দুর্যোগকালীন ভ্রাম্যমাণ স্কুল

সময়ের সঙ্গে বাড়ছে শিক্ষার আনুপাতিক হার। তবে প্রাথমিক পর্যায়ের শিক্ষা সমাপনীতে অনেক সমস্যার মুখোমুখি হতে হয় শিক্ষার্থীদের। গ্রামাঞ্চলের স্কুলগুলো একটা থেকে আরেকটার দূরত্ব অনেক বেশি। প্রায়ই দেখা যায়, যোগাযোগব্যবস্থা উন্নত না হওয়ায় সব ধরনের গ্রামীণ পরিবহন প্রত্যন্ত এলাকায় পৌঁছাতে পারে না। এতে ব্যাহত হয় একটি ভালো মানের স্কুল নির্মাণ। আবার স্কুলগুলোর কাঠামো ব্যবস্থা এমন যে সেখানে কোনো ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ হলে পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়াটা সম্ভব হয় না কিংবা স্কুলটা সরানোর নেই কোনো ব্যবস্থাও। দুর্যোগপ্রবণ বাংলাদেশে বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, আইলা, সিডরের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রতিবছরই আঘাত হানে। এতে যেমন বাধাগ্রস্ত হয় পড়াশোনার স্বাভাবিক গতি, তেমনি ঝরে পড়ে অনেক শিক্ষার্থী। প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেন লেখাপড়ায় কোনো ধরনের বাধার কারণ না হয় সেই লক্ষ্যে সম্প্রতি খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (কুয়েট)-এর স্থাপত্য বিভাগ আয়োজন করেছিল জাতীয় পর্যায়ে একটি ডিজাইন প্রতিযোগিতার। ‘আনস্টপ-অ্যাবল স্কুলিং: কনটিনিউং এডুকেশন উইথ ডিজাস্টার’ শীর্ষক এ প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণকারী প্রথমস্থান অর্জনকারী ডিজাইনারের প্রকল্পের ধারাবাহিকতার অংশ এবারের প্রকল্পটি। প্রকল্পটির উদ্ভাবক বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট)-এর স্থাপত্য বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী মাহেরুল কাদের প্রিন্স। তার অংশগ্রহণকৃত প্রকল্পটির নাম ‘আনস্টপ-অ্যাবল স্কুলিং: স্কুল উইদেন স্কুল’ প্রজেক্টটি প্রতিযোগিতায় অর্জন করে দ্বিতীয় স্থান।

প্রজেক্টটির ডিজাইন করার আগে নিজ গ্রাম চট্টগ্রামের আনোয়ারার তৌলা দ্বীপের প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর ওপর একটি নিরীক্ষা করেন প্রিন্স। লক্ষ করেন, ওখানকার স্কুলগুলোর দূরত্ব এবং কথা বলেন শিক্ষার্থীদের সঙ্গে তাদের চাওয়া-পাওয়া নিয়ে। শিক্ষার্থীদের চাওয়া ছিল তাদের স্কুল হবে কাছাকাছি, যেখানে থাকবে পর্যাপ্ত আলো-বাতাস, ইচ্ছে হলে ক্লাসের বাইরে গাছের নিচে বসে করা যাবে পড়াশোনা, থাকবে খেলার পাশাপাশি নির্মল বিনোদনের ব্যবস্থা। ডিজাইনার প্রজেক্টটি এমনভাবে ডিজাইন করেন, যা কি না শুধু দুর্যোগকালীনই নয়, ব্যবহার করা যাবে দুর্যোগের আগে ও পরে। এবং স্থাপন করা যাবে দেশের যেকোনো এলাকায়।

দুর্যোগ প্রবণ এলাকার স্কুলের মডেল

স্কুল যখন নিজস্ব সম্পদ

যেকোনো দুর্যোগের সংকেত পেলে দুর্যোগ উপদ্রুত এলাকার লোকজন নিজেদের থাকার ঘরবাড়ি, নিত্যব্যবহার্য জিনিসপত্র ফেলে রেখে যায় নিরাপদ আশ্রয়ে। চেষ্টা করে সাধ্যমতো যতটুকু সম্ভব নিজের সম্পদগুলো নিয়ে যাওয়ার। আর এই ভ্রাম্যমাণ স্কুলটিই হবে তাদের একান্ত নিজস্ব সম্পদ ইচ্ছে করলেই যা কি না নিজেরা ঠেলে বা গরুর গাড়িতে করে সরিয়ে ফেলতে পারবে।

