আবাসিক এলাকার বাণিজ্যিকীকরণ

সম্প্রতি ঘটা গুলশান আবাসিক এলাকার হলি আর্টিজান রেস্টুরেন্টের বর্বরোচিত হত্যাকান্ডকে কেন্দ্র করে রাজধানী ঢাকা এখন আতঙ্কের নগরী। আবার অনুরূপ কোনো হামলার আশঙ্কায় বাড়ানো হয়েছে নগরীর নিরাপত্তা। গুলশান-বনানী-বারিধারায় বিভিন্ন দেশের কূটনৈতিক মিশন, ডিপ্লোমেটিক জোন ও বিদেশিদের বসবাস বিবেচনায় নিশ্চিত করা হয়েছে নিছিদ্র নিরাপত্তাব্যবস্থা। এলাকার কিছু প্রবেশপথ ও সড়ক বন্ধ করে, এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় অযান্ত্রিক পরিবহন (রিকশা, ভ্যান ইত্যাদি) নিয়ন্ত্রণ করে তল্লাশি জোরদার করা হয়েছে, যার প্রভাব পড়েছে অত্র এলাকার সামগ্রিক জীবনযাত্রায়। এ এলাকার অনেক হোটেল ও গেস্ট হাউস এখন প্রায় ফাঁকা। ক্যাফে ও রেস্টুরেন্টগুলো ভুগছে ক্রেতাশূন্যতায়। হাসপাতাল, স্কুল-কলেজ, ব্যাংক-বীমাসহ অন্য অফিসগুলোও চলছে শঙ্কা নিয়ে। সব মিলিয়ে ওই ঘটনা-উত্তর পরিস্থিতিতে সার্বিক নগরজীবনে সৃষ্টি হয়েছে অস্বস্তিকর পরিস্থিতির।

এর পাশাপাশি এসব পরিকল্পিত আবাসিক এলাকায় কীভাবে অনাবাসিক কার্যক্রমের বিস্তার ও বাণিজ্যিকীকরণ ঘটল, তা নিয়ে সর্বমহলে চলছে আলোচনা-সমালোচনা, চলছে ব্লেম গেমও। এখানে উল্লেখ্য, পাকিস্তান আমলে পরিকল্পিত এসব আবাসিক এলাকায় আশির দশক পর্যন্ত তেমন কোনো অনাবাসিক কার্যক্রম ছিল না, কিন্তু এরপর এখানে প্লট বরাদ্দপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের নানা অজুহাতে (বিশেষ করে পরিবারের বাড়তি/নতুন ও অন্য সদস্যদের জন্য আবাসনের প্রয়োজনে) বিশেষত অতিলোভ ও লাভের পরিপ্রেক্ষিতে এলাকার চেহারা ক্রমেই পাল্টে যেতে থাকে। সেই থেকে কমবেশি সবার মধ্যেই তাঁদের পূর্বে নির্মিত একতলা-দুইতলা বা ডুপ্লেক্স বাড়ি ভেঙে ডেভেলপার দ্বারা বা রিয়েল এস্টেট কোম্পানির সঙ্গে দরাদরিতে প্লটের মালিকানা হস্তান্তর করে বহুতল অ্যাপার্টমেন্ট বা বাণিজ্যিক ভবন নির্মাণের প্রবণতা দেখা দেয়। এতে স্বাভাবিকভাবে এলাকায় বর্ধিত জনগণের জন্য বিভিন্ন নাগরিক সেবা-সুবিধার বাড়তি প্রয়োজনকে পুঁজি করে শুরুর দিকে একশ্রেণির প্লট/ইমারত/ফ্ল্যাটের মালিক কর্তৃক অনেকেই তাঁদের আবাসিক ভবন বা স্থাপনার মধ্যে বিভিন্ন ধরনের ব্যবসা-বাণিজ্যের (দোকান, রেস্টুরেন্ট, বুটিক শপ, অফিস, কোচিং সেন্টার ইত্যাদি) জন্য দোকান ভাড়া দিতে বা নিজেরাই ব্যবসা-বাণিজ্যের বিস্তার ঘটাতে থাকেন। বিষয়টি প্রথম দিকে বড় রাস্তার পাশে সীমাবদ্ধ থাকলেও পরে তা পুরো এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। এতে এলাকার ব্যবস্থাপনাসহ আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটতে থাকে।

