পাশ্চাত্য স্থাপত্যরীতির স্থাপনা বড়কুঠি

শিক্ষানগর রাজশাহী বরেন্দ্রভূমি হিসেবে সুপরিচিত। অঞ্চলটিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে বেশ কিছু পুরোনো স্থাপনা। যেগুলোর কিছু কিছু পর্তুগিজ, ওলন্দাজ, ফরাসি ও ডেনিশদের সহায়তায় নির্মিত। শুধু তা-ই নয়, এগুলোর স্থাপত্যরীতিও নিজস্ব ঢংয়ের। তবে ঐতিহাসিকভাবে এ শহরের সবচেয়ে আকর্ষণীয় স্থাপনা রামপুর-বোয়ালিয়ায় অবস্থিত প্রাচীন ওলন্দাজ কারখানা ভবন, যা ‘বড়কুঠি’ নামেই স্থানীয়ভাবে বহুল পরিচিত।

ভারতীয় উপমহাদেশে বিভিন্ন সময়ে ইউরোপের দেশ থেকে বণিকেরা ব্যবসা করতে আসতেন। ব্যবসার পাশাপাশি বিভিন্ন স্থানে আধিপত্য বাড়াতে দেশীয় আদলের তাঁরা ভবন নির্মাণ শুরু করেন। অবশ্য ব্রিটিশ শাসনামলে দেশীয় ঐতিহ্যের সঙ্গে মিল রেখে পাশ্চাত্যরীতিতে ভবন নির্মাণের চল ছিল। তবে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক ভবন নির্মিত হয় এ দেশে নীল চাষের শুরু থেকে। বিশ্বব্যাপী রেশম সুতার চাহিদা থাকায় তা সংগ্রহ করতেই রাজশাহীতে ওলন্দাজরা কারখানা ভবন বা অট্টালিকাটি গড়ে তোলে। এটি ওলন্দাজ আমলে যেমন ছিল, এখনো অবিকল তেমনই আছে। তবে সম্প্রসারিত ভবনটি ১৮৯৭ সালের ভূমিকম্পে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। শেষ পর্যন্ত ভবনটি পুরোপুরি ভেঙে ফেলতে হয়। আর তাই এখন যে স্থাপনাটি রয়েছে, তা একেবারেই আদি অট্টালিকা।

ভবনের পেছনের অংশ

ওলন্দাজদের সময়ে দুর্গবিশিষ্ট এ সৌধটির সুরক্ষার ব্যবস্থা ছিল চোখে পড়ার মতো। শত্রুর আক্রমণ প্রতিহত করতে কুঠির চারদিকে টাওয়ার ছিল। কুঠির বুরুজে শত্রুকে লক্ষ্য করার জন্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ছিদ্র রাখা হয়, যেখানে বন্দুকধারী পাহারারত রক্ষী থাকত। সে সময় কুঠির ছাদে কতকগুলো বিশেষ ধরনের কামান সজ্জিত ছিল। এখানকার একটি কামানকে বড়কুঠি থেকে সরিয়ে মুর্শিদাবাদের (পশ্চিম বাংলা) মরিচায় অবস্থিত মেদেনীপুরের জমিদার কোম্পানির ম্যানেজারের বাংলোয় নিয়ে যাওয়া হয়। মেদেনীপুরের জমিদার কোম্পানি কামানগুলোকে নদীয়া (পশ্চিম বাংলা) জেলার শিকারপুরে সরিয়ে নেয়। তবে একটি কামান এখনো পুলিশ লাইনে দেখতে পাওয়া যায়। এতে আছে একটি মনোগ্রাম এবং ব্যারেলের ওপর খোদাই করা ওই মনোগ্রামে ইংরেজি ডি. ও. সি. এ. অক্ষর কটি লেখা আছে। দূরপ্রাচ্যের ওপর আধিপত্য বিস্তারের জন্য মালয় দ্বীপপুঞ্জের ওলন্দাজ ও পর্তুগিজদের মধ্যে যে যুদ্ধ হয়, তাতে এ ধরনের কামান ব্যবহৃত হতো। যুদ্ধের পর এ উপমহাদেশেও জলদস্যুরা এ ধরনের কামান ব্যবহার করত। হয়তো বা কোনো ওলন্দাজ নৌযান থেকেই কামানগুলো এখানে স্থানান্তরিত করা হয়েছিল। এই ক্ষুদ্র কামানটি সাধারণত আত্মরক্ষায় ব্যবহার করা হতো। খুব সম্ভবত এই বিশেষ কামানটি ওলন্দাজরা নদীপথে রেশম অথবা অন্য মূল্যবান দ্রব্যাদির সঙ্গে নৌকার মধ্যে লুকিয়ে এখানে এনেছিল। 

