অমিত সম্ভাবনার আবাসনশিল্প
আবাসনশিল্পের সমস্যা ও সম্ভাবনা

প্রকৃতিতে লাগা বসন্তের মতো দেশের প্রায় স্থবির হয়ে পড়া ব্যবসা-বাণিজ্যেও লেগেছে বসন্তের ছোঁয়া। এ থেকে বাদ যায়নি দেশীয় আবাসন খাতও। অপূরণীয় ক্ষতি কাটিয়ে আবার জেগে উঠছে এ খাতসংশ্লিষ্ট ল্যান্ড ডেভেলপার, হাউজিং প্রতিষ্ঠান, স্থপতি, প্রকৌশলী, ঠিকাদার, শ্রমিক সবাই। তবে শিল্পটির আকাশ যে পুরোটাই মেঘমুক্ত তা বলা যাবে না এখনই। অসম্পন্ন কাজ সম্পন্ন হচ্ছে; উৎপাদন বাড়ছে নির্মাণসংশ্লিষ্ট পণ্যের; চেষ্টা চলছে অবিক্রীত ফ্ল্যাট বিক্রির। সরকারের কাছে দাবি রাখছে খাতসংশ্লিষ্টরা; সরকারও নিচ্ছে নানা পরিকল্পনা। বিগত দিনের ক্ষতি পুষিয়ে এভাবেই চলছে শিল্পটির এগিয়ে যাওয়ার সংগ্রাম। এ সংগ্রামের সফলতার ওপর নির্ভর করছে শিল্পটির সঙ্গে জড়িত কোটি মানুষের ভাগ্য; জীবন আর জীবিকা। অমিত সম্ভাবনাময় এই শিল্পটি যদি মাথা তুলে দাঁড়াতে পারে, তবে দেশের আবাসন সমস্যা সমাধানের পাশাপাশি সৃষ্টি হবে অর্থনীতির শক্তিশালী এক ভিত।

দেশের অর্থনৈতিক আয়ের সবচেয়ে বড় খাত পোশাকশিল্প। এরপরই অবস্থান আবাসনশিল্পের। বাংলাদেশ ল্যান্ড ডেভেলপারস অ্যাসোসিয়েশনের (বিএলডিএ) তথ্য মতে, দেশের জাতীয় অর্থনীতিতে শতকরা ২১ ভাগ অবদান আবাসনশিল্পের। এর সঙ্গে জড়িত ৩০০টি শিল্প খাতে বিনিয়োগের পরিমাণ প্রায় ১৭৫ হাজার কোটি টাকা। প্রবাসী বাঙালিদের পাঠানো অর্থের ৫০ ভাগই বিনিয়োগ হয় এ খাতে। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রায় আড়াই কোটি মানুষ শিল্পটির ওপর নির্ভরশীল। গত কয়েক বছর ধরে চলা এ খাতে অচলাবস্থার কারণে আটকে আছে বিনিয়োগের বড় একটি অংশ। ব্যবসায়িক স্থবিরতায় এরই মধ্যে বেকার হয়েছে প্রায় ২৫ লাখ শ্রমিক। এ খাতে সৃষ্টি হচ্ছে না নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ। অথচ প্রতিবছরই দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে পাস করে বের হচ্ছেন অনেক স্থপতি ও প্রকৌশলী। আবাসনশিল্পে মন্দার কারণে মাসের পর মাস স্থপতি, প্রকৌশলী, ঠিকাদারসহ খাতসংশ্লিষ্টরা পাচ্ছে না কাজের উপযুক্ত সম্মানী। এ শিল্পের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত ইট, বালু, রড, সিমেন্ট, টাইলস, ইলেকট্রিক পণ্যসহ নানা উৎপাদনমুখী খাতের উৎপাদন কমছে ব্যাপক হারে। গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংযোগের অভাবে সম্পূর্ণ রেডি ফ্ল্যাট গ্রাহকের কাছে হস্তান্তর করতে পারছেন না অধিকাংশ ডেভেলপার কোম্পানি। আর তাই অবিক্রীত রেডি ফ্ল্যাটের সংখ্যাটাও নেহাত কম নয়। এ তালিকায় রয়েছে আবাসন ব্যবসায়ীদের সংগঠন রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (রিহ্যাব) সদস্য ৩৩৮টি কোম্পানির প্রায় ২২ হাজার ৫৭৫টি রেডি ফ্ল্যাট, যার বর্তমান আর্থিক বাজারমূল্য ২১ হাজার ৫০৬ কোটি ৩৬ লাখ ৭৫ হাজার ১১১ টাকা (সূত্র-রিহ্যাব)। এতে আর্থিকভাবে চরম ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে আবাসন কোম্পানি, ফ্ল্যাট ও জমির মালিকেরা। রিহ্যাবের হিসাব বলছে, আবাসনশিল্পে বিনিয়োগের পরিমাণ প্রায় ৯০ হাজার কোটি টাকা। এর এক-তৃতীয়াংশই প্রবাসী বিনিয়োগ। মধ্য আয়ের মানুষের সঞ্চয় ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বিপুল পরিমাণ ঋণের টাকাও যুক্ত এর সঙ্গে। এ খাতকে ঘিরে গড়ে উঠেছে ২৭০টির মতো উপখাত, যার সঙ্গে সম্পর্কিত ছোট-বড় প্রায় ১০ হাজার শিল্প। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এ শিল্পে কাজ করছে কয়েক কোটি মানুষ।