আর এভাবেই দিনে দিনে গুলশান-বনানী আবাসিক এলাকার প্রায় সর্বত্রই বৈধ-অবৈধভাবে ব্যাপক হারে বাণিজ্যিকীকরণের ফলে যানজট সমস্যার ব্যাপকতা বাড়ায়, পরিবেশের বিপর্যয় ও বসবাসযোগ্য পরিবেশ বিনষ্ট হওয়ায় ৪ এপ্রিল মন্ত্রিপরিষদ সভায় সিদ্ধান্ত হয়, আগামী ছয় মাসের মধ্যে নগরীর আবাসিক এসব এলাকা থেকে বৈধ-অবৈধ সব ধরনের ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ ও অপসারণ করার। ব্যাপারটি প্রক্রিয়াধীন থাকা অবস্থায় কাকতালীয়ভাবে উত্তর গুলশানের অভিজাত আবাসিক এলাকাস্থ হলি আর্টিজান রেস্টুরেন্টে ঘটে নির্মম এ ঘটনা। ওই ঘটনা-উত্তর পরিস্থিতিতে প্রশ্ন ওঠে, পরিকল্পিত আবাসিক এলাকার ভেতরে কীভাবে রেস্টুরেন্টটি গড়ে উঠল? এর পাশাপাশি পুরো আবাসিক এলাকার বিভিন্ন স্থানে বেপরোয়াভাবে অসংখ্য হোটেল, গেস্ট হাউস ও রেস্টরেন্ট কীভাবে স্থাপিত হলো, এ নিয়ে সর্বত্র চলছে প্রচন্ড আলোচনা-সমালোচনা। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে ইতিমধ্যে সরকার গুলশান-বনানী এলাকার পরিবেশ সমুন্নত রাখতে যত্রতত্র (অবৈধভাবে) গড়ে ওঠা রেস্টুরেন্ট, হোটেল, ক্যাফে, বার ইত্যাদি অগ্রাধিকার ভিত্তিতে উচ্ছেদ/বন্ধ/অপসারণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

ইউএই মার্কেট, বনানী, ঢাকা ও আবাসিক এলাকার দোকানপাট

প্রসঙ্গক্রমে ঢাকায় এ ধরনের আবাসিক এলাকাগুলোর পরিকল্পনা ও বিবর্তনের দিকে ফিরে তাকালে দেখা যায়, ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান-ভারত বিভক্তির পর, পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকায় মধ্য থেকে উচ্চবিত্তদের আবাসনের জন্য এসব আবাসিক এলাকার পরিকল্পনা করা হয়। ১৯৫২ সালে প্রথম পরিকল্পিত হয় ধানমন্ডি আবাসিক এলাকা। পঞ্চাশের দশকের শুরুতে তৎকালীন নগরীর দক্ষিণ-পশ্চিম প্রান্ত সীমানায় বিদেশের শহরতলীর আবাসিক এলাকার আদলে খুব Low Density (কম ঘনত্বে)-তে ধানমন্ডির পরিকল্পনা করা হয়। ধারণা করা হয়েছিল যে প্রতিটা প্লটে হবে একটি পরিবারের বাস এবং বরাদ্দকৃত জমির ওপর একটি এক-দোতলা বা ডুপ্লেক্স বাড়ি নির্মিত হবে। এরই ভিত্তিতে তখন এখানে পানি ও পয়ঃপ্রণালি, ড্রেনেজ, বিদ্যুৎ, টেলিফোন ও গ্যাস লাইন স্থাপন করা হয়। প্রথম দিকে বরাদ্দকৃত প্লটের সাইজ ছিল এক বিঘা থেকে ১০ কাঠা আয়তনের, তবে পরে আবেদনকারীর সংখ্যা বাড়ায় প্লট সাইজ ছোট (৫ কাঠা পর্যন্ত) করা হয়। অন্যদিকে শুধু আবাসিক এলাকা হিসেবে পরিকল্পিত বিধায় এখানকার পরিকল্পনায় কাঁচাবাজার, কিচেন মার্কেট, স্কুল, ক্লিনিক ইত্যাদির মতো নাগরিক সুবিধার জন্য কোনো জায়গা রাখা হয়নি। ফলে আশির দশক পর্যন্ত ধানমন্ডিতে বরাদ্দকৃত প্লটসমূহে এক-দোতলা বা ডুপ্লেক্স বাড়ি নির্মাণের মাধ্যমে মানুষ বসবাস শুরু করলেও একসময় তাদের তথা বর্ধিত জনসংখ্যার প্রয়োজনে আপনাতে এর বিভিন্ন স্থানে, বড় সড়কের ধারে বা খালি জায়গায় স্বতঃস্ফূর্তভাবে কাঁচাবাজার, কর্নার শপ, দোকান, স্কুল, ক্লিনিক ইত্যাদি স্থাপিত হতে থাকে।

