ধনবাড়ী জমিদারবাড়ি

জমিদারবাড়ি মানেই অপূর্ব কারুকাজ করা বিশাল ভবন। প্রতিটি দেয়ালের পরতে পরতে সৌন্দর্যের ছোঁয়া ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সাক্ষী হয়ে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকা। অন্যান্য জমিদারবাড়ির চেয়ে একটু হলেও বাড়তি সৌন্দর্য খুঁজে পাওয়া যায় টাঙ্গাইলের ধনবাড়ি জমিদারবাড়িতে। এখানকার প্রতিটি ভবনই চমৎকার কারুকার্যময়। নান্দনিক এ ভবনগুলো পর্যটকদের যে দৃষ্টি আকর্ষণ করবেই, এতে সন্দেহ নেই এতটুকু।

নবাব প্যালেসের স্থাপত্য-কথন

ধনবাড়ী জমিদারবাড়ির অন্যতম স্থাপত্য নিদর্শন নবাব প্যালেস বা মঞ্জিল। চার গম্বুজবিশিষ্ট অপূর্ব স্থাপত্যরীতির শতাব্দী প্রাচীন এই নবাব প্যালেসটি পর্যটকদের আকৃষ্ট করে দারুণভাবে। প্রাচীরে ঘেরা এখানকার নবাব প্যালেস আর কাচারি। সুনিপুণ হাতে অত্যন্ত রুচিশীলতায় নবাব প্যালেসটি নির্মিত। প্যালেসটি দক্ষিণমুখী। ৬০ দশমিক ৯৬ মিটার (২০০ ফুট) দীর্ঘ বারান্দাসংবলিত। প্যালেসটির মূল প্রবেশপথ ইমারতটিকে অসম দুটি ভাগে বিভক্ত করেছে। প্রবেশপথের পূর্ব পাশ, পশ্চিম পাশ অপেক্ষা ছোট। প্রবেশ তোরণটি করিন্থিয়ান চূড়াসহ একজোড়া আয়তাকার পিলাস্টারে গঠিত। ফ্রিজ অলংকৃত, তদূর্ধ্বে সম্প্রসারিত কার্নিশের ওপর মারলন নকশা ও সবশেষে ওপরে দুটি ছত্রী শোভিত। ভবনটির ৪ দশমিক ৫৭ মিটার (১৫ ফুট) প্রশস্ত বারান্দা জোড়া করিন্থিয়ান কলামের সমন্বয়ে অর্ধবৃত্তাকার খিলানে গঠিত। কার্নিশের নিচের ফ্রিজের লতাপাতার নকশা, মারলনসংবলিত প্যারাপেট ও ছত্রী এ প্রাসাদের সৌন্দর্য বাড়িয়েছে বহুগুণ। ভবনটি চারটি বড় হলরুম এবং কতগুলো ছোট রুমের সমন্বয়ে গঠিত। খিলানের উপরিভাগ লাল, সবুজ ও হলুদ কাচে অলংকৃত। কোনো কোনোটি ফুলাকৃতির নকশাবাহী। ভবনের পূর্বদিকে রয়েছে বড় একটি তোরণ। তোরণের উভয় পাশে প্রহরীদের জন্য রয়েছে দুটি ঘর। তোরণটি বহু খাঁজবিশিষ্ট খিলানসংবলিত এবং তোরণের চূড়া দোচালা আকৃতির। তোরণটি জমিদার নওয়াব আলী চৌধুরী ব্রিটিশ গর্ভনরকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য নির্মাণ করেছিলেন। উল্লেখ্য, ১৯১৯ সালে ভারতের লর্ড রোনালস নবাব নওয়াব আলী চৌধুরীর আমন্ত্রণে ধনবাড়ী আসেন। তিনি স্টিমারে বৈরান নদীর কয়ডা ঘাটে এসে নামেন। সেখান থেকে তাকে ৩০টি হাতি বহরের শোভাযাত্রায় ধনবাড়ীর নবাব প্যালেসে আনা হয়।

