লিট ক্রিট বিডির স্বত্বাধিকারী মো. নজরুল ইসলাম
ইপক্সিতে ময়লা-ফাঙ্গাস জন্মে না। এটা স্বাস্থ্যকর। জয়েন্ট বা গ্যাপ না থাকায় ধুলা জমতে পারে না। তা ছাড়া দীর্ঘদিন এটি ব্যবহার করা যায়

বাংলাদেশে ইপক্সি ফ্লোরিংয়ের ধারণা একেবারে নতুন নয়। ২০০০ সালের আগে থেকেই শিল্পকারখানার ফ্লোরে ব্যবহার হতো ইপক্সি। গত দশকে টাইলস, মোজাইকের বিকল্প হিসেবে এই ফ্লোর বাণিজ্যিক ভবন ও ঘরবাড়িতে জনপ্রিয় হতে শুরু করে।
 
মেঝে, দেয়ালে ইপক্সি করালে তা টাইলসের চেয়েও বেশি টেকসই ও নান্দনিক হয়। বাংলাদেশে একসময় ইপক্সির চাহিদা বাড়বে তা ১৬ বছর আগেই আঁচ করতে পেরেছিলেন এলিট ক্রিট বিডির স্বত্বাধিকারী মো. নজরুল ইসলাম। এই প্রতিষ্ঠানটি বাংলাদেশে ইপক্সির পথিকৃৎ বলা যায়। ৫০০-এর অধিক প্রতিষ্ঠানে বিশ্বমানের সেবা দিয়েছে এলিট ক্রিট বিডি। ইপক্সি ফ্লোরিং নিয়ে অজানা অনেক প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন তিনি ‘বন্ধন’কে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সাইফুল হক মিঠু

ইপক্সি ফ্লোরিং মূলত কী? বুঝিয়ে বলবেন।
ঘরের মেঝে বা দেয়ালে টাইলস, মোজাইক কিংবা রঙের আচ্ছাদন দেওয়া হয়। ইপক্সি ফ্লোরিং হলো এসবের বিকল্প। মেঝে বা দেয়ালে টাইলস বা মোজাইকের পরিবর্তে রেজিন বা রাসায়নিকের আবরণ মূলত ইপক্সি ফ্লোরিং। সম্পূর্ণ ধুলাবালুমুক্ত করে মেঝে বা দেয়ালে দুই মিলিমিটার পুরু রাসায়নিক বা রেজিন ঢালা হয়। বিভিন্ন ধরনের রেজিনের এই আস্তরণই ইপক্সি।

ইপক্সি ফ্লোরকে পোক্ত ও  জীবাণুনাশক করে। শিল্পকারখানা বা হাসপাতালের মেঝেকে তাপ পরিবাহী, মজবুত, জীবাণুনাশক করে এই ইপক্সি। দুই দশক আগে বাংলাদেশে এর ব্যবহার শুরু হয়। মূলত ফার্মাসিটিক্যাল প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের ল্যাবরেটরি, কারখানার ফ্লোর বা দেয়ালকে ইপক্সি করত, তবে এখন ছোট-বড় কারখানা, অফিস এমনকি বাসায়ও ইপক্সি ব্যবহার করা হচ্ছে। আগে মালয়েশিয়া, জার্মানি থেকে লোক আসত ইপক্সির কাজ করতে। তবে এখন বাংলাদেশেই ৩০টির অধিক প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে, যারা উন্নত মানের ইপক্সি সেবা দিচ্ছে।

স্পোর্টস গ্রাউন্ডে ইপক্সি কোটিং

কী কী ধরনের স্থাপনায় এই রাসায়নিক ব্যবহার করা হয়?
ব্যয়বহুল ও দীর্ঘস্থায়ী হওয়ায় বাণিজ্যিক স্থাপনায় ইপক্সির ব্যবহার বেশি। এ ছাড়া জীবাণুনাশক হওয়ায় বর্তমানে শিল্পকারখানা, হাসপাতালেও ব্যবহৃত হচ্ছে। আর এখন অনেকেই পার্কিং লট, ঘরের মেঝেতেও ইপক্সি ব্যবহার করছে। ইপক্সি যেহেতু ঘরের মেঝেকে নান্দনিক করে এ কারণে রিসোর্ট, রেস্তোরাঁয় এর ব্যবহার বেড়েছে।

কত ধরনের ইপক্সি ফ্লোরিং করা যায়, স্থায়িত্বই-বা কেমন হবে?
বিভিন্ন রকমের রেজিনের ইপক্সি হয়। যেমন- সেল্ফ লেমিনেটিং ইপক্সি বা এসএলই। এটার স্থায়িত্ব ১০ থেকে ১৫ বছর। তার পরে যদি ভেঙে যায়, সেটা আবার ঠিক করা যায়। রোলার কোট সাধারণত ৫ থেকে ৬ বছর যায়। অ্যান্টি-স্ট্যাটিক ইপক্সিও ১০ থেকে ১৫ বছর ঠিকঠাক থাকে। কন্ডাক্টিভগুলোও ১০ থেকে ১২ বছর যায়। ব্যবহারের ওপর আসলে এটা নির্ভর করে। ব্যবহার ভালো হলে আরও বেশি সময় এগুলো স্থায়িত্ব পায়।

এসএলই, রোলার কোট সাধারণত হাসপাতাল, ফার্মাসিটিক্যাল প্রতিষ্ঠান, খাদ্যপণ্য প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানসহ একাধিক শিল্পপ্রতিষ্ঠানে ব্যবহার করা যায়। অন্যদিকে কন্ডাক্টিভ সাধারণ তাপ ও বিদ্যুৎ পরিবাহী। স্পর্শকাতর শিল্পকারখানা যেখানে আগুন বা বৈদ্যুতিক শর্টসাকির্টের ঝুঁকি বেশি, সেখানে সাধারণত কন্ডাক্টিভ ইপক্সি ফ্লোরিং ব্যবহার করা হয়।

থ্রি-ডি ইপক্সি ফ্লোরিং কী? এ বিষয়ে বিস্তারিত বলবেন কি? এতে খরচ কেমন?
এটা আসলে স্বচ্ছ রঙের ইপক্সি। ফ্লোর বা দেয়ালকে পুরোপুরি পরিষ্কার করে থ্রি-ডি স্টিকার বসানো হয়। এই স্টিকারগুলো চীন, ইউরোপ থেকে আগে আনা হতো। এখন ইন্টারনেট থেকে থ্রি-ডি ছবি সংগ্রহ করে সেগুলো স্টিকারের মতো করে প্রিন্ট করা যায়। এটা করতে হলে প্রথমে ফ্লোরটাকে ভালোভাবে সমান করতে হয়। ধুলাবালু পরিষ্কার করা হয়। এরপর ফ্লোরে স্টিকারটি আঠা দিয়ে আটকে বা বিছিয়ে দিতে হয়। ফ্লোরে সেই স্টিকার বসিয়ে দেওয়ার পর ১ মিলি বা ২ মিলি স্বচ্ছ রঙের রেজিন দেওয়া হয়। এভাবে মূলত থ্রি-ডি ইপক্সি করা হয়। থ্রি-ডি ইপক্সিতে প্রতি বর্গফুটে আমাদের ৩৫০ থেকে ৪০০ টাকা খরচ পড়ে। থ্রি-ডি ইপক্সির চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। বাসার পাশাপাশি রেস্টুরেন্টেও এই থ্রি-ডি ইপক্সির ব্যবহার বাড়ছে।

ইপক্সিতে কী ধরনের রাসায়নিক বা গ্লু ব্যবহৃত হয়, এর স্বাস্থ্যগত কোনো ঝুঁকি আছে কি?
ইপক্সিতে নানা ধরনের গ্লু বা আঠা ব্যবহার করা হয়। ইপক্সি অয়েল বেইজড আছে, ইপক্সাইড বেইজ আছে। কোনোটিতে ভোলাটাইল অর্গানিক কম্পাউন্ড বা ভিওসি থাকে। যেটাতে এই ভিওসির পরিমাণ বেশি থাকে, সেটাতে স্বাস্থ্যঝুঁকি আছে।