অপর দিকে ষাটের দশকে (১৯৬২ সালে) ঢাকার নগর পরিকল্পক ঢাকা ইম্প্রূভমেন্ট ট্রাস্ট (ডিআইটি)-এর অধীনে তৎকালীন নগরীর উত্তর-পূর্ব সীমানায় গুলশান-বনানী-বারিধারা আবাসিক এলাকার পরিকল্পনা করা হয়। দক্ষিণে বাড্ডা-রামপুরা-তেজগাঁও থেকে উত্তরে জোয়ারসাহারা-খিলক্ষেত পর্যন্ত লম্বালম্বিভাবে সমগ্র উঁচু জায়গার ওপর এই আবাসিক এলাকা পরিকল্পিত হয়। সেই অনুসারে ভূমি অধিগ্রহণ প্রক্রিয়াও শুরু হয়, কিন্তু সেখানে বসবাসরত অসংখ্য আদিবাসী মানুষের বাস্তুচ্যুত হওয়া তথা তাঁদের পুনর্বাসনের বিষয়টি বিবেচনা করে পরে পরিকল্পনাটি ছোট করা হয় এবং পর্যায়ক্রমে বাস্তবায়নের ব্যবস্থা নেওয়া হয়। প্রথমে এটি শুরু হয় গুলশান আবাসিক এলাকার উন্নয়নের মাধ্যমে। কথিত আছে, ডিআইটির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান জি এ মাদানীর স্ত্রী গুলশান আরার নামে ‘গুলশান মডেল টাউন’ উন্নয়নের কার্যক্রম শুরু হয়। ধানমন্ডির মতো একইভাবে গুলশান পরিকল্পিত হলেও শুরুতে এখানে অধিকতর বড় সাইজের (এক থেকে তিন বিঘা পর্যন্ত) প্লট সৃষ্টি ও বরাদ্দ দেওয়া হয়। পরে প্লট সাইজ কমানো হয়। ধানমন্ডির আদলে কম ঘনত্বের আবাসিক এলাকার বিবেচনায় এখানেও অনুরূপভাবে পানি, ড্রেনেজ, বিদ্যুৎ, টেলিফোন ও গ্যাস লাইন স্থাপন করা হয়। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় এটিই, তখনকার ঢাকার মূল এলাকার অনেক বাইরে পরিকল্পিত এই জায়গাটিতেও বিভিন্ন প্রয়োজনীয় নাগরিক সেবা ও সুবিধার জন্য পর্যাপ্ত জায়গা রাখা হয়নি। আবার এ কথাও শোনা যায়, তৎকালীন মূল নগরীর বাইরে এখানে ঝোপ-জঙ্গলে মেছোবাঘ, শিয়ালসহ দিনেদুপুরেও বিভিন্ন ধরনের অনেক হিংস্র পশুর অবাধ বিচরণ ছিল, যার কারণে প্লট বরাদ্দ পেয়েও বেশির ভাগই বাড়ি নির্মাণে এগিয়ে আসেননি। তবে এখানে বড় সাইজের প্লটগুলোতে বরাদ্দ প্রাপকদের অনেকে নিজস্ব নিরাপত্তাবলয় গড়ে তুলে সুইমিংপুল, লন বা বাগানের সমন্বয়ে ডুপ্লেক্স বাড়ি নির্মাণ করে তা বিদেশিদের ভাড়া দিতেন এবং হাতেগোনা কিছু দেশীয় ব্যবসায়ী ও শিল্পপতি এখানে বসবাস করতেন। আর সে সময় এখানে বসবাসরত বিদেশিরা তাঁদের সব নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী স্ব-স্ব দেশ থেকে নিয়ে আসতেন, যদিও পরে গুলশান ১ ও ২ নম্বর চত্বরে সংরক্ষিত বাণিজ্যিক প্লটে বা আবাসিক ইমারত-স্থাপনায় স্থানীয় কিছু লোকজন বিদেশ থেকে এসব গৃহস্থালি দ্রব্যাদি আমদানি করে তা চড়া দামে বিক্রি করা শুরু করেন, যা আমরা গুলশানে আশি-নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত দেখেছি।

হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁ, গুলশান

গুলশান প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি নগরীর তৎকালীন মধ্যম আয়ের নাগরিকদের জন্য বনানী আবাসিক এলাকাটিও গড়ে তোলা হয়। ধানমন্ডি-গুলশানের আদলে বনানীও কম ঘনত্বের আবাসিক এলাকা হিসেবে পরিকল্পিত বিধায় এখানেও সেভাবে পানি, ড্রেনেজ, বিদ্যুৎ, টেলিফোন ও গ্যাস লাইন স্থাপন করা হয়। এই ক্ষেত্রেও নগর পরিকল্পনাবিদ তথা নীতিনির্ধারকদের দুর্বলতায় ধানমন্ডি-গুলশানের মতো এখানে বিভিন্ন নাগরিক সুবিধার জন্য পর্যাপ্ত জায়গা রাখা হয়নি। ফলে বনানীতে মানুষের বসবাস শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাদের প্রয়োজনে এমনিতেই এর বিভিন্ন স্থান ও সড়কের ধারে স্বতঃস্ফূর্তভাবে কর্নার শপ, দোকান, স্কুল, ক্লিনিক ইত্যাদি গড়ে উঠতে থাকে। অন্যদিকে তখন বনানীতে স্বল্প আয়ের মানুষের আবাসনের জন্যও একটি ফ্ল্যাট প্রকল্প নেওয়া হয়। ডিআইটির নিজস্ব অর্থায়নে বনানীর উত্তর অংশে চারতলাবিশিষ্ট ৪২টি ভবন নির্মাণ করার পর বনানীর নির্জন পরিবেশে কেউ এসব ফ্ল্যাট গ্রহণের জন্য আগ্রহী না হলে পরে তা নির্মাণমূল্যে বিভিন্ন সরকারি-আধা সরকারি সংস্থার কর্মচারীদের বসবাসের জন্য বিক্রি করা হয়, যেখানে বর্তমানে সংশ্লিষ্ট সরকারি সংস্থার পদস্থ কর্মকর্তারা বসবাস করছেন।

