স্থপতি মোবাশ্বের হোসেন
নিরাপদ ও শ্রমিকবান্ধব কারখানা নির্মাণে এগিয়ে আসতে হবে পোশাক মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএকে

মোবাশ্বের হোসেন পেশায় স্থপতি। দেশে তো বটেই, দেশের বাইরে এশিয়া, এমনকি কমনওয়েলথ দেশসমূহের স্থপতিদের সম্মিলিত সংগঠনের নেতৃত্বেও রয়েছেন। তিনি ইনস্টিটিউট অব আর্কিটেক্ট, বাংলাদেশের (আইএবি) সভাপতি। কমনওয়েলথ অ্যাসোসিয়েশন অব আর্কিটেক্টসের (সিএএ) সভাপতি। পাশাপাশি আর্কিটেক্টস রিজিওনাল কাউন্সিল অব এশিয়ার (আর্কএশিয়া) সাবেক চেয়ারপার্সন। তার প্রতিষ্ঠিত আর্কিটেকচার ফার্ম অ্যাসোকনসাল্ট লি. ডিজাইন করেছে গ্রামীণ ব্যাংক ভবন, প্রশিকা ভবন, চট্টগ্রাম রেলওয়ে স্টেশনের মতো দেশসেরা সব স্থাপনা। জীবন তাকে যশ, খ্যাতি, বৈষয়িক প্রতিষ্ঠা দিয়েছে। একাত্তরের রণাঙ্গনের লড়াকু গেরিলা যোদ্ধা মোবাশ্বের হোসেনের জীবন তাই আশা, স্বপ্ন আর কর্মে ভরপুর। ইনস্টিটিউট অব আর্কিটেক্ট, বাংলাদেশের সভাপতি হিসেবে যৌথভাবে কাজ করছেন ফায়ার সার্ভিস এন্ড সিভিল ডিফেন্সের সাথে। তৈরি করেছেন ফায়ার সার্ভিসের নীতিমালাও। সাভারের আশুলিয়ার নিশ্চিন্তপুরে তাজরীন ফ্যাশন্সের অগ্নিকান্ডের বিষয়ে দেশের সেরা এ স্থপতি খোলামেলা কথা বলেছেন বন্ধনের সাথে। জানিয়েছেন এর কারণ, প্রতিকার ও করণীয় সম্পর্কে, দিয়েছেন কিছু দিকনির্দেশনাও। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আনিস রহমান

তাজরীন গার্মেন্টস নিয়ে নানা জন নানান মত দিচ্ছেন। অনেকে বুঝে কথা বলছেন আবার অনেকে বলছেন না বুঝে। টক শোগুলোতে ওই দিনের আগুনের ঘটনা নিয়ে কথা বলতে গিয়ে অনেকে বলেছেন, প্রত্যেক ফ্লোরে তালা লাগানো ছিল বলে শ্রমিকরা বের হতে পারেনি। যার ফলে এত বেশি শ্রমিক আগুনে পুড়ে মারা গেছে। এতে আমি ভিন্নমত পোষণ করছি। বরং তালা লাগানো ছিল বলেই অনেক কম মানুষ মারা গেছে। তালা না লাগানো থাকলে বাঁচার জন্য সবাই নিচে যেত। আর নিচে যাওয়া মানেই নিশ্চিত মৃত্যু। এটি মৃত্যুকূপে ঝাঁপ দেওয়ার মতো ঘটনা হতো। এই বিষয়টি আমাদের বুঝতে হবে। যে কোনো পোশাক কারখানার নিচের ফ্লোরটি সম্পূর্ণ খোলা থাকার কথা। এই কারখানায় সেটা না রেখে গ্রাউন্ড ফ্লোরের চারদিকে দেয়াল দিয়ে ছোট্ট একটি গেট রাখা হয়েছে। এটা সম্পূর্ণ নিয়মবহির্ভূত।

তাজরিন গার্মেন্টসে ভয়াবহ আগ্নিকাণ্ড। ছবি: ডব্লিউএসজি

গ্রাউন্ড ফ্লোরের কাপড়ের গোডাউনের মাঝেই রয়েছে বড় বড় তিনটি সিঁড়ি। এই তিনটি সিঁড়ি স্বাভাবিক কাজের জন্য ঠিক আছে। শ্রমিকদের ওঠানামার জন্যও যথেষ্ট। আগুন লাগার পর শ্রমিকদের নেমে আসার মতো পর্যাপ্ত স্থান এই সিঁড়িতে ছিল। কিন্তু এই কারখানায় সিঁড়ি নিচে গিয়ে যেখানে মিশেছে সেখানে রাখা কাপড়ের গুদামেই লেগেছে আগুন। মানুষ কীভাবে বেরুবে? আগুন লাগার পর পরই কিছু শ্রমিক সিঁড়ি দিয়ে বেরিয়ে আসতে পেরেছিল। তবে বেশিরভাগই তা পারেনি।

