নির্মাণের অপরিহার্য অনুষঙ্গ স্কাফোল্ডিং

স্কাফোল্ডিং একধরনের অস্থায়ী কাঠামো, যা বিভিন্ন ধরনের বড় নির্মাণস্থলে বা  সাইটে কিংবা যেকোনো ধরনের স্থাপনার মেরামত বা সংস্কারের সময় তৈরি করা হয়। এসব অস্থায়ী কাঠামো নির্মাণ বা মেরামতের কাজে প্রয়োজনীয় নির্মাণসামগ্রী এবং নির্মাণে যুক্ত শ্রমিকদের সহায়তা করে বিশেষভাবে। স্কাফোল্ডিংয়ে মেটাল নির্মিত পাইপ বা টিউব ব্যবহৃত হয়। তবে সব সময় যে এ ধরনের মেটাল পাইপ বা টিউব ব্যবহৃত হবে এমন কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। নির্মাণ সাইটে কাজের সুবিধা বা ধরন অনুযায়ী অন্য সামগ্রীও ব্যবহার করা যেতে পারে। এশিয়ার দেশগুলোতে বাঁশ খুব সহজলভ্য এবং দামে সস্তা হওয়ায় এ অঞ্চলের অধিকাংশ দেশেই স্কাফোল্ডিংয়ে বাঁশের ব্যবহার লক্ষণীয়।

অধুনা বিশ্বে আধুনিকতার ছোঁয়ায় উন্নয়ন হচ্ছে দ্রুততার সঙ্গে, যা নতুন নগর সৃষ্টির পাশাপাশি পুরোনো নগর পুনরায় নির্মাণ বা মেরামতে রাখছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। ফলে বিভিন্ন বড় শহরে এমনকি ছোট শহরেও পুনঃসংস্কারকৃত বহুতল ভবন দেখা যাচ্ছে। আর এসব বহুতল ভবনের নির্মাণকাজ, মেরামত, ফিনিশিং এবং পেইন্টিংয়ের মতো কাজে প্রয়োজন স্কাফোল্ডিংয়ের। স্কাফোল্ডিংয়ের মাধ্যমে নির্মাণকৃত অস্থায়ী কাঠামো একজন নির্মাণ শ্রমিককে যেকোনো উচ্চতায় কাজ করার সুযোগ করে দেয়। তদুপরি এটা নির্মাণ শ্রমিকদের যথাযথ নিরাপত্তা প্রদান করায় কাজে নির্মাণ শ্রমিকেরা স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে।

স্ট্যান্ডার্ডস ও ব্রেসেস, টিউব জয়েন্ট ও বেইস ফাউন্ডেশন (বা থেকে)

শুরুর কথা

Lascaux-এ পেলিওলাইটিক গুহার দেয়ালের পেইন্টিংয়ের মাধ্যমে সূত্রপাত স্কাফোল্ডিং ধারণাটির। আজ থেকে প্রায় ১৭ হাজার বছর আগে পেইন্টিংয়ের মাধ্যমে শুরু স্কাফোল্ডিংয়ের ব্যবহার। প্রাচীন গ্রিস, মিসর, চীন এবং নুবিয়ানস সভ্যতায় নির্মিত স্থাপনায় স্কাফোল্ডিংকে নির্মাণের সময় অস্থায়ী কাঠামো হিসেবে ব্যবহারের তথ্য পাওয়া যায়। শুরুর দিকে স্কাফোল্ডিং হিসেবে কাঠ ব্যবহার করে গাছের ছাল দ্বারা মজবুত করে বেঁধে এর দৃঢ়তা নিশ্চিত করা হতো।

