শ্বাসরুদ্ধকর সাইবেরিয়ার শুভ্র তুষারের বুক চিরে সোনালি আলোর দিগন্ত রেখা পেরিয়ে বিরামহীন ছুটে চলা ট্রান্স-সাইবেরিয়ান রেলওয়ে। এই রেলপথ দুটি মহাদেশকে সংযুক্ত করেছে। পৃথিবীর বৃহত্তম দেশ রাশিয়া, মধ্য এশিয়ার আরও কয়েকটি বৃহৎ স্বায়ত্তশাসিত দেশ, শত শত শহর, অন্তত ৪৪টি ছোট-বড় নদী পাড়ি দিতে হয় এই পথ পেরোতে। অগণিত শহর, নগর, বিস্তীর্ণ সবুজ তৃণভূমি ও সারি সারি দাঁড়িয়ে থাকা পাইনের বন এবং বিশাল গোবি মরুভূমির ঢেউ খেলানোর রূপ দেখতে দেখতে এগিয়ে চলে ঐতিহাসিক এই পথরেখা। ট্রান্স-সাইবেরিয়ান রেলপথ এমন এক গন্তব্য, যেখানে শুধু একবার ভ্রমণ করলেই বলা যায় পৃথিবীর সব রূপ ধরা দেবে আপনার কাছে। শত বছরের ঐতিহ্যবাহী ট্রান্স-সাইবেরিয়ান রেলপথের জানা-অজানা কথা তুলে ধরছেন নূরজাহান
ট্রান্স-সাইবেরিয়ান রেলওয়েটিকে বলা হয় পৃথিবীর দীর্ঘতম রেলওয়ে নেটওয়ার্ক। এটি রাশিয়ার দূরবর্তী ও প্রত্যন্ত অঞ্চল সাইবেরিয়ার সঙ্গে মস্কোকে যুক্ত করেছে। প্রায় ১০ হাজার কিলোমিটার দৈর্ঘ্যবিশিষ্ট পৃথিবীর দীর্ঘতম এই রেলপথটি দুটি শাখার মাধ্যমে চীন, মঙ্গোলিয়া ও উত্তর কোরিয়াকেও যুক্ত করেছে। ট্রান্স-সাইবেরিয়ান রেলওয়ে এতটাই দীর্ঘ যে কেউ ট্রেনে চড়ে যাত্রা শুরু করলে শেষ পর্যন্ত ঘুরে আসতে তাকে অন্তত আটটি টাইম জোন পাড়ি দিতে হবে। রোমাঞ্চকর পুরো ভ্রমণ বিরামহীনভাবে শেষ করতে লেগে যাবে ৭ থেকে ৮ দিন। ভীষণ প্রতিক‚ল পরিবেশ ও বৈরী আবহাওয়ার মধ্যে এই বিখ্যাত রেলওয়ের কাজ চলে দীর্ঘ ২৫ বছর। তৎকালীন হিসাবে পৃথিবীর সবচেয়ে ব্যয়বহুল এই রেলওয়ে নির্মাণে প্রায় এক বিলিয়ন ডলার খরচ হয়। শত বছর আগে রাশিয়ানদের এই সৃষ্টি বিশ্ববাসীর কাছে আজও বিস্ময়।
নির্মাণ ইতিহাস
উনিশ শতকে শুধু যোগাযোগ ঘাটতির জন্য দুর্গম সাইবেরিয়া অঞ্চলের উন্নয়ন অনেকাংশেই বাধাগ্রস্ত হচ্ছিল। যোগাযোগ বিঘ্নের জন্য এই অঞ্চলটি বলতে গেলে রাশিয়ার মূল ভূখন্ড থেকে একপ্রকার বিচ্ছিন্নই ছিল। বছরে মাত্র পাঁচ মাস নৌপথ ব্যবহার করে এই অঞ্চলের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করা হতো। আর যখন শীতকাল আসত তখন বরফের ওপর দিয়ে ঘোড়ায় টানা স্লেজ গাড়ি ব্যবহার করে যাতায়াত করা হতো। মূলত বরফে পরিণত হওয়া নদীগুলোই হয়ে যেত স্লেজ টানার পথ। কিন্তু দীর্ঘ ও দুর্গম এই পথ স্লেজ ব্যবহার করে যাতায়াত করা সহজ ব্যাপার ছিল না। এমন প্রতিকূল অবস্থার জন্যই ট্রান্স-সাইবেরিয়ান রেলপথ নির্মাণের চিন্তা করেছিলেন রাশিয়ার শাসকেরা। রাশিয়াজুড়ে রেলপথ সম্প্রসারণের লক্ষ্যমাত্রা হিসেবে ট্রান্স-সাইবেরিয়ান রেলওয়ে নির্মাণের পরিকল্পনা ১৮৯১ সালে রুশ মন্ত্রিসভায় সর্বসম্মতিক্রমে অনুমোদন করা হয়। যদিও এর আগে বহুবার এই পরিকল্পনাটি বাতিল করা হয়েছিল। এত দীর্ঘ রেলপথ নির্মাণ তো আর চাইলেই হয় না। তারপরও ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনা আর প্রত্যাশা নিয়ে ১৮৯১ সালের ১৯ মে নির্মাণকাজ শুরু হয়।