আর বারিধারা আবাসিক এলাকা পরিকল্পিত হয় আরও পরে। ঢাকাকে পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী করা সত্ত্বেও সে সময় অজ্ঞাত কারণে এখানে কোনো ডিপ্লোমেটিক এনক্লেভের পরিকল্পনা করা হয়নি। হয়তো পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী চাননি যে ঢাকায় কোনো ডিপ্লোমেটিক এলাকা থাকুক ও বাঙালিরা বিদেশিদের সান্নিধ্য পাক। ওই অবস্থায় স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় যে কয়টি দেশের লিয়াজোঁ বা প্রাদেশিক অফিস ছিল, তা ছিল নগরীর বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে। যেমন- মতিঝিল বাণিজ্যিক এলাকায় আদমজী ভবনে আমেরিকার, ডিআইটি ভবনে ব্রিটিশ সরকারের, ধানমন্ডিতে ভারত সরকারের, মগবাজার মোড়ে চায়নিজ ও ইস্কাটনে ফরাসি দূতাবাস ছিল। প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের শাসনামলে ঢাকায় কূটনৈতিক মিশনগুলোকে একটা জায়গায় আনার প্রয়াসে বারিধারার অংশ বিশেষকে ডিপ্লোমেটিক তথা কূটনৈতিক এলাকা হিসেবে ঘোষণা করা হয় এবং অতঃপর (এরশাদের শাসনামলে) বারিধারা আবাসিক প্লট বরাদ্দের ব্যবস্থা করা হয়। অপর দিকে বারিধারাস্থ কূটনৈতিক এলাকায় যেসব দেশকে জমি বরাদ্দ করা যায়নি, সেসব দেশকে গুলশানের বিভিন্ন স্থানে তাদের মিশন ও ডিপ্লোমেটদের আবাসনের ব্যবস্থা করা হয়। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে নগরীর বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ডিপ্লোমেটিক মিশন ও অন্যান্য বিদেশি প্রতিষ্ঠানের জন্য বিভিন্ন সময়ে সুপরিকল্পিতভাবে একটি ডিপ্লেমেটিক এনক্লেভ প্রতিষ্ঠার কথাবার্তা হলেও আজ অবধি তা বাস্তবায়িত হয়নি।

গুলশান লেক

এখানে আরেকটি উল্লেখ্য বিষয় হলো, এসব এলাকায় প্লটের মূল্য ও এর সুবিধাভোগীদের দাপট বা দৌরাত্ম্য। শুরুতে নামমাত্র মূল্যে অর্থাৎ কাঠাপ্রতি মাত্র ৭৫০ টাকায় গুলশান ও বনানীতে প্লট বরাদ্দ করা হয়। তথাপি সে সময় এই দামেও বাঙালি কর্মকর্তা ও ব্যবসাসায়ীদের পক্ষে প্লট কেনার সামর্থ্য ছিল না বিধায় এসব জায়গায় প্রথম দিকে বরাদ্দকৃত বড় সাইজের প্রায় প্লটের মালিক ছিলেন অবাঙালিরা। তবে প্লট সাইজ ছোট করার পর অনেক বাঙালি কর্মকর্তা ও ব্যবসায়ীরা এখানে প্লট গ্রহনে এগিয়ে আসেন। আগে যেহেতু তেমন আবেদনকারী ছিলেন না, তাই প্রথম দিকে প্লট বরাদ্দের জন্য কোনো নীতিমালা ছিল না। আবেদনকারীর সংখ্যা বাড়ার পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৬৮-৬৯ সালে প্লট বরাদ্দ নীতিমালা প্রণীত হয় এবং সেই ভিত্তিতে বরাদ্দ প্রদানের ব্যবস্থা করা হয়। তবে এ কথা সত্যি যে স্বাধীনতার আগে যাঁরাই গুলশান-বনানীতে প্লট বরাদ্দের জন্য আবেদন করেছেন, তাঁদের প্রায় সবাই এখানে প্লট বরাদ্দ পেয়েছেন। স্বাধীনতার পর নগরমুখী মানুষের চাপে বিশেষ করে যাঁরা পশ্চিম পাকিস্তান থেকে প্রত্যর্পণ করেছেন, তাঁদের অনেকে ঢাকার পরিকল্পিত এলাকায় প্লট বরাদ্দ লাভে চেষ্টা করতে থাকেন।

