ঢাকার যেসব ঐতিহ্যবাহী ও নান্দনিক স্থাপনা সগৌরবে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে, আর্মেনীয় চার্চ তার মধ্যে অন্যতম। আর্মেনীয় চার্চটি আর সব চার্চ বা গির্জা থেকে একটু আলাদা। প্রতিটি চার্চ বা গির্জায় কবর বা সমাধিস্থলটা থাকে আলাদা কিন্তু আর্মেনীয় চার্চ পুরোটাই যেন সমাধিস্থল। আর এসব সমাধি দামি মার্বেল পাথর দিয়ে গড়া। একজন আর্মেনীয় নিকোলাস পোগজের হাতেই গড়ে উঠেছে আর্মেনীয় চার্চ বা চার্চ অব দ্য রিজারেকশন।
আর্মেনীয়দের ঢাকা আগমন
ষোড়শ শতকে পারস্যের সাফাতি শাসকেরা মধ্য এশিয়ায় তাঁদের আবাসভূমি আর্মেনিয়া জয় করে নিলে আর্মেনীয়রা বহির্বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। এ সময় বহু আর্মেনীয়রা ভাগ্যান্বেষণে ভারতবর্ষে আসে। মোগল সম্রাট আকবর তখন ভারতবর্ষের শাসক। সম্রাট আকবরের অনুমতি সাপেক্ষে আর্মেনীয়রা ভারতে ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনা, বসতি স্থাপন ও গির্জা নির্মাণ করে। সম্রাট আকবর পূর্ববঙ্গের অন্যতম ভূঁইয়া ঈশা খাঁকে পরাজিত করে সোনারগাঁ দখলে ব্যর্থ হয়ে বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে ঢাকার রাজধানী করার সিদ্ধান্ত নেন। সম্রাট জাহাঙ্গীর ঢাকায় ১৬০৮ সালে বাংলার রাজধানীর পত্তন করেন। বাংলার প্রথম সুবাদার নিযুক্ত হয়ে ইসলাম খাঁ ১৬১০ সালে ঢাকায় পা রাখেন। তখন থেকে ঢাকা ব্যবসা-বাণিজ্যের কেন্দ্রস্থলে পরিণত হয় এবং পরিচিতি পায় নগর হিসেবে। এ সময় বিশ্বের বিভিন্ন জাতির মানুষেরা ঢাকায় আসতে থাকে। পর্তুগিজ, আর্মেনীয়, ডাচ, ব্রিটিশ, ফরাসি, গ্রিক, চীনা, শিখসহ বহু জাতি ও সম্প্রদায় ঢাকায় এসে বসত গড়ে তোলে এবং ব্যবসা-বাণিজ্য করতে থাকে। ঢাকা এ সময় সত্যিকারের একটি কসমোপলিটন নগরে পরিণত হয়। এর আগে আর্মেনীয়রা পশ্চিমবঙ্গের পাটনা, মুর্শিদাবাদ, হুগলি, কাশিমবাজার ও কলকাতায় বসত গড়ে তোলে। এ সময়টায় তারা ঢাকায় এসে ব্যবসা-বাণিজ্য শুরু করে। অল্পদিনের মধ্যেই ব্যবসায় প্রভূত উন্নতি হয়। আর্মেনীয়রা মসলিন শাড়ি, পাট, মসলা ইত্যাদি এ দেশ থেকে ইউরোপ ও মধ্য এশিয়ায় রপ্তানি করত। বিদেশ থেকে তারা পাথর ও রাসায়নিক সামগ্রী আমদানি করত। আর্মেনীয়দের বৈশিষ্ট্য হলো, তারা যে দেশেই থাকে, একই এলাকায় ঐক্যবদ্ধ হয়ে বাস করতে ভালোবাসে এবং নিজস্ব স্থাপত্যরীতিতে ঘরবাড়ি ও গির্জা গড়ে তোলে। ঢাকায় আর্মেনীয়দের সংখ্যা বাড়লে তারা আরমানিটোলায় বসতি স্থাপন ও চার্চ নির্মাণ করে।

