এস্টিমেটের যত কথা
ভবন নির্মাণের এস্টিমেট করতে যা যা লাগে

যাবতীয় নির্মাণকাজ শুরুর আগে সম্ভাব্য নির্মাণব্যয় (Cost of Construction) সম্পর্কে ধারণা থাকা একান্ত প্রয়োজন। নইলে নির্মাতাপ্রতিষ্ঠান কিংবা ভবনের মালিক বাধাগ্রস্ত হন সম্পূর্ণ নির্মাণকাজটি সফলভাবে সম্পন্ন করতে। কী পরিমাণ খরচ হতে পারে এ সম্পর্কে ধারণা না থাকলে পড়তে হয় নানা সমস্যায়। যেমন- নির্মাণকাজের আনুমানিক মূল্য প্রকৃত মূল্য থেকে কম হলে, নির্মাণকাজের মাঝামাঝি এসে নির্মাণব্যয় বৃদ্ধিহেতু বন্ধ হয়ে যেতে পারে। আর তাই প্রত্যেকেরই উচিত বাড়ি নির্মাণের আগে একজন দক্ষ এস্টিমেটর বা প্রকৌশলী দ্বারা প্রাক্কলিত ব্যয় নির্ধারণ করা।

সাধারণভাবে প্রকৌশল কাজের সম্ভাব্য পরিব্যয় (Cost) নির্ণয়ের পদ্ধতিকে প্রাক্কলন (Estimate) বলা হয়। ব্যবহৃত মালসামগ্রীর অনুপাত, গুণাগুণ ও কারিগরি সুনির্দিষ্ট বিবরণীসংবলিত বিনির্দেশ (Specification), কাঠামোর উপরিতল (Plan), সম্মুখ দৃশ্য (Elevation) ও প্রস্থচ্ছেদ (Section) ইত্যাদি ড্রয়িংয়ের ওপর ভিত্তি করে এস্টিমেট তৈরি করা হয়। কাজ করার আগে এটা তৈরি করা হয় বলে সম্ভাব্য পরিব্যয়ের সঙ্গে প্রকৃত পরিব্যয়ের মিল নির্ভর করে। এস্টিমেটিং করা হয় বাস্তবমুখী ও বাজারদরের ওপর নির্ভর করে।

বাড়ি তৈরির এস্টিমেট

এস্টিমেটের জন্য ডেটা (Data for Estimate)

যেকোনো নির্মাণকাজের এস্টিমেট তৈরি করতে যে যে তথ্যের প্রয়োজন-

১. ড্রয়িং প্ল্যান, এলিভেশন, সেকশন, বিস্তারিত ড্রয়িং প্রভৃতি। প্ল্যান, সেকশন ও এলিভেশনের ক্ষেত্রে 1cm =1m স্কেলে এবং বিস্তারিত ড্রয়িংয়ের ক্ষেত্রে 1cm = 10cm থেকে 1cm = 20cm স্কেল ব্যবহার করা হয়।

২. বিনির্দেশ (Specification): বিশেষ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট বিবরণকে বিনির্দেশ বলে। ড্রয়িং ও অন্যান্য খুঁটিনাটি বিবরণমাফিক প্রকল্প সমাধার যে কার্য নিপুণতা বা কারিগরি ও মালসামগ্রীর দরকার প্রকৌশল বিনির্দেশে তার বিবরণ থাকে। বিনির্দেশ ড্রয়িংয়ের প্রথমে অথবা নির্দিষ্ট পৃষ্ঠায় করা হয়।

৩. দর (Rates) : কাজের বিভিন্ন আইটেম, মালসামগ্রী, মজুরি ইত্যাদির জন্য আলাদা আলাদা দর নির্ধারণ করা হয়। আমাদের দেশে Public Works Department (PWD)-এর দরের শিডিউল বই (Schedule of Rate Book) থেকে সংগ্রহ করা হয়, যা Analysis of Rate-এর মাধ্যমে প্রস্তুতকৃত।