বেশির ভাগ ভিওসির পরিমাণ থাকে কম। সেগুলো সাধারণত ইউরোপের দেশ থেকে আমদানি করা হয়। দাম একটু বেশি হলেও আমরা সেগুলো ব্যবহার করি। যখন ইপক্সি বসানোর প্রক্রিয়া চলতে থাকে তখন এর স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি থাকে। মানে যাঁরা কাজ করেন, তাঁদের ঝুঁকিটা বেশি। তবে আমরা শ্রমিকদের গ্লাভস পরিয়ে কাজ করাই। ভালো ম্যাটেরিয়ালস ব্যবহার করি। সেক্ষেত্রে ঝুঁকির জায়গা অনেকটাই কম। এ ছাড়া ইপক্সি বসানোর পর আর কোনো স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি থাকে না।

ইপক্সি ফ্লোরিং করার খরচ ও সময়ের বিষয়টা বলবেন?
এটা আসলে নির্ধারিত হয় কতটুকু জায়গাজুড়ে বসানো হবে। ফ্লোর লেভেলিং করার পর প্রাইম কোটিং করতে হয়। তারপর বিভিন্ন ধরনের ইপক্সি ব্যবহার করা হয়। এতে কয়েক মাস লেগে যায়। খরচও ধরা হয় প্রতি বর্গফুটে। রেজিনের দাম, শ্রমিকের মজুরি এরপর আমাদের সামান্য কিছু মুনাফা রেখে মূল্য নির্ধারণ করা হয়।

ইপক্সি কোন কোন দেশ থেকে আমদানি করা হয়? সেগুলোর মানই-বা কেমন? দেশের বাজারে কোথায় কিনতে পাওয়া যায়?
চীন, তাইওয়ান, মালয়েশিয়া, জার্মানিসহ ইউরোপের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে ইপক্সি রেজিন আমদানি করা হয়।  প্রতিষ্ঠানভেদে দাম ওঠানামা করে। ইউকের ফ্লো ক্রিট, জার্মানির ভিয়াকো এসব ব্র্যান্ডের পণ্যের মান ও দাম তুলনামূলকভাবে বেশি। বাংলাদেশে বার্জার, আর এ কে, এলিট পেইন্ট এসব প্রতিষ্ঠানও ইপক্সি উৎপাদন করছে।

বাংলাদেশে কারা ইপক্সি ফ্লোরিংয়ের কাজ করছে? কাজের মান সম্পর্কে বলবেন।
বাণিজ্যিক ও বিভিন্ন শিল্পপ্রতিষ্ঠানে কাজ করে এমন ৩০ থেকে ৩৫টি প্রতিষ্ঠান ইপক্সির কাজ করে। এদের মধ্যে ৫ থেকে ৬টি প্রতিষ্ঠান আন্তর্জাতিক মানের কাজ করে থাকে।

জনবহুল স্থানের স্থায়িত্ব ও সৌন্দর্যবর্ধনে ইপক্সি কোটিং

ইপক্সি ফ্লোরিং করাতে কোন বিষয়ের ওপর প্রাধান্য দিতে হয়, কী কী জিনিস খেয়াল রাখতে হয়?
কংক্রিটকে প্রথমত সমান ও শক্তিশালী করতে হয়। কংক্রিট যদি একেবারে সাধারণ হয়, তাহলে কিন্তু হবে না। কংক্রিট যদি আড়াই হাজার পিএসআইয়ের নিচে হয়, তাহলে ইপক্সি দুর্বল হয়, উঠে যায়। এ জন্য শক্ত কংক্রিট দরকার। ফ্লোরটা সমান না হলে দেখতে ভালো লাগে না। ফ্লোর বা দেয়ালকে ধুলাবালুমুক্ত হতে হবে। এটা না হলে ফিনিশিং খারাপ হবে, দেখতে খারাপ লাগবে। যখন ইপক্সি করা হয়, তখন যদি তাপমাত্রা বেশি থাকে তাহলে দ্রæত কাজ করতে হয়। এ ছাড়া কিছু টেকনিক্যাল বিষয় আছে, সেগুলো মাথায় রেখেই কাজ করা হয়।

