মোজাইক ফ্লোর ফিনিশিংকাজের পদ্ধতি
প্রথমে প্যাটেন্ট স্টোন ঢালাইয়ের কাজটি যথাযথ নিয়ম অনুযায়ী শেষ করতে হয়। এরপর মোজাইক ঢালাইয়ের জন্য নির্বাচিত মার্বেল চিপস চালনিতে চেলে ডাস্ট-ফ্রি করে ময়লা-আবর্জনা পরিষ্কার করার পর পানি দিয়ে চিপস পরিষ্কার করে নিতে হয়। এরপর মোজাইক ফ্লোরিংয়ের জন্য পছন্দ করা ডিজাইন অনুসারে বিভিন্ন কালারের চিপসের অনুপাত ঠিক করে একত্রে মিশিয়ে কাজ করা হয়ে থাকে। এরপর সিমেন্ট (১০০% হোয়াইট কিংবা গ্রে ও হোয়াইট সিমেন্টের মিশ্রণ) এবং মার্বেল চিপস ১ : ১ অনুপাতে শুকনো অবস্থায় ভালোভাবে মিশিয়ে নিয়ে অল্প অল্প করে পানি দিয়ে ঢালাইয়ের উপযোগী কংক্রিট তৈরি করে ঢালাইয়ের কাজ সম্পন্ন করা হয়। কংক্রিট মেশানোর সময় পানির পরিমাণটা অবশ্যই লক্ষ রাখতে হবে। নইলে মিস্ত্রিরা তাদের কাজের সুবিধার্থে ইচ্ছামতো পানি ব্যবহার করে, যা কাজের মান রক্ষায় বিঘ্ন সৃষ্টি করে এবং স্থায়িত্ব কমিয়ে দেয়।
মোজাইক ঢালাইয়ের পর ৩০ দিন পানি আটকে নিরবচ্ছিন্নভাবে কিউরিং করা জরুরি। কিউরিং শেষে কয়েক দিন শুকানোর পর মোজাইক কাটা মেশিনের মাধ্যমে বিভিন্ন সাইজের পাথর ব্যবহার করে সারফেস ফিনিশিং দিতে হয়। মেশিনে কাটা শেষ হলে অধিকতর ফিনিশিং দেওয়ার জন্য পুনরায় পাথর ও শিরিষ কাগজ ব্যবহার করে হাতে কেটে ফিনিশিং দেওয়া হয়ে থাকে। সবশেষে, অ্যাসিড ও মোমপলিশ করে ব্যবহারের উপযোগী ফ্লোর তৈরি করা হয়।
উল্লেখ্য, মোজাইক ঢালাই ফ্লোর ছাড়াও খাড়া দেয়ালেও করা হয়। দেয়ালের মোজাইক কাটার জন্য কোনো মেশিন ব্যবহার করা যায় না। ফলে, ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে পাথর ও শিরিষ কাগজের মাধ্যমে হাতে কেটেই ফিনিশিং দিয়ে একইভাবে অ্যাসিড ও মোমপলিশ করতে হয়। মোজাইকের কাজ শ্রমসাধ্য এবং ব্যয়বহুল, যা প্রথমেই আলোচনা করা হয়েছে। এ ছাড়া কাজের জটিলতা অনেক। এসব কারণে মোজাইকের ব্যবহার বিলুপ্তপ্রায়।

মোজাইক টাইলস ফ্লোর ফিনিশিং
কাস্ট-ইন-সিটু মোজাইক ছাড়াও প্রি-কাস্ট মোজাইক টালি তৈরি করে ফ্লোর ফিনিশিংয়ের কাজ করা হয়। মোজাইক টালি তৈরির কাজটি সঠিকভাবে সম্পন্ন করার জন্য মালামাল নির্বাচন করা, কাজের পদ্ধতি এবং মালামাল ও কাজের গুণগত মান রক্ষা করার বিষয়গুলো সবই কাস্ট-ইন-সিটু মোজাইক ফ্লোরিংয়ের কাজের মতো। পার্থক্য শুধু ঢালাইয়ের কাজে কাস্ট-ইন-সিটু মোজাইক কার্যস্থলে অর্থাৎ নির্মিতব্য ফ্লোরে একবারে ঢালাই করে ফিনিশিং দেওয়া হয়।