এস্টিমেটের প্রকারভেদ

  • বিভিন্ন ধরনের এস্টিমেটের তালিকায় রয়েছে-
  • রাফ বা আনুমানিক এস্টিমেট (Approximate or Rough Estimate).
  • পোতা ক্ষেত্রফলভিত্তিক এস্টিমেট (Plinth Area Estimate).
  • ঘনত্বভিত্তিক রেট এস্টিমেট (Cubical Content Estimate).
  • আনুমানিক পরিমাণভিত্তিক এস্টিমেট (Approximate Quality Method Estimate).
  • একক দরভিত্তিক এস্টিমেট (Item Rate Estimate or Detailed Estimate).
  • সংশোধিত এস্টিমেট (Revised Estimate).
  • অনুপূরক এস্টিমেট (Supplementary Estimate).
  • অনুপূরুক ও সংশোধিত এস্টিমেট (Supplementary and Revised Estimate).
  • বার্ষিক মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণ এস্টিমেট (Annual Repair or Maintenance Estimate).

উপরিউক্ত এস্টিমেটগুলোর মধ্যে বাংলাদেশে একক দরভিত্তিক এস্টিমেট (Item Rate Estimate) বেশি ব্যবহৃত হয়। তা ছাড়া রাফ বা আনুমানিক এস্টিমেট, পোতা ক্ষেত্রফলভিত্তিক এস্টিমেট (প্রচলিত নাম ছাদ মাপ) সংশোধিত এস্টিমেট এবং রক্ষণাবেক্ষণ এস্টিমেট ভিন্ন ভিন্ন কাজের জন্য প্রায়ই প্রণয়নের প্রয়োজন পড়ে।

একটি ভবনের এস্টিমেট করতে হলে ভবনের ফাউন্ডেশন বা ভিত্তির মাটি কাটা থেকে শুরু করে ছাদে লাইম কংক্রিটের কাজ পর্যন্ত যাবতীয় আইটেমের হিসাব করতে হয়। প্রতিটি কাজের পরিমাণ নির্ণয় করতে হয়। সে প্রেক্ষিতে ভবনের কাজের ধারাবাহিকতা বজায় রেখে এগোনো উত্তম। ভবন নির্মাণে কী কী আইটেম অন্তর্ভুক্ত হবে, তা অবশ্যই জানা দরকার। প্রতিটি আইটেমের কাজের পরিমাণ নির্ণয়ের পর এতে ব্যবহৃত মালামালের হিসাব করতে হয়। যেমন : ইটের গাঁথুনির কাজে কত ইট, কত ব্যাগ বালু বা সিমেন্ট লাগে। আবার কংক্রিটের কাজে কত ইট, সিমেন্ট ও বালু লাগে। তেমনি প্লাস্টারের কাজে কত সিমেন্ট ও বালু লাগতে পারে তার বিশদ পরিমাণ বের করতে হয়। অতঃপর বিভিন্ন আইটেমে ব্যবহৃত সব ইট ও বালুর পরিমাণ যোগ করা হয়। সর্বশেষ সর্বমোট ইট, রড, বালু ও সিমেন্ট ইত্যাদির পরিমাণ নির্ণয় এবং তালিকাভুক্ত করে নির্মাণসামগ্রীর মূল্য তালিকা তৈরি করা যেতে পারে।