ধনবাড়ি নবাব প্যালেস

নবাব প্যালেস প্রধান ভবনের তোরণের ডান পাশে রয়েছে একটি ত্রিতল ভবন। ভবনটি ৫৩ দশমিক ৯৫ মিটার (১৭৭ ফুট) দীর্ঘ এবং ৩ দশমিক ০৫ মিটার (১০ ফুট) প্রশস্ত বারান্দাসংবলিত। বিগত শতকের মধ্যভাগে ভবনটি নির্মিত হলেও এতে ইউরোপীয় ও স্থানীয় স্থাপত্যিক বৈশিষ্ট্যের মধ্যে দারুণ সমন্বয় লক্ষ করা যায়। ভবনটিতে রয়েছে ১৩টি ঘর। কাচারি ভবনের বারান্দাটি ১৬ জোড়া করিন্থিয়ান কলামের সমন্বয়ে অর্ধবৃত্তাকার বহু খাঁজবিশিষ্ট খিলান সমন্বয়ে নির্মিত। প্রাচীরঘেরা চত্বর অংশে আবাসিক ভবন দুটি ছাড়া আরও আছে ফুলের বাগান, চিড়িয়াখানা, বৈঠকখানা, গোমস্তাঘর, নায়েবঘর, কাচারিঘর, পাইক-পেয়াদার বসত আর দাস-দাসী চত্বর।

ধনবাড়ি মসজিদ

রয়েল রিসোটের ঠিক পাশেই রয়েছে ৭০০ বছরের পুরোনো এক মসজিদ। চীনা-মিসরীয়দের তৈরি মোগল স্থাপত্য নিদর্শনের এই মসজিদটির মেজেতে মোজাইক মার্বেল পাথরের নিপুণ কারুকার্য এক কথায় অসাধারণ। মসজিদটির পাশে রয়েছে একটি কক্ষ, যা নওয়াব আলী চৌধুরীর মাজার। এখানে ২৪ ঘণ্টা কোরআন তিলাওয়াত হয় সেই ১৯২৯ সাল থেকে। এখনো এক মিনিটের জন্য বন্ধ হয়নি কোরআন তিলাওয়াত। বর্তমানে সাতজন কারি নিযুক্ত রয়েছেন। তারা প্রতি দুই ঘণ্টা পর পর একেকজন কোরআন তিলাওয়াত করেন। এ বিরল ঘটনা এখানে আগত যেকোনো পর্যটক কিংবা দর্শনার্থীকে অবাক করে।

ধনবাড়ী উপজেলার ঐতিহাসিক স্থাপত্যের অন্যতম নিদর্শন ধনবাড়ী মসজিদ। বংশাই ও বৈরান নদীর মাঝখানে অপূর্ব নৈসর্গিক প্রকৃতির মাঝে অবস্থান স্থাপনাটির। মোগল আমলে চন্দ্র বংশীয় রাজা যশোধর ছিলেন সাবেক পুখুরিয়ার (বর্তমানে ধনবাড়ী এই পরগণার অন্তর্গত ছিল) শাসক। তাঁর সেনাপতি ছিল গৌড়ের সুলতানের ওমরাহ ধনুয়ার খাঁ। তিনি কৌশলে রাজ্যটি দখল করে  দিয়েছিলেন ছেলে ইস্পিঞ্জার খাঁকে। এই ইস্পিঞ্জার খাঁ ও তাঁর ভাই মনোয়ার খাঁ ধনবাড়ীতে জমিদারি প্রতিষ্ঠা করেন। অবশ্য জমিদারি প্রতিষ্ঠা করা নিয়ে রয়েছে ভিন্ন মতবাদও। ধনবাড়ী জমিদারবাড়ি প্রধান আবাস ভবন, কাচারি ভবন, তিন গম্বুজবিশিষ্ট মসজিদ ও কবরস্থান সমন্বয়ে পরিকল্পিত এক স্থাপনা। প্রধান আবাস ভবনটি বেষ্টনি প্রাচীরে সুরক্ষিত। এর অভ্যন্তরে রয়েছে প্রশস্ত বাগিচা। ধারণা করা হয় ইস্পিঞ্জার খাঁ ও মনোয়ার খাঁ ছিলেন ধনবাড়ী মসজিদের প্রতিষ্ঠাতা। মসজিদটি ধনবাড়ী নবাব প্যালেসের বাইরে দিঘির পাড়ে অবস্থিত। মোগল স্থাপত্যরীতিতে নির্মিত মসজিদটির আকার-অবয়বে বেশ কয়েকবার পরিবর্তন আনা হয়েছে। তারপরও অপূর্ব কারুকার্যখচিত মসজিদটি যে কারও মনোযোগ আকর্ষণ করে দারুণভাবে। তিন গম্বুজবিশিষ্ট মসজিদ লাগোয়া সুদৃশ্য ও জাঁকজমকপূর্ণ একটি মিনার রয়েছে। মসজিদকে কেন্দ্র করে প্রচলিত আছে মানত প্রথা। মসজিদটি ১০ কাঠা জমির ওপর অবস্থিত। আদি মসজিদটি ছিল আয়তাকার। তখন এর দৈর্ঘ্য ছিল ১৩ দশমিক ৭২ মিটার (৪৫ ফুট) এবং প্রস্থ ছিল ৪ দশমিক ৫৭ মিটার (১৫ ফুট)। 