স্থাপত্য নকশায় একটি বিষয় রয়েছে আর তা হলো কুয়া। প্রত্যেকটি ভবনের সিঁড়ির ঘরটি সোজা থাকে। দেখতে অনেকটা কুয়ার মতো। ১০০ তলা ভবন হলেও উপর থেকে অনায়াসে সোজাসুজিভাবে নিচে দেখা যায়। এতে বলা যায় একটি চুঙ্গির ভেতরে থাকে বিল্ডিংয়ের সিঁড়িঘর। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ব্রিকফিল্ডের চিমনি যত লম্বা হয় এর ইটগুলো তত ভালো পোড়ে। কেননা এতে আগুন গতিশীল ও শক্তিশালী হয়। একটি টানেলের মধ্য দিয়ে যায় বলে অক্সিজেন বেশি টানতে পারে। আগুনের ধর্ম হলো সে অক্সিজেন পুড়িয়ে ফেলে।

তাজরীন ফ্যাশন্স কারখানায় দুই দিকে তিনটি সিঁড়ি ছিল। গোডাউনের পেটের ভেতর থেকে উঠে গেছে সিঁড়ি দুটি। কাপড়ের গুদামের ভেতর দিয়ে বাইরে বের হতে হয়। এই কারখানায় প্রবেশের জন্য বড় একটি গেট ছিল, এটি খোলা হতো বড় গাড়ি প্রবেশের সময়। শ্রমিকদের কর্মস্থল ছিল সিঁড়ি দিয়ে উঠে গিয়েই খোলা জায়গায়। দেয়ালের পার্টিশন দিয়ে সিঁড়িঘরটিকে আলাদা করা ছিল না। প্রত্যেক ফ্লোরের সাথে সরাসরি সংযোগ ছিল সিঁড়ির। কলাপসিবল গেট দিয়ে যা আলাদা করা। কোথাও আগুন লাগলে সিঁড়িঘর সবচেয়ে বিপজ্জনক। মনে রাখতে হবে, একটি সিঁড়ি যেমন একটি ভবন থেকে বাঁচার জন্য মুক্তির পথ, ঠিক তেমনি সিঁড়ি আবার একটি ভবনে আগুন লাগলে সবচেয়ে বিপজ্জনক।

দুটি উপায় আছে। একটি হচ্ছে সিঁড়িঘর থেকে আপনার ঘরের মাঝে একটি গ্যাপ রেখে দুটি দরজা রাখতে হবে। প্রথমে একটি দরজা খুলে আপনি ভেতরে প্রবেশ করবেন। প্রবেশ করে দরজা লাগিয়ে দেবেন। এবার আপনার ভেতরের দরজা খুলে বাসায় প্রবেশ করবেন। তাহলে বাইরের ধোঁয়া আপনার ঘরে প্রবেশ করতে পারবে না। এভাবে নিরাপদে বেরিয়ে আসা যায়। এ পদ্ধতিতে আগুন উপরে চলে এলেও অনেক ক্ষেত্রে আত্মরক্ষা করা সম্ভব। এরই মধ্যে সাহায্যকারী দল চলে আসবে। আর দ্বিতীয় পদ্ধতিটি হলো সিঁড়ি কারখানার একদম বাইরে করা। এটি হলে ধোঁয়া আকাশে চলে যাবে। আটকে থাকবে না। বদ্ধ ঘরের মধ্যে সিঁড়ি হলে, সিঁড়িঘরের জানালা যেন খোলা থাকে। এটা মাথায় রাখতে হবে

যে কোনো বাড়ি বা কারখানায় সিঁড়িঘরে যদি আগুন লাগে তাহলে সেটি চিমনির মতো হয়ে উপরের দিকে উঠে যায়। উপরের তলাগুলো যদি ফাঁকা না থাকে তাহলে আগুন বাড়তে পারে না। কারণ এতে আগুন বেশি অক্সিজেন পায় না। আশপাশে ফাঁকা জায়গা থাকলে প্রচুর অক্সিজেন নিতে পারে। ফলে প্রজ্বলিত আগুন খুব সহজেই ছড়িয়ে পড়ে। শুধুমাত্র এ কারণেই তাজরীনের শতাধিক শ্রমিকের প্রাণ দিতে হলো। নিয়মমতো সিঁড়িঘর দেয়াল দিয়ে আটকানো থাকলে এত দ্রুত আগুন ছড়িয়ে পড়ত না। অন্তত মানুষগুলোকে জীবিত বের করে আনা সম্ভব হতো।