গির্জা নির্মাণ
শুরুর দিকে আরমানিটোলায় একটি ছোট্ট গির্জায় স্থানীয় আর্মেনীয়রা প্রার্থনা করত এবং কারও মৃত্যু হলে তেজগাঁও রোমান ক্যাথলিক গির্জার পাশে মরদেহ সমাহিত করত। ১৭৮১ সালে একজন বিত্তবান আর্মেনীয় নিকোলাস পোগজ বেশ কয়েক বিঘা জমি কিনে ক্ষুদ্র গির্জাটির স্থলে একটি বিশাল গির্জা নির্মাণ করেন। তাঁর স্ত্রী সোফিয়াকে (মৃত ১৭৫৪) গির্জার ভেতরে সমাহিত করা হয়। তিনি গির্জাটির নাম দেন চার্চ অব দ্য রিজারেকশন। গির্জাটি নির্মাণের জন্য মাইকেল সার্কিস, অকোটাবাটাসেতু সিভর্গ, আগা এমনিয়াস, মার্কার পোগজ প্রমুখ ঢাকায় অবস্থানকারী বিত্তশালী আরমানি সহায়তা করেন। প্রতিষ্ঠার পর এ গির্জায় প্রতি বোরবার প্রার্থনা অনুষ্ঠিত হতো। গির্জাটি নির্মিত হওয়ায় ঢাকার আর্মেনীয়দের উপাসনা ও সমাধিস্থল সংকটের নিরসন হয়। কথিত আছে, অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ ভাগে ঢাকায় আর্মেনিয়ান গির্জার উদ্বোধনের সময়ে আর্মেনিয়রা ব্যান্ড বাজিয়ে মিছিল করেছিল।
ঢাকায় আর্মেনীয়দের গির্জাটি স্থাপত্যশৈলীতেও অনন্য। চারদিকে উঁচু প্রাচীরবেষ্টিত গির্জাটির প্রবেশপথ বিশাল ও জমকালো। গির্জাটির অবস্থানও বিচিত্র। এর পেছনের দিকটি পূর্ব দিকে এবং সামনের দিকটি পশ্চিম দিকে অবস্থিত। মূল গির্জাটি গ্রিক স্থাপত্যরীতি অনুসরণে নির্মিত। এর বৈশিষ্ট্যময় মিনারটি চার স্তরবিশিষ্ট। গির্জার শীর্ষে ক্রস চিহ্ন রয়েছে। গির্জার ভেতর উপাসনাকারীদের বসার চমৎকার ব্যবস্থা রয়েছে। একসঙ্গে শতাধিক নর-নারী বসে প্রার্থনা করতে পারে। গির্জার সঙ্গে আছে একটি দৃষ্টিনন্দন এপিটাফ। গির্জার আশপাশে রয়েছে অসংখ্য কবর। গির্জার পশ্চিম প্রান্তে ওয়ার্ডেন এবং কাস্টোডিয়ানের বাসগৃহ রয়েছে। বর্তমান ওয়ার্ডেন মার্টিন এখানে বাস করছেন। তিনিই বর্তমানে ঢাকায় বসবাসরত একমাত্র আর্মেনীয়।
গির্জা বৃত্তান্ত
আয়তকার গির্জাটি লম্বায় প্রায় সাড়ে ৭০০ ফুট। সমতল ছাদের গির্জাটি উভয় পাশে পলেস্তারা করা ইটের নির্মিত। গির্জার বিশালাকার চারটি প্রবেশপথ ও ২৭টি জানালার সবই কাঠের খড়খড়ির। গির্জা ভবনের ভেতরের মেঝে তিনভাগে বিভক্ত। এতে রয়েছে রেলিং ঘেরা একটি বেদি। মাঝের অংশে দুটি ফোল্ডিং প্রবেশপথ। তৃতীয় ভাগটি মহিলা ও শিশুদের জন্য বেষ্টনী দিয়ে পৃথক করা। এর ওপরের দিকে রয়েছে একটি গ্যালারি। দেয়াল