ভবন তৈরির রড

একটি ভবন তৈরিতে প্রথমে এর বিস্তারিত নকশা প্রণয়ন জরুরি। সে নকশাকে ভিত্তি করেই দালানের বিস্তারিত এস্টিমেট করা হয়। কিন্তু প্রায়ই দেখা যায় বাড়ির মালিকেরা নকশা প্রণয়নের খরচের কথা চিন্তা করে, কোনো অভিজ্ঞ প্রকৌশলীর দ্বারস্থ না হয়ে একজন রাজমিস্ত্রির সহায়তা নেন। এর ফলে হয়তো ৩০ হাজার টাকা বাঁচাতে গিয়ে ৩০ লাখ টাকার ভবন ঝুঁকিপূর্ণভাবে নির্মাণের ফলে পরে মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন হয়। যদিও এটি এস্টিমেটের অংশ নয় তবুও ভালো ড্রয়িং ছাড়া ভালো এস্টিমেট আশা করা যায় না। কারণ ড্রয়িং বা নকশা দেখেই এস্টিমেট করা হয়। আমাদের দেশের নির্মাতারা প্রায়ই এ ধরনের ভুল করে। তাই বাড়ি করার আগে মালিকের উচিত বাড়ির ড্রয়িং এবং ডিজাইনের জন্য একজন অভিজ্ঞ আর্কিটেক্ট বা প্রকৌশলীর শরণাপন্ন হওয়া। রানা প্লাজা ধসের পর থেকে যদিও বাড়ির ড্রয়িং, ডিজাইন এবং সুপারভিশনের ওপর সরকার অনেক বেশি গুরুত্বরোপ করেছে। তবে তা প্রয়োজনের তুলনায় যথেষ্ট নয়।

এস্টিমেট করবেন যেভাবে 

আমাদের দেশে সব এস্টিমেট উপ-সহকারী পর্যায়ের পুর প্রকৌশলী দিয়ে করানো হয় এবং সহকারী পুর প্রকৌশলীদের দ্বারা নিরীক্ষা করা হয়। এটা তো গেল সরকারি হিসাব। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো কিছু বিষয়ে আপনার নিজস্ব গুণাবলি থাকলে আপনিও হয়ে যেতে পারেন একজন দক্ষ এস্টিমেটর এবং পারবেন নিজের বাড়ির এস্টিমেট নিজেই তৈরি করতে।

যে ধরনের গুণাবলি প্রয়োজন

  • নির্মাণকাজের খুঁটিনাটি সম্পর্কিত জ্ঞান।
  • নির্মাণকাজের বাস্তব অভিজ্ঞতা।
  • জ্যামিতিক মাপজোক বা গাণিতিক হিসাবের দক্ষতা।
  • প্রয়োজনীয় মালসামগ্রী, শ্রমঘণ্টা, যন্ত্রপাতি ও যাবতীয় পরিব্যয় সম্পর্কিত তথ্যজ্ঞান।
  • বিভিন্ন এলাকা, নানা কাজ ও বিভিন্ন শ্রেণীর কর্মী সম্পর্কে বিচার বোধ।
  • এস্টিমেট তৈরিতে উৎকৃষ্ট পদ্ধতির অবাধ প্রয়োগ ক্ষমতা।
  • ড্রয়িং বোঝার ক্ষমতা যথা- প্ল্যান, সেকশন, এলিভেশনের মাপজোক বের করতে পারা।
  • বর্তমান বাজার দর সম্পর্কে ভালো ধারণা রাখা।
  • যত্ন ও শ্রমসাপেক্ষ কাজ পূর্ণাঙ্গ নির্ভুলরূপে সমাধা করার সক্ষমতা।
  • এস্টিমেটসংক্রান্ত উপাত্ত শ্রেণীভুক্ত করণ ও মূল্যায়ন করার দক্ষতা।
  • নির্মাণকাজের ধাপগুলো মানসলোকে দর্শন করার সক্ষমতা।

কোনো ভবনের সর্বমোট খরচ অর্থাৎ নির্মাণের শুরু থেকে নির্মাণ শেষ অবধি যে পরিমাণ খরচ হবে সেটা নির্ণয়ের পদ্ধতিই এস্টিমেট। সর্বমোট খরচ প্রথমে খসড়া আকারে এবং পরে বিস্তারিত আকারে করা হয়। খসড়া বা রাফ এস্টিমেট সাধারণত একটি গ্রহণযোগ্য দরে (প্রতি বর্গমিটার/ফুট প্ল্যান এরিয়া রেট) নির্ধারণ করা হয়। সর্বমোট খরচের প্রায় ৬০ শতাংশ নির্মাণসামগ্রী, ২০ শতাংশ সেবার চার্জ এবং বাকি ২০ শতাংশ অন্যান্য আনুষঙ্গিক খরচ হিসেবে ধরা হয়।