আর মোজাইক টালি অন্যত্র তৈরি করে জমাট বাঁধানোর পর পর্যাপ্ত কিউরিং শেষে কার্যস্থলে এনে সিমেন্ট মর্টার দিয়ে ফ্লোরে বসানো হয়। এই টালি নির্দিষ্ট সাইজ অনুসারে ফর্মে ঢেলে প্রেশার মেশিনের সাহায্যে কম্প্যাকশন করে তৈরি করা হয়। টালি তৈরির কাজে ফর্মে মোজাইক ঢালাই এবং কম্প্যাকশন করার আগপর্যন্ত প্রতিটি কাজ যেমন- মালামাল নির্বাচন করা, পরিষ্কার করা, মেশানো ইত্যাদি সবই কাস্ট-ইন-সিটু মোজাইক ঢালাইয়ের নিয়মেই সম্পন্ন করা হয়ে থাকে।
মোজাইক ঢালাই ফর্মে ঢেলে টালি কম্প্যাকশন করার পর জমাট বাঁধার জন্য কমপক্ষে ১০ ঘণ্টা সময় দিতে হয়। জমাট বাঁধার পর ৩০ দিন পর্যন্ত কিউরিং করা হয়। এরপর ডিজাইন মোতাবেক সিমেন্ট-বালুর মর্টার ব্যবহারে ফ্লোরে বসানোর ২৪ ঘণ্টা পর থেকে পুনরায় কিউরিং করতে হয়। পর্যাপ্ত কিউরিং সম্পন্ন করে পাথর ও শিরিষ কাগজ দিয়ে ঘসে মসৃণ করার পর অক্সালিক অ্যাসিড ও মোমপলিশ করে ব্যবহারের উপযোগী ফ্লোর তৈরি করা হয়ে থাকে। উল্লেখ্য, একইভাবে ব্যয়বহুল এবং কাজের জটিলতার কারণে এই কাজটিও বিলুপ্তপ্রায়।

সিরামিক টাইলসে ফ্লোর ফিনিশিং
কাস্ট-ইন-সিটু মোজাইক এবং মোজাইক টালির পর ফ্লোর ফিনিশিংয়ের কাজে বর্তমানে আমাদের দেশে সিরামিক টাইলসের ব্যবহার প্রাধান্য পেয়েছে। এই সিরামিক টাইলস একসময় বিদেশ থেকে আমদানি করা হতো। বর্তমানে ফ্লোর ফিনিশিংয়ের কাজে ব্যবহৃত টালির সিংহভাগই আমাদের দেশে প্রস্তুত করা হচ্ছে। দেশে উৎপাদিত টালি বিদেশি টালির তুলনায় দামে সস্তা এবং কোয়ালিটিও খারাপ নয়। তারপরও সর্বমোট চাহিদার একটা অংশ বিদেশ থেকে আমদানি করা হয়ে থাকে।
বিদেশ থেকে আমদানি করা টালির মানের তুলনায় দামটা বেশি, টালি বিভিন্ন সাইজ ও মানের হয়ে থাকে। আগে দেশের সিরামিক ইন্ডাস্ট্রিতে প্রস্তুত করা ৪”x৪”, ৬”x৬”, ৮”x৮” সাইজের টালি প্রস্তুত করা হতো। এর থেকে বড়গুলো বিদেশ থেকে আমদানি করা হতো। এখন দেশেও ২৪”x২৪” বা ততোধিক সাইজের টালি প্রস্তুত হচ্ছে। অন্যদিকে বিদেশ থেকে আরও বড় যেমন ৩২”x৩২”, ২৪”x৪৮”, ৩০”x৬০” ইত্যাদি সাইজের টালি আমদানি করা হয়।
টালির সাইজ ছাড়াও গুণগতমান এবং টেক্সারে ভিন্নতা আছে। যেমন- সিরামিক কোটেড, হোমোজিনিয়াস, ম্যাট ফিনিশিং, গেøইজড ফিনিশিং, মিরর পলিশড, লেজার কাট ইত্যাদি। এসব নানা ধরনের টালির মান অনুসারে দামের পার্থক্য হয়ে থাকে। ফলে, ক্রেতাসাধারণ তাঁদের আর্থিক সংগতি এবং রুচি অনুযায়ী এসব টালি পছন্দ করে থাকেন। টালি দ্বারা নির্মিত ফ্লোর ব্যবহারের সাচ্ছন্দ্যতা বেশি এবং রক্ষণাবেক্ষণ সহজ। কিন্তু, মোজাইকের তুলনায় সিরামিক টালির ফ্লোরের নির্মাণব্যয় এবং স্থায়িত্ব অনেক কম।