নি‍র্মাণাধীন আবাসন প্রকল্প

দেশের আবাসনশিল্পের দুরবস্থার জন্য মূলত দায়ী রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা। গত বছর টানা হরতাল-অবরোধে আবাসন খাতে ক্ষতি হয়েছে প্রায় ৬০০ কোটি টাকা, দাবি রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (রিহ্যাব)। এ ছাড়া রয়েছে বিদ্যুৎ ও গ্যাস সংযোগসহ নানা সমস্যা। তা ছাড়া একটি প্রকল্প সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে পোহাতে হয় নানা ঝক্কি-ঝামেলা। বেসরকারি আবাসিক প্রকল্প অনুমোদনে ১১টি সরকারি সংস্থা থেকে সংগ্রহ করতে হয় ছাড়পত্র। এতে সময় লাগে এক বছরেরও বেশি। আবার ফাইল নড়ে না ঘুষ ছাড়া। এসব সমস্যার পাশাপাশি খাতসংশ্লিষ্টদের নিজেদের সৃষ্ট নানা সমস্যায় হুমকির মুখে আবাসনশিল্প। 

যে যে কারণে সম্ভাবনাময় আবাসনশিল্পটি দুর্দশায় পতিত

  • জমির উচ্চমূল্য
  • নির্মাণসামগ্রীর অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি
  • ব্যাংক ঋণের জটিলতা, সীমাবদ্ধতা ও উচ্চ সুদের হার
  • বিদ্যুৎ ও গ্যাসসংকট
  • রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা
  • ব্যাপক চাঁদাবাজি
  • সঠিক পরিকল্পনার অভাব
  • সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর অসহযোগী মনোভাব
  • সেবাদানকারী সংস্থাগুলোর সমন্বয়হীনতা
  • নকশা অনুমোদনে রাজউকের দীর্ঘ প্রক্রিয়া
  • বিনিয়োগস্বল্পতা
  • বিনিয়োগকৃত অর্থ ফেরত পাওয়ার অনিশ্চয়তা
  • ভূমিস্বল্পতা
  • ভূমিনীতি
  • ট্যাক্স জটিলতা
  • মূল্যবৃদ্ধি ও মূল্যহ্রাসের ব্যাপক তারতম্য
  • মধ্যস্বত্বভোগী ও দালালদের দৌরাত্ম্য
  • উঁচু স্থাপনা নির্মাণে কড়াকড়ি আরোপ।