অযত্ন অবহেলায় ভবন অভ্যন্তর

অষ্টাদশ শতকের প্রথম ভাগে ওলন্দাজদের এ অঞ্চলের বাণিজ্যিক কেন্দ্র কুঠিরূপে। এই কুঠি ১২ কামরাবিশিষ্ট দ্বিতলাকারে নির্মিত হয়। এই মূল কুঠির দৈর্ঘ্য ৮২ ফুট, প্রস্থ ৬৭ ফুট। একটি সভাকক্ষবিশিষ্ট ওপরে ছয়টি কামরা আছে। এর দরজা ও জানালাগুলো অধিকাংশই সুপ্রশস্ত ও প্রায় একই মাপের। এ কুঠির দেয়ালগুলো অত্যন্ত পুরু। নিচতলার কক্ষগুলো অস্বাভাবিক রকমের অন্ধকার। এসব কক্ষ রেশম রাখার গুদামঘর হিসেবে ব্যবহৃত হতো। নিচের কামরাগুলো বর্তমানে বহু কামরায় বিভক্ত। ওপরে ওঠানামার জন্য পশ্চিম পাশ দিয়ে একটি প্রশস্ত সিঁড়ি রয়েছে। ইংরেজ আমলে এই সুবৃহৎ কুঠির সঙ্গে আরও কতগুলো কামরা সংযোজন করে কুঠির আকার বড় করা হয়েছিল। ওপরের কামরাগুলো আবাসিক বাংলোর জন্য নির্দিষ্ট থাকত।

ওলন্দাজরা চলে যাওয়ার পর এ ভবনটি ছিল ব্রিটিশ বাণিজ্য কুঠি। ১৮৩৩ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বাণিজ্যিক কার্যক্রম বন্ধ হওয়ার আগে পর্যন্ত এটি তাদের বাণিজ্যিক কেন্দ্র ছিল। ১৮৫৭ সালের সিপাহি বিদ্রোহের সময় এই ভবনকে ইউরোপীয় স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর সদর দপ্তর করা হয়েছিল। তারপর ভবনটি মেদিনীপুরের জমিদার কোম্পানির আওতায় চলে যায়। তারা এর একটি অংশকে ইন্ডিয়ান জেনারেল নেভিগেশন কোম্পানির কাছে ভাড়া দেয়। ওই কোম্পানি তাদের স্থানীয় এজেন্টের আবাসগৃহ ও অফিস হিসেবে এটি ব্যবহার করে। ১৯৪৭ এ দেশ বিভাগের পর ভবনটি বেসামরিক সরবরাহ বিভাগের গুদামঘরে পরিণত হয়। পরে ১৯৫৩ সালে এ ভবনটিকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলরের বাসভবন এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের অফিস হিসেবে ব্যবহৃত হয়।

ভবনের গম্বুজ ও ভবনের প্রবেশপথ

বড়কুঠি প্রাঙ্গণে একটি ছোট কবরস্থান রয়েছে। ১৪টি কবরের মধ্যে ১৩টি ফলকযুক্ত কবর রয়েছে। এর প্রাচীরের বাইরেও একটি কবর আছে। ক্রিস্টোফার ওল্ড ফিল্ড এবং এডওয়ার্ড লেনন ক্যাম্পবেল নামের ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দুজন বেসামরিক কর্মচারীর কবরও এখানে আছে। ফরাসিদের কয়েকজনের কবরের মধ্যে ইউজিন ডেভেরিয়ার কবরটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। মাত্র ১৫ বছর বয়সে তার মৃত্যু হয়। তার বাবা নেপোলিয়নের অধীন একজন সৈনিক ছিলেন। এ উপমহাদেশে এসে তিনি নীলের ব্যবসা আরম্ভ করেছিলেন। লে. জজ শার্প নামে একজন  সৈনিকের সমাধিও আছে। আরও আছে দুজন মহিলার সমাধি। তাঁদের একজন লে. কর্নেল এইচ জে উডের পত্নী এবং অপরজন চার্লস ওয়াল্টার উইলিয়াম কেরির শিশুকন্যা। বড়কুঠির কয়েক শ গজ পশ্চিমে রয়েছে একটি প্রাচীন মসজিদ ও হজরত মখদুম শাহের সমাধি। ১৬৩৪ সালে জনৈক আলী কুলি বেগ কর্তৃক সমাধিসৌধের গম্বুজটি নির্মিত হয়েছিল। সব শ্রেণীর লোকই এর প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে থাকে। 

সুমনা বিশ্বাসসূত্র : বাংলাদেশ জেলা গেজেট, রাজশাহী।

প্রকাশকাল: বন্ধন ৩৫ তম সংখ্যা, মার্চ ২০১৩

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top