তখন নগরীতে বর্ধিত জনগণের আবাসনের লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু পরিকল্পিত এলাকাসমূহে (ধানমন্ডি-লালমাটিয়া, গুলশান-বনানী ও উত্তরায়) অবরাদ্দকৃত প্লটগুলো যৌথভাবে অথবা সেখানে ইমারত নির্মাণ করতে আগ্রহী ব্যক্তিদের মধ্যে বরাদ্দ দেওয়ার নির্দেশ দেন। কিন্তু ওই আদেশটি কার্যকর হওয়ার আগে বঙ্গবন্ধু ষড়যন্ত্রকারীদের হাতে মারা যান। জানা মতে, বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে গুলশান-বনানী এলাকায় কাউকে কোনো প্লট বরাদ্দ করা হয়নি। তবে সে সময় বারিধারা আবাসিক কাম ডিপ্লোমেটিক এলাকার পরিকল্পনা করা হয় এবং আগ্রহী ডিপ্লোমেটিক মিশনের মধ্যে সেখানে কিছু প্লট বরাদ্দের ব্যবস্থা করা হয়। প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের শাসনামলে বারিধারায় অনেক দেশের ডিপ্লেমেটিক মিশন স্থাপনে জমি বরাদ্দ করা হয়। তাছাড়া জিয়াউর রহমানের শাসনামলে রাজনৈতিকভাবে প্লট বরাদ্দের কোনো অপসংস্কৃতি ছিল না। এই অপকর্মটি শুরু হয় প্রেসিডেন্ট এরশাদের শাসনামলে। তাঁর সামরিক থেকে বেসামরিক সরকার গঠনের প্রক্রিয়ায় স্বার্থান্বেষী লোকজনকে ‘কেনাবেচা’ করে দল ভারী করতে গিয়ে গুলশান-বনানী-বারিধারায় প্লট বরাদ্দ, বহুতল ভবনের নকশা অনুমোদন এবং বিদ্যমান আবাসিক প্লট বা ইমারতে বাণিজ্যিক ব্যবহারে নামমাত্র কনভারশন ফি প্রদান করে অনুমতি প্রদানের ব্যবস্থাকরণে পূর্ত মন্ত্রণালয় ও ডিআইটিকে বাধ্য করা হয়। শুধু তা-ই নয়, তাঁর কথামতো চলা ও প্রদেয় বিভিন্ন সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের জন্য ডিআইটির বোর্ড অব ট্রাস্ট্রিজ ভেঙে আমলাতান্ত্রিক ‘রাজউক’ বা রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ বানানো হয়।

ইউনাইটেড হাসপাতাল, গুলশান, ঢাকা

এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আমাদের পরিকল্পনাবিদদের দুর্বলতা। ধানমন্ডি-গুলশান-বনানী আবাসিক এলাকা হিসেবে পরিকল্পিত হলেও এখানে আবাসিকদের জন্য প্রয়োজনীয় নাগরিক সেবা-সুবিধা ও বাণিজ্যিক কার্যক্রমের জন্য কোনো জমির সংস্থান না রাখা। পরে বিভিন্ন সময়ে বিচ্ছিন্নভাবে এসব বিষয়ের জন্য কিছু জমির সংস্থান করা হলেও তা বাস্তবতার তুলনায় অপর্যাপ্ত প্রতীয়মান হয়। নগর পরিকল্পনাবিদ ও নীতিনির্ধারকেরা এটা বিবেচনাই করেননি, কীভাবে ও কোথা থেকে এসব আবাসিক এলাকায় বসবাসকারী মানুষেরা তাদের প্রয়োজনীয় বিভিন্ন সেবাদি পাবে। ধানমন্ডিতে কোনো কাঁচাবাজার ও কবরস্থান নেই। অপর দিকে ষাটের দশকে বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে গুলশান-বনানী-বারিধারার পরিকল্পনা করা হলেও সেখানে বনানীতে একটি ছোট্ট কবরস্থান ব্যতীত আর কোনো কবরস্থান নেই। ফলে বর্তমানে কবরের ওপর কবর দেওয়া ছাড়া আর কোনো গত্যন্তর নেই। সময়ের প্রেক্ষাপটে এসব আবাসিক এলাকায় জমির দাম যেভাবে আকাশচুম্বী হয়েছে, তেমনি বনানীতে কবরের মূল্য অকল্পনীয় হয়ে গেছে। আর সময়ের প্রেক্ষাপটে এসব এলাকায় প্রথমদিকে খুবই সীমিত ও নিয়ন্ত্রিতভাবে এলাকার মানুষের চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে কিছু সেবা কার্যক্রম (কর্নার শপ, লাইব্রেরি, ব্যাংক ইত্যাদি) পরিচালনার অনুমতি দেওয়া হলেও বহুতল অ্যাপার্টমেন্ট ও অন্যান্য বিবিধ বাণিজ্যিক কার্যক্রমের অধিকতর বিস্তারে সেখানে আপনাআপনিভাবেই স্থানে স্থানে ব্যবসা-বাণিজ্য গড়ে উঠে আজকের এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। বিশেষ করে রিয়েল এস্টেট ব্যবসা ও আবাসিক প্লট কনভারশন করে বাণিজ্যিকীকরণের সুযোগ দেওয়ায় বর্ধিত জনসংখ্যার চাহিদার কারণে বৈধ-অবৈধ প্রক্রিয়ায় ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রবণতা অত্যাধিক বেড়ে যায়।