আবাসনশিল্পের সঙ্গে জড়িত সবারই চাওয়া খাতটি ফিরে পাক তার স্বাভাবিকতা। এ লক্ষ্যে প্রচেষ্টারও কোনো কমতি নেই। চলছে নানা সেমিনার, সিম্পোজিয়াম, সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রী ও দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বৈঠক। সম্প্রতি রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (রিহ্যাব) আবাসনশিল্পে চলমান সমস্যা সমাধান এবং ক্ষতি পুষিয়ে নিতে সরকারের কাছে পেশ করেছে কিছু দাবিদাওয়া। যার অন্যতম দ্রুততার সঙ্গে ডিটেইল এরিয়া প্ল্যানের (ড্যাপ) ক্রটি সংশোধন, বিভিন্ন অধিদপ্তরে ছাড়পত্র নেওয়ার প্রক্রিয়া সহজীকরণ, ওয়ানস্টপ সার্ভিস চালু এবং বিগত সময়ে অনুমোদন না পাওয়া প্রকল্পগুলোর অনুমতি দানসহ বিদ্যমান সব ধরনের সমস্যার সমাধান। এ ছাড়া সংগঠনটির নেতৃত্ব গ্যাস, পানি, বিদ্যুৎ সমস্যা সমাধানে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের কর্তাব্যক্তিদের সহায়তা চেয়েছেন। এ ছাড়া রয়েছে ফ্ল্যাট বা অ্যাপার্টমেন্ট ক্রেতাদের স্বল্প সুদে দীর্ঘমেয়াদি ব্যাংকঋণ প্রদানে অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাছে রাখা প্রস্তাব।

এ ব্যাপারে পিছিয়ে নেই সমজাতীয় অন্য সংগঠনগুলোও। বাংলাদেশ ল্যান্ড ডেভেলপারস অ্যাসোসিয়েশনের (বিএলডিএ) পক্ষ থেকে আবাসন খাতে বিদ্যমান কতিপয় সমস্যা সমাধানে কয়েকটি প্রস্তাবনা তুলে ধরা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে- এক মাসের মধ্যে প্রকল্প অনুমোদনের জন্য ওয়ানস্টপ সার্ভিস চালু, ভূমি উন্নয়ন বিধিমালা ২০১২ (সংশোধিত) প্রণয়নের আগ পর্যন্ত আবাসন প্রকল্পগুলোতে বাড়ি তৈরির নকশা অনুমোদন, বিদ্যমান হাউজিং প্রকল্পগুলোকে ড্যাপে ওভার লে হিসেবে উপস্থাপন, নতুন ড্যাপ প্রণয়নের ক্ষেত্রে আবাসন খাতের সংগঠনের প্রতিনিধিদের রিভিউ কমিটিতে অন্তর্ভুক্তিকরণের  মতো বিষয়।

ক্রমেই পিছিয়ে পড়া আবাসনশিল্পের পূর্বরূপ ফিরিয়ে সমস্যার গভীর খাদ থেকে তুলে আনতে সরকারের গণপূর্ত মন্ত্রণালয়, রাজউক, সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় নিচ্ছে নানা পদক্ষেপ। কেননা জাতীয় অর্থনীতিতে আবাসনশিল্পের অবদান অনেক। অসংখ্য মানুষকে আবাসন সেবার আওতায় আনা; দেশের বেকার সমস্যা কমানো এবং এই শিল্পকে ঘিরে গড়ে ওঠা নানা উৎপাদনমুখী শিল্প গড়ে ওঠায় দেশের সামগ্রিক উন্নয়নে এর রয়েছে অসামান্য অবদান। প্রতিবছর জাতীয় রাজস্ব খাতে শিল্পটি দিচ্ছে প্রচুর অর্থ। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড থেকে প্রাপ্ত তথ্যানুসারে বিগত কয়েকটি অর্থবছরে জিডিপিতে আবাসন খাত ও খাত সংশ্লিষ্ট শিল্পের অবদান-

