অনেক আগে থেকেই চট্টগ্রাম ছিল ব্যবসা-বাণিজ্যের কেন্দ্র্র। বিশ্বের অন্যতম প্রাচীন এ বন্দর নগরে ব্যবসা করতে আসতেন নানা দেশের মানুষ। তাঁদের কর্মতৎপরতায় দেশের বাণিজ্যিক এ রাজধানীতে গড়ে উঠেছে অনিন্দ্য স্থাপত্যশৈলীর প্রাচীন সব স্থাপনা। ব্রিটিশ আমলে নির্মিত শতবর্ষী কোর্ট বিল্ডিং চট্টগ্রামের পুরোনো সব স্থাপনার অন্যতম প্রতিভূ।
ইতিহাসের পাতায়
খ্রিষ্টীয় ষষ্ঠ ও সপ্তম শতকে চট্টগ্রাম ছিল আরাকান রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত। ১৩৪০ খ্রিষ্টাব্দে সুলতান ফখরুদ্দীন মুবারক শাহ দখল করার পর থেকে পরবর্তী ১৯৮ বছর চট্টগ্রাম কেবল মুসলিম শাসনাধীনে ছিল। মরক্কোর বিশ্বখ্যাত পরিব্রাজক ইবনে বতুতা ফখরুদ্দীন মুবারক শাহের শাসনামলে বাংলার রাজধানী সোনারগাঁ ও চট্টগ্রাম আসেন। তাঁর বর্ণিত ভ্রমণকাহিনিতে চট্টগ্রামকে ঘিরে দারুণ মুগ্ধতার পরিচয় মেলে।
সুলতান গিয়াসউদ্দীন মাহমুদ শাহ ১৫৩৮ খ্রিষ্টাব্দে শের শাহের কাছে যুদ্ধে পরাস্ত হন। এরপর পুনরায় আরাকানিরা দখলে নেয় চট্টগ্রাম। এরপর প্রায় ১২৮ বছর আরাকানি শাসকেরা চট্টগ্রাম দখলে রাখেন। মোগল সম্রাট আওরঙ্গজেবের মামা শায়েস্তা খান ১৬৬৪ খ্রিষ্টাব্দে বাংলার সুবেদার নিযুক্ত হয়ে আরাকানি মগ ও পর্তুগিজ জলদস্যুদের বিতাড়িত করতে চট্টগ্রামে অভিযান চালান। এর পর থেকেই চট্টগ্রাম মোগল শাসনাধীনে এসেই রূপান্তরিত হয় জেলায়। মোগলরাই প্রথমবারের মতো চট্টগ্রামকে জেলা হিসেবে সুশৃঙ্খল প্রশাসনিক কাঠামোর আওতায় নিয়ে আসে। প্রায় ১৯৪ বছর পার্বত্য চট্টগ্রামও চট্টগ্রাম জেলার সঙ্গে একীভূত ছিল। ১৮৬০ খ্রিষ্টাব্দে ইংরেজ আমলে পার্বত্য চট্টগ্রামকে আলাদা জেলায় উন্নীত করা হয়।

চাটির গাঁও থেকে চট্টগ্রাম
ষষ্ঠ ও সপ্তম শতকে আরাকানিদের রাজত্বের সময় চট্টগ্রামের অফিস-আদালত কোথায় ছিল তার কোনো স্পষ্ট বিবরণ পাওয়া যায়নি। কথিত আছে, বর্তমান কোর্ট হিলের চ‚ড়ায় এক চাকমা রাজার প্রাসাদ ছিল। চাকমা রাজার আমলে হজরত বদর শাহ (রহ.) চট্টগ্রামে ইসলাম প্রচার করতে এসে বিচিত্র এক পরিস্থিতিতে পড়েন। ওই সময় চট্টগ্রাম ছিল জিন-পরি এবং নানা প্রকার অশরীরী অশুভ আত্মার আবাসস্থল। জিন-পরি ও অশরীরী অশুভ আত্মারা তাঁকে কোথাও থাকতে দিতে অস্বীকৃতি জানায়। হজরত বদর শাহ (রহ.)