কিছু মানুষের স্বপ্ন থাকে আকাশ ছোঁয়া। এমন কিছু মানুষের একই বৃত্তে এসে মিলিত হওয়ার মঞ্চ অ্যাকুয়া নেচার অ্যান্ড রিসোর্ট, যা এখন বাস্তবায়নের অপেক্ষায়।
শুরুর গল্পটা অনেকটা এ রকম। বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ বর্ষে নিজের পছন্দের প্রজেক্ট নিয়ে থিসিস করার সুযোগ হলে ইচ্ছে হয় এমন কিছু কাজ করার, যা প্রকৃতি ও মানুষের সহাবস্থান নিশ্চিত করবে। সাধারণত মানুষের পদচিহ্ন পড়লে প্রকৃতি রূপ নেয় মলিনতায়। কিন্তু স্থাপত্যর মূল বৈশিষ্ট্য প্রকৃতিকে কম বিনষ্ট করে প্রকৃতির আরও কাছাকাছি যাওয়া। কিন্তু ব্যাটে-বলে মিল ছিল না তেমন কোনো প্রজেক্ট। অবশেষে এর সন্ধান পেলাম বুয়েটের স্থাপত্য বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আহসান উল্লাহ মজুমদার স্যারের কাছে।
প্রকল্পটির অবস্থান সিলেটের শ্রীমঙ্গলে। শ্রীমঙ্গল শহর থেকে ১৯ কিলোমিটার দূরে বৌলাসি গ্রামের শেষ প্রান্তে হাইল হাওরের শুরুতে ১২০ একর জায়গার ওপর প্রকল্পটি ব্যক্তিমালিকানায় গড়ে উঠবে। প্রকল্প বাস্তবায়নকারী প্রতিষ্ঠান প্রোপার্টি মার্কেটিং (Property Marketing)।

সাইটটি প্রথম দেখার অনুভূতি এককথায় অসাধারণ, শহুরে ইট-কংক্রিটের জঞ্জালে বড় হওয়া কারও জন্য অদ্ভুত সুন্দর জায়গা এটি। বিস্তীর্ণ হাওরের মাঠে ছোট ছোট নৌকা ঘুরে বেড়াচ্ছে। শুনতে অদ্ভুত শোনালেও হাওরে এত বেশি জলজ উদ্ভিদ যে হাওরটাকে আস্ত একটা মাঠ বলে বিভ্রম হয়। নৌকা চলাচলের আলাদা রাস্তা স্বভাবতই তৈরি হয়ে আছে। এরও মাস খানেক পর গেলে দৃশ্যপট একেবারেই ভিন্ন তখন কিন্তু নৌকা নেই, পুরো জায়গাজুড়েই বিস্তীর্ণ সবুজ ধানখেত। এরও কিছুদিন পর গেলে দেখা মিলবে টলটলে পানিতে নীল আকাশের প্রতিবিম্ব। প্রকৃতির রং এখানে কখনো বা নীল, কখনো বা সবুজ, কখনো আবার দুয়ের সমন্বিত রূপ। এরই নাম হাইল হাওর। এই হাওরের একাংশে বাইক্কা বিল, যার সঙ্গে যুক্ত গোপলা নদী; যার আসল নাম গোপেশ্বরী।
বিচার-বিশ্লেষণ শেষে এই প্রকল্পটিকে দীর্ঘমেয়াদি করতে কিছু কর্মসূচি নির্ধারণ করা হয়, যার মূল লক্ষ্য ছিল পর্যটনশিল্পে অবদান রাখার পাশাপাশি এলাকার মানুষের জীবনমান উন্নয়ন। এই হাওরের ওপর জীবিকা নির্ভর করে অনেক মানুষের। ক্রমাগতভাবে মাছ ধরায় বিঘ্নিত হচ্ছে হাওরের পরিবেশ। একসময় এখানে প্রচুর অতিথি পাখি আসত, যার পরিমাণ ক্রমেই কমছে। যদি প্রকল্পের মাধমে স্থানীয় জেলেদের কাজের ব্যবস্থা করা যায়, তবে হাওরের মাছের ওপর নির্ভরশীলতা কমবে অনেকাংশে; বাড়বে মাছের উৎপাদন। এ হাওরে আসবে পরিযায়ী পাখি, আর এ পাখি দেখতে ছুটে আসবে টুরিস্টরা। সেই সঙ্গে আসবে প্রকৃতি ও পাখিপ্রেমী গবেষকেরাও। এলাকাটির উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য এখানে প্রচুর বাঁশ উৎপন্ন হয়। মহিলাদের তৈরি হস্তশিল্প যথাযথ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে বাজারজাত করা হবে প্রোপার্টি মাকের্টিংয়ের সৌজন্যে। কেননা মহিলাদের স্বাবলম্বী করে তাদের যদি সচেতন করা যায়, তবে মাছের প্রজননকালে মাছ ধরতে তারা বাধা দেবে। এ ছাড়া শিশুদের আলোকিত মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে এখানে গড়ে তোলা হবে একটি কমিউনিটি লাইব্রেরি। রিসোর্টটি গড়ে উঠলে এলাকার অধিবাসীদের বিকল্প কাজের সুযোগ সৃষ্টি হবে। তাদের ইকো গাইড হিসেবে প্রশিক্ষিত করে গড়ে তোলা সম্ভব হবে।

হাওরাঞ্চলের হাউস প্যাটার্ন (House Pattern) বা বাড়ির কাঠামো নকশা পর্যবেক্ষণ করে দেখা যায়, এদের উঠান রৈখিক বা লম্বিক (Linear Pattern)। পূর্বদিকে ঘরের দরজা। কারণ, দিনের বেশির ভাগ সময়ে এদের কাজ করতে হয় উঠোনে। পূর্ব ও পশ্চিমে ঘর থাকায় তারা সকালে উঠোনে রোদ পায় আর বিকেলে পায় ছায়া। এতে ধান, জাল শুকোতে সুবিধা হয়। এ ছাড়া উত্তর-পূর্ব কোণ থেকে ঝড় আসায় উত্তর দিক ফাঁকা রেখে বড় গাছ লাগানো হয়।
সবকিছুর পর যখন নকশা করা হয়, তখন যে ধারণা নিয়ে কাজ করা হয়েছিল। সেটা ছিল গৌতম বুদ্ধের একটি বাণী- ‘As a bee takes honey from the flowers, leaving its colour and frangrance unharmed, so should a coise man wonder in the village.’