সুস্থতায় পরিবেশবান্ধব আবাসন

উপরিউক্ত চার্ট থেকে বিভিন্ন সমস্যা জর্জরিত খাতটির প্রদেয় রাজস্ব চিত্র সহজেই অনুমেয়। দেশের মোট জিডিপি আয় বাড়ার সঙ্গে রাজস্বও বেড়েছে এ খাত থেকে। কিন্তু ২০০৯-১০ অর্থবছরের পর দেশে চরম রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা বিরাজ করায় রাজস্ব কমেছে অনেকটাই। বিপুল অঙ্কের রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হওয়ায় সরকার নিতে যাচ্ছে কিছু পদক্ষেপ। সম্প্রতি গণপূর্ত মন্ত্রণালয় আবাসন খাতের সমস্যা সমাধানে ‘ওয়ান উইন্ডো সেল’ করার ব্যাপারে ভাবছে। এই সেল গঠিত হলে একই স্থানে আবাসন খাতসংশ্লিষ্ট ১০-১১টি দপ্তরের সেবা একযোগে পাওয়া যাবে, এখনো অনুমোদন পেতে আলাদা আলাদা দপ্তরে যেতে হয়। যাতে সময় লাগে এক বছরেরও বেশি। ইতিমধ্যেই এ জন্য একটি উপকমিটি কাজ করছে, যাদের প্রতিবেদনের ভিত্তিতে চূড়ান্ত হবে সেল গঠনের সিদ্ধান্ত। এ ছাড়া আবাসনশিল্পের সুবিধার্থে চলছে জোনভিত্তিক অনুমোদন প্রদানেরও চিন্তাভাবনা। এ ব্যবস্থায় একটি এলাকায় কোনো একটি ভবন নির্মাণের জন্য অনুমোদন নেওয়ার পর আরেকটি ভবন নির্মাণে আবারও একই বিষয়ে অনুমোদনের প্রয়োজন পড়বে না। কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) থেকেও। নকশা অনুমোদনে যাতে সরকারি সংস্থাগুলোয় যেতে না হয় সে জন্য ওয়ান স্টপ সার্ভিস চালুর ব্যবস্থা নিতে যাচ্ছে রাজউক। তা ছাড়া আবাসন নির্মাণ প্রতিষ্ঠানগুলো অনুমোদিত নকশা মেনে যথাযথভাবে প্রকল্প বাস্তবায়ন করে ব্যবস্থা করা হচ্ছে তা মনিটরিংয়েরও।

আবাসনশিল্পের অগ্রগতির লেখচিত্র

কিন্তু এতসব পদক্ষেপ নিলেও সমস্যা যে পুরোটাই কাটবে তা মনে করছেন না আবাসন খাতের বিশেষজ্ঞরা। কারণ, এখনো এ শিল্পকে ঘিরে গৃহীত হয়নি কোনো মহাপরিকল্পনা। আবাসন খাতের সমস্যা সমাধানের গঠিত হয়নি কোনো কমিশনও, যা ছিল দীর্ঘদিনের দাবি। এ শিল্পের গতি-প্রকৃতি, ভবিষ্যৎ, জাতীয় স্বার্থ এবং সামাজিক বিকাশে খাতটির যথাযথ গুরুত্ব সরকারি নীতিনির্ধারকেরা এখনো উপলব্ধি করতে পারেননি বলে এ ব্যাপারে এখনো অনেকটাই নির্বিকার। এ কারণে তৃতীয় বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় চরম উপেক্ষিত বাংলাদেশের আবাসনশিল্প। স্বাধীনতার ৪২ বছর পেরোলেও এখনো সবার জন্য সম্ভব হয়নি আবাসনসুবিধা নিশ্চিত করা। রিহ্যাবের হিসাবমতে, ২০১৫ সাল নাগাদ দেশে আবাসনের চাহিদা হবে প্রায় এক কোটি। এখন শুধু ঢাকাতেই প্রতিবছর এক লাখ পরিবারের জন্য নতুন বাসস্থান প্রয়োজন। অথচ প্রতিবছর নির্মিত আবাসনের পরিমাণ সর্বসাকুল্যে ১০ হাজারের বেশি নয়। আবাসনসংকট মাথায় নিয়ে কোনো জাতিই সুষ্ঠু ও সমন্বিত উন্নয়নের ধারায় এগিয়ে যেতে পারে না। অথচ রাষ্ট্রের প্রতিটি নাগরিকেরই চাই একটু মাথা গোঁজার ঠাঁই! এটা কোনো দাবি নয়, অধিকার। ঘনবসতিপূর্ণ এ দেশের বিশাল এই জনগোষ্ঠীর আবাসন সেবা দিতে সরকার তেমন কিছুই করেনি। এ ক্ষেত্রে ব্যক্তিমালিকানাধীন আবাসন কোম্পানির ভূমিকা অনস্বীকার্য। শত প্রতিক‚লতার মধ্যে এসব কোম্পানি বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে দেশের আবাসন সমস্যা নিরসন করছে অনেকাংশে। এ জন্য অবশ্যই তারা প্রশংসার দাবিদার।

