রাজধানীর পাবলিক পার্কের হালচাল

ইট-কাঠের নগরীতে কাজের চাপে প্রতিনিয়তই হাঁপিয়ে উঠছে মানুষজন। মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন এমন অবস্থা দূর করতে কাজের ফাঁকে দরকার সুস্থ ও নির্মল বাতাসের পরশ। বিকেলের দখিনা বাতাসেই হয়তো দূর হয়ে যেতে পারে সারাদিনের কর্মব্যস্ততার অবসাদ। কিন্তু পার্ক ছাড়া রাজধানীতে এ সুযোগ কই? অগত্যা কর্মব্যস্ততার ক্লান্তি দূর করতে সরকারি-বেসরকারি কিছু পার্কই একমাত্র ভরসা হয়ে উঠছে। ভরসার পাত্রেও আশায় গুড়েবালি। কতিপয় মানুষের ব্যবসায়িক মনোভাব আর অসচেতনতায় নগরবাসীর খোলা হাওয়ায় দম নেওয়ার জায়গা কমছে। এত কিছুর পরও যেগুলো টিকে আছে ভালো নেই সেগুলোর পরিবেশও। মাদকসেবী, পতিতা আর হকারদের দৌরাত্ম্যে পরিবেশ হয়েছে আরও খারাপ। ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের হিসেবে রাজধানীতে ছোটবড় মিলিয়ে তাদের ৫৪টি উদ্যান বা পাবলিক পার্ক আছে। আছে পাশাপাশি সরকারি-বেসরকারি আরো কিছু পাবলিক পার্কও। তবে পার্কগুলোর বেশিরভাগেরই নেই নির্মল পরিবেশ, নেই বসার সুষ্ঠু ব্যবস্থা। প্রাপ্তবয়স্কদের পাশাপাশি শিশুদের জন্য নেই পর্যাপ্ত খেলাধুলার আয়োজনও। বেশ কিছু উদ্যানে শিশুদের খেলনাগুলো পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে রয়েছে। রাজধানী ঢাকার জন উদ্যান বা পাবলিক পার্কের হালচাল নিয়ে বন্ধনের বিশেষ এ আয়োজন। এখানে থাকছে পার্কগুলোর সার্বিক পরিস্থিতির পাশাপাশি সমস্যাগুলো চিহ্নিত করার প্রয়াস। সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিদের পরামর্শে তুলে ধরা হয়েছে সমাধানও। বাকিটুকু সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষেরই বিবেচ্য। লিখেছেন জিয়াউর রহমান চৌধুরী। বিশেষ কৃতজ্ঞতা : আলী আসিফ, আজহার হোসেন ও তানজিল রিমন

ওসমানী উদ্যান

নগর ভবনের ঠিক বিপরীত পাশ থেকে ওসমানী উদ্যানের ফটক দিয়ে ঢুকতেই চোখে পড়ে একটি স্থাপনা। মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর ২-এর মানচিত্র এবং এই সেক্টরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নাম উপস্থাপিত হয়েছে এতে। এর পাশেই থাকা বেঞ্চিতে শুয়ে ধূমপান করতে দেখা গেল এক দর্শনার্থীকে। অথচ অদূরেই ডিসিসির দেওয়া একটি সাইনবোর্ডে উল্লেখ করা হয়েছে, উদ্যানে ধূমপান ও শয়ন নিষেধ। এতে আরও বলা হয়েছে, ফুল ও গাছের পাতা ছেঁড়া, ডাল ভাঙা, ঘাস মাড়ানো, মোটরসাইকেল, বাইসাইকেল ও অন্যান্য বাহন চালানো নিষেধ। অথচ অসচেতন দর্শনার্থীরা এসব নিষেধাজ্ঞা আমলে নিচ্ছে না। আবার উদ্যানের লেকের পাড়ে একটি সাইনবোর্ডে লেকে মাছ ধরাকে আইনত দন্ডনীয় অপরাধ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু অনেককেই লেকে বড়শি দিয়ে মাছ ধরতে দেখা যায়।