স্কাফোল্ডিংয়ের ধরন ও ব্যবহারের ব্যাপক পরিবর্তন সাধিত হয় ব্রিটিশ কোম্পানি প্যাটেন্ট র‍্যাপিডের হাত ধরে। ১৯১৯ সালে এই কোম্পানিটির স্কাফোল্ডিং পায় দারুণ জনপ্রিয়তা। বর্তমানে কোম্পানিটির কর্ণধার হারসকো (Harsco)। পালমার জোনস স্কাফোল্ডিংয়ের বিভিন্ন ইউনিটযুক্ত করে স্ক্যাফিকচার (Scaffixer) প্রবর্তন করেন, যা গাছের ছালের তুলনায় স্কাফোল্ডিংয়ে দৃঢ়তা প্রদানে সক্ষম। স্ক্যাফিকচার আবিষ্কারের পর স্কাফোল্ডিংয়ের বদৌলতে নির্মাণকাজে আসে বৈপ্লবিক পরিবর্তন। যার ফলস্বরূপ ১৯১৩ সালে পালমার জোনসের কোম্পানিকে বাকিংহাম প্যালেস পুনর্নির্মাণে মনোনীত করা হয়। পালমার জোনসের স্ক্যাফিকচারে সময়টায় এসে পায় ব্যাপক জনপ্রিয়তা। ১৯২৩ সালে কাঠের পরিবর্তে শুরু হয় স্টিল পাইপ ব্যবহার। পরবর্তী সময়ে যার ব্যবহার শুরু হয় বাণিজ্যিকভাবে ব্যাপক পরিসরে। নতুনভাবে সৃষ্ট এসব স্কাফোল্ডিংয়ে পরস্পরের মধ্যে বিভিন্ন ইউনিটের প্রতিস্থাপন সুবিধা ছিল অনেক। যার ফলে কাঠামোগতভাবে অনেক দৃঢ় এবং স্থায়িত্বপূর্ণ স্কাফোল্ড সৃষ্টি সম্ভব হয়। বিশেষত বহুতল ও সুউচ্চ ভবনের নির্মাণকাজে। বিশেষভাবে নির্মিত স্কাফোল্ডিংয়ের ফ্রেমসমূহকে বাণিজ্যিকভাবে প্রথম বাজারজাত করা হয় ১৯৪৪ সালে, যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী পুনর্নির্মাণে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়।

স্কাফোল্ডিংয়ে সময়ের

ইউরোপীয় অঞ্চলে BSEN-১২৮১-১ কোড দ্বারা নির্দেশিক স্ট্যান্ডার্ড স্কাফোল্ডিং ব্যবহার অধিক সুবিধাজনক। কেননা এতে স্কাফোল্ডিংয়ের কার্যক্ষমতা এবং সুবিধাসমূহের ব্যাপারে নিশ্চিত থাকা যায়। তা ছাড়া এতে নির্দেশিত স্কাফোল্ডিংসমূহ অন্যান্য কাজে ব্যবহার করা যায়।

নির্মাণকাজে এবং সাইটে স্কাফোল্ডিং ব্যবহারের প্রথম ও প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে নির্মাণশ্রমিক ও প্রকৌশলীদের নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করা। তা ছাড়া স্কাফোল্ডিংয়ের ব্যবহারের ফলে নির্মাণসামগ্রীকে খুব সহজে ও নিরাপদে পরিবহন করা যায়। তদুপরি ডিজাইন অনুযায়ী স্ট্যান্ডার্ড মেটাল ব্যবহার করে স্কাফোল্ডিংয়ে নির্মাণকাজ করলে দুর্ঘটনার ঝুঁকি কমে অনেকাংশে।

স্টিল টিউব ফ্রেমে ডাবল স্কাফোল্ডিং

যা নিয়ে স্কাফোল্ডিং  

স্কাফোল্ডিংয়ের প্রধান প্রধান উপাদানের মধ্যে রয়েছে টিউব, কাপলার এবং বোর্ড।

টিউব

মেটালের পাতলা টিউবগুলো স্কাফোল্ডিংয়ে স্ট্যান্ডার্ড বলে বিবেচিত। একে স্কাফোল্ডিং জগতের বৈপ্লবিক পরিবর্তনের সূচক হিসেবে বিবেচনা করা হয়, যা যুগ যুগ ধরে স্কাফোল্ডিংয়ের বেইসলাইনে (Baseline) পরিণত হয়েছে। স্কাফোল্ডিংয়ের উদ্দেশ্যে মেটালের তৈরি এই হালকা টিউব প্রথম বাজারে আসে ১৯৫০ সালের মধ্যভাগে। ২৪ পাউন্ডের ইউনিট স্কাফোল্ডিং দ্বারা যেকোনো সাইজ বা উচ্চতার স্কাফোল্ডিংয়ের সন্নিবেশ করা সম্ভব কয়েকজন শ্রমিক দ্বারাই; যার জন্য আগে থেকে কোনো ধরনের নাট বা বোল্টের প্রয়োজন নেই।