সিঁড়িঘর আটকানো থাকলে আগুন ছড়াত না। আগুন কুন্ডলী করে উপরের দিকে উঠে যেত। দুই ঘণ্টা এভাবে দরজা আটকে রেখে ছড়িয়ে পড়া আগুন ঠেকাতে পারলে এ সময়ের মধ্যে উদ্ধারকারীরা সহায়তার জন্য চলে আসত পারত।

না না। একদম ঠিক না। এটি যারা বলছে সেটা তাদের নিজস্ব মতামত। এটা মালিকপক্ষের এক ধরনের উদাসীনতা। এটি যারা করছে, তারা তাদের কারখানায় কর্মরত শ্রমিকদের জান আর নিজেদের মাল নিয়ে অত্যন্ত উদাসীনতার পরিচয় দিচ্ছে। তাদেরকে সচেতন হতে হবে। নইলে আগামীতে তাদের আরো বড় মূল্য দিতে হবে।

আমি বার বার সিঁড়ির কথা বলব। একটি সিঁড়ি বাইরে সরাসরি দেওয়া থাকলে কিংবা কাপড় রাখার গুদামটি একপাশে দেয়াল দিয়ে আটকে রাখলে এমনটা হতো না। কাপড়ে আগুন লাগলে ভেতরে থাকত। শ্রমিকরা মরত না। তারা সিঁড়ি দিয়ে বেরিয়ে যেত।

কাপড়ে আগুন লাগার পর প্রচুর ধোঁয়া তৈরি হয়। কারণ এতে কেমিক্যাল ছিল। কাপড়ে আগুন লাগলে যে ধোঁয়া সৃষ্টি হয় সত্যি সত্যি তা অত্যন্ত যন্ত্রণাদায়ক। ধোঁয়াচ্ছন্ন অবস্থায় শ্রমিকেরা যখন দিগি দিক ছুটছিল তখন তাদের মস্তিষ্ক কাজ করছিল না। ধোঁয়ায় ব্রেন অকার্যকর হয়ে যায়। লোপ পায় চিন্তাশক্তি। একটা মানুষ দিগ্ভ্রান্ত না হলে ১০ তলা থেকে ঝাঁপ দিতে পারে না। যখন কারও মস্তিষ্ক কাজ করে না তখন সে এ কাজটা করে।

বাঁচার দুটি কারণ। প্রথমত অনেকেই বাঁচতে খোলা ছাদে গিয়েছিল। কারখানার উপর তলায় নির্মাণ কাজ চলছিল। সেখানে কাজের প্রয়োজনে বাঁশের মাচা তৈরি করা ছিল। এই মাচা বেয়ে যারা নামতে পেরেছে তাদের বেশিরভাগ বেঁচে গেছে। আর দ্বিতীয়ত কারখানার ভেতরের গরম বাতাস বের করে দেওয়ার জন্য প্রত্যেক ফ্লোরে কয়েকটি বড় ফ্যান ছিল, যা দেয়ালের সাথে জানালার মতো করে লাগানো। যেহেতুু ফ্যানের পাখা হালকা। শ্রমিকরা সহজে এই ফ্যানের পাখা বাঁকা করে ওই সামান্য ফাঁকা জায়গা দিয়ে নিজেদের বের করে এনেছে। আর এভাবেই বাঁচিয়েছে তাদের জীবন।