২২ দশমিক ১০ একর আয়তনের উদ্যানটির উন্নয়ন ও সৌন্দর্যবর্ধনের কাজ শুরু হয় ২০০৫ সালের ১৮ আগস্ট। ডিসিসির অর্থায়নে এই কার্যক্রমের মাধ্যমে উদ্যানের চারদিকে দেওয়া হয় নান্দনিক সীমানাপ্রাচীর, লাগানো হয় বিভিন্ন প্রজাতির উদ্ভিদ, করা হয় পায়ে চলা পথ ও কৃত্রিম লেক, ভূমিতে মাটি ভরাট ও সমান করা হয়, পুরনো পুকুর থেকে লেক পর্যন্ত পানি চলাচলের পাইপলাইন নির্মাণ ও উদ্যানের উত্তর-দক্ষিণ দিকে দুটি দেউড়ি নির্মাণ করা হয়। তবে উদ্যানটির উন্নয়নের পর নিরাপত্তারক্ষী না দেওয়ায় তাতে আগের মতোই ভবঘুরে, ভিক্ষুক, মাদকসেবী-ব্যবসায়ীদের বিচরণ ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে।

কলাবাগান লেক সার্কাস পার্ক

ডিসিসির পার্কের তালিকায় কলাবাগান লেক সার্কাস নামে একটি পার্ক আছে। কিন্তু কলাবাগান লেক সার্কাস এলাকায় এ নামে কোনো পার্ক খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। কলাবাগান লেক সার্কাস পার্ক নামে কোনো পার্ক নেই। তবে কলাবাগান লেক সার্কাস সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের পাশে একটি ছোট মাঠ রয়েছে। এটি তেঁতুলতলা মাঠ নামে পরিচিত। এটিও ডিসিসির তালিকার পার্ক হতে পারে। কিন্তু এলাকাবাসী জানান, এটি কোনো পার্ক নয়। কলাবাগান শিশুপার্কের নামই কলাবাগান লেক সার্কাস পার্ক বলে তারা ধারণা করছেন।

দেখা গেছে, ঢাকা ওয়াসার মড্স জোন-৩-এর পানির পাম্পে লেখা রয়েছে ‘কলাবাগান শিশুপার্ক পানির পাম্প।’ কিন্তু আশপাশে কোনো শিশুপার্ক পাওয়া যায়নি। এলাকাবাসী জানান, কলাবাগান খেলার মাঠ ও পানির পাম্পের মাঝের জায়গায় শিশুপার্কটি ছিল। কিন্তু সেখানে শুধু নার্সারির অস্তিত্বই লক্ষ করা যায়।

ধানমন্ডি লেক পার্ক

ধানমন্ডি লেকের পাশ ঘেঁষেই এ পার্ক। অন্য সব পাবলিক পার্ক ঘুরে হতাশার সংবাদের মাঝে একটুখানি আলোর দেখা মিলল এখানে। বেশ কিছুদিন ধরেই এখানে সংস্কার কাজ চলছিল। সদ্য সমাপ্ত সংস্কার কাজ শেষে সুসংবাদ এসেছে এখানে বেড়াতে আসা মানুষজনের কাছে। আরো প্রশস্ত রাস্তা হয়েছে পার্কে, পার্কের অভ্যন্তরে রাতের জন্য আরো বাতির ব্যবস্থা হয়েছে। সবকিছু মিলিয়ে ধানমন্ডি লেক পার্ক একেবারে নতুন সাজে সেজেছে। কয়েক কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত এ বিশেষ প্রকল্পে হালে ফিরেছে পার্কের সৌন্দর্য। এখানকার ব্যায়ামের সরঞ্জামগুলো অন্য পার্কের মতো বেহালে নেই। ব্যায়ামের জিনিসপাতিগুলো ঠিকঠাকই দেখা গেল। পুরনো রাস্তার সাথেই আরো প্রশস্ত একটি রাস্তা করা হয়েছে। রাস্তায় বসানো হয়েছে লাল টাইলস। তবে লেকের পানি এখনো অপরিষ্কারই রয়ে গেছে। বেশ কয়েক মাস ধরে পুনরায় লেকের উন্নয়ন কাজ শুরু হয়েছে। এই উন্নয়ন কতদিন ধরে চলে এবং পরিশেষে কী হাল হয় সেটাই এখন দেখার বিষয়।