স্কুলের ডিজাইন

যেমন খুশি যেখানে খুশি তৈরি করা যাবে এ ধরনের স্কুল। যার ধরন কিছুটা বক্স আকৃতির। প্রয়োজন অনুযায়ী ছোট ছোট বাঁশের মডিউলারগুলো জোড়া দিয়ে বড় বা ছোট করা যাবে। আর এটি তৈরি করতে প্রয়োজন হবে না দক্ষ কোনো নির্মাণশ্রমিকের। স্থানীয় লোকজন কিংবা ছাত্রছাত্রীরা নিজেরাই তৈরি করতে পারবে। অধ্যাপক পাবলো পিকাসোর মতে, ‘সব শিশুই আর্টিষ্ট, কিন্তু বড় হলে কজনেই বা আর্টিষ্ট থাকে।’ পিকাসোর এই ভাবনার প্রভাবে ডিজাইনার স্কুলের প্রবেশ পথেই রেখেছেন একটি ট্রান্সপারেন্ড ল্যান্ড। লেখাপড়া শেষে তাদের আঁকা কিছু ছবি ওখানে রাখবে যা কি না চিত্রপ্রদর্শনীর কাজটাও করবে, যা ছাত্রছাত্রীদের সৃষ্টিশীল কিছু করতে উৎসাহিত করবে। বাঁশ কেটে মাঝখান থেকে চিরে তৈরি করতে হবে প্ল্যাটফর্ম। যেখানে ব্যবহার করা যেতে পারে হোগলার ছাল দিয়ে তৈরি বিশেষ ধরনের পার্টি। যেখানে বিদ্যুৎ নেই সেখানে আলো তৈরির জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে ১.৫ লিটার প্লাস্টিক বোতলে ওয়াটার এবং ব্লিচ সমন্বিত অনুষঙ্গ। সূর্যের আলো রিফ্লেকশনে যা কি না ৫০-৬০ ওয়াটের আলো উৎপন্ন করবে। আর প্রযুক্তিটি থাইল্যান্ডসহ অন্য দেশে নিম্নখরচে বাড়ি তৈরিতে ব্যবহৃত হচ্ছে। আবার ১০০ মি.মি. লেয়ার, ১০০ মি.মি. চার্কো, ২৫০ মি. সেন্ড, ২৫০ মি. গ্রাভেল এগুলোর লেয়ারের মাধ্যমে তৈরি হবে ফিল্টার। যেখানে সংরক্ষিত হবে বৃষ্টির পানি এবং তা ব্যবহার করা যাবে প্রয়োজনবোধে। স্কুলের সবার শেষের বক্সটা ব্যবহৃত হবে সার্ভিসিং বক্স হিসেবে। যেখানে জড়ো করে রাখা যাবে সব ধরনের ফার্নিচার। থাকবে টয়লেটের ব্যবস্থা। পাঁচ লিটারের ব্যবহারকৃত বোতলের ওপরের অংশ কেটে ফেলে পাইপিংয়ের মাধ্যমে বেচিং তৈরি করা যাবে। বন্যার সময় যদি পানি জমে যায় তাতেও স্থায়িত্ব পাবে স্কুলটি। এর জন্য প্রয়োজন কিছু ড্রাম সংযুক্ত করা, যার পাটাতনের সাহায্যে পানির ওপর ভাসতে থাকবে স্কুলটি।

স্কুলের স্ট্রাকচারাল মডেল

সেন্স অব বিলংগিং

দুর্যোগের সময় পড়াশোনা বন্ধ থাকবে এমন চিন্তা এখন করতে হবে না শিক্ষার্থীদের, যা কি না শিশুদের মানসিক দৃঢ়তা বিকাশে সহায়ক হবে। এখান থেকে শিক্ষার্থীরা শুধু লেখাপড়াই নয়, শিখবে নতুন সব টেকনোলজি সম্পর্কেও। যার ভবিষ্যৎ ফলাফলটা হবে দারুণ ইতিবাচক।

স্কুল তৈরিতে ব্যবহৃত বিভিন্ন উপকরণ

প্রকল্পটিতে যে ধরনে উপকরণ ব্যবহার করা হয়েছে, তা অনেক ব্যয়সাশ্রয়ী বা কম খরচের। রিসাইকেল পূর্ণ উৎপাদন করতে সক্ষম এমন আয়রন দিয়ে তৈরি করতে হবে একটি ট্রাক, যার ওপরে থাকবে বাঁশের তৈরি ফ্লোর। অর্থাৎ রিসাইকেল-অ্যাবল স্টিল, বাঁশ, কাঠ ও পানির বোতল প্রকল্পটির প্রধান নির্মাণ উপকরণ।

তানজিনা আফরিন ইভা

প্রকাশকাল: বন্ধন ৪০ তম সংখ্যা, আগস্ট ২০১৩

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top