ইপক্সি ফ্লোরিংয়ের কোনো অসুবিধা আছে কি?
এর খরচ একটু বেশি। এ ছাড়া ইপক্সি ফ্লোরিংয়ে কোনো অসুবিধা নেই।

গ্রাহকেরা কেনো টাইলস, মোজাইক না করে ইপক্সি ফ্লোরিং করবে?
টাইলসে জয়েন্ট থাকে, সেই জয়েন্টে ময়লা জমে। এ ছাড়া টাইলস টেকসই না। আবার টাইলস থেকে ধুলা-আবর্জনা তৈরি হয়। অন্যদিকে ইপক্সিতে ময়লা-ফাঙ্গাস জন্মে না। এটা স্বাস্থ্যকর। জয়েন্ট বা গ্যাপ না থাকায় ধুলা জমতে পারে না। তা ছাড়া দীর্ঘদিন এটি ব্যবহার করা যায়। অ্যালার্জি বা হাঁপানির সমস্যা যাঁদের আছে, তাঁদের চিকিৎসকেরাও বলে ফ্লোরটাকে ইপক্সি করে নেওয়ার জন্য। পক্ষান্তরে টাইলস ও মোজাইক হয় কম টেকসই।

ইপক্সি ফ্লোরিংয়ে এলিট ক্রিট বিডি কীভাবে সম্পৃক্ত হলো। কাজ ও প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে বলবেন?
২০০৫ সালে আমরাই বাংলাদেশে প্রথম এটা শুরু করি। এর আগে মালয়েশিয়া ও জার্মান প্রতিষ্ঠান এখানে কাজ করত। তারা বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানির ল্যাবরেটরি, কারখানায় ইপক্সি করত।

শিল্প প্রতিষ্ঠানে ব্যবহৃত ইপক্সি কোটিং

গাজীপুরের কালিয়াকৈরে ২০০৪-০৫ সালে একটা কারখানায় ইপক্সির কাজ হয়। মালয়েশিয়ান একটা প্রতিষ্ঠান ফ্লো ক্রিটের ম্যাটেরিয়াল ব্যবহার করে সেই কারখানার কাজ করেছিল। আমার এক বন্ধুর মাধ্যমে মালয়েশিয়ান প্রতিষ্ঠানের ইপক্সি সম্পর্কে জানতে পারি। তারপর ফ্লো ক্রিটের বিপণনে কাজ শুরু করি। ওদের সঙ্গে থেকে কাজগুলো শিখলাম। আমার কিছু বন্ধু মালয়েশিয়ান প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ইপক্সির কাজ করত। আমাদের অনেকেই কাজটা শিখে গেল। ম্যাটেরিয়ালস পাওয়ার রাস্তাও পেয়ে গেলাম, এভাবে যাত্রা শুরু।

আমরা ১৫ বছর ধরে বাংলাদেশে কাজ করছি। বড় বড় প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি সরকারি ও সেনাবাহিনীর অনেক কাজ করেছি। ১৬ বছরে প্রায় ৫০০ প্রতিষ্ঠানে আমরা কাজ করেছি। আমরা এ পর্যন্ত কাজ করেছি প্রায় ১৬ মিলিয়ন বর্গফুট। ধীরে ধীরে বাড়ছে আমাদের কর্মপরিধি।

আপনাকে ধন্যবাদ।
ধন্যবাদ, বন্ধনকেও।

  • প্রকাশকাল: বন্ধন ১৩৯ তম সংখ্যা, মার্চ ২০২২

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top