অপরকল্পিতভাবে গড়ে ওঠা নগর আবাসন

অবশ্য আবাসন কোম্পানির বিরুদ্ধে অভিযোগেরও কমতি নেই। ব্যাপক আবাসন চাহিদাকে পুঁজি করে কোম্পানিগুলোর কাছে সেবার চেয়ে অনেক ক্ষেত্রে ব্যবসাই মুখ্য। রাজধানী ও এর আশপাশে নদীনালা, খালবিল, জলাধার ভরাট করে আবাসন কোম্পানিগুলো একের পর এক তুলছে বহুতল ভবন। এতে নষ্ট হচ্ছে কৃষিজমি; হারাচ্ছে পরিবেশের ভারসাম্য। অনেক হতদরিদ্র কৃষকের জমি কখনো নামমাত্র মূল্যে কিনে বা কখনো জোড়জবর দখল করে নেওয়া হচ্ছে। নব্বইয়ের দশকে ব্যাপক আবাসন চাহিদার কল্যাণে গড়ে ওঠে অসংখ্য আবাসন কোম্পানি। ২০০০ সালের পর খাতটিতে ব্যাঙের ছাতার যুক্ত হয়েছে মানহীন আবাসন কোম্পানি। এদের লক্ষ্য সমাজের উচ্চবিত্ত শ্রেণী। এদেরকে ঘিরেই মূলত কোম্পানিগুলো বানিয়েছে বিলাসবহুল সব অ্যাপার্টমেন্ট। সমাজের মধ্যবিত্ত শ্রেণীর জন্য গড়ে ওঠেনি তেমন কোনো আবাসনব্যবস্থা। তা ছাড়া ভালো কোম্পানিগুলো ভবন নির্মাণে মান বজায় রাখলেও অসংখ্য প্রতিষ্ঠান এসবের ধার ধারেনি। নামসর্বস্ব কিছু কোম্পানি মধ্যবিত্তদের জন্য কিছু অ্যাপার্টমেন্ট নির্মাণ করলেও সেগুলোর মান নিয়ে রয়েছে নানা প্রশ্নœ। নিম্নমানের নির্মাণপণ্য এবং এগুলো সঠিক অনুপাতে ব্যবহার না করায় ভবন নির্মাণের কয়েক বছরের মধ্যেই ভবন হেলে পড়াসহ নানা সমস্যা প্রকট হয়ে ওঠে। এ ছাড়া কাজ শেষ হওয়ার কয়েক বছরের মধ্যেই ভবনে ফাটল, ড্যাম্প সমস্যা, পানি চুঁইয়ে পড়াসহ নানা অভিযোগ অ্যাপার্টমেন্ট ক্রেতাদের। এসব সমস্যা জেনেও মধ্যবিত্তেরা তাদের বহুকষ্টে সঞ্চিত অর্থ দিয়ে অ্যাপার্টমেন্ট কিনে যে সমস্যায় পড়ছে-

  • একটি ভবন থেকে আরেকটি ভবনে অপর্যাপ্ত জায়গা
  • খোলামেলার অভাবে বাতাস না পাওয়া
  • রোদের অভাব
  • বাগান না থাকা
  • আগুন নিয়ন্ত্রণব্যবস্থার সীমাবদ্ধতা
  • বাচ্চাদের খেলার জায়গার অভাব
  • ভবনের ছাদে জমির মালিকের একক অধিকার
  • মেইল বক্স না থাকা
  • পার্কিং সমস্যা
  • সরু সিঁড়ি
  • আলো-বাতাস প্রবেশের সমস্যা
  • স্যাঁতসেঁতে ভাব
  • পানি ও বিদ্যুৎ লাইনে সমস্যা
  • স্যুয়ারেজ সমস্যা প্রভৃতি।
ঢাকার আবাসন চিত্র