তা ছাড়া জেনারেল এরশাদের শাসনামলে রাজনৈতিক বিবেচনায় প্লট বরাদ্দের ব্যবস্থা করায় তখন এসব আবাসিক এলাকার অনেক পার্ক, খেলার মাঠ ও লেক ধ্বংস করে প্লট বানিয়ে তা নিজস্ব লোকজনের মধ্যে বরাদ্দের ব্যবস্থা করেও গুলশান-বনানীর পরিবেশের অধঃপতনের সূত্রপাত ঘটানো হয়। ধারণা করা হয়েছিল, গণতান্ত্রিক সরকারব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হলে বিষয়টির রোধ করা যাবে এবং সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হবে। না, হয়নি। বরং দিনে দিনে অবস্থার আরও অধঃপতন ঘটেছে। এই প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন সময়ে কিছু দলীয় সমর্থক ও ব্যবসায়ীরা এত বেপরোয়া হয়ে যান যে তাঁদের কেউ কেউ গুলশান-বনানীতে ছয়তলার অনুমোদন নিয়ে ১২-১৪ তলা পর্যন্ত নির্মাণ করে বসেন। কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তিকে তো ‘আওয়াজ’ দিয়েই এসব অপকর্ম চালাতে দেখা যায়। আর তাঁদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে কনভার্টেট ও বাণিজ্যিক উভয় ধরনের প্লটে কমবেশি সবাই বিধিবিধান উপেক্ষা করে ইমারত নির্মাণ ও ইচ্ছেমতো ব্যবসা-বাণিজ্য চালাতে থাকেন। রাজউকের পক্ষ থেকে বিভিন্ন সময়ে এসব অবৈধ ও অননুমোদিত নির্মাণ এবং ব্যবসা-বাণিজ্যের বন্ধকরণে কিছু চেষ্টা যে চালানো হয়নি তা নয়, কিন্তু লাভ হয়নি। কারণ, যখন যাঁরা ক্ষমতায় ছিলেন, তাঁদের দলীয় লোকজন ও ক্ষমতার প্রভাবে বা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের ‘ম্যানেজ’ করে আজ অবধি এসব অবৈধ কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িত কোনো একটা প্লটেরও বরাদ্দ বা ইমারতের নকশা চ‚ড়ান্তভাবে বাতিল করা যায়নি। কতিপয় ক্ষেত্রে কিছু ইমারতের সামনে ভাঙচুর করা এবং মোবাইল কোর্ট কর্তৃক প্লটের মালিক বা ভাড়াটিয়াদের জরিমানা করা হলেও কোনো প্লট বা ইমারতে পরিপূর্ণভাবে অবৈধ ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ করা সম্ভব হয়নি। আর এখন তো এসব এলাকার ঘরে ঘরে বুটিক শপ, রেস্টুরেন্ট, ক্যাফে, কোচিং সেন্টার, স্কুল চালু হয়েছে।

গুলশান এলাকায় উচ্ছেদ অভিযান

বর্তমানে গুলশান-বনানীর অবস্থা এমন যে রিয়েল এস্টেট ব্যবসায়ীদের জমি লাভে প্রচন্ড প্রতিযোগিতা ও ব্যাংক-বীমা কোম্পানিগুলোর দাপটে হালে গুলশান ও বনানীর কামাল আতাতুর্ক অ্যাভিনিউতে কাঠাপ্রতি জমির দাম ৮-১০ কোটি টাকা পর্যন্ত পৌঁছেছে। আর প্লটের মালিক ও রিয়েল এস্টেট ব্যবসায়ীদের অতি লাভ ও হারাহারিতে অনেক প্লটে তো ২০-৩০টা পর্যন্ত ফ্ল্যাট নির্মিত হয়েছে। ছোট রাস্তার ধারেও বড় বড় বাণিজ্যিক অফিস, বিশ্ববিদ্যালয়, হাসপাতাল, হোটেল, শপিং সেন্টার, ব্যাংক-বীমা, ক্লাব ইত্যাদি স্থাপিত হয়েছে। সব মিলিয়ে বর্তমানে এসব এলাকার কোনো একটা ইমারত বা স্থাপনায় নেই পর্যাপ্ত কার পার্কিং স্পেস। যেসব ইমারতে বেসমেন্ট নির্মাণ করা হয়েছে, অনেকে তাও আবার অন্য ব্যবহারে নিয়ে গেছেন। এভাবে ইমারতের অভ্যন্তরে পার্কিং স্পেসের অভাবে সংলগ্ন সড়কের ওপর গাড়ি পার্কিং করে রাখার কারণে সর্বক্ষণ যানজট লেগেই থাকে। ফলে পরিকল্পিত আবাসিক এলাকা হয়েও এখানে এখন আর কেউ নির্বিঘ্নে বসবাস ও চলাচল করতে পারছেন না। এহেন পরিস্থিতিতে, হলি আর্টিজান বেকারি রেস্টুরেন্টে নির্মম হত্যাযজ্ঞের পর গুলশান-বনানী এলাকার ওপর সবার টনক নড়ে। উত্তর গুলশানস্থ লেকপাড়ে ওই প্লটটি দেশের একজন স্বনামধন্য মহিলা ডাক্তারকে একটি ম্যাটারনিটি ক্লিনিক স্থাপনের জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল। সেখানে প্রথমে ‘লেক ভিউ’ নামে একটি ক্লিনিক স্থাপিত হলেও পরে প্লটটির অংশবিশেষে মালিকের অতিলোভে এই রেস্টুরেন্টটি করতে ভাড়া দেওয়া হয়। যতটুকু জানা যায়, এই রেস্টুরেন্টটির স্থাপনে রাজউকের কোনো ধরনের অনুমোদন ছিল না, যা লিজ দলিলের সঙ্গে সম্পূর্ণভাবে ব্যত্যয়। ঘটনা-উত্তর প্রশ্ন উঠেছে, সিটি করপোরেশনও কীভাবে এই গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় রেস্টুরেন্ট পরিচালনার ট্রেড লাইসেন্স প্রদান করেছে এবং অন্য সেবা কর্তৃপক্ষগুলো এখানে কীভাবে তাদের সার্ভিসেসের বাণিজ্যিক সংযোগ দিয়েছে? বাস্তবে নগরীর বিভিন্ন সংস্থার মধ্যে সমন্বয়হীনতার সুযোগে সর্বত্র এ রকম অপকর্ম ঘটছে। স্বাভাবিকভাবে এতে প্রভাব-প্রতিপত্তি, অর্থ ও দুর্নীতির বিষয়গুলোও জড়িত। এতে সত্যিকার অর্থে, এসব এলাকা থেকে অননুমোদিত বা অবৈধ স্থাপনাসমূহ আদৌ অপসারণ করা যাবে কি না, তা নিয়ে সর্বমহলে গুঞ্জন চলছে। কথা হচ্ছে গুলশান-বনানী আবাসিক এলাকাকে এর পূর্বাবস্থায় ফেরত নেওয়া বা আনা যাবে কি!