টিউব তৈরি হয় সাধারণত স্টিল বা অ্যালুমিনিয়ামে। শুধু কম্পোজিট স্কাফোল্ডিংয়ে কাচের ফাইবারের ফিলামেন্ট নাইলন বা পলিস্টার ম্যাট্রিক্স ব্যবহার করা হয়। কম্পোজিট টিউবের দাম বেশি হওয়ায় এগুলোকে শুধু মাথার ওপরের বৈদ্যুতিক তারগুলোকে কোনোভাবেই আলাদা করা না গেলে তবেই ব্যবহার করা হয়। নিরাপত্তাজনিত কারণে বেশি ব্যবহৃত হয় কম্পোজিট টিউব। আর স্টিলের টিউব ব্যবহারের ক্ষেত্রে সাধারণত কালো বা গ্যালভানাইজড স্টিলের টিউব ব্যবহার করা হয়। এই টিউব সাধারণত ৪৮.৩ সিসি ব্যাসসংবলিত নানা দৈর্ঘ্যরে হয়ে থাকে। স্টিলের টিউব ও অ্যালুমিনিয়াম টিউবের মধ্যকার মূল পার্থক্য অ্যালুমিনিয়াম টিউবগুলো অনেক বেশি হালকা যেখানে অ্যালুমিনিয়াম টিউবের ওজন ১.৭ কেজি/মিটার আর স্টিলের টিউবের ওজন ৪.৪ কেজি/মিটার। অ্যালুমিনিয়াম টিউব অনেক বেশি স্থিতিস্থাপক হওয়ায় চাপ ধারণক্ষমতা স্টিলের টিউবের তুলনায় অপেক্ষাকৃত কম। প্রাথমিক অবস্থায় টিউবগুলো সাধারণত ৬.৩ মিটার লম্বা হয়ে থাকে। পরবর্তী সময়ে যা থেকে নির্মাণের চাহিদা আর প্রয়োজন অনুসারে প্রয়োজনীয় আকার-আকৃতিতে কেটে নেওয়া যায়। বড় বড় টিউব উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান টিউব উৎপাদনের সময় ব্যান্ডের নাম টিউবের গায়ে স্থায়ীভাবে লিখে রাখে।

কপলার (Coupler)

কপলার হলো সংযোগ স্থাপনকারী, যা সাধারণত টিউবকে একত্র রাখে। এগুলো সচরাচর স্ক্যাফোল্ড কপলার (Scaffold Coupler) নামে পরিচিত। কপলার সাধারণত তিন ধরনের- ১. রাইট অ্যাঙ্গেল (Right-Angle) কপলার ২. পুটলগ (Putlog) কপলার ৩. সুইভেল (Swivel) কপলার। বিভিন্ন ধরনের টিউবকে Lend to end পাশাপাশি সংযুক্ত করতে সংযোগ পিন বা Sleeve কপলার ব্যবহার করা হয়। শুধু লোড বহনকারী সংযোগস্থলের ক্ষেত্রে Right-Angle কপলার এবং Swivel কপলার ব্যবহার করা হয় টিউবের মধ্যকার সংযোগ স্থাপনের ক্ষেত্রে। একক কপলার সাধারণত কোনো ধরনের লোড বহন করে না। এবং ডিজাইনেও তাদের কোনো ধরনের সহায়ক অনুষঙ্গ হিসেবে বিবেচনায় নেওয়া হয় না।