অথচ উন্নত দেশে আবাসন কোম্পানিগুলোকে ভবন নির্মাণে কিছু নিয়মকানুন মানতে হয়। উচ্চবিত্তের পাশাপাশি অ্যাপার্টমেন্ট নির্মাণে মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্তের জন্য আলাদা আলাদা আবাসন প্রকল্প নিতে হয়। এতে কোম্পানিগুলো শুধু ব্যবসাই করে না, সমাজ সেবাও সমান অবদান রাখে। যেহেতু এ দেশে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর সংখ্যা বেশি তাই এই বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর কথা বিবেচনায় নিয়ে প্রতিটি আবাসন কেম্পানির এ খাতে বিনিয়োগ করা উচিত। তবেই সমাজের বিশাল এই শ্রেণী অ্যাপার্টমেন্ট কিনতে উৎসাহী হবে। আবাসনশিল্পে লাগবে দীর্ঘমেয়াদি ব্যবসায়িক জোয়ার।

যেকোনো দেশের আবাসনশিল্প তথা ব্যবসার উন্নয়নে ব্যাংকঋণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। কিন্তু এখানে এ খাতে ঋণের ব্যাপারে এখনো কোনো নির্দিষ্ট সিদ্ধান্তে আসা সম্ভব হয়নি। শিল্পটির সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের অভিমত, অনিয়ন্ত্রিত ও অস্বাভাবিক ঋণপ্রবাহে এ খাত বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উদাসীনতায় ২০০৬ সাল থেকে ক্রমবর্ধমান হারে আবাসন খাতে ঋণ সরবরাহে এগিয়ে এসেছে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো। অর্থনীতিবিদদের অনেকের মতে, এ শিল্পে আর্থিক বুদবুদ (ইকোনমিক বাবল) সৃষ্টি হয়েছে। আবাসনশিল্পকে অনুৎপাদনশীল খাত বিবেচনা করে এই খাতে সব প্রকার ঋণ সরবরাহ কমানোর শর্তজুড়ে দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এমন কড়াকড়ি শর্তারোপের ফলে সরকারি, বেসরকারি ও বিশেষায়িত বাণিজ্যিক ব্যাংক এবং প্রতিষ্ঠানগুলো আবাসন খাতে ঋণ সরবরাহ কমিয়েছে উল্লেখযোগ্য হারে। পাশাপাশি তারা সরবরাহকৃত ঋণের অর্থ ফেরতের জন্য চাপ দিচ্ছে আবাসন কোম্পানিগুলোকে। এতে একদিকে আবাসন কোম্পানিগুলো যেমন ঋণ পাচ্ছে না, অন্যদিকে ফ্ল্যাট বা প্লট ক্রেতাদেরও ঋণ দেওয়া হচ্ছে না। এতে এ খাতের ব্যবসায়ীরা দারুণ ক্ষুব্ধ। রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (রিহ্যাবের) তথ্যানুসারে, আবাসন খাতে ব্যাংকঋণ হিসেবে ছাড়কৃত অর্থের পরিমাণ-

