মোগল সমাধির খোঁজে

জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে সম্রাট শাহজাহান। প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠে অসুস্থ শরীরে নিজের বানানো অমর কীর্তি তাজমহলের দিকে তাকিয়ে থাকেন অপলক নয়নে। আহা কী অপূর্ব সমাধিসৌধ! দেখলেই মনে পড়ে প্রিয়তমা স্ত্রী মমতাজকে; বেরিয়ে আসে হাহাকার ভরা দীর্ঘশ্বাস। ভোরের আলোর সোনালি আভায় দ্যুতি ছড়ায় তাজমহলের অনিন্দ্য সৌন্দর্য। বিশ্বের দূর-দূরান্ত থেকে দর্শনার্থীরা ছুটে আসে অপার এ সৌন্দর্য দেখতে। না, এটা কোনো সিনেমার চিত্রনাট্য নয়। পুরোটাই বাস্তব। এর মাধ্যমেই হয়তো বিশ্ব প্রথম জেনেছিল ভালোবাসার প্রিয় মানুষটিকে বাঁচিয়ে রাখতে তাঁরই সমাধিতে নির্মাণ করা যায় ভালোবাসার সৌধ, যা কি না স্থান করে নিয়েছে বিশ্বের সপ্তাশ্চর্যের তালিকায়। মোগলদের কাছ থেকেই বুঝি শিখেছিল বিশ্বের মানুষ কীভাবে প্রাণপ্রিয়কে ঠাঁই দিতে হয় ইতিহাসের পাতায়। স্থাপনার মধ্যে কীভাবে অমরত্ব পেতে পারে ভালোবাসা। আর মোগল এ আমলেই বাংলার বুকে ভালোবাসা আর পবিত্রাত্মার এমন কিছু সমাধিসৌধ নির্মিত হয়েছিল, যা আজও অমর হয়ে আছে স্বমহিমায়, সৃষ্টির নান্দনিকতায়। এমন দুটি সমাধিসৌধের সলুকসন্ধান এ রচনায়।

পরী বিবির সমাধি

ইরান দুখত রহমত বানু। নামটা অপরিচিত লাগছে? মাথা নেড়ে উত্তর দেওয়ার আগে ‘পরী বিবি’ নামটি শুনেছেন কি না একবার ভাবুন তো? এটাই কিন্তু পরী বিবির আসল নাম। এ নামে খুব কম লোকই তাঁকে চেনে। পরীর মতোই সুন্দর ছিলেন বলেই নামটা পরী বিবি। অপরূপা এ রাজকন্যার অকালমৃত্যু বৃদ্ধ পিতা শায়েস্তা খাঁকে বিহŸল করে তোলে। প্রিয় কন্যার মৃত্যুতে শায়েস্তা খাঁর হৃদয়ে শুরু হয় প্রপঞ্চ রক্তক্ষরণ। ক্ষোভে-দুঃখে লালবাগ কেল্লাকে ‘অপয়া’ ভেবে বন্ধ করে দেন এর নির্মাণকাজ। কন্যার মৃত্যুর কিছুদিন আগেই শুরু করেছিলেন লালবাগ কেল্লার নির্মাণকাজ। পরে ওই কেল্লার ভেতরই সমাহিত করেন প্রিয় কন্যা পরী বিবিকে। কিন্তু তাঁর এই অকাল প্রয়াণ বাংলার বুকে স্থাপন করল অপরূপ সমাধিসৌধের। তাঁর অন্তিম শয্যার ওপর যে সৌধ নির্মাণ করেছিলেন অগাধ স্থাপত্যজ্ঞানের অধিকারী কন্যা অন্তঃপ্রাণ পিতা, সেটি ঢাকার অন্যতম সেরা সৌন্দর্যময় অনুপম মোগল স্থাপত্য নিদর্শন। কন্যাহারা পিতার এই শোকনিদর্শনটি দেখতে শত শত মানুষ ভিড় করে লালবাগ কেল্লায়। সেখানে মাঠের মাঝখানে একই সরলরেখা বরাবর তিনটি স্থাপনার মাঝেরটি পরী বিবির সমাধি।