বিস্তারিত এস্টিমেট তৈরি করতে হলে প্রথমে বিভিন্ন আইটেমের কাজের পরিমাণ নির্ণয় করে এটা বিশ্লেষণ (Analysis) করে নির্মাণসামগ্রীর পরিমাণ এবং পরে মূল্য নির্ধারণ (Cost Analysis) করা হয়। তারপর ওই সব আইটেমের কাজের কর্মীদের মজুরি নির্ধারণ করা হয়। আনুষঙ্গিক অন্যান্য খরচসহ উল্লেখিত সামগ্রীর মূল্য, শ্রমিক মজুরি ইত্যাদি মিলিয়ে মোট খরচ হিসাব করা যেতে পারে।

বাড়ি তৈরির এস্টিমেট

ইমারতের বিস্তারিত এস্টিমেটের বিভিন্ন আইটেমসমূহ

  • ফাউন্ডেশন বা ভিত্তির মাটি কাটা
  • ফাউন্ডেশন বা ভিত্তির মাটি ভরাট
  • প্লিন্থের মাটি ভরাট
  • ভিত্তিতে এক ইটের ফ্ল্যাট সোলিং বা ৩ ইঞ্চি সিসি ঢালাই
  • ভিত্তিতে আরসিসির কাজ
  • আন্ডার গ্রাউন্ড ওয়াটার রিজারভারের কাজ
  • শর্ট কলাম ঢালাইয়ের কাজ
  • গ্রেট বিম ঢালাইয়ের কাজ
  • কলাম ঢালাইয়ের কাজ
  • ছাদ ঢালাইয়ের কাজ
  • বাউন্ডারি ওয়ালের কাজ
  • সুপার স্টাকচারের গাঁথুনির কাজ
  • লিন্টের ফলস সিলি ও সানশেডের আরসিসির কাজ
  • সকল সাটারিংয়ের কাজ
  • দরজা-জানালার কাঠের কাজ
  • সব গ্রিলের এমএসের মাইন্ড এমএস স্টিলের কাজ
  • সব রেলিংয়ে এসএস কাজ (এসএস = স্টেইনলেস স্টিল)
  • সব প্লাস্টারের কাজ (ভেতর ও বাইরে)
  • ওভারহেড পানির ট্যাংকের কাজ
  • প্যারাপেট ওয়ালের কাজ
  • রুফে লাইম কংক্রিটের কাজ
  • জিএফে সিসি ঢালাইয়ের কাজ (জিএফ = গ্রাউন্ড ফ্লোর)
  • সব ফ্লোরে টাইলসের কাজ
  • সব বাথরুম ও কিচেন ওয়ালে টাইলসের কাজ
  • সব জানালায় থাই গ্লাসের কাজের দরজার প্লালের কাজ
  • সব স্যানিটারি কাজ
  • সব ইলেকট্রিক কাজ
  • ভেতরের সব ওয়াল ও সিলিংয়ে ডিস্টেমপার বা প্লাস্টিক ইমালশন
  • বাইরের ওয়ালের ওয়েদার কোট
  • সব এমএস জিমিলে এনামেল পেইন্ট
  • সব কাঠের পাল্লায় বার্নিশের কাজ।

এ ছাড়া আরও অনেক আইটেম, যেগুলো ভবন নির্মাণের সঙ্গে যুক্ত, সেসবের এস্টিমেট ও বাজারদর অনুযায়ী সর্বমোট প্রাক্কলিত ব্যয়ের বিস্তারিত থাকবে আগামী সংখ্যায়।

প্রকৌশলী সুবীর কুমার সাহা

প্রকাশকাল: বন্ধন ৪৫ তম সংখ্যা, জানুয়ারি ২০১৪

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top