শ্যামলী পার্ক

শ্যামলী সিনেমা হলের পাশ দিয়ে পিসি কালচার হাউজিংয়ের দিকে যেতেই চোখে পড়বে শ্যামলী মাঠটি। মাঠ ঠিকই আছে কিন্তু ঠিক কতদিন থাকবে তা বলা মুশকিল। এখানে মাঠের মধ্যে নির্মাণ কাজ চলছে। কিসের নির্মাণ কাজ চলছে? এমন অনেক প্রশ্নের নির্মাণ শ্রমিকদের কাজ থেকে কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি। এখানেই সমস্যার শেষ নয়। পার্কে বেশ কিছু খেলাধুলার সরঞ্জাম থাকলেও এর কোনোটিরও অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। খেলাধুলার সরঞ্জামহীন এ পার্কে এখন শুধু ভূমিটুকুই আছে। বাকি সুযোগ-সুবিধার কোনো কিছুই আর অবশিষ্ট নেই।

সায়েদাবাদ পার্ক

অনেক খুঁজে পাওয়া গেল সায়েদাবাদ পার্ক। পার্কের পাশেই থাকা একাধিক দোকানি জানেন না সায়েদাবাদ পার্ক কোথায়! শুধু স্থানীয় দোকানিরাই নন, সেখানে অবস্থানরত ট্রাফিক পুলিশ কিংবা সাধারণ মানুষও জানেন না সায়েদাবাদ পার্ক নামে কোনো পার্ক আছে কিনা। জানবেনই বা কিভাবে, সেখানে এখন আর পার্কের কোনো নিদর্শন নেই, আছে শুধু আবর্জনার স্তূপ। আবর্জনার উপরই আবার বাসস্ট্যান্ড। সেখানে বাস মেরামতও চলে। মেরামতের যন্ত্রপাতি পার্কের জায়গায় পড়ে আছে। এখানে বাস মেরামতের ব্যাপারে জানতে চাইলে এক বাসের চালক জানালেন, ‘জায়গা তো পইড়া আছে। যত দিন ধইরা বাস চালাই, তত দিন ধইরাই এই অবস্থা দেইখা আইতাছি।’ সায়েদাবাদ পার্কের জায়গায় কয়েকটি টং-দোকানও রয়েছে। আশপাশের দোকান ও হোটেলের ময়লা এখানে ফেলা হয়।

পান্থকুঞ্জ পার্ক

পার্কে সবাই আসে নির্মল হাওয়ার খোঁজে। কিন্তু এখানে দুই পাশের রাস্তা থেকে ধুলা আসছে, যানবাহনের শব্দ আসছে। পার্কটিতে নিয়মিত ঝাড়ু দেওয়া হয় না। ভেতরে পাতা ও আবর্জনা জমে থাকে। বর্ষাকালে সামান্য বৃষ্টিতেই পানি জমে যায়। পানি নিষ্কাশনের কোনো ব্যবস্থা নেই। পার্কের একটি ফটক ছিন্নমূল একটি পরিবার দখল করেছে। তাই সেই ফটক বন্ধ। যে ফটকটি খোলা, তার উপর একটি সাইনবোর্ডে লেখা আছে, ‘পার্ক পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করার জন্য বেলা ১১টা হইতে বিকাল চারটা পর্যন্ত বন্ধ থাকিবে।’ কিন্তু পার্ক বন্ধ থাকলেও নিয়মিত পরিষ্কার করা হয় না বলে জানান পার্কে হাঁটতে আসা লোকজন। ভেতরে গাছপালায় নিয়মিত পানি দেওয়া হয় না। ফলে ছোট ছোট গাছ শুকিয়ে যাচ্ছে। পার্কে ছোট দুটি সাইনবোর্ডে লেখা আছে, ‘পার্কের ভেতরে ধূমপান নিষেধ’ ও ‘বেঞ্চে পা তুলিয়া বসিবেন না।’ কিন্তু এই দুটি কাজই করতে দেখা গেছে। দুটি খুঁটি দেখে বোঝা যায়, পার্কে একটি দোলনা ছিল। পার্কের দেয়ালে ডিসিসির আরেকটি সাইনবোর্ড সাঁটানো আছে। তাতে লেখা, ‘পান্থকুঞ্জ পার্কের ফুটপাতের রাস্তা শুধু চলাফেরা করার জন্য ব্যবহার করা যাবে, অন্য কোনো কাজে ব্যবহার করা যাবে না।’ কিন্তু সাইনবোর্ডের পাশেই ফুটপাতের উপর বসেছে টং দোকান যা পথচারীদের চলাচলে বিঘœ সৃষ্টি করছে। ছিন্নমূল মানুষ এই ফুটপাতেই আশ্রয় নিয়েছে। রান্না করছে, খাচ্ছে এবং এখানেই ঘুমাচ্ছে। আবার পাশের ফুটপাতে কোথাও কোথাও আবর্জনা জমে আছে।