পরী বিবির সমাধির নকশা

শায়েস্তা খাঁ সুদূর রাজমহল থেকে কালো ব্যাসল্ট পাথর, চুনার থেকে বেলেপাথর ও জয়পুর থেকে সাদা মার্বেল পাথরের বড় বড় ফলক এনেছিলেন ঢাকায় সমাধিটি নির্মাণের জন্য। দরজা ও খিলানের জন্য এনেছিলেন শ্বেতচন্দন কাঠ। এত দূর থেকে বিশালাকার মার্বেল পাথরের ফলক আনাটা ছিল রীতিমতো দুরূহ কাজ। সমাধির ফলকগুলো আস্ত রেখে এর ওপর নকশা কাটা হয়। আর এই ফুলেল নকশাখচিত জালি ও ফলক দিয়ে সমাধিসৌধের বিভিন্ন অংশ নির্মিত। শোকের প্রতীক কালো এ পাথর শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে যেন পিতৃহৃদয়ের গভীর বেদনারই নীরব বহিঃপ্রকাশ।

আওরঙ্গজেবের পুত্র শাহজাদা আজমের সঙ্গে বিয়ে ঠিক হয়েছিল পরী বিবির। শাহজাদা আজম ঢাকার সুবেদার হয়ে এসেছিলেন ১৬৭৮ সালের ২৯ জুলাই। এসেই তিনি পিতার নামে কেল্লা আওরঙ্গবাদ নির্মাণে উদ্যোগী হন। কিন্তু মাত্র এক বছরের মাথায় তাঁকে এখান থেকে সরে যেতে হয়। সুবেদার হয়ে শায়েস্তা খাঁ ঢাকায় আসেন দ্বিতীয় মেয়াদে। শাহজাদা আজম কেল্লাটির কাজ শেষ করার জন্য তাঁকে অনুরোধ করেন। বাংলার সুবেদার শায়েস্তা খাঁ এটির নির্মাণকাজ প্রথমে শুরু করলেও পরে কেল্লায় আর ইট গাঁথেননি। অনেকে মনে করেন, কন্যার মৃত্যুর ফলে তিনি এ দুর্গটিকে অপয়া মনে করেছিলেন। আর তাই কেল্লায় ইট না গেঁথে এর প্রাঙ্গণে গড়েছেন কন্যার সমাধিসৌধ।

স্থাপত্যরীতি বিচারে স্থাপনাটি হিন্দু ও মুসলমান স্থাপত্যকলার মিশ্রিত রূপ। বর্গাকার এ ভবনের প্রতিটি বাহু ৬০ ফুট। যার চার কোনায় চারটি বর্গাকার রুম আছে, যার সঙ্গে যুক্ত চারটি মিনার। মিনারগুলো আবার মোগল স্থাপত্যের নিদর্শনকে মনে করিয়ে দিতেই  কার্নিশাকৃতির স্ল্যাশবের ওপর পেঁয়াজ ডোম দিয়ে সংযুক্ত। সমাধিসৌধের মূল গম্বুজটি সোনার পাত দিয়ে মোড়ানো। সূর্যের কিরণে ঝলমল করত স্বর্ণগম্বুজটি। সময়ের বিবর্তনে  চুরি হয়ে গেছে সোনার পাতটি। এখন যে কালো গম্বুজ দেখা যায়, তা তামা বা পিতলের পাতে মোড়ানো। তাজমহল ও সম্রাট হুমায়ুনের সমাধির স্থাপত্যরীতির সঙ্গে মুসলিম স্থাপনা ও হিন্দু মন্দিরের স্থাপত্যরীতির সমন্বয়ে শায়েস্তা খাঁ এ সমাধিসৌধটি নির্মাণ করেন। শুধু মোগল স্থাপত্যই নয়, স্থপতি শায়েস্তা খাঁর অন্যতম শ্রেষ্ঠ স্থাপত্য নিদর্শন হিসেবেও উচ্চ প্রশংসিত নিজকন্যা পরী বিবির এই সমাধিসৌধটি।