স্কাফোল্ডিংয়ের নানা ধাপ

বোর্ড

বোর্ডগুলো সাধারণত স্ক্যাফোল্ড ব্যবহারকারীদের কাজের ক্ষেত্র তৈরি করে। এগুলো মূলত সিজনিং (Seasoning) করা কাঠ, যা সাধারণত তিন ধরনের পুরুত্বে পাওয়া যায়- ৩৮ মিমি, ৫০ মিমি এবং ৬৩ মিমি। এর মধ্যে ৩৮ মিমি পুরুত্বের কাঠ বেশি মাত্রায় ব্যবহৃত হয়। এই কাঠগুলো সাধারণত চওড়ায় ২২৫ মিমি এবং লম্বায় সর্বোচ্চ ৩.৯ মিটার। কাঠের বোর্ডের প্রান্তগুলো মেটাল প্লেট বা নেইল প্লেট দ্বারা আবৃত করে সুরক্ষা ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হয়। এগুলোকে হুপ আয়রন (Hoop Iron) বলা হয়। এ ছাড়া লেমিনেটিং বোর্ড, কাঠ, স্টিল ও অ্যালুমিনিয়ামের ডেকও অনেক সময় ব্যবহার করা যায়। এ ছাড়া বেশির সময় ব্যবহার করা হয় সোল বোর্ড। যদি স্ক্যাফোল্ডের পৃষ্ঠদেশ বেশি নরম হয় কিংবা এর কার্যক্ষমতা নিয়ে সন্দেহ থাকে, তবে অনেক ক্ষেত্রে সাধারণ মানের কাঠও ওয়াকিং সারফেস হিসেবে ব্যবহার করা যায়।

অন্যান্য স্ক্যাফোল্ড উপাদানের মধ্যে রয়েছে ভিত্তি প্লেট (Base Plate), লেডার (Ladder), দড়ি (Anchor Ties), সিট (Sheet), গিন হুইল (Gin Wheel) ইত্যাদি। অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানই স্ক্যাফোল্ডকে একটি নির্দিষ্ট রঙে পেইন্ট করে থাকে, যাতে কোনো ধরনের চুরির ঘটনা ঘটলে তা যেন দূর থেকেই বোঝা যায়। স্ক্যাফোল্ডের যেসব উপকরণ মেটাল নির্মিত, সেগুলোকে রং করা যায়। কিন্তু কাঠের উপাদানকে রং করা হয় না। কেননা এতে কাঠে কোনো ধরনের ক্রটি থাকলে সহজেই তা চোখ এড়িয়ে যায়।

হংকংয়ে বাঁশের স্কাফোল্ডিং ব্যবহার বেশি যেখানে বাঁশগুলোকে নাইলনের দড়ি দিয়ে বেঁধে কপলার তৈরি করা হয়। বাংলাদেশ ও ভারতে বাঁশের সঙ্গে কাঠকে স্ক্যাফোল্ড হিসেবে ব্যবহার করা হয়।

স্কাফোল্ডিংয়ের নানা অংশ 

স্কাফোল্ডিংয়ের প্রধান প্রধান অংশসমূহ- 

  • স্ট্যান্ডার্ডস (Standards)
  • লেজারস (Ledgers)
  • ট্রান্সমস (Transms)
  • ব্রেসেস (Braces)
  • পুটলগ (Putlog)
  • বোর্ড (Board)
  • গার্ড নেইল (Guard Nail)
  • টো-বোর্ড (Toe-Board)
  • ভিত্তি (Foundation)
  • টাইস (Ties)
  • পাম্প জ্যাক (Pump-Jack)

স্ট্যান্ডার্ডস

স্ট্যান্ডার্ডস হচ্ছে স্কাফোল্ডিং কাঠামোর খাড়া মেম্বার। একে সাধারণত গর্ত করে মাটির ভেতরে ঢুকিয়ে দেওয়া হয় অথবা এমনি মাটির ওপর রাখা হয়। স্ট্যান্ডার্ডসকে সাধারণত Upright বলা হয়। এরা প্রযুক্ত চাপ ও লোড প্রাথমিকভাবে বহন করে পরবর্তী সময়ে মাটিতে স্থানান্তর করে। এদের বেইস প্লেটের ঠিক মাঝে Shank থাকে, পুরো টিউবটিকে যথাস্থানে ধরে রাখতে। তা ছাড়া এটার মধ্যে পিন দিয়ে বোর্ডগুলোকে সংযুক্ত রাখা যায়।