‘বাঁশবাগানের মাথার ওপর চাঁদ উঠেছে ওই
মাগো আমার শ্লোক বলা কাজলা দিদি কই?’
গ্রামীণ মায়াময় এ দৃশ্যপট এখন কেবলই গল্প। গ্রামে এখন আগের সেই আমেজটা আর পাওয়া যায় না। তাই অ্যাকুয়া নেচারের প্রতিটা কটেজ তৈরি হবে মাটি, বাঁশ আর খড়ের ছাউনি দিয়ে। বাড়ি তৈরিতে এ উপকরণগুলো অধিক ব্যবহৃত না হওয়ার কারণ, রক্ষণাবেক্ষণ করতে হয় বেশি। কিন্তু গবেষণায় দেখা যায়, বাঁশকে যদি আগ থেকে বিটুমিনে ডুবিয়ে রাখা হয় অথবা বিশেষ রাসায়নিক দ্রব্য দ্বারা প্রক্রিয়াজাত করা হয়, তবে এর জীবনকাল বাড়ে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এখন এসব উপকরণ ব্যবহারে স্থাপনা তৈরি হচ্ছে; হচ্ছে আমাদের দেশেও। পুরো সাইটের মাত্র শতকরা দুই ভাগে স্থাপনা তৈরি করা হবে, বাকি অংশ দান করা হবে প্রকৃতিকে।

শতকরা দুই ভাগের এ অংশকে দুটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে; সাইটের শুরুর অংশে বন্যা না এলে পানি উঠবে না, এখানে তৈরি হবে একটি গ্রাম। গ্রামে প্রবেশের শুরুতে একটা ফ্রেমের মধ্য দেখা যাবে বটবৃক্ষ, তার পশ্চিমে থাকবে অভ্যর্থনা ডেস্ক, যেখানে রয়েছে পার্কিং-সুবিধাও। রিসোর্টের ভেতরে কোনো মোটরযান প্রবেশ করতে পারবে না। একটা অংশ গ্রাম, অন্য অংশটা ভাসমান। গ্রামাংশে চারটা ঘর নিয়ে একটা বাড়ি। এর মধ্যে দুটো ঘর মাটির, দুটো বাঁশের। একটা বাড়িতে লোকাল গাইড থাকবে যে টুরিস্টদের সেবা দেবে। থাকবে একটা দোতলা বাঁশের ঘর, যার নিচের তলায় থাকবে সবার জন্য ডাইনিং-সুবিধা। কিংবা বলা যায় আড্ডা দেওয়ার স্থান যার চারপাশে রইবে না কোনো দেয়াল। খনার বচন ‘পুবে হাঁস পশ্চিমে বাঁশ’ অনুসারে প্রতিটা বাড়ির পুবে থাকছে একটা পুকুর, পুকুরঘাট, পশ্চিমে বাঁশঝাড় ছাড়াও লাগানো হবে বড় গাছ। থাকবে কিছু ধানখেত, এই রিসোর্টে অতিথিদের প্রকৃতি দেখার আমন্ত্রণের জন্য স্থানে স্থানে থাকবে বসার সুব্যবস্থা। মূল রাস্তার একদিকে থাকবে বড় গাছ অন্যদিকে হাওর। রাস্তাটা উঁচু হবে যাতে বন্যার পানি ঢুকতে না পারে, বর্ষায় গ্রামে পানি এলে মনে হবে পুরো রিসোর্টটি পানির ওপর ভাসছে। দোতলা রেস্টুরেন্ট থাকবে ভাসমান অংশের কটেজে, যেখান থেকে সরাসরি আসা যাবে। অতিথিদের আপ্যায়িত করা হবে প্রাকৃতিকভাবে উৎপাদিত সবজি ও মাছ দিয়ে।
এ ছাড়া থাকবে বটতলা, যেখানে স্থানীয় সংস্কৃতিকে তুলে ধরা হবে। কেউ চাইলে উঠোনেও গানের আসর বসাতে পারবে। থাকবে বড় মাঠ যেখানে বিভিন্ন উৎসবে মেলা ছাড়াও আয়োজন করা যাবে নানা ধরনের অনুষ্ঠানের। কর্মচারীদের থাকার ব্যবস্থা হবে রিসোর্টে, থাকবে কিছু চায়ের দোকান। এ ছাড়া একটা বাঁশের খামার থাকবে যাতে নির্মাণ উপকরণ হিসেবে বাঁশের সহজলভ্যতা নিশ্চিত করা যায়।
