জলছায়ার মতো মনে হানা দেয় ছেলেবেলার অনেক দুরন্তপনা। মনে করিয়ে দেয় স্মৃতিবিজড়িত দুঃসাহসিক ও উন্মাদনায় ভরপুর চঞ্চল ডানপিটে সময়কে। হারানো শৈশব-কৈশোরের দারুণ সব স্মৃতি তরুণ বৃদ্ধ সকলের মনে উঁকি মারে বার বার, যা জল রঙে হৃদয় গহিনে আঁকা। প্রখর রবির উত্তাপে সাইকেল চালানো কিংবা শীতের হিমেল বাতাসের ঝাপটায় ঘুড়ি ওড়ানো অথবা নদীর একূল থেকে ওকূলে সাঁতরে যাওয়ার মতো অগণিত হিরন্ময় কিশোর স্মৃতি সবার বেলায় রয়েছে। আর বর্তমান প্রজন্ম এখন শৈশব-কৈশোরের সময়টা কাটাচ্ছে স্কুল-কলেজের অতিরিক্ত বইয়ের বোঝা কাঁধে নিয়ে, নয়তো কম্পিউটার আর ইন্টারনেটের পর্দায় চোখ রেখে। যেটা জ্ঞানের ভান্ডার সমৃদ্ধ করে বিশ্বে মাথা তুলে দাঁড়াতে তাদের সহায়তা করছে।
বাল্যকালের ফেলে আসা স্মৃতি যাতে হারিয়ে না যায় এবং বর্তমানের বিশ্ব চ্যালেঞ্জে যেন আমাদের তরুণ প্রজন্ম পিছিয়ে না পড়ে এমন একটি নির্মল পরিবেশ তৈরি করতে হবে। আর এ ভাবনা থেকেই মোঃ বাহাউদ্দিন সাগর রাজধানীর বেগুনবাড়ীর হাতিরঝিলে প্রায় ৯.৫ একর জায়গায় Youth exposition Centre নামের একটি থিসিস প্রজেক্ট হাতে নেন। এখানে তরুণ প্রজন্মের জন্য সৃষ্টি হতে যাচ্ছে আধুনিক সব সুযোগ-সুবিধা সংবলিত এক্সপজিশন সেন্টার। জীবনকে সত্যিকারভাবে উপভোগ করার একটি আদর্শ স্থান হতে পারে এটি।

স্থপতি সাইফুল হক ও আশিক ভাস্কর মান্নানের অনুসারী শিক্ষার্থী মোঃ বাহাউদ্দিন সাগর শুরু করেন তার থিসিস প্রজেক্টের কাজ। স্থাপত্য কাজে তার সব সময়ের আদর্শ আধুনিক স্থাপত্যকলার পথিকৃৎ শ্রদ্ধেয় স্থপতি মাজহারুল ইসলাম। কেননা সনাতন স্থাপত্যশৈলী থেকে বেরিয়ে এসে তিনি আমূল পরিবর্তন এনেছেন অধুনা নির্মাণযজ্ঞে। আধুনিক সজ্জায় সজ্জিত করেছেন রাজধানী ঢাকা ও অন্যান্য শহরকে। এমন সব দেশবরেণ্য স্থপতির স্থাপত্যকর্ম অনুসরণ করে প্রায় ৪ মাসের প্রচেষ্টায় শেষ করলেন তার থিসিস প্রজেক্ট পেপার।
শুরু থেকেই তার পরিকল্পনায় ছিল ইয়ুথ এক্সপজিশন সেন্টারে প্রবেশপথের জায়গা রাখবেন একটু উঁচুতে, যেন ঢোকার সময় গ্যাদারিং সৃষ্টি না হয়। সেই সাথে পর্যাপ্ত আলো-বাতাস পাওয়া যায়। সমাজের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য কিছু করার ভাবনাটা বাহাউদ্দিন সাগরের বরাবরই ছিল। তাই তো তিনি ভেবে রেখেছেন অন্তত রাতের বেলা ভবনের নিচে দরিদ্র ছেলেমেয়েদের জন্য নৈশ স্কুলের ব্যবস্থা করার। দিনে দিনে হারিয়ে ফেলছি আমরা আমাদের পুরনো সব ঐতিহ্য। প্রতি বছর ডিসেম্বরের শেষ দিনে পুরান ঢাকাবাসী শাকরাইন নামের বিরাট এক ঘুড়ি উৎসব পালন করে। কিন্তু রাজধানীর সব জায়গা থেকে সেখানে গিয়ে তা উপভোগ করা সম্ভব হয় না। তাই প্রকল্প এলাকার একাংশে আয়োজন করা যাবে ঘুড়ি উৎসবের। প্রকল্প এলাকার ৯.৫ একরের মধ্যে ৩.৫ একর জায়গা জুড়ে নেওয়া হয়েছে লেক করিডর এরিয়া যেখানে থাকবে বোটিং সিস্টেম বা নৌকা চালনার সুযোগ এবং যাতায়াত ব্যবস্থার জন্য এর সাথে সংযোগ দেওয়া হবে ৫ থেকে ৬টা ব্রিজ। বোটিং সিস্টেমের কারণে নিকেতন, গুলশান, তেজগাঁও, রামপুরাসহ কয়েকটি এলাকাতে যাতায়াত সহজ হবে।