তবে নগরীর অভিজাত আবাসিক এলাকায় অনাবাসিক তথা বাণিজ্যিক কার্যক্রমের অনিয়ন্ত্রিত বিস্তার ও পরিবেশের অবক্ষয়ে এই সিদ্ধান্ত গ্রহণে সরকারের আর কোনো বিকল্প ছিল না। মন্ত্রিসভা থেকে সিদ্ধান্তটির বাস্তবায়নে তাৎক্ষণিক রাজউককে অনুমোদন-বহিভূত সব ইমারত কিংবা স্থাপনার নকশা বাতিল ও উচ্ছেদ করা, সিটি করপোরেশনকে এসব স্থাপনার ব্যবসা-বাণিজ্যের ট্রেড লাইসেন্স বাতিল করা এবং ঢাকা ওয়াসাকে পানি ও পয়োনিস্কাশন, ডেসা/ডেসকোকে বিদ্যুৎ ও তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষকে গ্যাস সরবরাহ বিচ্ছিন্ন করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সেই সঙ্গে সরকারের কর বিভাগকে এসব স্থাপনা থেকে ট্যাক্স ও ভ্যাট গ্রহণ না করার নির্দেশও দেওয়া হয়েছে। কিন্তু ওই সিদ্ধান্তগ্রহণ ও নির্দেশনার পর ইতিমধ্যে প্রায় চার মাস অতিক্রান্ত হলেও কোনো সংস্থার পক্ষ থেকে এখনো কারও বিরুদ্ধে তেমন কার্যকর কোনো ব্যবস্থা গৃহীত হয়নি। বরং এসব অনৈতিক কাজের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের দৌড়-ঝাঁপ শুরু হয়েছে। যার প্রভাবে, যেখানে মন্ত্রিসভায় সিদ্ধান্ত হয় যে এসব আবাসিক এলাকায় বৈধ ও অবৈধ কোনো অনাবাসিক/বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান ও কার্যক্রম থাকতে পারবে না, কয়েক দিন পর সেখানে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের বরাতে বলা হয় ‘সেবামূলক’ প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যাপারে এলাকাবাসীর মতামতের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। কিন্তু দেশের বিদ্যমান পরিস্থিতি তথা প্রভাবশালী ব্যক্তিদের প্রভাবে শেষ পর্যন্ত এই সিদ্ধান্তের কতটুকু বাস্তবায়ন হয়, এটিই এখন দেখার অপেক্ষায়।

গুলশান-১

এ বিষয়টির যথাযথভাবে নিষ্পত্তির জন্য কীভাবে এসব আবাসিক এলাকা অনাবাসিকে পরিণত হলো এবং কারা এর জন্য দায়ী তা চিহ্নিত করা প্রয়োজন। কিছু কেস স্টাডি বা বিস্তারিত তদন্তেরও প্রয়োজন রয়েছে- আবাসিক এলাকায় প্লট বরাদ্দ ও নকশা অনুমোদন নিয়ে কীভাবে তা বাণিজ্যিক বা অন্য কারণে ব্যবহার করা হল। এর জন্য শুধু বরাদ্দগ্রহীতা বা মালিকপক্ষই দায়ী, নাকি আরও কেউ দায়ী তা চিহ্নিত করা প্রয়োজন। জমির ব্যবহার পরিবর্তন, নকশা সংশোধন, বাণিজ্যিক ব্যবহারের অনুমতি লাভ, ট্রেড লাইসেন্সপ্রাপ্তি, বাণিজ্যিক ভিত্তিতে পানি-বিদ্যুৎ-গ্যাসের সংযোগ লাভ ইত্যাদি বিষয়গুলো তো এত সহজে হওয়ার কথা নয়। অনুরূপভাবে আবাসিক এলাকায় ব্যবসা-বাণিজ্যের ট্যাক্স নির্ধারণের বিষয়টিও কিন্তু সহজ নয়। কে বা কারা এসব প্লট বরাদ্দ নিয়েছেন, তাঁদের তালিকা দেখলে বিষয়টি সহজে বোঝা যাবে। আগে এসব স্থানের সঙ্গে ‘মডেল টাউন’ কথাটি জড়িত ছিল, যা হালে আর শোনা যায় না। কারণ, এসব শহর প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য অনেক আগে বিচ্যুতি ঘটেছে অর্থাৎ এখন নগরীর পরিকল্পিত-অপরিকল্পিত এলাকাগুলো প্রায় একাকার হয়ে গেছে। যেমন- ধানমন্ডির সঙ্গে জিগাতলা-রায়েরবাজার, গুলশান-বারিধারার সঙ্গে বাড্ডা-শাহজাদপুর যেন মিশে গেছে।