সিঙ্গেল স্কাফোল্ডিং

লেজারস ও ট্রান্সমস

লেজার হচ্ছে অনুভূমিক টিউব, যা স্ট্যান্ডার্ডসের মধ্যে সংযোগ স্থাপন করে। ট্রান্সমসগুলোকে লেজারের ওপরে Right-Angle-এ স্থাপন করা হয়। প্রধান প্রধান ট্রান্সমসগুলোকে স্ট্যান্ডার্ডসের পাশে বসানো হয়। তারা স্ট্যান্ডার্ডসগুলোকে যথাস্থানে ধরে রাখতে সাহায্য করে বোর্ডের জন্য সাপোর্ট হিসেবে কাজ করে। ইন্টারমিডিয়েট ট্রান্সমসগুলোকে প্রধান প্রধান ট্রান্সমসের মাঝে মাঝে রাখা হয়, যাতে বোর্ডগুলো ভালোভাবে সাপোর্ট দিতে পারে।

ব্রেসেস

ব্রেসেস হচ্ছে স্ট্যান্ডার্ডের সঙ্গে Diagonal উপায়ে যুক্ত মেম্বার। এরা স্ট্যান্ডার্ডসগুলোকে তাদের নিজস্ব স্থানে ধরে রাখতে সাহায্য করে মূল কাঠামোকে দৃঢ়তা প্রদান করে।

পুটলগ

পুটলগ দেয়ালের সঙ্গে আড়াআড়িভাবে স্থাপিত মেম্বার। এদের এক অংশ দেয়ালের মধ্যে এবং অন্য অংশ লেজারের সঙ্গে সংযুক্ত থাকে। পুটলগকে অনেক সময় Brick-Layer স্ক্যাফোল্ড বলা হয়। নির্দিষ্ট স্পেস পরপর  পুটলগ দেওয়া হয়। পুটলগ প্রদানে টাইস প্রয়োজন। কাজের প্ল্যাটফর্ম বা সারফেস তৈরিতে নির্দিষ্ট স্থান পরপর পুটলগ দেওয়া একান্ত জরুরি।

বোর্ড 

বোর্ড হচ্ছে স্কাফোল্ডিংয়ের আড়াআড়ি প্ল্যাটফর্ম, যা নির্মাণশ্রমিকদের পাশাপাশি নির্মাণসামগ্রীর সাপোর্ট দেয়। এরা সাধারণত পুটলগের সাহায্যে নিজ অবস্থান ধরে রাখে।

গ্রান্ড রেইল

এটা একধরনের রেইল, যা লেজারের মতো স্কাফোল্ডিং দেওয়া হয়। এটা সাধারণত ওয়াকিং লেভেলে প্রদান করা হয়।

টো-বোর্ড

টো-বোর্ড হচ্ছে বিশেষ একধরনের বোর্ড, যা লেজারের সমান্তরালে থাকে। পুটলগের সাহায্যে সাপোর্ট প্রদান করে টো-বোর্ডগুলোকে কাজের জন্য সৃষ্ট প্ল্যাটফর্মের লেবেলে ধরে রাখা হয়।

ভিত্তি

ভালো ভিত্তি স্থাপনার জন্য খুব জরুরি। প্রায়ই স্কাফোল্ডিংয়ে সাধারণ মানের বেইস প্লেটের থেকে ভালো মানের প্ল্যাটফর্ম দরকার হয় নিরাপত্তা এবং লোড স্থানান্তরের জন্য। বেইস প্লেট ছাড়াও স্কাফোল্ডিং ব্যবহার করা যেতে পারে কংক্রিট বা এ ধরনের শক্ত সারফেসে। যদিও বেইস প্লেট সব সময় ব্যবহারের সুপারিশ করা হয়। নরম এবং বিপজ্জনক সারফেসে অবশ্যই সোলে বোর্ড ব্যবহার করতে হবে এবং এই সোলে বোর্ডের ক্ষেত্রফল কোনোভাবেই ২০০০ বর্গ সেমি থেকে কম হবে না। এবং এই বোর্ডের চারপাশের আকার ২২০ মিমির নিচে হতে পারবে না। এসব বোর্ডের পুরুত্ব হবে ৩৫ সেমি। তা ছাড়া কাজ করার জন্য নির্মিত প্ল্যাটফর্মের নিরাপত্তার জন্য এর সঙ্গে সংগতিপূর্ণ অন্যান্য সহায়ক উপাদানও রয়েছে। তদুপরি জরুরি ও বিপজ্জনক পরিস্থিতিতে দ্রুততার সঙ্গে এখান থেকে বেরিয়ে আসার ব্যবস্থা থাকা একান্ত প্রয়োজন।