-এর বারবার অনুরোধে শেষ পর্যন্ত তারা ছোট্ট একটা জায়গা তাঁর জন্য ছেড়ে দেয়। পীর বদর শাহ (রহ.) তখন সেই ছোট্ট জায়গায় জ্বালিয়ে দেন একটি চাটি বা বাতি। সেই স্থানটি ছিল জামালখাঁ ও মোমিন রোডের সংযোগস্থলের মধ্যস্থিত ছোট টিলায়। চাটি জ্বালানোর পর তিনি মহান সৃষ্টিকর্তার ইবাদতে মশগুল হয়ে পড়েন। ধীরে ধীরে তাঁর জ্বালানো বাতির তেজ বাড়তে থাকে। সেই সঙ্গে বিস্তৃতি হতে থাকে আলো। এই ঘটনা থেকে অঞ্চলটির নাম চাটিগাঁ। পরে নাম হয় চট্টগ্রাম। চাটিকে স্থানীয়ভাবে চেরাগও বলা হতো। সেই সূত্র ধরে ছোট পাহাড় বা টিলাটিও নতুনভাবে চেরাগী পাহাড় নামে পরিচিতি পেতে থাকে। বর্তমানে জায়গাটি চেরাগী মোড় হিসেবে খ্যাত। কারও কারও দাবি, পীর বদর শাহ (রহ.) একটি মাত্র চাটাই বিছানোর অনুমতি পান। এই চাটাই থেকেই ক্রমান্বয়ে চট্টগ্রাম নামের উৎপত্তি।
জমিদার অখিল চন্দ্র সেন ও ফেয়ারি হিল
১৭৭৬ খ্রিষ্টাব্দে ব্রিটিশ শাসক ফ্রান্সিস লো সর্বপ্রথম চট্টগ্রামের শাসনভার গ্রহণ করেন। ইংরেজ আমলের শুরুতে চট্টগ্রামের প্রশাসনিক কেন্দ্র ছিল মাদ্রাসা পাহাড়। বর্তমান ডক্টর মুহাম্মাদ এনামুল হক রোডের পশ্চিম দিকের পাহাড়কে বলা হতো মাদ্রাসা। এই পাহাড়ে মাদ্রাসা অবস্থিত হওয়ায় এ রকম নামকরণ করা হয়েছে। বর্তমানে মাদ্রাসার স্থলে এই পাহাড়ে অবস্থান মুহসীন কলেজের। তাই এই পাহাড়কে এখন কলেজের নামানুসারে ডাকা হয়। চট্টগ্রামের আলা সদর আমিন আদালতের অবস্থান মাদ্রাসা পাহাড়ে। পশ্চিম দিকের পাহাড়ে ছিল সদর মুন্সেফি ও অন্য একটি আলা সদর আদালত। পরবর্তীকালে জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে শহর দক্ষিণ দিকে সম্প্রসারিত হতে থাকলে ইংরেজরা অফিস-আদালতগুলো স্থানান্তরের প্রয়োজন অনুভব করে। আর এর জন্য চলতে থাকে উপযুক্ত জায়গা খোঁজা। অনেক চিন্তা-ভাবনার পর সহজ যাতায়াত, কৌশলগত সুবিধাজনক অবস্থান ও পরিসর বিবেচনায় পরির পাহাড়কে নির্বাচন করা হয়। ইংরেজরা পরির পাহাড়ের নাম পরিবর্তন না করে ইংলিশ ভাষায় ‘ফেয়ারি হিল’ বলে অভিহিত করত। ফলে শাসকশ্রেণীর বুলি হিসেবে এই পাহাড় ‘ফেয়ারি হিল’ নামে খ্যাত। পাহাড়টি ছিল পর্তুগিজ জন হ্যারির ব্যক্তিগত সম্পত্তি। জঙ্গলাকীর্ণ এই পাহাড়ে তখন ছিল একটি কুঠির। এই কুঠিরে পর্তুগিজদের পরিচালিত একটি ছোট চিকিৎসাকেন্দ্র ছিল। ব্রিটিশ শাসনামলে বুলক ব্রাদার্স নামক একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান ছিল, যা ইংরেজ শাসনের শুরুতে ছিল যথেষ্ট প্রভাবশালী। নানা ধরনের ব্যবসা ছাড়াও বুলক ব্রাদার্স ব্রিটিশ শাসনামলে বার্মা তেল কোম্পানির প্রধান পরিবেশক হিসেবে কাজ করত। এই বুলক ব্রাদার্সের এজেন্টের বসবাস ছিল পরির পাহাড়ে। ব্রিটিশ শাসন শুরু হওয়ার পর ইংরেজ ক্যাপ্টেন ট্যাঙরা পর্তুগিজ জন হ্যারির কাছ থেকে পরির পাহাড়টি কিনে নেন। ক্যাপ্টেন ট্যাঙরা থেকে পাহাড়টি কেনেন প্যারেডা নাম্নী এক ভদ্রলোক। এই সব কেনাবেচা ও হস্তান্তরের ঘটনা ঘটেছে ১৮৫০ খ্রিষ্টাব্দের আগে। কারণ, ঊনবিংশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে পটিয়া থানার ছনহরা নিবাসী জাহাজ ব্যবসায়ী ও খ্যাতনামা জমিদার অখিল চন্দ্র সেন তৎকালীন মুদ্রায় নয় হাজার টাকায় প্যারেডার কাছ থেকে পরির পাহাড় কিনে নেন।

কোর্ট হিলের লাল দালান
অফিস-আদালতের জন্য সুপরিসর ভবন নির্মাণের জন্য ১৮৮৯ খ্রিষ্টাব্দে অখিল চন্দ্র সেনের কাছ থেকে পাহাড়টি সরকারিভাবে হুকুম-দখল করা হয়। ১৮৯৩-১৮৯৪ খ্রিষ্টাব্দে ব্রিটিশ নির্মাণশৈলীর স্বাক্ষর রেখে একটি লাল রঙা ভবন নির্মাণ করা হয়। এই ভবনটি ব্রিটিশ শাসকদের সুরুচি ও দূরদৃষ্টির পরিচায়ক। ধারণা করা হয়, কলকাতার রাইটার্স বিল্ডিংয়ের অনুকরণে ভবনটি নির্মিত। ব্যাপারটি আসলে সে রকম নয়। সমসাময়িক যেকোনো স্থাপত্যর মধ্যে শৈল্পিক ও নান্দনিকতায় মিল থাকে। এটা কিন্তু খুব স্বাভাবিক বিষয়। মূলত ভবনটি ছিল দ্বিতল। আয়তন ছিল ১,১৮,২০২ বর্গফুট। নির্মাণের পরপর মাদ্রাসা পাহাড় থেকে অফিস-আদালত সবই এখানে সরিয়ে আনা হয়। এই ভবনটি শুরু থেকেই আদালত ভবন হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। আর পরির পাহাড়ও আস্তে আস্তে হয়ে উঠেছে কাচারি পাহাড় বা কোর্ট হিল। কোর্ট বিল্ডিংয়ে বর্তমানে ডিস্ট্রিক্ট জজ কোর্ট, ডিভিশনাল কমিশনারের অফিস ও কোর্ট, মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেটের কোর্ট ও বার কাউন্সিল অবস্থিত। এখানেই আছে শতবর্ষী কোর্ট বিল্ডিং ও সংলগ্ন চত্বর। এর পেছনেই আছে নতুন কোর্ট বিল্ডিং। কোর্ট বিল্ডিংয়ের পুরোনো ভবনটির অবস্থান ১,৫০,০০০ বর্গফুটের বিশাল এলাকা নিয়ে। কিন্তু এর পূর্ণ কার্যক্রম সম্পাদন করতে হলে প্রয়োজন প্রায় ৩,৫০,০০০ বর্গফুট এলাকা। ব্যবহারের ফলে পুরোনো ভবনের এমন দশা যে গণপূর্ত অধিদপ্তর একে ১৯৮৫ সালে পরিত্যক্ত ঘোষণা করে। এই ঘোষণার ফলে অনেকেই এই পুরোনো ভবনটি ভেঙে ফেলার বিপক্ষে মত দেন। যে মতের পরিপ্রেক্ষিতে শুরু হয় নতুন ভবন নির্মাণের কাজ।