যে সুবিধা পাওয়া যাবে ও সমাধান হবে যে সমস্যাগুলোর
- এটা একটা নিচু নির্মাণাধীন স্থাপনা বিশিষ্ট এলাকা।
- এই জায়গায় ৩ দিক থেকে প্রবেশ করা যায়।
- জমির পেছনের দিকে শিল্প কারখানার পাশাপাশি রয়েছে কিছু আবাসিক এলাকাও।
- এই প্রজেক্ট হাতিরঝিল প্রকল্পের পরিবেশ এবং আশপাশের বসবাসকারীদের জন্য একটি ভালো বিনোদনের জায়গা হতে পারে।
- এই জমির পূর্ব দিকে হাতিরঝিল লেকের অবস্থান।
- সরাসরি তেজগাঁও-গুলশান লিংক রোডের সাথে সংযুক্ত।
- লেকের উপর দিয়ে সংযুক্ত ব্রিজটি প্রজেক্টের সাথে মগবাজার, রামপুরাকে সংযুক্ত করেছে।
যে কারণে ইয়ুথ এক্সপজিশন সেন্টার
তারুণ্যের বয়সসীমা ধরা হয় ১১ থেকে ২৪ বছর। এই বয়সসীমায় শুধু ঢাকা শহরই নয়, দেশের নানা স্থানের তরুণেরা আজকের এই প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বের বহুমুখী চ্যালেঞ্জে নিয়মিত পরিসরে কয়েক ধাপ পিছিয়ে পড়ছে। বিশ্বের সাথে তাল মেলাতে পারছে না তারা তাদের মেধামননে। কয়েক ধাপ এগোনোর পরই মাঝপথে মুখ থুবড়ে পড়ছে নতুন কোনো সমস্যায়। তরুণ প্রজন্মের আবিষ্কার, বিজ্ঞান, শিল্পচর্চা করার সুযোগ-সুবিধা অথবা সহায়তা দুটোর একটাও পরিপূর্ণ অথবা পরিপূরকভাবে পাচ্ছে না তরুণেরা। অথচ এই বয়ঃসন্ধির তরুণেরা স্বপ্ন দেখতে শেখে এবং অন্যকে স্বপ্ন দেখাতে শেখায়। নির্ধারণ করে তাদের ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা। কিন্তু প্রয়োজনীয় অবকাঠামো এবং পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধার অভাবে তারা তাদের স্বপ্নময় আবিষ্কার, শিল্প চর্চার মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজকে পেছনে ঠেলে দিয়ে নিজেদেরকে নিমজ্জিত করছে আড্ডায় আর অনুৎপাদনশীল কাজে। অথচ তরুণ বয়সের এ সময়টা মানুষের জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময়। কারণ এই সময়ে একজন মানুষের চারিত্রিক, বাহ্যিক, মানসিক এবং শিল্পতাত্ত্বিক মনের বিকাশ ঘটে। যা পরবর্তীতে একটা জাতিকে তার অভীষ্ট লক্ষ্যে নিয়ে যেতে পারে।

প্রকল্পে যা যা থাকছে
ইয়ুথ এক্সপজিশন সেন্টারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে তরুণদের জন্য এটা একটা সঠিক সামাজিক শিক্ষা কেন্দ্র। এই প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরে থাকবে শিল্পচর্চা এবং বিজ্ঞান গবেষণা কেন্দ্র। ফলে একজন তরুণ নিজেকে বিজ্ঞানমনস্ক করে গড়ে তুলতে পারবে। পর্যাপ্ত পরিমাণ খালি জায়গায় থাকছে সাইকেলিং সুবিধা। পাশাপাশি থাকছে বড় গ্যালারি এবং সাংস্কৃতিক চর্চার জন্য বড় হলরুম। ঘুড়ি উৎসবসহ যাবতীয় জাতীয় অনুষ্ঠান আয়োজনের জন্য থাকছে খোলামেলা পরিসর।
বর্তমান যুগ তথ্যপ্রযুক্তির যুগ। তাই এই প্রজেক্টের আওতায় তথ্যকেন্দ্রের ব্যবস্থার পাশাপাশি থাকবে সাংবাদিক সম্মেলন কেন্দ্র ও আর্ট ইনস্টিটিউট, যেখানে থাকবে ছবি আঁকার সুব্যবস্থা। সেই সাথে খাবারের জন্য রয়েছে রেস্তরাঁ।

মোঃ বাহাউদ্দিন সাগর বাবা আলহাজ্ব রুহুল আমিন এবং মা রহিমা আমিনের ৩ সন্তানের মধ্যে প্রথম, জন্ম ১৯৮৭ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর। ২০০৪ সালে তিনি কমলাপুর হাইস্কুল থেকে এসএসসি এবং ২০০৬ সালে ধানমন্ডি কোডা কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। পরবর্তীতে আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ (এআইইউবি) থেকে স্থাপত্য বিদ্যায় বিএসসি করেন।
মারুফ আহমেদ
প্রকাশকাল: বন্ধন ৩২ তম সংখ্যা, ডিসেম্বর ২০১২