সভ্যতার বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের চিন্তাধারার ক্রমাগত বিকাশ না হওয়াটাই অস্বাভাবিক। আদি মানবেরা খোলা আকাশের নিচে বাস করত, এরপর তারা গাছের ডালপালা ও পাতা দিয়ে তৈরি করতে শিখল নিজেদের বসবাসের জন্য বাসস্থান। কিন্তু তাদের তৈরি এই বাসস্থান তেমন নিরাপদ ও স্থায়ী ছিল না। তাই তারা বসতবাড়ি নির্মাণে নতুন অনুষঙ্গের খোঁজে নেমে পড়ল। তৈরি করতে শিখল নিরাপদ ও স্থায়ী বসতঘর। আবিষ্কৃত হলো চুন, সুরকি, ইট, কংক্রিটের মতো নির্মাণ উপকরণ। তৈরি হলো বহুতল ভবন, আকাশচুম্বী অট্টালিকা। এর পরও কিন্তু থেমে থাকেনি জ্ঞানপিপাসু, অনুসন্ধানপ্রিয়, নতুনের সন্ধানে সর্বদা জাগ্রত মানবজাতির অগ্রযাত্রা। যখনই মানুষ ভাবতে থাকে প্রযুক্তি ও উৎকর্ষতার চরম শিখরে পৌঁছে গেছি, তখনই তাদের বিস্মিত করতে হাজির হয় বিজ্ঞানমনস্ক একদল মানুষ। সর্বসম্মুখে নিয়ে আসে নব আবিষ্কৃত বিস্ময়জাগানিয়া সব আবিষ্কার।
এখন আমরা যে ইট ব্যবহার করছি, তা নিরাপদ ও টেকসই বটে, কিন্তু ব্যয়বহুল। তা ছাড়া সচরাচর এই ইট তৈরিতে যেসব উপাদান ব্যবহার করা হয়, তা সহজলভ্য ও অফুরন্ত নয়। তাই সাশ্রয়ের কথা মাথায় রেখে অনেক দিন ধরেই একদল বিজ্ঞানী তুলনামূলক কম মূল্যের বিকল্প নির্মাণসামগ্রী অনুসন্ধান করছে। তাদের নানামুুখী অনুসন্ধানের মধ্যে উল্লেখ করার মতো পরীক্ষণ উপকরণ স্থায়ী, পানিরোধক এবং ব্যবহার ও তৈরিতে ভিন্ন রকম ‘পশুর রক্ত’।

যখনই গবাদিপশু পালনের প্রসঙ্গ আসে, একটু লক্ষ করলেই দেখা যাবে যে এসব পশুর বিশেষ করে গরুর প্রায় সম্পূর্ণ অংশ কোনো না কোনোভাবে কাজে লাগে। যেমন- গরুর দুধ আমরা পান করি, পুষ্টিকর পানীয় হিসেবে আবার এই দুধ দিয়ে তৈরি হয় নানাবিধ পুষ্টিগুণসম্পন্ন খাদ্যদ্রব্য। এদের চামড়া প্রক্রিয়াজাত করে তৈরি হয় ব্যাগ, জুতা, শীতবস্ত্র। গরুর মাংসের কথা না বললেই নয়। সারা বিশ্বে প্রোটিনের উল্লেখযোগ্য উৎস হিসেবে সুপরিচিত এবং সুস্বাদু খাদ্য এটি। এমনকি গরুর গোবর সার হিসেবে বহুল প্রচলিত। আবার কিছু স্থানে এটি মেঝে তৈরির উপাদান হিসেবে ব্যবহার করা হয়। শুধু বাদ থাকে গরুর রক্ত, যা অপ্রয়োজনীয় হিসেবে ফেলে দেওয়া হয়। কিন্তু যদি এই রক্তও কাজে লাগানো যায় তবে কেমন হয়? অবাক হলেও ব্যাপারটা সত্য! সেই দিন আর বেশি দূরে নয়, যখন গরুর রক্তও কাজে লাগানো যাবে।
আশ্চর্য হলেও এটা সত্য যে সারা বিশ্বে প্রতিদিন অবিশ্বাস্য রকমের মাংসের চাহিদা রয়েছে। এর জন্য জবাই করা হয় লাখ লাখ পশু। আর এর সঙ্গে উপজাত হিসেবে উৎপন্ন হয় প্রচুর অপ্রয়োজনীয় বর্জ্য। রক্ত এর মধ্যে অন্যতম। একটি গরু জবাই করলে প্রায় আট গ্যালন রক্ত পাওয়া যায়, যার পুরোটাই ফেলে দেওয়া হয়। সাধারণত রক্ত জমাট বাঁধে। এই ধারণা থেকে ওয়েস্টমিনিস্টার ইউনিভার্সিটি (University of Westminster) থেকে সদ্য স্নাতক জ্যাক মানরো (Jack Munro) তৈরি করেন ‘রক্তের ইট’। তাঁর বিশ্বাস, এই ইট প্রচলিত কাদা ও পানি দিয়ে তৈরি ইটকে সফলভাবে প্রতিস্থাপন করতে পারবে। বিশেষ করে সিওয়া (Siwa), মিসর (Egypt) এসব স্থান বৃষ্টিতে উল্লেখযোগ্যভাবে ক্ষয়প্রাপ্ত হয়। এক গবেষণায় তিনি দেখান এই ইট দালান তৈরিতে মজবুত ও নির্ভরযোগ্য উপাদান হিসেবে দারুণ কার্যকর।
ইট তৈরিতে যখন রক্ত
সদ্য জবাইকৃত পশুর তাজা রক্তের সঙ্গে রক্ত সংরক্ষণের জন্য বিশেষ সংরক্ষণকারক (preservative) মেশানো হয় আর সঙ্গে বালু মিশিয়ে বর্গাকৃতির মোল্ডে ঢেলে এক ঘণ্টা তাপ দেওয়া হয়, এরপর একে ঠান্ডা করলেই পাওয়া যায় ইট, যা প্রচলিত ইটের মতোই ব্যবহার করা যায়।