বর্তমানে প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন হিসেবে পুরোনো ভবনটি অত্যন্ত গুরুত্ববহ। পাকিস্তান আমলে ১৯৫৩ খ্রিষ্টাব্দে এই ভবনের ওপরে আরও এক তলা ভবন নির্মাণ করা হয়, যা ভবনের কাঠামোগত সৌন্দর্যের হানিকর। যুগের তাগিদে এবং মানুষের প্রয়োজনে সরকার ২,৪৬,৭১১ বর্গফুট আয়তন বিশিষ্ট নতুন আদালত ভবন নির্মাণপূর্বক ২০১০ সালের ৮ সেপ্টেম্বর নতুন ভবনের উদ্বোধন করা হয়।
কোর্ট বিল্ডিংয়ের স্থাপত্যরীতি
অনেকেরই ধারণা, চট্টগ্রাম কোর্ট বিল্ডিংয়ের নকশাটি কলকাতার রাইটার্স বিল্ডিংয়ের নকশার হুবহু প্রতিরূপ। কিন্তু সমসাময়িক ব্রিটিশ স্থাপত্যশৈলী একই রকম ছিল প্রায় সর্বত্রই। মূলত কলকাতার অনুরূপ ভবন তৈরি বা চট্টগ্রামে এ রকম বড় স্থাপনা তৈরির মূল কারণ ছিল নগরায়ণের গোড়াপত্তনের পাশাপাশি সাম্রাজ্যবাদের প্রতিষ্ঠা। দেশভাগের আগে এই স্থাপনা মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত হতো।

এ সময়ের বাংলাদেশের স্থাপত্যরীতিতে মূলত বেশ কয়েক ধরনের প্রভাব লক্ষণীয়-
১. ভিট্রূভিয়ান ক্লাসিসিজম- অষ্টাদশ শতকের আগে (উদাহরণ- ব্যাংক অব বেঙ্গল, জনসন রোডের ক্লাসিক্যাল চার্চ)
২. ইন্ডিয়ান নিও ক্লাসিসিজম- উনিশ শতকের শুরুতে (উদাহরণ- আহসান মঞ্জিলের অন্দর মহল, ঢাকা মেডিকেল কলেজ)
৩. ট্রপিক্যাল ইউরো ইন্ডিয়ান স্টাইল- উনিশ শতকের শেষ ভাগে (উদাহরণ- চট্টগ্রাম কোর্ট বিল্ডিং, ঢাকার পুরোনো পৌর ভবন)
৪. রাস্যিয়াল ক্লাসিসিজম- উনিশ শতকের পরে (উদাহরণ- আহসান মঞ্জিল, শাখানিধি লজ)
৫. গোথিক স্টাইল- (উদাহরণ- নর্থ ব্রুক হল)
তাই এই ট্রপিক্যাল ইউরো ইন্ডিয়ান স্টাইলের ধারক এই সুরম্য অট্টালিকা পুরো চট্টগ্রামের নগরায়ণের এক মাইলফলক। তবে এই কোর্ট বিল্ডিং এক দিনে স্থাপিত হয়নি। হয়েছে দিনের পর দিন অক্লান্ত পরিশ্রমে পরিবর্ধিত ও পরিমার্জিত রূপে। সেই পরিবর্ধন ও পরিমার্জন রূপ প্রকাশ পেয়েছে স্কিমিটিক ড্রয়িং আকারে। প্রথম ছয় ধাপের বিবর্তন খুব দ্রুত হলেও