সিঙ্গেল স্কাফোল্ডিং

টাইস

স্কাফোল্ডিং কোনো স্বাধীন কাঠামো নয়। একে ধরে রাখতে বিভিন্ন উপাদান টাইস দ্বারা যুক্ত করা প্রয়োজন। সাধারণত প্রতি ৪ মিটার পরপর টাইস দেওয়া দরকার। টাইসগুলো যত দূর সম্ভব স্ট্যান্ডার্ডস এবং লেজারের সংযোগস্থলের কাছাকাছি হওয়া উচিত। এখনকার নির্মাণশৈলী অনুযায়ী টাইসগুলোর অবশ্যই শেয়ার বহনের সক্ষমতা থাকতে হবে। যেহেতু টাইসগুলোকে জানালার খোলা জায়গা দিয়ে প্রবেশ করানো হয় তাই অনেক ক্ষেত্রেই খাড়া ট্রান্সমস স্কাফোল্ডিংয়ের সঙ্গে টাইসকে যুক্ত করে দেওয়া হয়। টিউব এবং কাঠামোর সারফেসের ফাঁকা জায়গা কাঠ দিয়ে বন্ধ করা হয় শক্ত ও দৃঢ় সারফেস তৈরির জন্য।

পাম্প জ্যাক

পাম্প জ্যাক হচ্ছে একধরনের পোর্টেবল স্কাফোল্ডিং সিস্টেম। এই স্কাফোল্ডিং দুই বা ততোধিক খাড়া পোস্টের ওপরে দাঁড়িয়ে থাকে। স্ক্যাফোল্ড ব্যবহারকারী নিজের কাজের চাহিদা ও প্রয়োজনানুযায়ী প্যাডেল করে স্ক্যাফোল্ডটিকে ওপরে বা নিচে নামিয়ে নিজ কাজ সম্পন্ন করে থাকে।

স্কাফোল্ডিংয়ের বিভিন্ন উপাদানের মধ্যবর্তী দূরত্ব অনেকটাই নির্দিষ্ট। সাধারণ কাজের জন্য স্কাফোল্ডিংয়ের বে-এর সর্বোচ্চ দূরত্ব ১.১ মিটার। কিন্তু অনেক বেশি ভারী কাজের জন্য বে-এর দূরত্ব ১ মিটার বা ১.৮ মিটার পর্যন্ত কমিয়ে আনা হয়। স্কাফোল্ডিংয়ের প্রস্থ সাধারণত বোর্ডের প্রস্থ দ্বারা নির্ধারিত। কিন্তু ৬০০ মিমির কম প্রস্থের বোর্ড সাধারণত ব্যবহার করা হয় না। সাধারণভাবে বোর্ডগুলো চওড়ায় ৮৭০ মিমি হয়ে থাকে। মাঝে মাঝে এদের মধ্যে অতিরিক্ত বোর্ড ঢোকানো হয় মধ্যবর্তী ফাঁকা জায়গা কমিয়ে আনতে। খাড়াভাবে লেজারের মধ্যবর্তী দূরত্ব ২ মিটার রাখা হয়। কিন্তু এটাকে ২.৭ মিটার পর্যন্ত বাড়ানো সম্ভব।