সমস্যার মূল সুর

প্রতিটি পাবলিক পার্ক ঘুরেই দেখা গেছে প্রায় একই চিত্র। কোথাও মাদকসেবীদের আড্ডা, আবার কোথাও পতিতাদের দৌরাত্ম্য। আবার কয়েকটিতে খেলাধুলার সব সরঞ্জাম পাওয়া যায়নি। পাবলিক পার্কের এসব সমস্যা নিয়ে কথা হয় বুয়েটের স্থাপত্য বিভাগের অধ্যাপক ড. খন্দকার সাব্বির আহমেদের সাথে। তিনি বলেন, ‘আমাদের এ রাজধানীতে কোনো কিছুই পরিকল্পনা করে করা হয়নি। আর এখানকার সবকিছুই ম্যানমেড অর্থাৎ মনুষ্যসৃষ্ট। এখানে প্রাকৃতিক পরিবেশ ধ্বংস করে যেমন আবাসন গড়ে তোলা হয়েছে, তেমনি খামখেয়ালিপনাতেও নষ্ট হয়েছে অনেক খোলা জায়গা। ঢাকার অনেক জায়গাতেই খোলা পরিবেশ নেই। আবার অতিরিক্ত মানুষের চাপ নিতে ঢাকার অনেক কিছুই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ চাপ নিতে গিয়ে আমাদের মানসিকতা এমনভাবে তৈরি হয়েছে যে এখানে কোনো প্রাকৃতিক খোলা পরিবেশ মানেই অপচয়। তাই যেখানে খোলা প্রাকৃতিক পরিবেশ ছিল সেখানে অপচয় ঠেকানোর নামে দামি দামি অট্টালিকা গড়ে তোলা হয়েছে। যেমনÑ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সামনের খোলা জায়গা এভিয়েশনকে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে, মহাখালী ফ্লাইওভারের পাশের খালি জায়গায় সেতু ভবন তৈরি হয়েছে। এ ছাড়া গুলশান এভিনিউসহ ঢাকার বেশ কিছু জায়গার খোলা পরিবেশ বিনষ্ট করা হয়েছে। এতে যেমন অক্সিজেনের সরবরাহ কমেছে তেমনি কমেছে নগরবাসীর বেড়ানোর সাধ। আবার বেসরকারিভাবে আবাসনের চাহিদা মেটাতে গিয়েও অব্যবস্থাপনার ছাপ পাওয়া গেছে। বেসরকারিভাবে গড়ে ওঠা বেশির ভাগ আবাসন প্রকল্পে কোনো পার্ক বা খোলা জায়গা রাখা হয়নি। প্রতিষ্ঠানগুলোর মালিকদের অধিক মুনাফা লোভই এর মূল কারণ।’

আছে সমাধান

  • খন্দকার সাব্বির আহমেদ সমস্যা সমাধানে কিছু পরামর্শ দিয়েছেন। 
  • দেশে প্রচলিত আইন-কানুন অনুযায়ী জরিপ করে রাজধানীর সব খোলা-প্রাকৃতিক জায়গাকে চিহ্নিত করতে হবে। 
  • এসব চিহ্নিত জায়গায় কোনো ধরনের ভবন বা অন্য কিছু নির্মাণ নিষিদ্ধ করতে হবে।
  • যে পার্ক বা খোলা জায়গাগুলো এখনো অবশিষ্ট আছে সেগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ করে প্রাকৃতিক ও নির্মল পরিবেশ ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করতে হবে। 
  • বেসরকারি-সরকারি যেভাবেই আবাসন প্রকল্প হোক না কেন সেসব প্রকল্পে খোলা জায়গা বা পার্ক রাখতে হবে। 
  • রাজউক, সিটি কর্পোরেশনসহ সরকারি সংশ্লিষ্ট সব প্রতিষ্ঠানকে আরো সক্রিয় করতে হবে।
  • এসব প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম বাড়িয়ে বেহালে থাকা পাবলিক পার্কগুলোকে দখলে নিয়ে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে।
  • ঢাকা বা ঢাকার আশপাশে যেখানেই আবাসন হোক না কেন সেখানে এ ধরনের সমস্যা আমলে নিয়ে প্রকল্পের অনুমোদন ও নকশা করতে হবে।