পরের ধাপগুলো সংঘটিত হয়েছে ৫০ বছর ধরে। একেবারে শেষ ধাপের নির্মাণকাজ যখন হয়, তখন এটিকে কড়ি বর্গা রুফিং সিস্টেমে আনা হয়। মাইল্ড স্টিলের রুফের স্ট্রাকচারে পোড়ামাটির তৈরি টালি বসিয়ে যে রুফ তৈরি করা হয়, তা চুন-সুরকির মর্টার দিয়ে আটকে দেওয়া হয় পুরো ছাদের সঙ্গে। এরপর বাইরে থেকে লাল রং করে দেওয়া হয়, যা আগের সৌন্দর্য অনেকটাই নষ্ট করে ফেলে।

কক্ষগুলোকে সামনে রেখে পুরো কোর্ট বিল্ডিং চত্বরের সার্কুলেশন সিস্টেম তৈরি করা হয়েছিল। এই সিস্টেম বা পদ্ধতিতে ব্রিটিশরা বাইরের রোদ বৃষ্টি থেকে নিজস্ব জাজ বা বিচারকদের রক্ষা করত। তাদের ভাবনায় ছিল স্টাইলটি যেন পুরো ভবনের মধ্যে ট্রান্সপারেন্সি বা স্বচ্ছতা এনে বিচারব্যবস্থার প্রতি মানুষের আনুগত্য ফিরিয়ে আনে। এ সময় ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের ফলেই ব্রিটিশ স্থাপনাগুলোর মধ্যে এ রকম পরিবর্তন এসেছিল বলে অনেক স্থাপত্য বোদ্ধার বিশ্বাস। আবার অনেকে মনে করেন, ব্রিটিশদের মতো বিল্ডিং ম্যাটেরিয়ালস ওই সময় এ দেশে ব্যবহার সম্ভব ছিল না। তাই কাঠ ও কাচের পরিবর্তে ইট-কাঠ দিয়েই বানানো হয়েছিল এ রকম স্থাপনা। স্থাপনাটিতে আর্চ, কলাম ও ক্যাপিটাল ইত্যাদির ব্যবহার লক্ষণীয়। কলামসমূহের নিচে দেখা যায় কলাম ক্যাপিটাল, যা মোডিফাইড আয়োনিক ও কোরিন্থিয়ানের চিহ্ন বহন করছে। স্থাপনাটির কার্নিশ ও ছোট্ট জানালাগুলোতে রয়েছে আয়োনিক ডিজাইনের ব্যবহার। বারান্দার ওপেনিংগুলোতে আছে টিপিক্যাল আর্চ। এই আর্চ এর ব্যবহার আবার ব্রিটিশরা নিয়েছিল রোমানদের কাছ থেকে। এখানে রোমান স্টাইলের অর্ধবৃত্তাকার আর্চ ও বৃত্তাকার পাঞ্চ দেখা যায়, যা ট্রপিক্যাল ইউরো ইন্ডিয়ান স্টাইলের সামগ্রিক উদাহরণ। চট্টগ্রামের আবহাওয়ার প্রতি ব্রিটিশরা ছিল অনেক বেশি রূঢ়। তাই সেই রূঢ়তা প্রকাশ পেয়েছে এই স্থাপনায়, যা স্থাপনাটিকে অনেকটাই ইন্ট্রোভার্ট বা কেন্দ্রমুখী করেছে। ফলে অনেক আগ থেকেই চট্টগ্রামের মানুষের কাছে এই কোর্ট বিল্ডিং বা লাল দালান ভীতিকর রূপেই প্রতীয়মান হয়ে আসছে।
কলোনিয়াল পিরিয়ডের স্থাপনাগুলোতে যেখানে গাড়ি এসে থামত, সেই পোর্চের ওপর টেরাস করা হতো। কিন্তু চট্টগ্রামের এই কোর্ট বিল্ডিংয়ে পোর্চের ওপর করা হয়েছে সিঁড়িঘর। হয়তো বা এটি মূল প্ল্যানিংয়ে ছিল না। প্রথম দোতলা তৈরি হওয়ার পর এর ওপর যখন আরেকটি ছাদ ঢালাই শুরু হয়, তখন নিরুপায় হয়েই এই ব্যবস্থা করতে হয়েছিল বলে অনেকের ধারণা।