পৃথিবীর ষষ্ঠ দেশ হিসেবে রাশিয়ায় রেলওয়ের প্রচলন হয় ১৮৩৬ সালে। ২৭ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে এই রেললাইন নির্মাণ করা হয় সম্রাট প্রথম নিকোলাসের বাড়ি থেকে এবং শেষ হয় প্যাভলভস্কে গিয়ে। এই রেললাইন তৎকালীন জারসকোভ তথা বর্তমান পুশকিনের সঙ্গে সেন্ট পিটার্সবার্গের যোগাযোগ সৃষ্টি করে। পরবর্তী সময়ে সম্রাটের আদেশে ১৮৪২ সালে সেন্ট পিটার্সবার্গ রেলওয়ে স্টেশনের কাজ শুরু হয় এবং একই সঙ্গে সেন্ট পিটার্সবার্গের সঙ্গে মস্কোর যোগাযোগের জন্য রেলওয়ে নির্মাণ শুরু হয়। তৎকালীন সবচেয়ে বিখ্যাত দুজন আর্কিটেক্ট কনস্টান্টিন টন ও রডলফ ঝেলিয়াজেভিখ স্টেশনের নকশা প্রণয়ন করেন। এর নির্মাণকাজ শেষ হয় ১৮৫২ সালে। ১৮৫৬ সালে সম্রাট প্রথম নিকোলাসের মৃত্যুর পর এর নামকরণ করা হয় ‘নিকোলভ রেলওয়ে’। সেই থেকেই শুরু হয় রাশিয়ার রেলওয়ে সম্প্রসারণ। আশির দশকে রেলওয়ের জনপ্রিয়তা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়। আর তখনই ট্রান্স-সাইবেরিয়ান রেলওয়ের প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হতে থাকে, যা কি না রাশিয়ার একটি বিশাল অংশকে সংযুক্ত করবে।
পরিকল্পনা
প্রতিকূল আবহাওয়া ও বিপজ্জনক পরিবেশের কথা মাথায় রেখে এ রেলওয়ে নির্মাণ প্রকল্পকে তিনটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। সময় ধরা হয়েছে ১০ বছর। ভ্লাডিভস্টক ও চেলিয়াবিন্সক থেকে একযোগে কাজ শুরু করা হয়।
প্রথম ধাপ
জার নিকোলাস আলেক্সন্দ্রোভিচ উদ্বোধন করেন দ্য গ্রেট সাইবেরিয়ান রেলওয়ের নির্মাণকাজ। ১৮৯১ সালের মে মাসে প্রথম ধাপের কাজ শুরু হয় ভ্লাডিভস্টক থেকে। প্রায় ৪০৮ কিলোমিটার দূরের গ্রাফসকায়া স্টেশনকে যুক্ত করা হয় ভ্লাডিভস্টকের সঙ্গে। কাজ দ্রুত শেষ হয়ে গেলে ১৮৯৭ সালেই এ যোগাযোগ শুরু হয় এই অংশে। যুগপৎ চলতে থাকে সেলিয়াবিংক্স থেকে ওব নদী পর্যন্ত ১৪১৮ কিলোমিটার রেললাইন বসানোর কাজও। এরপরই শুরু হয় ট্রান্স-সাইবেরিয়ান রেলেওয়ের একেবারে মধ্যাংশের কাজ। ওব নদী থেকে ইরকুটস্ক পর্যন্ত ১৮৭১ কিলোমিটার রেললাইন বসানোর মধ্য দিয়ে শেষ হয় প্রথম ধাপের নির্মাণকাজ। এই অংশের কাজ শেষ হয় ১৮৯৯ সালে।

দ্বিতীয় ধাপ
দ্বিতীয় ধাপে সম্ভবত সবচেয়ে কঠিন ছিল নির্মাণকারীদের জন্য। মাইসোভায়াস্টেশন থেকে শুরু করে বৈকাল হ্রদের পূর্ব উপকূল ধরে শিল্কানদী পর্যন্ত ১১০৪ কিলোমিটার রেলওয়ে সংযোগ করতে গিয়ে প্রকৃতির কাছে চরম পরীক্ষা দিতে হয় নির্মাণশ্রমিকদের। এরপর শিক্লা নদী পেরিয়ে খাবারোভস্ক পর্যন্ত আরও ৩৬১ কিলোমিটার রেলওয়ে নির্মাণের পরেই শেষ হয় দ্বিতীয় ধাপের কাজ।