থেকে ৪ ফুট দূরে অর্ধবৃত্তাকারে ১০ ফুটের মতো উঁচু একটি বেদি। আছে ওপরে ওঠার সিঁড়ি। গির্জার ভেতর এখনো আছে একটি তৈলচিত্র। ইতিহাসবিদ অধ্যাপক মুনতাসীর মামুনের মতে, এই চিত্রকর্মটি চালর্স পোট নামক এক চিত্রকরের আঁকা। চালর্স পোট ছিলেন পোগোজ স্কুলের তৎকালীন প্রধান শিক্ষক। কর্নেল ডেভিডসনের ভাষায় ঢাকার আরমানি চার্চ ‘১৪ ফুট প্রশস্ত এক বারান্দা দিয়ে গির্জায় ঢুকতে হয়। দালানের ভেতরের মেঝে তিনভাগে বিভক্ত; রেলিং ঘেরা একটি বেদি, মাঝখানের অংশে রয়েছে দুটি ফোল্ডিং দরজা, শেষভাগটি বেষ্টনী দিয়ে আলাদা করা, যাতে শুধু বসেন মহিলা ও শিশুরা। এর ওপরে একটি গ্যালারি। দেয়াল থেকে ৪ ফুট দূরে অর্ধবৃত্তাকার একটি বেদি, সম্ভবত কাঠের তৈরি এবং ১০ ফুটের মতো উঁচু। ওপরে ওঠার সিঁড়িতে ৩ ফুট করে লম্বা ২৪টি মোমবাতি আর চকচকে ধাতুর কয়েকটি ক্রুশ।’

ক্লক টাওয়ার
১৮৩৭ সালে গির্জার পশ্চিম পাশে যুক্ত হয় একটি ক্লক টাওয়ার। গির্জার ১৫ ফুটের মধ্যে চূড়ায় চারটি শঙ্খিল মিনারের বর্গাকার টাওয়ার ছিল স্থুল। টাওয়ারটির চার দেয়ালের মাঝে মাটি থেকে কয়েক ফুট উঁচুতে দেয়ালে লাগান একটি মার্বেল ফলক। এ ফলকে আরমানি ও ইংরেজিতে লেখা- ‘মি সার্কিস ঈশ্বরকে উৎসর্গ করছেন এই চমৎকার জাঁকাল মিনার।’ আর এর ঘণ্টা ধ্বনি পৌঁছে যেত বহুদূর পর্যন্ত। ঢাকাবাসী এই ঘণ্টার শব্দেই ঠিক করে নিতেন তাঁদের দৈনন্দিন কার্যসূচি। উনিশ শতকের মাঝামাঝিতে আরমানিদের অনেকের জমিদারি হাত ছাড়া হতে শুরু করে। আরমানিদের ব্যবসায় মন্দা দেখা দিলে ব্যয় সংকোচনের জন্য ১৮৮০ সালে ঘণ্টাটি বাজানো বন্ধ করে দেওয়া হয়। ১৮৯৭ সালের ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত হয় ঘণ্টাঘরটি।
আরমানীয় কবর
গির্জায় প্রবেশমুখে রয়েছে প্রায় ১৪ ফুট প্রশস্ত বিশাল বারান্দা। গির্জার প্রার্থনা ঘরের অপর তিন পাশে প্রায় চার শর মতো আরমানীয় কবর। বারান্দায় বিভিন্ন আরমানি খ্রিষ্টানের স্মরণে স্থাপিত আছে স্মৃতিফলক। সমাধিগুলোর মধ্যে সবচেয়ে আকর্ষণীয় পাশাপাশি থাকা দুটি সমাধি। এর একটি আলেকজান্ডারের অপরটি ন্যান্সির। গির্জা সূত্রে জানা যায়, তাঁরা দুজন ছিলেন প্রেমিক-প্রেমিকা। আলেকজান্ডারের মৃত্যুর এক বছর পর মারা যায় ন্যান্সি। আলেকজান্ডারের সমাধির ওপর খোদাই করা ন্যান্সির বাণী লেখা আছে- Oh Dear, You are not alone, I am also here, Nancy. পুরো চার্চ ঘিরে শুধু কবর আর কবর। সব কবরই শ্বেতপাথরসহ নানা ধরনের মূল্যবান পাথর দিয়ে বাঁধাই করা। তা ছাড়া মৃত ব্যক্তির নামসহ রয়েছে ফুল-পাখির বিভিন্ন নকশা। প্রাণের সমস্ত আবেগ ঢেলে মৃত ব্যক্তির উদ্দেশ্যে প্রতিটি কবরের গায়ে রয়েছে কাব্যময় লেখা।