প্রধান ফটক

কিন্তু সংস্কারের পর মসজিদটির আকার রীতিমতো পরিবর্তিত হয়, যা শুধু বিভ্রান্তিকরই নয় বরং কিছুটা অসংগতিপূর্ণ। বর্তমানে এটি একটি বর্গাকৃতির মসজিদ। সাধারণ তিন গম্বুজবিশিষ্ট আয়তাকৃতির মোগল মসজিদের সঙ্গে বৈসাদৃশ্যপূর্ণ। সংস্কারের পর বর্তমানে এর অনেক বৈশিষ্ট্যই ভিন্ন আঙ্গিক গ্রহণ করেছে এবং সে সঙ্গে লুপ্ত হয়েছে এর প্রাচীনত্ব, বেড়েছে চাকচিক্য। সুন্দর কারুকার্যময় এ মসজিদের পূর্বদিকে বহু খাঁজবিশিষ্ট খিলানযুক্ত তিনটি প্রবেশপথ আছে। এ ছাড়া উত্তর ও দক্ষিণে আরও একটি করে সর্বমোট পাঁচটি প্রবেশপথ রয়েছে। মসজিদটি বর্ধিতকরণ ও সংস্কার সাধনের পরেও এর ওপরস্থ তিনটি গম্বুজ ও পাঁচটি প্রবেশপথে প্রাচীনত্বের ছাপ লক্ষ করা যায়। প্রচলিত নিয়মে এ মসজিদের পূর্বদিকের তিনটি প্রবেশপথ বরাবর এর অভ্যন্তরে কিবলা দেয়ালে নির্মিত হয়েছে তিনটি মিহরাব। কেন্দ্রীয় মিহরাবের কুলুঙ্গিটি অষ্টভুজাকার ও বহু খাঁজবিশিষ্ট খিলানসহযোগে ফুলেল নকশায় অলংকৃত। উভয় পাশ দুটি বহু খাঁজবিশিষ্ট খিলানযোগে গঠিত, তবে অলংকারহীন। কেন্দ্রীয় মিহরাবের পাশে রয়েছে একটি মিম্বর। মসজিদের অভ্যন্তরভাগ সর্বত্র চীনামাটির টুকরো দিয়ে মোজাইক নকশায় অলংকৃত, যার অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ফুলেল নকশা লক্ষণীয়। মসজিদসংলগ্ন অর্ধবিঘা আয়তনের অনুচ্চ প্রাচীরবেষ্টিত একটি প্রাচীন কবরস্থান রয়েছে। এ মসজিদে একসঙ্গে ২০০ মুসল্লি নামাজ আদায় করতে পারে। বর্তমানে মসজিদ অভ্যন্তরে শোভা পাচ্ছে মোগল আমলের তিনটি ঝাড়বাতি।

