাকতে পারে ভূগর্ভস্থ এই জলাধার। সেখান থেকে পানি কিছুটা পরিশোধন করে গৃহস্থালির বিভিন্ন কাজে তা ব্যবহার করার বিষয়ে পরিকল্পনা করা যেতে পারে। সর্বশেষ বিকল্প হতে পারে, একটি নির্দিষ্ট জোনের অন্তর্গত সব বাসার বৃষ্টির পানি একটি কেন্দ্রীয় পরিশোধন কেন্দ্রে এনে সেখান থেকে তা পরিশোধনের পর ঐ এলাকায় সরবরাহ করা।

বাড়ির ছাদে পানি ধরার ব্যবস্থা

চাহিদা মেটাতে বৃষ্টির পানি

এ শহরে ৫০ লাখের স্থলে প্রায় দেড় কোটি লোকের বসবাস। সুতরাং এ বিশাল জনগোষ্ঠীর পানির চাহিদা মেটাতে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ জরুরি। জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে দালানকোঠা, রাস্তাঘাট নির্মাণে খালি জায়গা কমে যাচ্ছে। বৃষ্টির পানি ভূগর্ভে প্রবেশ ব্যাহত হচ্ছে। সৃষ্টি হচ্ছে জলাবদ্ধতা। তাই বৃষ্টির পানি ভবনের ছাদে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। বৃষ্টির পানি নিরাপদ। কেননা এটি আর্সেনিক ও রোগ-জীবাণুমুক্ত। রেইন ওয়াটার হারভেস্টিং অন্য যে কোনো পদ্ধতি থেকে সহজ। এটি চালাতে বিশেষ কোনো দক্ষতার প্রয়োজন নেই। পদ্ধতিটা ঠিক রাখতে সামান্য রক্ষণাবেক্ষণই যথেষ্ট। ছাদে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করে খুব সহজেই গৃহস্থালি কাজে ব্যবহৃত পানির ৫০% চাহিদা মেটানো সম্ভব। কিচেন, ফ্লোর ওয়াশ, ক্লথ ক্লিনিং, ইয়ার্ড ক্লিনিং, গাড়ি ধোয়া, বাগানে পানি দেওয়া, এমনকি টয়লেটেও বৃষ্টির ধরে রাখা পানি ব্যবহৃত হয়। খাওয়ার পানি হিসেবে ব্যবহারের আগে ফুটিয়ে পান করা শ্রেয়। পরিষ্কার পাত্রে বৃষ্টির পানি সংগ্রহ করে সরাসরিও পান করা যায়। বৃষ্টির পানি ছাদের রেইন ওয়াটার পাইপ দিয়ে ড্রেনের সঙ্গে না দিয়ে গ্রাউন্ড ওয়াটার পাইপ দিয়ে নিচে ট্যাঙ্কে সংরক্ষণ করা যেতে পারে। সে জন্য বিল্ডিং তৈরির সময় ট্যাঙ্ক স্থাপনের পরিকল্পনা রাখতে হবে। বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে ছয় মাস বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করে পানির চাহিদা মেটানো সম্ভব। সে ক্ষেত্রে পাম্পিং খরচটাও কমে যাচ্ছে। রক্ষা হচ্ছে পরিবেশের ভারসাম্য। পানি সঙ্কট মোকাবেলায় উৎস হিসেবে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের গুরুত্ব তুলে ধরতে হবে। সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি সংস্থার এ ব্যাপারে এগিয়ে আসা দরকার। এ কাজে নগরবাসীর সম্পৃক্ততা প্রয়োজন। তা ছাড়া নগরীর প্রতিটি বাড়ির মালিককে নিজ নিজ ছাদে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করতে হবে। তা হলে কেবল সম্ভব পানি সঙ্কট নিরসন করা।

লক্ষণীয় যা

বৃষ্টি শুরুর প্রথম ১০ মিনিটের পানি ছেড়ে দিয়ে তার পর থেকে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করতে হবে। পানি যেখানে এসে জমা হয় তথা ক্যাচমেন্ট সব সময় পরিষ্কার রাখতে হবে। নইলে পানিবাহিত রোগ হতে পারে। বৃষ্টির পানিতে প্রয়োজনীয় খনিজ উপাদান অনুপস্থিত থাকে। বৃষ্টির পানি দীর্ঘসময় রেখে ঠিকমতো সংরক্ষণ না করলে এটি দূষিত হতে পারে। 

বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ ও ব্যবহার

দেশে ভবিষ্যৎ পানি সঙ্কট মোকাবেলা করতে বৃষ্টির পানির ব্যবহার বাড়াতে হবে। আইন প্রণয়নের মাধ্যমে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ ও তার ব্যবহার নিশ্চিত করা বাধ্যতামূলক করা প্রয়োজন। আর এ বিষয়ে দরকার সরকারের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা। বিশেষ করে এর ব্যবহার বাধ্যতামূলক করার জন্য এটিকে সরকারের নীতিমালার সাথে সম্পৃক্ত করা প্রয়োজন। জাতীয় ইমারত নির্মাণ বিধিমালা, জাতীয় গৃহায়ন নীতিমালা ও সরকারের অন্য সব সংশ্লিষ্ট নীতিমালায় এটি অন্তর্ভুক্ত করা সময়ের দাবি। নতুন আইনের মাধ্যমে ভবন মালিকদেরও বৃষ্টির পানি ধরে রাখতে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। বিশ্বের অনেক দেশই বৃষ্টির পানি বিশেষ পদ্ধতিতে মাটিতে পাঠানোর মাধ্যমে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ধরে রেখেছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে বাংলাদেশেও পদ্ধতিটি জরুরি হয়ে পড়েছে। জমিয়ে রাখা পানির একটি অংশ পাইপের মাধ্যমে মাটির গভীর স্তরে পাঠিয়ে দেওয়া হবে। যাতে ভূগর্ভস্থ পানির রিচার্জ নিশ্চিত হবে। ভারতের আহমেদবাদসহ ইউরোপের অনেক দেশের সফলতার ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশও এ ক্ষেত্রে একটি মডেল হতে পারে।

প্রকাশকাল: বন্ধন ২৮ তম সংখ্যা, আগস্ট ২০১২

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top