বাস্তবে দেশের সার্বিক অবস্থা বিবেচনায় এসব এলাকাকে পুরোপুরি পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে কি না, তাও বিবেচ্য বিষয়। কেননা, এর পেছনে দেশের প্রভাবশালী ব্যক্তিদের স্বার্থ জড়িত। এও সুচিন্তিতভাবে নির্ধারণ করা প্রয়োজন, এসব স্থাপনা ও প্রতিষ্ঠানগুলো কোথায় স্থানান্তরিত হবে? তাদের কী পরিকল্পিত এলাকা থেকে সরিয়ে অপরিকল্পিত এলাকা বা রাজধানীর বাইরে পাঠিয়ে দেওয়া হবে? পূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন বলেছেন, আগ্রহী ব্যক্তিদের পূর্বাচল বা উত্তরা (তৃতীয় পর্ব) এলাকায় জমি বরাদ্দের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। কিন্তু এসব এলাকা তো এখনো বাসযোগ্য হয়নি। তাই সার্বিক বিষয়টি যথাযথভাবে পর্যালোচনা করে এগোনো উচিত। তা ছাড়া গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, রাজধানীর এসব স্থাপনা ও প্রতিষ্ঠান থেকেই সরকার বেশি কর তথা রাজস্ব পায়, সুতরাং সিদ্ধান্তটি যেন সরকারের জন্য আবার বুমেরাং হয়ে না বসে তাও ভাবা প্রয়োজন। তবে আবাসিক এলাকার পরিবেশ বিঘ্নিত করে গণহারে ব্যবসা-বাণিজ্য ও এলাকাবাসীর দুর্ভোগ সৃষ্টি করা কোনো অবস্থায় কাম্য নয়। মহাপরিকল্পনায় ভূমি ব্যবহার তথা মূল বরাদ্দপত্রের শর্তানুসারে যেখানে যা হওয়ার, সেখানে তা-ই হওয়া উচিত। কিন্তু দৃশ্যত দেশে কোনো সরকারের আমলে এসব সিদ্ধান্তের কাঙ্খিত প্রতিফলন ঘটেনি। বরং মহাপরিকল্পনা ও স্থানীয় উন্নয়ন পরিকল্পনায় যা-ই থাকুক না কেন, যখন যে সরকার যা চেয়েছে, তা-ই হয়েছে। ফলে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের কোনো একটি শহর বা পৌর এলাকা মূল পরিকল্পনা মোতাবেক গড়ে ওঠেনি।

মালয়েশিয়ান দূতাবাস, বারিধারা

কাজেই এই বিশাল কর্মযজ্ঞটি শুরু করার আগে প্রতিটা এলাকায় সংশ্লিষ্ট সব সংস্থার সমন্বয়ে বিস্তারিত জরিপ ও নীতিমালা প্রণয়ন করে এগোনো উচিত। কে বা কারা, কখন কীভাবে তাঁদের প্লটের ব্যবহার পরিবর্তন করেছেন, তা গভীরভাবে বিচার-বিশ্লেষণ ও পর্যালোচনার প্রয়োজন। কারণ, যাঁরা বিভিন্ন সময়ে কনভারশন ফি দিয়ে অনুমতি নিয়েছেন, তাঁদের ক্ষেত্রে সেভাবে (কেস টু কেস) ব্যবস্থা নিতে হবে। তড়িঘড়ি না করে, অবশ্যই যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করে কাজটি বাস্তবায়ন করতে হবে। অন্যথায় এ নিয়ে অনেক মামলারও উদ্ভব হতে পারে। লক্ষণীয় যে বিভিন্ন সময়ে তড়িঘড়ি করে এ ধরনের কাজ বাস্তবায়ন করতে গিয়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ম ও আইনের গ্যাড়াকলে পড়ে বা স্বার্থান্বেষী মহলের প্রভাবে বাধাগ্রস্ত হয়েছে। কাজেই সমন্বিত কর্মসূচি গ্রহণের বিকল্প নেই। দলীয় বা রাজনৈতিক বিবেচনার পরিবর্তে স্থানীয় এলাকা বা জোনভিত্তিক দলমত-নির্বিশেষে এলাকার গণ্যমান্য মুরব্বি ও পেশাজীবীদের সমন্বয়ে কমিটি গঠন করে সেই ভিত্তিতে কোন স্থাপনাটি প্রকৃত সেবামূলক এবং রাখা প্রয়োজন, তার ওপরই সিদ্ধান্ত ও কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে।

প্রকৌশলী মো. এমদাদুল ইসলাম
নগর ও উন্নয়ন বিশ্লেষক সাবেক প্রধান প্রকৌশলী, রাজউক

প্রকাশকাল: বন্ধন ৭৬ তম সংখ্যা, আগস্ট ২০১৬

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top