আমার এটা বিশ্বাস হয় না। যারা এসব বলছে তারা কেন বলছে আমি জানি না। তবে এখানে দুর্ঘটনার কারণে এত মৃত্যুর জন্য যে বিষয়টি কাজ করেছে তা হলো অসচেতনতা। অগ্নিকান্ডকে গুরুত্ব না দেওয়া। আমার মতে, মালিক এটি করেনি। কারণ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির সাথে কথা বলে জেনেছি, যে টাকা ইন্স্যুরেন্স করা আছে কারখানাটিতে তার চেয়ে অনেক বেশি টাকার ক্ষতি হয়েছে। তাছাড়া কারখানার সৌন্দর্যের জন্য অনেক সুন্দর নতুন টাইলস লাগিয়ে ছিল মালিকপক্ষ। কারাখানাটিতে অগ্নিনির্বাপণের সব ব্যবস্থাই ছিল। কিন্তু এগুলোকে কাজে লাগানো যায়নি বা হয়নি। অগ্নিনির্বাপণ উপকরণগুলো সবার সামনে এমন জায়গায় রাখা উচিত যা সহজলভ্য হয়। এখানে এমন ব্যবস্থা ছিল না। শ্রমিকদের স্বার্থের কথা না ভেবে অপরিকল্পিত উপায়ে কারখানাটিতে গঠনগত পরিবর্তন আনার ফলেই এই দুর্ঘটনা ঘটেছে। যার ফলে মূল্য দিতে হলো এতগুলো তাজা প্রাণের।

হ্যাঁ, সেটাই তো প্রশ্ন। চার থেকে পাঁচটি প্রতিষ্ঠানের ছাড়পত্র না থাকলে একটি পোশাক কারখানা চালু করা যায় না। এখানে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বে অবহেলার কারণে এই দুর্ঘটনা ঘটেছে। এ দায় তারা কোনোভাবেই এড়াতে পারে না। ন্যূনতম একটি কারখানা দেওয়ার যোগ্যতা না থাকলে তাকে অনুমোদন দেওয়ার অধিকার কারও নেই। এ দায় এখন কে নেবে? পোশাক কারখানার মান বাড়ানোর দায়িত্ব বিজিএমইকেই নিতে হবে। নিরাপদ ও শ্রমিকবান্ধব কারখানা নির্মাণে এগিয়ে আসতে হবে পোশাক মালিকদের সংগঠন বিজিএমইকে। সরকার পারবে না। এগুলো মনিটর করতে অনেক জনবল দরকার। এই মুহূর্তে সরকার কীভাবে এত জনবল নিয়োগ দেবে। সরকার আমার সন্তানের শিক্ষা গ্রহণের জন্য স্কুল করে দিয়েছে। তার স্কুলে নিয়ে যাওয়া, তার পড়াশোনা ঠিকমতো হচ্ছে কিনা সেটা দেখার দায়িত্ব আমার। বিজিএমইএকে এখন সন্তানের বাবার ভূমিকা পালন করতে হবে। এই শিল্পটাকে বড় ধরনের সমস্যা থেকে উত্তরণে সবাইকে শক্ত হয়ে কাজ করতে হবে।

অবশ্যই দেশীয় পোশাকশিল্পে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। এ খাতের বিনিয়োগকারীরা উৎসাহ হারিয়ে ফেলতে পারে। হতে পারে শ্রমিকদের মনস্তাত্তি¡ক ট্রমা। বিদেশি বিনিয়োগ নিয়ে সৃষ্টি হতে পারে সঙ্কট। আতঙ্ক নিয়ে কাজ করা, আর নিশ্চিন্ত মনে কাজ করার মাঝে পার্থক্য অনেক। এটাই হলো রূঢ় বাস্তবতা। বিজিএমইএ তার শিল্পরক্ষায় কী ধরনের ভূমিকা নেবে সেটাই এখন বিবেচ্য বিষয়। 

যে কোনো ধরনের সমূহ বিপদ থেকে রক্ষা করে এই সেক্টরকে সামনের দিকে সুন্দরভাবে এগিয়ে নিতে সবচেয়ে বড় ভূমিকা বিজিএমইএ’র। নিয়মিত তদারকির জন্য তারা স্থায়ী একটি টাস্কফোর্স গঠন করতে পারে। প্রয়োজন হলে আমরা তাদের সাহায্য করব।