স্থায়িত্ব ও গুণগত মানের দিক দিয়ে উচ্চমূল্যের ক্রমানুসারে গ্রানাইট, মার্বেল, মোজাইক ও সিরামিক টাইলসকে ক্রমানুসারে সাজানো যেতে পারে। তবে কিছু কিছু বিদেশি সিরামিক টাইলস আছে, যার দাম আনুপতিক হারে অনেক বেশি এবং সৌন্দর্য ও স্থায়িত্ব ও বেশি। টাইলস লাগানোর আগে সাধারণত ফ্লোর চিপিং ও পরিষ্কার করে তার ওপর ১ : ৩ বা ১ : ৪ অনুপাতে সিমেন্ট ও বালুর মিশ্রণে তৈরি মর্টার দিয়ে বসানো হয়। এ ছাড়া টালি কাজে লাগানোর আগে পর্যাপ্ত পরিমাণে ভিজিয়ে নেওয়া অত্যাবশ্যক।

মার্বেল টাইলসে ফ্লোর ফিনিশিং
ফ্লোর ফিনিশিংয়ের মালামাল হিসেবে মার্বেল অতি উচ্চাভিলাষী এবং ব্যয়বহল নির্মাণ উপকরণ। মার্বেল একটি খনিজ পদার্থ, যা বড় বড় পাথর হিসেবে খনি থেকে উত্তোলন করে ৩/৪” পুরু করে শিট আকারে কাটার পর সেখান থেকে বিভিন্ন সাইজের টালি প্রস্তুত করা হয়ে থাকে। ছোট-বড় টালির সাইজের ওপর দামের তারতম্য হয়। এ ছাড়া মার্বেলের গুণগতমানের ওপরও দামের তারতম্য হয়ে থাকে। আমাদের দেশে সাধারণত ইন্ডিয়া ও ইতালি থেকে মার্বেল আমদানি করা হয়।
ইন্ডিয়ার মার্বেলের তুলনায় ইতালির মার্বেলের গুণগতমান এবং দাম অনেক বেশি। মার্বেল বিভিন্ন কালার ও টেক্সারের হয়ে থাকে। ব্যবহারকারীর আর্থিক সংগতি এবং রুচি অনুযায়ী মার্বেল ব্যবহার করা হয়। মার্বেল সিমেন্ট-বালুর মর্টার দ্বারা ফ্লোরে বসিয়ে মোজাইক ফ্লোরের মতো মেশিনে এবং হাতে কেটে ফিনিশিং দিয়ে একই নিয়মে অ্যাসিড এবং মোমপলিশ করা হয়ে থাকে। মার্বেলের আভিজাত্য অনেক বেশি, এর সঙ্গে অন্যান্য ফ্লোর ফিনিশিংয়ের কোনো তুলনা হয় না।
গ্রানাইট ফ্লোর ফিনিশিং
গ্রানাইট মার্বেলের চেয়ে অধিক দামি এবং মানসম্মত একটি নির্মাণসামগ্রী। এটিও একটি খনিজ পদার্থ, যা সরাসরি খনি থেকে উত্তোলন করে মার্বেলের মতো একই নিয়মে টালি প্রস্তুত করা হয়। তবে আমাদের দেশে ফ্লোর ফিনিশিংয়ের কাজে সচরাচর গ্রানাইট ব্যবহার করা হয় না। গ্রানাইট সাধারণত কিচেনের ওয়ার্ক টপ, সিংক এবং বার্নার স্ল্যাবের ওপর লাগানো হয়ে থাকে। অধিক দামের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে আমাদের দেশে কোথাও কোথাও কম পুরুত্বের (১০ বা ১২ এমএম) গ্রানাইট ব্যবহার করা হয়।
ইমারতে ফ্লোর ফিনিশিং – ১ম পর্ব
ইমারতে ফ্লোর ফিনিশিং – ৩য় পর্ব
ইমারতে ফ্লোর ফিনিশিং – ৪র্থ পর্ব
– প্রকৌশলী মো. হাফিজুর রহমান
পিইঞ্জ, চিফ ইঞ্জিনিয়ার (অপারেশন)
এনা প্রপার্টিজ লি.
প্রকাশকাল: বন্ধন ১৬০ তম সংখ্যা, ডিসেম্বর ২০২৩