পাবলিক পার্ক ও বাংলাদেশ প্রেক্ষিত

বাংলাদেশের সাথে অন্য দেশের পাবলিক পার্কগুলোর যথেষ্ট পার্থক্য রয়েছে। উন্নত দেশের পাবলিক পার্কগুলো তৈরির সময় নানা পরিকল্পনা ও ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করা হয়। পাশাপাশি পরিবেশের ভারসাম্যের ব্যাপারটিও মাথায় রাখা হয়। যথাসম্ভব প্রাকৃতিক পরিবেশ ঠিক রেখে আধুনিকতার চেষ্টা চলে সেখানে। বাতাস যাতে সহজে প্রবেশ করতে পারে বা প্রবেশে যাতে কোনো ধরনের সমস্যা না হয় সে বিষয়গুলো মাথায় রেখে পাবলিক পার্ক তৈরি করা হয়। কিন্তু আমাদের দেশে এর ঠিক উল্টো। পাবলিক পার্কগুলো তৈরির সময় বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কোনো পরিকল্পনার বালাই রাখা হয়নি। পার্ক মূলত কয়েক ধরনের হয়। জনসাধারণের প্রবেশের উপর নির্ভর করে ন্যাশনাল, সেক্টরাল, রিজিওনাল, স্মল ইত্যাদি ধরনের পার্ক তৈরি করা হয়। এসব পার্ক এলাকা ও স্থানভেদে এক এক ধরনের পরিকল্পনায় তৈরি হয়। যেমন-  বিভাগীয় শহরের পার্কের জন্য এক ধরনের পরিকল্পনা আবার জাতীয়ভাবে পার্কের জন্য আরেক ধরনের পরিকল্পনা। এতে এসব করতে গেলে এক ধরনের জাতীয় পরিকল্পনা তৈরি করা হয়। কোন জায়গায় কতটুকু প্রাকৃতিক পরিবেশ থাকবে; কোন এলাকায় কেমন পার্ক হবে, বনভূমি কতটুকু হবে, কৃষি জমি কেমন থাকবে বা হলে কোথায় হবে বা কেমন করে হবে এসব বিষয় এতে অন্তর্ভুক্ত থাকে।

আমাদের দেশে অনেক পুরনো একটি পার্ক রমনা পার্ক। পালিক পার্ক হিসেবে বহুল পরিচিত এ পার্কটিকে এক সময় বাদশাহী নামেই ডাকা হতো। এটাকেই এক সময় দেশের কেন্দ্রীয় পার্ক ধরা হতো। অথচ এখন এ পার্কটি জৌলুসহীন। গভর্নর হাউস, সুপ্রিম কোর্টসহ নানা নিদর্শনমূলক স্থাপত্য, শেরাটন হোটেল (বর্তমানে রূপসী বাংলা হোটেল), বারডেম হাসপাতাল, ঢাকা ক্লাব, টেনিস ফেডারেশন ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানের ভবন তুলে পার্কটির আর বিশেষ কোনো সৌন্দর্য অবশিষ্ট রাখা হয়নি। উন্নয়নের নামে পার্কটিকে এক কথায় ধ্বংস করা হয়েছে বলা যায়। গড়ে তোলা স্থাপত্যগুলো পার্কের অবস্থা পরিবর্তন করেছে। পার্কটি এখন অপরাধীদের আস্তানা আর মাদকসেবীদের আড্ডাখানায় রূপান্তরিত হয়েছে। এখানকার অবকাঠামোগুলো গড়ে তোলায় বাইরের অনেক কিছুই পরিবর্তিত হয়েছে। এ রমনা পার্কের পাশেই তৈরি করা হয় শিশুপার্ক। এখানেও ঠিক একই চিত্র। প্রাকৃতিক পরিবেশ বা বনায়নের কোনো ছোঁয়া নেই এখানে। পার্ক বলতে যে স্থানকে বোঝানো হয় এটি কিন্তু তেমন নয়। আধুনিকতার নামে শুধু কিছু অবকাঠামোই বানানো হয়েছে।