ভাঙা হাতের এক নারীমূর্তি
ভাঙা হাতের এক নারীমূর্তি দাঁড়িয়ে আছে কবরের এপিটাফের ওপর। কীভাবে নারীমূর্তিটির হাত ভেঙেছে তা জানে না কেউই। হাত ভাঙার খবর জানা না গেলেও, কবরটি কার সেটা এপিটাফে উল্লেখ করা। মূর্তিটি ক্যাটচিক অ্যাভেটিক থমাসের সমাধি বা কবরের ওপর স্থাপিত। ক্যাটচিক অ্যাভেটিক থমাসের স্ত্রী শ্বেতপাথরের এই মূূূূর্তিটি কলকাতা থেকে আনিয়ে তা তাঁর প্রিয়তম স্বামীর কবরে স্থাপন করেন। তাঁর স্বামী মারা যান ১৮৭৭ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর ৫৬ বছর বয়সে। মূর্তিটির হাত কীভাবে ভেঙেছে তার সঠিক ইতিহাস কেউ বলতে পারে না। তবে বেশ কিছুদিন আগে একজন জার্মান মূর্তিটির ছবি তুলেছিলেন, তখন মূর্তিটির হাত ভাঙা ছিল না। পরবর্তী সময়ে তিনি আবার যখন বাংলাদেশে আসেন, তখন মূর্তিটিকে হাত ভাঙা অবস্থায় দেখতে পান।
নির্দিষ্ট দিনে প্রার্থনা
চার্চের বারান্দার সিলিংয়ের ওপর আছে বিশাল পিতলের ঘণ্টা। প্রার্থনাকক্ষে যেতে হলে বারান্দার সমাধির ওপর দিয়ে হেঁটে যেতে হয়। বারান্দা ছাড়া ভেতরে যাওয়ার আর কোনো পথ নেই। উনিশ শতকের শেষদিকে শহরে আরমেনীয়দের সংখ্যা কমতে থাকায় গির্জাটির রক্ষণাবেক্ষণে ক্রটি দেখা দেয়। জৌলুশ কমতে থাকায় এ সময় থেকে গির্জাটির নিজস্ব কোনো প্রিস্টের খবর জানা যায় না। এ কারণে বছরের একটি নির্দিষ্ট দিনে (সম্ভবত ১ জানুয়ারি) অন্য গির্জা থেকে প্রার্থনা পরিচালনায় জন্য প্রিস্ট আনা হতো। দিন দিন আরমানিদের সংখ্যা কমতে থাকায় এই প্রার্থনার দিনটি ছাড়া বছরের বাকি দিনগুলোতে গির্জার প্রার্থনার কক্ষগুলো বন্ধ থাকত।

শেষের আগে
ভারতবর্ষে ইংরেজ শাসনের গোড়ার দিকে ঢাকায় আর্মেনীয়দের প্রভাব-প্রতিপত্তি বাড়লেও বিংশ শতাব্দীর শুরু দিকে তা দিন দিন কমতে থাকে। এবং ধীরে ধীরে তারা একটি প্রভাবহীন সম্প্রদায়ে পরিণত হয়। এই চার্চটি ঢাকায় আর্মেনীয়দের একসময়ের সরব উপস্থিতির সাক্ষ্য বহন করছে। স্থাপত্যিক সৌন্দর্যেও চর্চাটি অনন্য। তাই দেশ-বিদেশের অসংখ্য পর্যটক দূর-দুরান্ত থেকে প্রতিদিন নান্দনিক এই চর্চাটি দেখতে আসে।
মেহেদী হাসান
প্রকাশকাল: বন্ধন ৪০ তম সংখ্যা, আগস্ট ২০১৩