ট্রান্সমসের স্পেসিং সাধারণত নির্দিষ্ট হয় বোর্ডের পুরুত্ব দ্বারা। যেমন- ৩৮ মিমি বোর্ডের জন্য ট্রান্সমসের স্পেসিং প্রয়োজন ১.২ মিটারের বেশি, ৫০ মিমি বোর্ডের ট্রান্সমস স্পেসিং ২.৬ মিটার এবং ৬৩ মিমি বোর্ডের জন্য এই স্পেসিং ৩.২৫ মি. পর্যন্ত হয়ে থাকে।

স্কাফোল্ডিংয়ের রকমফের

সিঙ্গেল স্কাফোল্ডিং

সিঙ্গেল স্কাফোল্ডিংয়ে সাধারণত একই লেয়ারের স্ট্যান্ডার্ডস, লেজার, পুটলগ ইত্যাদি দ্বারা কাঠামো নির্মাণ করা হয়। এটা সাধারণত দেয়ালের সমান্তরালে এবং দেয়াল থেকে ১.২ মিটার দূরত্বে তৈরি করা হয়। এতে স্ট্যান্ডার্ডসগুলোকে সাধারণত ২ থেকে ২.৫ মিটার পরপর এবং লেজারকে লম্বালম্বিভাবে প্রায় ১.২ থেকে ১.৫ মিটার পরপর স্থাপন করে সংযোগ দেওয়া হয়। পুটলগে প্রাপ্ত লেজারের সঙ্গে সংযুক্ত করে অন্য প্রান্ত ওয়ালের মধ্যকার ছিদ্র বা ফাঁকা জায়গায় রাখা হয়। এ সময় পুটলগগুলোর মধ্যবর্তী দূরত্ব হয় প্রায় ১.২ থেকে ১.৫ মিটার। গার্ড, বোর্ড এবং অন্য মেম্বারগুলোকে এর ওপরে স্থাপন করা হয়। এ ধরনের স্কাফোল্ডিং সাধারণত ইটের গাঁথুনি তৈরিতে ব্যবহার করা হয় এবং এদের অনেক সময় পুটলগ স্কাফোল্ডিং বলে।

ডাবল স্কাফোল্ডিং

পাথরের গাঁথুনিতে দেয়ালের মধ্যে ছিদ্র বা ফাঁকা জায়গা রাখা খুবই দুরূহ ব্যাপার! যার ফলে স্কাফোল্ডিংয়ের পুটলগে দেয়ালের মধ্যে সাপোর্টের কোনো ব্যবস্থা থাকে না। এসব ক্ষেত্রে অনেক বেশি শক্তিশালী ও মজবুত দুই লেয়ারের স্কাফোল্ডিং তৈরি করা হয়। এর প্রতিটি সারিতে খাড়া ও আলাদা আলাদা ফ্রেমওয়ার্ক থাকে। প্রথম সারি বা লেয়ারের দেয়াল থেকে ২০ থেকে ৩০ সেমি দূরে স্থাপন করা হয় এবং অন্য লেয়ারের কাঠামো প্রথম লেয়ার থেকে ১ মিটার দূরে স্থাপন করা হয়। পুটলগকে এর পর দুই লেয়ারের ফ্রেমওয়ার্কের ওপর বসানো হয়। ক্রস ব্রেসেসের মাধ্যমে স্কাফোল্ডিংগুলোকে আরও বেশি দৃঢ়তা প্রদান করা হয়। এ ধরনের শক্তিশালী ও মজবুত স্কাফোল্ডিং ডাবল স্কাফোল্ডিং হিসেবে খ্যাত।

কন্টিলিভের স্কাফোল্ডিং

বিশেষ কারণ এবং অবস্থায় কন্টিলিভের স্ক্যাফোল্ডিং ব্যবহার করা হয়। যেসব বিশেষ বিশেষ পরিস্থিতিতে কন্টিলিভের স্কাফোল্ডিং প্রয়োজন-

  • যদি নির্মাণস্থলের মাটি স্ট্যান্ডার্ডসকে যথাস্থানে ধরে রাখতে ব্যর্থ হয়।
  • যদি দেয়ালের ওপরের অংশের নির্মাণকাজ অব্যাহত রাখতে হয়।
  • যদি স্কাফোল্ডিংয়ের কাছাকাছি অবস্থিত দেয়ালকে যাতায়াতের জন্য উন্মুক্ত রাখা জরুরি হয়।