বিকল্প সমাধান

রাজধানীর শেরেবাংলা নগর, সংসদ ভবন ও এর আশপাশের এলাকা প্রাকৃতিক এলাকা হিসেবে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। পুরনো বিমানবন্দর, সংসদ ভবন ও শেরেবাংলা নগরের এ জায়গাগুলো প্রাকৃতিক এলাকা হিসেবে ঘোষণা দিয়ে এর কোনো ক্ষতি করা যাবে না। পাশাপাশি এ জায়গাগুলোতে কোনো ধরনের কৃত্রিম কাঠামো বানানো বন্ধ করতে হবে। সেক্টরাল পার্ক হিসেবে ধানমন্ডি, বনানী, গুলশান লেক পার্কের পার্থক্যগুলোকেও পাশাপাশি প্রাকৃতিকতা ধরে রেখে উন্নয়ন করতে হবে। ধানমন্ডি লেকে দেখা যায়, এটিকে কিন্তু পার্ক হিসেবে তৈরি করা হয়নি। লোককে কেন্দ্র করেই একটু জায়গা গড়ে তোলা হয়েছে। এখানে দেখা যায়, সব বাড়ি লেকের দিকে পেছন করে বানানো। এর মানে এ পার্কটি কোনো পরিকল্পনা ছাড়াই গড়ে উঠেছে। এ পার্কগুলোকে ছোট পার্ক হিসেবে পুনঃপরিকল্পনা করে জনগণের উপযোগী করে বানানো যেতে পারে। পার্কগুলো মূলত সাধারণ মানুষ ছাড়াও বিশেষত শিশু ও বয়স্করা ব্যবহার করে থাকে। তাই পার্কগুলো এমন হতে হবে যাতে করে গাড়ির রাস্তা পার হওয়া লাগবে না। জনগণের ব্যবহারের উপর নির্ভর করে পার্কগুলো বিভিন্ন আকার ও আকৃতির হতে পারে। আর এগুলোকে অবশ্যই পরিবেশবান্ধব হতে হবে। পরিবেশের যাতে কোনো ধরনের ক্ষতি না হয় সে বিষয়টি মাথায় রাখতে হবে। পার্কগুলো মূলত মানুষের কমফোর্ট বা বিনোদনের জন্য বানানো হয়। ভৌগোলিক কারণে পার্কগুলো বড় ছোট ইত্যাদি রকম হতে পারে। তবে প্রতিটি পার্কের সাথে আরেক পার্কের যোগসূত্র থাকবে। আর পার্কগুলো এমন হবে যেখানে টেকসই বৈচিত্র্য ধারণ করতে হবে। যেমনÑ পার্কগুলোতে একটির সাথে আরেকটির লিংক থাকলে কোনো দুর্ঘটনায় একটি ধ্বংস বা নষ্ট হলে এর জীববৈচিত্র্য, গাছপালা ও পশু-পাখি অন্য পার্কে স্থানান্তরিত হতে পারবে। রাজধানী ঢাকা এমনিতেই প্রাকৃতিকভাবে চারপাশে নদী দ্বারা বিস্তৃত। আর ভেতরেও অসংখ্য ছোট বড় খাল ও লেক আছে। এগুলোর মাধ্যমেই লিংকটা করা যেতে পারে। এভাবে রমনা পার্ক বা বোটানিক্যাল গার্ডেনেরও উন্নয়ন করা উচিত। তবে এগুলোর উন্নয়ন অবকাঠামো কেন্দ্রিক না হয়ে পরিবেশবান্ধব হতে হবে। যাতে টেকসই জীববৈচিত্র্য ধরে রাখা যায়।