ধনবাড়ী জমিদারবাড়ি এখন

বর্তমানে ধনবাড়ী জমিদারবাড়ি নবাব আলী হাসান রয়েল রিসোর্ট সেন্টার হিসেবে খ্যাত। পর্যটকদের জন্য এখানে কটেজসহ ১৩টি কক্ষ রয়েছে। রয়েছে থাকা-খাওয়ার সুব্যবস্থা। পর্যটকদের সহযোগিতার জন্য তত্ত্বাবধায়কসহ নিয়োজিত আছে বেশ কিছু কর্মচারী। এই জমিদারবাড়ির বিশেষ বৈশিষ্ট্য এই যে এখানে মোগল আমলের যে স্থাপত্য ও নিদর্শন, তা অক্ষত অবস্থায় রয়ে গেছে। অথচ অনেক জমিদারবাড়ি যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে পরিণত হয়েছে ধ্বংসস্তূপে। অত্যাশ্চর্যের  বিষয়, এখনো অধিকাংশ স্থাপনার কিছু কিছু অংশ ঝকঝক-তকতক করছে। ১৯২৯ সালে সৈয়দ নবাব আলী চৌধুরীর ওয়াফাতের পর অদ্যাবধি তাঁর সমাধিস্থলে নিরবচ্ছিন্নভাবে কোরআন শরিফ পড়া হয়। একটানা প্রায় ৮০ বছর যাবৎ নিয়মিতভাবে এখানে প্রতিদিন পবিত্র কোরআন পাঠ চলছে। এর পাশাপাশি এখানকার ঝকঝকে সব নিদর্শন পর্যটকসহ সবাইকে বিস্মিত না করে পারে না। রয়েল রিসোর্ট আপনার জন্য এমন ব্যবস্থা করেছে, যেখানে ৪০০ বছরের পুরোনো ঐতিহ্যের ভেতর খুঁজে পাবেন আজকের আধুনিকতা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা, রাষ্ট্রভাষা বাংলা করার প্রথম প্রস্তাবক এবং ব্রিটিশ সরকারের প্রথম মুসলিম মন্ত্রী নওয়াব সৈয়দ নবাব আলী চৌধুরীর সেই ঐতিহ্যবাহী প্যালেসটি আজকের রয়েল রিসোর্ট। বর্তমানে যা পরিণত হয়েছে জনপ্রিয় পর্যটনকেন্দ্রে।

থাকবেন যেখানে

এখানে এলেই আপনি থাকবেন নবাবী স্টাইলে। তবে সেটা নির্ভর করছে আপনার সামর্থ্যরে ওপর। রয়েছে চার ধরনের আবাসনব্যবস্থা। মঞ্জিল (মূল প্রাসাদ), প্যালেস (কাচারিঘর), ভিলা (২০০ বছরের পুরোনো টিনশেড ভবন) এবং কটেজ (সম্প্রতি নির্মিত টিনশেড বাংলো)। মঞ্জিল এবং প্যালেসের খাট, সোফাসহ সব আসবাব প্রাচীন আমলের, যা নবাবেরা ব্যবহার করতেন। কিন্তু ভিলা এবং কটেজে নবাবদের আসবাব পাওয়া যাবে না। আবাসনব্যবস্থাভেদে দিন প্রতি ভাড়া এক থেকে পাঁচ হাজার টাকা। দল বেঁধে গেলে পাওয়া যায় বিশেষ ছাড়।

জমিদার বাড়ির প্রবেশপথ ও ধনবাড়ীর মসজিদ

রিসোর্টের পূর্বপাশেই রয়েছে বিশালাকার দিঘি। ৩০ বিঘার এই দিঘিতে যে কেউ মাছ ধরতে পারে। চড়তে পারে ডিঙিনৌকায়। পুরো বাউন্ডারিঘেরা এই রিসোর্টটি ঘুরে দেখার জন্য রয়েছে ঘোড়া ও ঘোড়ার গাড়ি। এখানে দেখা মিলবে গারোদের সংস্কৃতি। ঐতিহ্যবাহী গারোদের নাচ দেখতে হলে আগে থেকেই জানাতে হবে রিসোর্ট কর্তৃপক্ষকে। এ ছাড়া বিলুপ্ত প্রায় লাঠিখেলার ঐতিহ্য এখনো ধরে রেখেছে কর্তৃপক্ষ।

যেভাবে যাবেন

টাঙ্গাইল জেলার ঐতিহ্যবাহী ধনবাড়ী থানার উত্তর প্রান্তে টাঙ্গাইল থেকে ৬০ কিলোমিটার দূরে ঢাকা-জামালপুর মহাসড়কের সন্নিকটে অবস্থিত ধনবাড়ী জমিদার প্যালেসটি। ধনবাড়ী বাসস্ট্যান্ড থেকে মাত্র ১৫০ গজ দূরে ধনবাড়ী জমিদারবাড়িটির অবস্থান। ঢাকা থেকে সড়কপথে মাত্র তিন থেকে সাড়ে তিন ঘণ্টায় ধনবাড়ী জমিদারবাড়িতে পৌঁছা যায়।

তথ্যসূত্র: ইন্টারনেট ও বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর।

শামস আহমেদ

[email protected]

প্রকাশকাল: বন্ধন ৫০ তম সংখ্যা, জুন ২০১৪

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top