তারা চাইলে আমরা স্থপতি, প্রকৌশলী, ফায়ার সার্ভিস মিলে একটি দল হয়ে সকল পোশাক কারখানা পরিদর্শন করব। দেখব, বিল্ডিং কোড অনুসরণ করে এগুলো নির্মাণ করা হয়েছে কিনা? পরিবেশগত কোনো ক্ষতিকর দিক আছে কিনা। জানালা দরজাসহ কারখানাটির নকশা নির্মাণ বিধিমালা অনুসরণে অনুমোদিত কিনা? এ ছাড়াও আমরা দেখব কারখানাটি কতটা শ্রমিকবান্ধব ও নিরাপদ। এটা নিশ্চিত করতে যতটুকু কাজ করার সেই কাজের নিশ্চয়তা প্রদানে যা যা করণীয় আমরা তাদেরকে সেই পরামর্শই দেব। শ্রমিকের জীবনরক্ষায় সর্বনিম্ন কী কী করণীয় সেই কাজটি করতে আমরা সচেষ্ট হবো। আমরা বিজিএমইএকে কাজের দায়িত্ব নিতে বলেছি এজন্য যে, বিজিএমইএ কাজটি হাতে নিলে কারখানা মালিকরা শুনবে। কেননা এটি তাদের সংগঠন। কারখানাগুলো তদারক করবে বিজিএমইএ। তাদের নিয়ম না মানলে নিজেরাই ব্যবসায়িক ক্ষতির মুখে পড়বে। বিজিএমইএ’র দায়িত্ব, বিষয়টি ফলোআপ করা। এই সেক্টরটাকে সামনে এগিয়ে নিতে দ্রুত একটি টাস্কফোর্স গঠন করতে হবে। এই টাস্কফোর্সে প্রতিনিধিত্ব করবে সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে শ্রমিক, ব্যবসায়ী, স্থপতি ও সংশ্লিষ্ট বিনিয়োগকারীরা। সকলের সমন্বয়ে কাজটি করলে অনেক ভালো হবে।

আমি বলব যে পাঁচটি প্রতিষ্ঠান এই কারখানাটির অনুমোদন দিয়েছে। তারা কিসের ভিত্তিতে এই মৃত্যুকূপটিকে কারখানা হিসেবে লাইসেন্স দিল। তাদের বিচার হতে হবে। এবং তা করতে হবে এই মুহূর্তেই। যে স্থপতি এভাবে ভবন ডিজাইন করেছে তার বিচার হওয়া উচিত। ফায়ার ব্রিগেডের যে কর্মকর্তা এই ভবনটি দেখেছেন, তিনি কিসের ভিত্তিতে সার্টিফিকেট দিলেন। ইন্সু্যুরেন্স কোম্পানির যিনি এই ভবন পরিদর্শনে এসেছিলেন, তিনিই বা কিসের ভিত্তিতে ইন্স্যুরেন্স পেপারস রেডি করেছেন। এই ভবনের নির্মাণকাজ একশ’ ভাগ আইনবহির্ভূতভাবে করা হয়েছে। এই ভবনের লোকেশন পর্যন্ত বেআইনি।

ইমারত নির্মাণ বিধিমালায় সুস্পষ্টভাবে এর বিস্তারিত উল্লেখ করা আছে। একটি কারখানা করতে সর্বনিম্ন কী কী ব্যবস্থা রাখতে হবে। সেটিও বলা আছে। অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থার কথা পরিষ্কারভাবে ইমারত নির্মাণ বিধিমালায় উল্লেখ রয়েছে। একটি কারখানার পাশে খোলা জায়গা থাকার কথা, যাতে আগুন লাগলে ফায়ার সার্ভিস চারদিক থেকে পানি দিতে পারে আর আটকে পড়া লোকদের বের করে নিয়ে আসতে পারে। তাছাড়া সিঁড়িগুলো ভালোভাবে মনিটর করা উচিত। বাইরের দিক থেকে সিঁড়ি তৈরি করতে হবে। সিঁড়িঘরটি দেয়াল দিয়ে ঘিরে দিতে হবে। কাপড়ের গুদামে কোনোভাবে বিদ্যুতের সংযোগ রাখা যাবে না। থাকবে না কোনো বৈদ্যুতিক বাতি, ফ্যান কিংবা এ জাতীয় কোনো কিছু। এ ক্ষেত্রে ঘরের মধ্যে চার্র্জার লাইট বা সানলাইট ব্যবহারের সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে।

পোশাক কারখানাগুলোতে থাকতে হবে পানির লাইন রাখার ব্যবস্থা। সেটা হতে পারে আমাদের নদীগুলো থেকে নিয়ে। সার্বক্ষণিক একটি লাইন থাকবে। যে কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে ফায়ার সার্ভিসের লোকজনকে বড় গাড়ি নিয়ে সেখানে যেতে হবে না। তারা কারখানার সামনে যাবে, পাইপ লাগিয়ে আগুন নেভাবে। পানি নিয়ে কোনো সমস্যা হবে না। এই ছোট প্রযুক্তি কলকাতার রাস্তায় ৮০ বছর ধরে চালু রয়েছে। আমাদের রাস্তায় এগুলো বসাতে পারি। উন্নত দেশগুলোতে আরো উন্নত প্রযুক্তি হাইপ্রেসার হাইড্রেন রয়েছে।