মানুষের বিনোদন ও আরামের জন্য খুব বড় না করে এলাকাভেদে ছোট ছোট পার্ক গড়ে তোলা যেতে পারে। পার্কগুলো কিন্তু একটি এলাকা বা শহরের তাপমাত্রা, দূষণ ও পানির প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। একটি পার্ক তার আশপাশের ২৫০-৩০০ মিটার জায়গার পরিবেশকে নিয়ন্ত্রণ করে তাপমাত্রা ও দূষণ কমাতে সাহায্য করে। এ কারণে একটি পার্কের ২০০-৩০০ মিটারের মধ্যে আরেকটি পার্ক স্থাপন করলে সবগুলো তাদের আশপাশের জায়গাগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে। এছাড়া নগরের তাপমাত্রা বলতে যেসব এলাকায় অবকাঠামো বেশি সেখানে সবুজ আইনগত করা উচিত। যেমনÑ মতিঝিল ও কারওয়ান বাজারের সবুজ আইল্যান্ড। হার্ড সারফেসের দূষণ ও তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে এগুলো সহায়তা করবে। পার্ক বা খোলা জায়গায় যেখানে গাছ থাকে সেখানকার আশপাশে তাপমাত্রা প্রায় ৬-৮ ডিগ্রি কম থাকে। এমনিতেই ঢাকা শহরের তাপমাত্রা তুলনামূলক ২-৩ ডিগ্রি বেশি। তাই জনগণ বা পার্কগুলোতে বনায়ন ও গাছ থাকলে তাপমাত্রা কমবে।

বেগুনবাড়ী-হাতির ঝিল প্রকল্পটি আমাদের জন্য আশার কথা হলেও এখনো খুব বেশি আশা দেখা যাচ্ছে না। কারণ প্রকল্পটি প্রাকৃতিক না হয়ে অনেক বেশি অবকাঠামো কেন্দ্রিক হয়ে গেছে। এখানে প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশি স্থাপনা গড়ে উঠেছে। সবুজ বা বনায়ন করা গেলে আরো ভালো হতো। আর সোনারগাঁও হোটেলের পেছনের এ জলাশয় ধানমন্ডি লেকের সাথে যুক্ত করলে এটি বালু নদী পর্যন্ত বিস্তৃত হতো। এ পানি পথে ওয়াটার স্কুটার চালু করলে সড়ক পথের যানজটও কিছুটা কমত। এ পথটি গুলশান পর্যন্ত বিস্তৃত করা গেলে সড়ক পথের চাপও কমত। কিন্তু এখন পর্যন্ত সে সব উন্নয়ন করা সম্ভব হয়নি। অনেক বেশি কৃত্রিম করে ফেলা হয়েছে প্রকল্পটিকে। একটি পার্ক বা বৃক্ষ কিন্তু একটি শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র। একটি গাছ তার ২০-৩৫ মিটার বিস্তারে অক্সিজেন ও পানির প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। এ রকম একটি গাছ একজন মানুষের বার্ষিক অক্সিজেন ও অন্যান্য উপাদান সরবরাহ করতে সক্ষম। সে হিসেবে ঢাকা শহরের লোকসংখ্যা যদি দেড় কোটি ধরা হয় তা হলে গাছের প্রয়োজন প্রায় সাড়ে ৪ কোটি। কিন্তু এত পরিমাণ গাছ আছে এ শহরে? নেই বলেই এখানে এত সমস্যা আর জলাশয় থাকা দরকার ৬ শতাংশ যা নেই বললেই চলে এবং দিন দিন এ পরিমাণ আরো কমছে। নতুন ঢাকায় খালি জায়গার পরিমাণ ১২-১৫ শতাংশ আর পুরান ঢাকায় এটি ১০-এরও নিচে। যে পরিমাণটি প্রয়োজনের তুলনায় খুবই নগণ্য।

তবে এত সমস্যা সত্তে¡ও কিছুই করা যাবে না, এমন নয়। বরং প্রাকৃতিক পরিবেশ ও উপাদান রেখে যে কোনো কিছুই করা যেতে পারে। শহরে অনেক ধরনের কাজই হবে। তবে এতে প্রাকৃতিক খোলা পরিবেশের কোনো ক্ষতি বা বিনাশ করা যাবে না। বরং জীববৈচিত্র্য আরো টেকসই হবে যদি আমরা প্রাকৃতিক পরিবেশের ভেতর দিয়ে যাই।

প্রকাশকাল: বন্ধন ২৯ তম সংখ্যা, সেপ্টেম্বর ২০১২

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top