তাহাখানা কমপ্লেক্সসংলগ্ন সমাধিক্ষেত্র

পরী বিবির সত্যিকার পরিচয় নিয়ে অনেকের মধ্যে রয়েছে মতভেদ ও রহস্য। তিনি কি সত্যিই শায়েস্তা খার কন্যা ছিলেন, নাকি অন্য কেউ। শাহজাদা আজমের সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়েছিল? না হয়নি। এসব নিয়ে রয়ে গেছে বেশ খানিকটা বিভ্রান্তি। কিছু কিছু বিষয়ে একমত হতে পারেননি ইতিহাসবিদেরাও। তাঁদের কারও কারও মতে, পরী বিবি ছিলেন আসাম রাজকুমারী। সুবেদার মীর জুমলার আসাম জয়ের সময় তিনি মাত্র নয় বছর বয়সে বন্দী হয়ে ঢাকায় আসেন। পরে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হন এবং সম্রাট আওরঙ্গজেবের নির্দেশে শাহজাদা আজম তাঁকে বিয়ে করেন। তবে বেশির ভাগ ইতিহাসবিদই পরী বিবিকে শায়েস্তা খাঁর কন্যা বলে স্বীকৃতি দিয়েছেন। ইতিহাসবিদদের মতে, পরী বিবি যে শায়েস্তা খাঁর কন্যা, এর প্রমাণ হলো শায়েস্তা খাঁর নিজস্ব অহসিয়তনামা। এই অহসিয়তনামা বাংলাদেশ সরকারের কাটরা ওয়াকফ পরিদপ্তরে সংরক্ষিত আছে। পরী বিবির বিয়ে সম্পর্কে ঐতিহাসিকদের মত, ১৬৬৮ সালের ৩ মে শাহজাদা আজমের সঙ্গে এক লাখ ৮০ হাজার টাকার দেনমোহরে তাঁর বিয়ে হয়েছিল। তাঁদের দাম্পত্য জীবন ছিল ১৬ বছরের।

লালবাগ কেল্লার ভেতরে হওয়ায় পরী বিবির সমাধিসৌধ দখলের হাত থেকে রক্ষা পেয়ে এখনো সগর্বে টিকে আছে মোগল ঐতিহ্য নিয়ে। তবে এখন নেই সেই আদি সৌন্দর্য ও কারুকার্যমণ্ডিত রূপ। অনেক প্রত্নতাত্ত্বিকের বিশ্বাস, এখানে আদৌ কোনো সমাধি নেই। এ নিয়ে যত বিতর্কই থাকুক না কেন কন্যাহারা পিতার শোকের এই নিদর্শন যুগ যুগ ধরে ছুঁয়ে যাবে মানুষের হদয়।

তাহাখানা কমপ্লেক্স

তাহাখানা কমপ্লেক্স

ভাবুন তো কোনো এক ব্যস্তসমস্ত রাস্তায় হাঁকডাক বাজারে আপনি হাঁটছেন গৌড়ের পথে। সেখানে ঘুরতে ঘুরতে মনে হলো আপনি হঠাৎ করেই চলে এসেছেন মোগল আমলে। যেদিকে চোখ যায় সুবিশাল এলাকাজুড়ে কেবলই কারুকার্যময় স্থাপনারাজি। সেগুলোর মধ্যে গিয়ে নিজেকে আপনার মনে হবে আপনি আছেন মোগল আমলে। চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ এককালে পরিচিত ছিল বাংলার গৌড় নামে। সারা বিশ্বে এর শৌর্য ও বীর্যের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল দিকে দিকে। আর সৌন্দর্যমণ্ডিত এ শহরে শায়িত আছে মহান সাধক শাহ নিয়ামত উল্লাহ ওয়ালীর পবিত্র মরদেহ। আর মোগল আমলেই তাঁর সমাধির ওপর বুনন করা হয়েছে অপূর্ব এক সৌধ। নাম যার শাহ নিয়ামত উল্লাহ ওয়ালীর সৌধ বা মাজার।

শাহ নিয়ামত উল্লাহ ওয়ালীর জন্ম দিল্লির কাছাকাছি কর্নাল শহরে। মারা গেছেন এই বাংলায় আনুমানিক ১০৭৫ হিজরি বা ১৬৬৪ খ্রিষ্টাব্দে। মৃত্যুর পর তাঁর কবর সংরক্ষণের জন্যই তৈরি এই সমাধিক্ষেত্র। পাশেই রয়েছে একটি মসজিদ, যা কি না এই বাংলায় মোগল আমলের স্মারক হিসেবে অমর হয়ে আছে। নাম তার তাহাখানা কমপ্লেক্স। ছোট সোনামসজিদ থেকে মাত্র আধা কিলোমিটার দূরেই তাহাখানা কমপ্লেক্সের অবস্থান। সুবেদার শাহ সুজার শাসনামলে (১৬৩৯-১৬৬০ খ্রি.) নির্মিত এ স্থাপত্য দেখে মনে হতে পারে মোগল সাম্রাজ্যে ফিরেছেন আপনি। সোনামসজিদের পাশে বিশাল একটা দিঘির পশ্চিম পাড়জুড়েই রয়েছে তাহাখানা কমপ্লেক্স।