এখানে গ্রাম্য খেলাধুলার পাশাপাশি অতিথিদের জন্যে থাকবে মাছ ধরা, নৌকায় ঘুরে বেড়ানোর চমৎকার সব ব্যবস্থা। কমিউনিটি পাঠাগারে প্রজেক্টরের সাহায্যে অডিও ভিজ্যুয়াল শো আয়োজন করা হবে, যাতে থাকবে স্থানীয় ও রিসোর্টে আগত অতিথিদের সরব উপস্থিতি। রিসোর্ট কর্তৃপক্ষ আগত অতিথিদের শ্রীমঙ্গলের অন্যান্য দর্শনীয় স্থান দেখানোর ব্যবস্থাও নেবে।
স্থানীয় উপকরণে নির্মিত ভাসমান কটেজটি নোঙর করা থাকবে বাঁশের তৈরি ট্রেইলের সঙ্গে। ভাসমান কটেজ বানানোর পেছনে মূল কারণ ওখানকার জলজ উদ্ভিদের বৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত না করা। এতে করে পর্যটকেরা ভিন্ন রকম এক আবহ পাবে। ভাসমান কটেজ ডিজাইন করার সময় যেসব বিষয় বিবেচ্য ছিল তা হলো- উপকরণগুলো স্থানীয়ভাবে সহজলভ্য এবং সহজে সংস্থাপনযোগ্য। যাতে স্থানীয় বাসিন্দারা সহজেই এটির রক্ষণাবেক্ষণ করতে পারে। স্থানীয় নির্মাণ উপকরণের মধ্যে রয়েছে বাঁশ; যা সহজে স্থানীয়ভাবে পাওয়া যায় এবং প্লাস্টিকের ড্রাম, যা দামে অত্যন্ত সস্তা। যেহেতু বাঁশ হচ্ছে ডিজাইনের মূল উপকরণ, তাই নির্মাণপ্রক্রিয়া স্থানীয়ভাবেই সম্ভব। যেকোনো সময় বাঁশের দেয়াল সরিয়ে শুধু ফ্রেমটাকে রাখা যাবে। কাঠামোর ওপরের এবং নিচের অংশের তীর্যক বন্ধনী একে টিকে থাকতে সাহায্য করবে। ট্রেইলের শেষ প্রান্তে থাকছে ওয়াচ টাওয়ার। রয়েছে পাখিদের আবাস্থল (Bird Sanctuary) করার পরিকল্পনাও।

রিসোর্টটি হবে সৌরবিদ্যুৎচালিত, যাতে ব্যবহার করা হবে না কোনো ধরনের ব্যাটারি, দিনের বেলায় অতিরিক্ত বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে অন্তর্ভুক্ত হবে এবং রাতে জাতীয় গ্রিড থেকে প্রয়োজনীয় বিদ্যুৎ ব্যবহার করা হবে। বর্জ্য ন্যূনতমকরণ, পুনর্ব্যবহার এবং পুনর্ব্যবহারযোগ্য করে তোলা রিসোর্টের কাজের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ। দূষিত পানি, রান্নাঘরের বর্জ্য এবং পয়োনিষ্কাশনজনিত আবর্জনাকে লাভজনক উদ্দেশে ব্যবহার করার জন্য এগুলো কাঁচামাল হিসেবে বিবেচিত হবে। কমিয়ে আনবে কর্মচারীদের প্রশিক্ষণ, ক্রয় পদ্ধতি এবং বর্জ্য প্যাকেজিং বিপুলভাবে। স্থানীয় কর্মচারীরা অধিকাংশ কার্ডবোর্ড এবং ধাতব প্যাকেজিংয়ের বিকল্প ব্যবহার করতে পারবে, ফলে প্রাথমিকভাবে বর্জ্য হিসেবে থাকবে প্লাস্টিক। বোতলজাতকৃত পানির প্লাস্টিক বোতল সংগ্রহ করে পুনর্ব্যবহার উপযোগী করার জন্য থাকবে একজন স্থানীয় পরিবেশক। অ্যাকুয়া নেচারে প্রকৃতি এ মহাযজ্ঞ দেখার অগ্রিম নিমন্ত্রণ রইল সবার।
তামান্না মান্নান
প্রকাশকাল: বন্ধন ৪৫ তম সংখ্যা, জানুয়ারি ২০১৪