রিহ্যাব প্রদত্ত তথ্যে দেখা যায়, ২০০৬ সাল থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত সাত বছরে প্রায় পাঁচ গুণ ঋণপ্রবাহ বেড়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, আবাসন খাতে ধারাবাহিকভাবে বেড়েছে ব্যাংক ঋণের স্থিতিও। ২০১২ সালে আবাসন খাতে মোট ঋণ স্থিতি ছিল ৩৫ হাজার ২১০ কোটি টাকা, যা ২০১১ সালে ২৮ হাজার ৮০ কোটি টাকা, ২০১০ সালে ছিল ২১ হাজার ৬৭০ কোটি টাকা। আবাসন খাতের বিশেষায়িত সরকারি আর্থিক প্রতিষ্ঠান হাউজ বিল্ডিং ফাইন্যান্স করপোরেশনের (এইচবিএফসি) ২০১২ সালে ঋণ স্থিতি ছিল দুই হাজার ৬০০ কোটি টাকা, ২০১০ ও ২০১১ সালে এই স্থিতি ছিল দুই হাজার ৫১০ কোটি টাকা। আর্থিক প্রতিষ্ঠান ন্যাশনাল হাউজিং ফাইন্যান্স আবাসন খাতে ঋণ স্থিতি ২০১১ সালের থেকে ২০১২ সালে কমিয়ে ২৪০ কোটি টাকায় নিয়ে আসে। যেখানে ২০১১ সালে ছিল ২৫০ কোটি টাকা। তবে আবাসন খাতে সবচেয়ে বেশি ঋণ স্থিতি রয়েছে বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতে। আবাসন খাতে বেসরকারি ব্যাংকগুলোর ঋণপ্রবাহ ২০১২ সালে ঋণ স্থিতি ছিল ১৯ হাজার ১৮০ কোটি টাকা, ২০১১ সালে তা ১৪ হাজার ৭৬০ কোটি টাকা এবং ২০১০ সালে ছিল নয় হাজার ৯০০ কোটি টাকা। অন্যদিকে রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতে ঋণ স্থিতি ২০১২ সালে ছিল ছয় হাজার ৩৪০ কোটি টাকা, ২০১১ সালে পাঁচ হাজার ৩০০ কোটি টাকা এবং ২০১০ সালে চার হাজার ৮১০ কোটি টাকা। আবাসন খাতে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে ঋণপ্রবাহ ক্রমান্বয়ে বাড়লেও গত বছর এই খাতে শ্রেণীভুক্ত ঋণের পরিমাণও বেড়েছে আশঙ্কাজনক হারে। অন্যদিকে ফ্ল্যাট কেনার জন্য গ্রাহককে ঋণ দেওয়া বন্ধ করা হয়েছে। আগে যেখানে ৮০ শতাংশ পর্যন্ত ফ্ল্যাট কেনার ঋণ দেওয়া হতো, এখন তা ২০ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়েছে। এতে আবাসন কোম্পানিগুলো ক্রমেই হারাচ্ছে ক্রেতা। একই সঙ্গে ব্যাংক ঋণের সুদ ও কিস্তির চাপও বাড়ছে। ফলে প্রভাব পড়ছে ফ্ল্যাট ও প্লটের দামের ওপর। (সূত্র: বাংলাদেশ ব্যাংক ও রিহ্যাব)