অগ্নিদগ্ধ কারখানায় উদ্ধার তৎপরতা

স্বাধীনতা আমাদের কী দিয়েছে তা কল্পনাও করা যায় না। দেশের বাইরে নানা জায়গায় বক্তৃতা দিতে গিয়ে স্বাধীনতার কথা বলি। একবার পাকিস্তানে গিয়ে আমাদের শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধের স্থাপত্য নিয়ে কথা বলতে বলতে মুক্তিযুদ্ধের ধ্বংসলীলা তুলে ধরেছিলাম। তখন দেশের অনেকেই আমাকে নিষেধ করলেন। কিন্তু আমার বক্তৃতা শুনে অনুষ্ঠানে উপস্থিত পাকিস্তানের এ প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা আমাকে জড়িয়ে ধরে বলল, সত্যিই পাকিস্তানিরা এই ঘৃণ্য কাজ করেছে? আমি তাদের বলেছিলাম, তোমাদের লোকরা আমাদের বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করেছিল যাতে করে আমরা ত্রিশ বছরের মধ্যে মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারি। আমরা কিন্তু তোমাদের উপর এখন প্রতিশোধ নিচ্ছি। তোমরা দেখবে, আমরা চল্লিশ বছরের ব্যবধানে তোমাদের চেয়ে উপরে উঠেছি। আমি এখন জোর গলায় বলতে পারি, বাংলাদেশের অবস্থান পাকিস্তানের চেয়ে অনেক ভালো। আমাকে আমেরিকান ইনস্টিটিউট অব আর্কিটেক্ট থেকে প্রফেশনাল ডেভেলপমেন্টের জন্য প্রেসিডেন্ট গোল্ড মেডেল দেওয়া হয়েছে। শুধু তাই নয়, তারা আমাকে সেই ইনস্টিটিউটের সদস্যও বানিয়েছেন। আমি যখন পুরস্কার নিতে যাই তখন দেখি, সেখানে বাংলাদেশের পতাকা পত পত করে উড়ছে। সারা পৃথিবী থেকে প্রায় তিন হাজার আর্কিটেক্ট সেখানে উপস্থিত। আমি বলেছিলাম, আমরা যদি স্বাধীন না হতাম তাহলে আজ এই মর্যাদা পেতাম না। স্বাধীনতা না পেলে বড়জোর পাকিস্তানের একজন কর্মচারী হিসেবে বেঁচে থাকতে হতো। স্বাধীনতা আমাদের স্বপ্নের দুয়ার খুলে দিয়েছে। আমরা যদি চাই এবং আমাদের সরকার যদি আন্তরিক হয় তাহলে আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে অপার সম্ভাবনার দেশ হিসেবে বিশ্বে বাংলাদেশ মাথা উচুঁ করে দাড়াঁবে।

পর পর চার বছর আমি আইএবির প্রেসিডেন্ট, মাঝখানে এক টার্ম ছিলাম না। ভবিষ্যতে যাতে আর ইনস্টিটিউট অব আর্কিটেক্টস, বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট হিসেবে আমাকে না থাকতে হয় সেজন্য আমি আইএবির সংবিধান পরিবর্তন করছি। যাতে চাইলেও আমাকে আর এ প্রতিষ্ঠানের সভাপতি করার সুযোগ না থাকে। কেননা আমি যদি আইএবিকে ভালোবাসি তাহলে আমার প্রথম কাজ হচ্ছে, আমার জীবদ্দশায় নতুন নেতৃত্ব তৈরি করা। এ দায়িত্ব আমার উপরেই বর্তেছে। সে কারণেই সংবিধান পরিবর্তন করছি। যাতে নতুন নেতৃত্ব দায়িত্ব নিতে পারে।

আমি প্রায় জায়গায়ই এ কথাটি বলি। বন্ধনের পাঠকদের জন্যও বলছি, আমার প্রিয় নেতাদের একজন নেলসন ম্যান্ডেলা। তার এই উক্তিটি আমাকে সব সময় প্রেরণা জোগায়- The sports has the power to change the world. It has the power to unite people in a way that little else does. আশা করি পাঠকরা কথাটি মনে রাখবেন।

তোমাকেও ধন্যবাদ।

  • প্রকাশকাল: বন্ধন ৩৩ তম সংখ্যা, জানুয়ারি ২০১৩

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top