স্থাপনাটির প্রতিটি প্রবেশপথ সুন্দরভাবে অলংকৃত। ডোমের আর্চগুলোতে এখনো দেখা যায় বিশেষ ডিজাইন ও ডিটেইলিং। স্থাপনার একেবারে শেষ ধাপের এক্সটেনশনে ইসলামিকাইজেশনের জন্য দুটো ডোম সংযুক্ত করা হয়। এতে এই স্থাপনাতে কোয়াসি ইসলামিক স্টাইলের মাধ্যমে ইসলামিক রূপদান সম্ভব হলেও পুরো স্থাপনায় একটি মিশ্র ভাব চলে আসে (কোয়াসি ইসলামিক স্টাইলের উদাহরণ হলো- নতুন হাইকোর্ট ভবন, বঙ্গভবন)। কিন্তু ডোমের ডিটেইলিং, প্যারাপেট ইত্যাদি ধার করা হয় ইন্দো-ইউরোপিয়ান স্টাইল থেকে। এক তলা থেকে দোতলায় ওঠার সিঁড়ি কাস্ট আয়রন দিয়ে তৈরি, যা টিপিক্যাল কলোনিয়াল স্টাইলকে নির্দেশ করে।

হাইব্রিড আর্কিটেকচার
চট্টগ্রাম হাইকোর্ট বিল্ডিংটিতে একটি হাইব্রিড আর্কিটেকচার রূপে ইন্ডিয়ান, ইউরোপিয়ান, ভিট্রুভিয়ান, গোথিক ও ইসলামিক স্থাপনার চিহ্ন বিরাজমান। তবে হাইকোর্ট বিল্ডিংয়ের অবস্থা এখন অনেক করুণ। ভবন সংরক্ষণ ও সংস্থাপনের নামে এখন সেখানে চলছে নতুনভাবে স্থাপনাটিতে রং করার হিড়িক। ভবনের সামনে আছে পার্কিং এরিয়া। সেখানে যথেচ্ছভাবে গাড়ি রেখে নষ্ট করা হচ্ছে পারিপার্শ্বিক পরিবেশ। অথচ নতুন স্থাপিত ভবনে আছে প্রায় ১০০ গাড়ি পার্কিংয়ের ব্যবস্থা। এসব কারণে পুরোনো স্থাপনাটি এখন হুমকির মুখে। বিভিন্ন সময় নিম্নমানের রং করে ভবনের সৌন্দর্যবর্ধনের চেষ্টা করা হলেও সেটা উল্টো ভবনের বয়স কমিয়েছে। এতে ভবনের দেয়ালের চুন-সুরকি ভেদ করে মূল স্থাপনার মাঝে ঢুকে পড়ছে পানি। বর্ষাকালে ভবনের দেয়ালের দেখাশোনা করা হয় না। ফলে বিভিন্ন গাছগাছালি গজিয়ে ভবনের বাইরের খোলস অনেকটাই দুর্বল করে ফেলেছে। অপরিকল্পিত এই সৌন্দর্যবর্ধনের ফলে সেদিন আর হয়তো বেশি দূরে নয় যেদিন আমাদের সামনে থেকে হারিয়ে যাবে চট্টগ্রামের শতবর্ষী ঐতিহ্যবাহী এই স্থাপনাটি।
স্থপতি রাজীব চৌধুরী
তথ্যসূত্র : মোহাম্মাদ মাহাবুবুর রহমান, সচিব (যুগ্ম জেলা ও দায়রা জজ), পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমিবিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন, খাগড়াছড়ি
প্রকাশকাল: বন্ধন ৪৬ তম সংখ্যা, ফেবু্রুয়ারি ২০১৪