ভাসমান (Suspended) স্কাফোল্ডিং

এটা খুব হালকা ধরনের স্কাফোল্ডিং, যা সাধারণত মেরামতের কাজ, পেইন্টিং, পয়েন্টিং ইত্যাদির জন্য তৈরি। এ ধরনের স্কাফোল্ডিংয়ের কাজে প্ল্যাটফর্মটিকে ওপরের ছাদ থেকে দড়ি বা চেইন কিংবা তার দিয়ে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়। এই ঝুলন্ত প্ল্যাটফর্মটিকে নিজের ইচ্ছামতো বা কাজের প্রয়োজন অনুযায়ী ওপরে ওঠানো বা নিচে নামানো যায়।

Trestle স্কাফোল্ডিং

এ ধরনের স্কাফোল্ডিং ঘরের ভেতরের মেরামতের কাজ বা পেইন্টিংয়ের জন্য করা হয়ে থাকে। কাজের প্ল্যাটফর্মটিকে একটা চলমান বা চারপাশে নড়তে পারে এমন একটা Contrivance-এর সঙ্গে যুক্ত করা হয়।

স্কাফোল্ডিং টিউব কাঠামো

স্টিল স্কাফোল্ডিং 

স্টিলের স্কাফোল্ডিংগুলো কাঠের স্কাফোল্ডিংয়ের মতো। শুধু কাঠের মেম্বারগুলোর জায়গায় স্টিলের টিউব এবং সংযোগ স্থাপনের জন্য দড়ির জায়গায় Couplet এবং Titting ব্যবহার করা হয়। কিন্তু স্টিলের স্কাফোল্ডিংয়ের কার্যক্ষমতা, দৃঢ়তা এবং স্থায়িত্ব কাঠের স্কাফোল্ডিংয়ের তুলনায় অনেক বেশি, যদিও প্রাথমিক পর্যায়ে স্টিলের খরচ বেশি কিন্তু সে তুলনায় এর Salvage Value অনেক বেশি। তাই বর্তমান নির্মাণে স্টিলের স্কাফোল্ডিং ব্যবহৃত হচ্ছে ব্যাপকভাবে।

পৃথিবীর উন্নত দেশে বহুতল ভবন নির্মাণের কথা চিন্তায় আনা সম্ভব নয় স্কাফোল্ডিংয়ের ব্যবহার ছাড়া। এখন বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। নির্মাণকাজের গতি অনেকাংশে নির্ভর করে ভালো মানের স্কাফোল্ডিং কাঠামোর ওপর। তাই পৃথিবীর উন্নত দেশগুলো নতুন নতুন নির্মাণশৈলীর পাশাপাশি আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করছে স্কাফোল্ডিংয়ে। সেই তুলনায় বাংলাদেশ এখনো অনেকটাই পিছিয়ে। এখানে এখনো ব্যক্তিগত পর্যায়ের পাশাপাশি অনেক বাণিজ্যিক বহুতল ভবন নির্মাণে সনাতন যুগের কাঠ ও বাঁশ নির্মিত স্কাফোল্ডিং ব্যবহৃত হচ্ছে। স্টিলের স্কাফোল্ডিংয়ের প্রাথমিক খরচের কথা চিন্তা করে অনেকেই বাণিজ্যিকভাবে এটি ব্যবহারে আগ্রহী নন। যদিও এর কর্মক্ষমতা ও স্থায়িত্বের কথা বিবেচনায় নিয়ে অনেকেই বাণিজ্যিকভাবে এর ব্যবহার শুরু করেছে। তাই দেশের অবকাঠামোগত নির্মাণকাজের আধুনিকায়নের পাশাপাশি  স্কাফোল্ডিংয়ের আধুনিকায়ন একান্ত প্রয়োজন হয়ে পড়েছে।

প্রকৌশলী সনজিত সাহা

[email protected]

প্রকাশকাল: বন্ধন ৪৭ তম সংখ্যা, মা‍র্চ ২০১৪

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top