এখানে একই সঙ্গে রয়েছে একটি মসজিদ, প্রাসাদ ও শাহ নেয়ামত উল্লাহ ওয়ালীর সমাধি। আয়তাকার আকৃতির দুইতলাবিশিষ্ট ইমারত-প্রাসাদ মোগলদের স্থাপত্যকলার  নিদর্শন বহন করছে আজও। তাহাখানার মূল প্রাসাদ থেকে উত্তর-পশ্চিম দিকে সামান্য দূরেই অবস্থান শাহ নিয়ামত উল্লাহ ওয়ালীর মসজিদ। তাহাখানা থেকে ৩০-৩৫ মি. উত্তরে রয়েছে শাহ নিয়ামত উল্লাহ ওয়ালীর সমাধি। এই সমাধিসৌধটি একটি উঁচু প্ল্যাটফর্মের ওপর তৈরি। পুরোপুরি ইটের তৈরি এই স্থাপনাটি একটি উচ্চ বেদির ওপর স্থাপিত, যার ঠিক মাঝে সংরক্ষিত কবরস্থানটি। চারপাশ ঘিরে টানা বারান্দা। বাইরে থেকে কবরখানাটি ৪৯ ফুট বাই ৪৯ ফুটের বর্গাকার কক্ষ। এই বর্গাকার ক্ষেত্রের চার কোনায় চারটি ছোট মিনার অবস্থিত। যেগুলো আবার প্যারাপেট থেকে বেশ খানিকটা উঁচুতে উঠে গেছে। স্থাপনার প্রতিটি বাহুতে আছে তিনটি করে প্রবেশপথ। প্রতিটি পথ মোগল স্মারক বহন করছে। পূর্ব-পশ্চিম এবং দক্ষিণে তিনটি করে খিলানযুক্ত মোট ১২টি খিলানপথ দেখেই লর্ড ক্যানিংহ্যাম এর নাম দিয়েছিলেন বারদুয়ারী। বারদুয়ারীর প্রতিটি দেয়ালের ভেতরে ও বাইরে আছে মোগল মুন্সিয়ানা। খাঁজ কাটা প্যানেলিংগুলো মাটি থেকে শুরু হয়ে কার্নিশ পর্যন্ত উঠে গেছে।

শাহ নিয়ামত উল্লাহর সমাধিসৌধ

এককালে এর পূর্বদিকে ঠিক মাঝঘর বরাবর তিনটি প্রবেশপথ খোলা ছিল। এখানে আছে মূল কবরস্থান। কিন্তু এখন খোলা থাকে শুধুই দখিনা দুয়ারটা। উত্তর দিকে আছে একটি ছোট মিহরাব। ওপরেই বিদ্যমান একটি গম্বুজ। এর শৃঙ্গ কলসমুখী। দেখতে ঠিক মোগল ও মোগল-পরবর্তী আমলের পেঁয়াজাকৃতির গম্বুজের মতো।

প্রত্নতাত্ত্বিকেরা মনে করেন শাহ সুজা নিয়ামত উল্লাহ ওয়ালীর উদ্যোগেই এই কবরস্থানটির উন্নয়নের কাজ শুরু হয়ে বর্তমান চেহারা প্রাপ্ত হয়েছে। আবার অনেকের বিশ্বাস শাহ নিয়ামত উল্লাহ ওয়ালীর জন্য শাহ সুজা এই কমপ্লেক্স তৈরি করেছিলেন, যেখানে তাঁর মরদেহ পরবর্তী সময়ে সংরক্ষণ করা হয়েছে। সে যা-ই হোক, এই স্থাপনাই বাংলার মানুষকে উৎসাহিত করেছিল নান্দনিক স্থাপত্যের সমাধিসৌধ নির্মাণে। এই বাংলার বুকেই ঠিক অনুরূপ স্থাপনার স্থাপত্যশৈলীর দেখা মিলবে ঢাকার পরী বিবির মাজারের স্থাপত্য নিদর্শনে।

 স্থপতি রাজীব চৌধুরী

প্রকাশকাল: বন্ধন ৪৭ তম সংখ্যা, মা‍র্চ ২০১৪

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top