নি‍র্মাণাধীন আবাসন প্রকল্প

সম্ভাবনাময় শিল্প হিসেবে আবাসনশিল্পের গুরুত্ব অপরিসীম। নানা সমস্যা সত্ত্বেও এ শিল্পটির এগিয়ে চলা প্রশংসনীয়। অন্যান্য দেশের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশেও হচ্ছে বিশ্বমানের আবাসন প্রকল্প। দুবাই, নিউইয়র্ক, কানাডা, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়াসহ প্রভৃতি শহরের বাসিন্দারা অ্যাপার্টমেন্টে যেসব সুবিধা পায়, এ দেশের আধুনিক অ্যাপার্টমেন্টগুলোতেও তার কোনো কমতি নেই। দেশের অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ হয়ে উঠেছে আবাসনশিল্প। এ শিল্পটির ক্রমবর্ধমান বিকাশ প্রমাণ করে, শত প্রতিকূলতা পেরিয়ে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। কিছু ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নেওয়া গেলে এ শিল্প অর্থনীতিতে রাখবে অসামান্য অবদান। সম্প্রতি অনেক দেশেই তৈরি হচ্ছে ‘সেকেন্ড হোম’। অন্য দেশের নাগরিকেরাও সেকেন্ড হোমের ক্রেতা। যেমন- বর্তমানে আবাসনশিল্পের প্রাণকেন্দ্র পর্যটন নগর দুবাইয়ের পাম আইল্যান্ড, মরিশাসের সাগরপারের অ্যাপার্টমেন্ট, থাইল্যান্ডের আবাসন প্রকল্প পাচ্ছে ব্যাপক জনপ্রিয়তা। এসব প্রকল্পে বিশ্বের নামীদামি তারকাসহ অসংখ্য ভ্রমণপিপাসু মানুষ অ্যাপার্টমেন্ট বা বাড়ি কিনছেন। থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুরের মতো দেশেও বাংলাদেশের অনেক নাগরিক বাড়ি কিনেছেন। এই বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে বিভিন্ন প্রকল্প নেওয়া উচিত বাংলাদেশেও। সাধারণত সমুদ্রতীর, নদীতীর, জঙ্গল, পাহাড় প্রভৃতি প্রকৃতিঘেরা স্থানে ইকো রিসোর্ট নির্মাণ করা যেতে পারে, যেখানে দেশি-বিদেশিরা এগুলো কিনতে পারবে। এটা আবাসনশিল্প বিকাশে রাখবে ব্যাপক অবদান। রিহ্যাবও চায় এই প্রক্রিয়াই নিজেদের অন্তর্ভুক্ত করতে। ইতিমধ্যেই কক্সবাজারে সেকেন্ড হোম প্রকল্পের জন্য সরকারের কাছ থেকে এক হাজার বিঘা জমি বরাদ্দ চেয়েছে তারা। সেকেন্ড হোম হলে বিদেশি বিনিয়োগ পাওয়া যাবে বলে আশা সংগঠনটির। তবে এসব প্রকল্প গ্রহণের পাশাপাশি আবাসনশিল্পের সঠিক বিকাশে দেশের সব শ্রেণী-পেশার মানুষের কথা বিবেচনা করে আবাসন প্রকল্প নেওয়া উচিত। প্রয়োজনে সরকারি সহযোগিতার ভিত্তিতে পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপের (পিপিপি) আওতায় একটি মহাপরিকল্পনার মাধ্যমে আবাসন প্রকল্প নেওয়া যেতে পারে। তা ছাড়া ব্যাপক আবাসন প্রকল্পে যেন পরিবেশের ক্ষতি না হয় বরং নগরের সৌন্দর্য বাড়ে সেদিকে যথেষ্ট সজাগ থাকতে হবে। দেশের অন্য নগরগুলো যেন ঢাকার মতো অপরিকল্পিতভাবে গড়ে না ওঠে এবং সেখানে যেন একটি সুষ্ঠু পরিকল্পনার আওতায় আবাসনশিল্পকে আনা হয়, সে দিকে সরকারের সুনজরদারি খুবই জরুরি।

সব সমস্যাকে পেরিয়ে নব উদ্যমে শুরু হোক নির্মাণযজ্ঞ; শিল্পটি ফিরে পাক নতুন প্রাণচাঞ্চল্য। আবাসনশিল্পে জড়িত প্রতিষ্ঠানগুলো আবারও হয়ে উঠুক উৎপাদনমুখর। জমি, নির্মাণপণ্য, পরিবহন ব্যয় ইত্যাদির দাম যেন অস্বাভাবিক না হয়ে জনসাধারণের নাগালে থাকে, সে বিষয়টি নিশ্চিত করতে দরকার সরকারের কঠোর নজরদারি। তবেই ফ্ল্যাট বা অ্যাপার্টমেন্টের দাম কমবে। আবাসনশিল্প তখনই শক্তিশালী খাতে পরিণত হবে, যখন রাষ্ট্রের সব শ্রেণী-পেশার মানুষের জন্য আবাসনসুবিধা নিয়ে প্রকল্প নির্মিত হবে, যা কেনার জন্য থাকবে ব্যাংকঋণ, দীর্ঘমেয়াদি কিস্তি সুবিধাসহ নানা প্রণোদনা। এ জন্য প্রয়োজন সমন্বিত উদ্যোগ সরকারি ও বেসরকারি উভয় পর্যায়েই। 

প্রকৌশলী সুবীর কুমার সাহা

প্রকাশকাল: বন্ধন ৪৭ তম সংখ্যা, মা‍র্চ ২০১৪

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top