বিশ্বাস হচ্ছে না? না হওয়ারই কথা। কিন্তু এটা সত্য। অন্তত স্থপতি জ্যাক মানরো তা-ই করে দেখিয়েছেন। অনেক দিন ধরে আশ্চর্য সব গবেষণা করছেন বাড়ি তৈরির নতুন উপাদান আবিষ্কারের লক্ষ্যে। আর এরই ফলস্বরূপ তিনি আবিষ্কার করতে সক্ষম হন রক্ত থেকে ইট তৈরিতে। ইট তৈরির প্রক্রিয়া সম্পর্কে এর উদ্ভাবক জানান –
‘পৃথিবীতে পশুর রক্ত একটি সুলভ ও যথেষ্ট পরিমাণে প্রাপ্ত অপ্রয়োজনীয় উপাদান। পশুর মৃতদেহ থেকে প্রাপ্ত রক্ত কাজে না লাগিয়ে ফেলে দেওয়া হয়। তাঁর আবিষ্কৃত প্রক্রিয়ার শুরুতে রক্তের সঙ্গে সংরক্ষণকারক উপাদান যেমন ইডিটিএ (EDTA) (যা ব্যাকটেরিয়া ও ফাঙ্গাস প্রতিরোধ করে) এবং বালু মেশানো হয়। এই মিশ্রণকে এরপর সুবিধাজনক আকৃতির ছাঁচে ঢেলে এক ঘণ্টা ৭০ ডিগ্রি সে. তাপমাত্রায় রাখা হয়। তাপের এই প্রয়োগ রক্তে থাকা প্রোটিনকে জমাট বাঁধতে সাহায্য করে আর পরিশেষে আমাদের দেয় অদ্রবণীয় কঠিন বস্তু, যা বালুকে জমাট বাঁধিয়ে স্থিতিশীল ও স্থায়ী কঠিন উপাদানে পরিণত করে।
এভাবে প্রাপ্ত ইটের উৎপাদন খরচ অনেক কম, এটি আবার বিস্ময়করভাবে শক্ত; তার ওপর আবার পানিরোধী। যেহেতু এটি অপ্রয়োজনীয় উপাদান থেকে তৈরি, তাই তুলনামূলক দরিদ্র দেশে এর ব্যবহার হয়ে উঠতে পারে দারুণ জনপ্রিয়।
ব্যবহার
বাড়ি তৈরির উপাদান হিসেবে ইটের ব্যবহার বহুল প্রচলিত। রক্তের তৈরি এই ইট হয়ে উঠতে পারে বাড়ি তৈরির সাশ্রয়ী উপাদান। যেহেতু এর উৎপাদনে খরচ নেই বললেই চলে, তাই কম খরচের নির্মাণসামগ্রী হিসেবে এটি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারে। তা ছাড়া এই ইট বিস্ময়করভাবে শক্ত ও পানি প্রতিরোধক। তাই কাঠামোয় পানিরোধক উপাদান হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে।
মরুভ‚মির ক্ষয় রোধে এটি রাখতে পারে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা। বিশেষ করে ইটটির আবিষ্কারক জ্যাক মানরো তাঁর গবেষণায় দেখিয়েছেন, যদি রক্ত বালুর পুরু স্তরে ছড়িয়ে দেওয়া হয়, তবে তা বালুর সঙ্গে শক্ত বন্ধনে পুরু স্থায়ী স্তর তৈরি করে। আর তাই এ ইট ব্যবহারে নির্মিত বাড়িটিকে ছিদ্রযুক্ত কাঠামোর মতো লাগে। এ ছাড়া বিভিন্ন আকৃতির সৌন্দর্যবর্ধক স্থাপত্য নির্মাণে এর রয়েছে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা।

শেষের আগে
এসব জেনে অনেকের কাছেই হয়তো বিষয়টি গোলমেলে লাগছে। রক্তের তৈরি ইট দিয়ে দালানকোঠা! মনে হচ্ছে না, এ যেন কোনো ভূতের গল্পের কাল্পনিক দৃশ্যপট? ব্যাপারটা অস্বাভাবিক হলেও সত্য। যদিও এখনো গবেষণাগারেই এর ব্যবহার সীমিত। তবে রক্ত দিয়ে তৈরি ইট খুব শিগগিরই সুপরিচিত হতে যাচ্ছে, এ ব্যাপারে সন্দেহ নেই। ভাবনার বিষয়, সাধারণ মানুষের কাছে এটি কতটা গ্রহণযোগ্যতা পাবে। কিন্তু এটি সত্য, এই ইট ব্যবহারগত দিকে সাশ্রয়ী, মজবুত, স্থায়ী ও পানি প্রতিরোধী। আর তাই অন্তত বাঁধ তৈরি আর মরুভূমির ক্ষয় রোধে এর ব্যবহার যে দারুণ কার্যকর হবে তা বলাই বাহুল্য।
তথ্যসূত্র : ইন্টারনেট
মোঃ নূর বাসিত জামান
লেকচারার, পুরকৌশল বিভাগ, ইউনিভার্সিটি অব ইনফরমেশন টেকনোলজি অ্যান্ড সায়েন্সেস।
প্রকাশকাল: বন্ধন ৪২ তম সংখ্যা, অক্টোবর ২০১৩