তৃতীয় ধাপ
সবচেয়ে অসমতল অংশের কাজটি রেখে দেওয়া হয়েছিল তৃতীয় ধাপের জন্য। সমতল রোডগুলোর কাজ শেষে তৃতীয় ধাপে বাকি ছিল বন্ধুর রোডগুলোতে রেললাইন বসিয়ে সেগুলোর সংযোজন করা। প্রথমেই বৈকাল স্টেশন থেকে মাইসোভায়া স্টেশন পর্যন্ত ২৬১ কিলোমিটার রেলপথ বসানোর কাজ শেষ হয়। এরপর শুরু হয় ম্যারাথন অংশের কাজ। স্ত্রেতেংক্স থেকে খাবারোভস্ক পর্যন্ত ২১৩০ কিলোমিটার দীর্ঘ আমুর রেলওয়ে নির্মাণ করতে সময় লেগেছিল ৬ বছর। এ আমুর রেলওয়ে ইউরোপের সঙ্গে প্রশান্ত মহাসাগরের যোগাযোগ স্থাপন করে।
প্রধান তিনটি রুট
১. প্রধান ট্রান্স-সাইবেরিয়ান রুট: মস্কো-ভ্লাভিস্টক
২. ট্রান্স-মঙ্গোলিয়ান রুট: মস্কো-উলানবাটার
৩. ট্রান্স-মাঞ্চুরিয়ান রুট: মস্কো-বেইজিং
নির্মাণশ্রমিক
ট্রান্স-সাইবেরিয়ান রেলওয়ে নির্মাণের শুরুতে ১৮৯১ সালে মাত্র ৯৬০০ মিনিট নিয়ে কাজ শুরু হয়। প্রাথমিকভাবে যে পরিমাণ শ্রমিক কাজ শুরু করেছিলেন, পরবর্তী সময়ে তার বহুগুণ বেশি শ্রমিক নিয়োগ দেওয়া হয়। এই রেলপথ নির্মাণে কখনো কখনো একই সময়ে লাখের বেশি শ্রমিক কাজ করেছেন। আর যত এগিয়েছে, শ্রমিকের সংখ্যাও তত বেড়েছে। সে সময় অসংখ্য শরণার্থীকে রাশিয়া এবং সাইবেরিয়া প্রবেশের সুযোগ দেওয়া হয়। এসব শরণার্থী ট্রান্স-সাইবেরিয়ান রেলপথের সবচেয়ে ঝুঁঁকিপূর্ণ অংশের কাজ করেছিলেন। শরণার্থী ছাড়াও সাধারণত কৃষক দিনমজুর, অবসরপ্রাপ্ত সৈনিক এবং সাজাপ্রাপ্ত আসামিরা শ্রমিক হিসেবে কাজ করতেন।

বিস্ময়কর কিছু তথ্য
- ট্রান্স-সাইবেরিয়ান রেলওয়ের মূল রুটের দৈর্ঘ্য ৯ হাজার ২৮৮ কিলোমিটার।
- দীর্ঘতম ব্রিজ খাভারোভস্ক, ২.৬ কিলোমিটার।
- এই রেলওয়ে দুটি মহাদেশের ওপর দিয়ে গেছে, এশিয়া ৮১ শতাংশ ও ইউরোপ ১৯ শতাংশ।
- মস্কো থেকে ভ্লাডিভস্টক পর্যন্ত ট্রান্স-সাইবেরিয়ান রেলওয়েতে ভ্রমণকালে আপনি ১০টি টাইম জোনের ওপর দিয়ে যাবেন!
- এই রেলওয়ে মোট ৮৭টি শহরের ওপর দিয়ে মস্কো থেকে ভ্লাডিভস্টক গিয়ে পৌঁছায়।
- ভোলগা, ওকা, ওব, আমুরের মতো ১৬টি বড় বড় নদী ওপর দিয়ে তৈরি হয়েছে এই সুবৃহৎ রেলওয়ে।
- জাপান সমুদ্রতট বরাবর ৩৯ কিলোমিটার এবং সার্কাম-বৈকাল রেলওয়ে বৈকাল হ্রদের তট বরাবর প্রায় ২০৭ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে, যা ট্রান্স-সাইবেরিয়ান রেলওয়ের শোভাবর্ধণ করে।
বর্তমানে ট্রান্স-সাইবেরিয়ান রেলপথ রাশিয়ার অর্থনীতির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপাদান ও চালিকাশক্তি। এটি শুধু রাশিয়ায় নয়, সারা বিশ্বের মধ্যে একটি বিস্ময়কর প্রজেক্ট। এমনকি ১০০ বছর পরে এসেও ট্রান্স-সাইবেরিয়ান রেলপথটি ইউরোপ ও এশিয়াকে যুক্ত করার মাধ্যমে এর উদ্দেশ্য সাধন করে যাচ্ছে।
প্রকাশকাল: বন্ধন ১৬৮ তম সংখ্যা, আগস্ট ২০২৪