জাতিসংঘ পার্ক

প্রতিনিয়ত নিজের সত্তাকে খুঁজে বেড়ানো মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। নগরায়ণের প্রচণ্ড চাপে যখন দৈনন্দিন নাগরিক-জীবনে নাভিশ্বাস উঠছে, সেই মুহূর্তে একটু প্রশান্তির স্পর্শ ক্লান্ত চেতনাকে সামান্য হলেও জাগিয়ে তোলে নতুন উদ্যমে। স্থাপত্য ও পরিকল্পনায়, বিশেষত ল্যান্ডস্কেপ ডিজাইনে তাই উন্মুক্ত স্থান বা উদ্যান কিংবা পার্ক স্থাপন ও সংরক্ষণ গুরুত্ব পায় সমভাবে। উন্মুক্ত এ উদ্যানগুলো নগরের সবুজের চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি মানুষের প্রশান্তি ও বিশ্রামের স্থান হিসেবে বিবেচ্য। এ কারণে পার্ক বা উদ্যান একটি গুরুত্বপূর্ণ নগর উপাদান (Urban Element) হিসেবে পরিচিত।

ব্যস্ত শহরে, ইট কংক্রিটের ভিড়ে এক টুকরো নৈসর্গিক সবুজের ছোঁয়ায় যেমন বদলে দেওয়া সম্ভব সবকিছু, তেমনটা কিন্তু আর কোনো কিছুতেই সম্ভব নয়। কেবল মানসিক প্রশান্তিই নয়, বরং বেঁচে থাকার অপরিহার্য উপাদান অক্সিজেন উৎপাদনেও বনায়নের কোনো বিকল্প নেই। তা ছাড়া এ পার্কে ঘুরতে আসা মানুষগুলো ক্ষণিকের জন্য হলেও সবুজের মাঝে শান্তি খুঁজে পায়, সামাজিক যোগাযোগের জন্য যার মূল্য বেশি ছাড়া কম নয়।

‘চট্টগ্রাম জাতিসংঘ উদ্যান’ দেশের বাণিজ্যিক রাজধানী চট্টলার বুকে তেমনই এক পার্ক। চট্টগ্রামের অত্যন্ত ঘনবসতিপূর্ণ পাঁচলাইশ আবাসিক এলাকায় পার্কটির অবস্থান। ১৯৫৯-৬০ সালে পাঁচলাইশ আবাসিক এলাকা গড়ে ওঠে। এরপর পেরিয়েছে দীর্ঘ সময়। নগরের প্রসারণ ও মানুষের নিজস্ব তাগিদে শহরে সবুজের সমারোহ দিন দিন কমেছে। এই কমে যাওয়া আশঙ্কাজনক হারে বাড়ে নব্বইয়ের দশকের শুরুতে। মানুষের অসচেতনতার ফাঁদে পড়ে শহরের বুক থেকে সবুজ যেন একেবারে হারিয়ে না যায়, সেই প্রয়াসে নব্বইয়ের শুরুতে জাতিসংঘের অর্থায়নে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের উদ্যোগে স্থাপিত হয় ‘চট্টগ্রাম জাতিসংঘ উদ্যান’।

সাইট প্ল্যান (মাস্টার প্ল্যান ২০০৭)

  • প্রায় ১ দশমিক ৭ একর জমিতে স্থাপিত পার্কটি স্থাপনের পেছনে যে যে উদ্দেশ্য কাজ করেছে তা হলো-
  • ঘনবসতিপূর্ণ আবাসিক এলাকার মধ্যে একটি সবুজের কেন্দ্রস্থল (Green Hub) তৈরি করা।
  • আবাসিক এলাকার মানুষের জন্য কেন্দ্রীয় বিশ্রামস্থল (Resting Space) গড়ে তোলা।
  • বাংলার ঐতিহ্যবাহী বাড়ির সম্মুখ উঠানের আদলে আবাসিক এলাকায় একটি উন্মুক্ত প্রাঙ্গণ (Open Courtyard) তৈরি করা।
  • কেন্দ্রীয় বাগান (নার্সারি) তৈরি করা।

পার্কে যেসব গাছ আছে
পলাশ, নারিকেল, নিম, আম, সোনালু, ঝাউ, ইউক্যালিপটাস, কাঁঠাল, জারুল, পেয়ারা, শিলকড়ই, কৃষ্ণচূড়া, নিম, সুপারি ও অন্যান্য।

একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত জাতিসংঘ পার্কটি এলাকার অধিবাসীদের সবুজের চাহিদা পূরণ করছিল ভালোভাবেই। কিন্তু ধীরে ধীরে কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা ও সঠিক রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে পার্কটি হারাতে থাকে তার আবেদন। পার্কটিতে লাগানো গাছ ও অন্য উদ্ভিদগুলোর পরিচর্যার অভাবে ঘটে সৌন্দর্যহানি। একই সঙ্গে অসামাজিক কিছু কর্মকাণ্ড পার্কটিকে অনেকটাই বিবর্ণ করে রাখে দীর্ঘদিন ধরে।

পার্কটির দৃশ্যমান যত সমস্যা
পাঁচলাইশের জলাবদ্ধতা সমস্যার কারণে পার্কটির চারপাশের রাস্তা ১ দশমিক ৫ থেকে ২ দশমিক ৫ ফুট উঁচু করা হয়, যে কারণে পার্কটিতে বৃষ্টির সময় পানি জমে থাকায় সব সময় স্যাঁতসেঁতে পরিবেশ বিরাজ করে।

পার্কটির নিজস্ব পয়োনিষ্কাশন লাইনে ফাটল ধরার পাশাপাশি নালাগুলো নষ্ট হওয়া পানি জমে থাকার অন্যতম কারণ।

পার্কের ল্যান্ডস্কেপে রয়েছে উদাসীনতা ও অযতেœর সুস্পষ্ট ছাপ। পায়ে চলা পথের ইটগুলো খসে পড়েছে কিছু স্থানে। মানুষের বসার জন্য নামকাওয়াস্তে জাহাজের কিছু অকেজো আসন ফেলে রাখা হয়েছে।

পার্কের প্রবেশপথেই রয়েছে দুই ফুট চওড়া একটি উন্মুক্ত নালা, যা লাফিয়ে পার হওয়া ছাড়া পার্কে প্রবেশের অন্য কোনো উপায় নেই। এতে যেকোনো সময় ঘটতে পারে অনাকাক্সিক্ষত দুর্ঘটনা।

মূল হাঁটার রাস্তার পাশে অনাকর্ষণীয় ও এলোমেলোভাবে বসার কিছু আসন ফেলা রাখা হয়েছে।

সাম্প্রতিক পরিবর্তন ও আইন লঙ্ঘন
২০১৩ সালে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন পার্কটির একটি বড় অংশজুড়ে একটি জিমনেশিয়াম ও সুইমিংপুল নির্মাণের কাজ শুরু করে, যা এই ছোট পার্কটির পরিসরকে আরও ছোট করে ফেলে। নির্মাণকাজের সুবিধার্থে কেটে ফেলা হয় অনেক গাছ। নির্মাণাধীন জিমনেশিয়াম ও পুল মোট পার্কের প্রায় ৩৩ শতাংশ এলাকাজুড়ে নির্মাণ করা হচ্ছে, যা বাংলাদেশের জলাধার সংরক্ষণ আইন ২০০০-এর পরিপন্থী।

বাংলাদেশে মহানগর, বিভাগীয় শহর ও জেলা শহরের পৌর এলাকাসহ দেশের সব পৌর এলাকার খেলার মাঠ, উন্মুক্ত স্থান, উদ্যান এবং প্রাকৃতিক জলাধারের পরিসর পরিবর্তন বা পরিবর্ধন করা যায় না। জলাধার সংরক্ষণ আইন ২০০০ অনুযায়ী, অনুমতি ব্যতীত খেলার মাঠ, উন্মুক্ত স্থান, উদ্যান এবং প্রাকৃতিক জলাধার হিসেবে চিহ্নিত জায়গার শ্রেণি পরিবর্তন করা যাবে না বা অনুরূপ ব্যবহারের জন্য ভাড়া, ইজারা বা অন্য কোনোভাবে হস্তান্তর করা যাবে না। এই ধারার উদ্দেশ্য পূরণকল্পে কোনো উদ্যানের মৌলিক বৈশিষ্ট্য নষ্ট হয়, এভাবে তার বৃক্ষরাজি নিধন নিষিদ্ধ। 

বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড (বিএনবিসি) অনুযায়ী, পার্ক অথবা উন্মুক্ত স্থানে ইমারত নির্মাণ করতে হলে,
১. ইমারতটি খেলাধুলা সম্পর্কিত হতে হবে।
২. ইমারত উচ্চতা চার মিটার (১৩ ফুট) এবং পুরো এলাকার আয়তনের মাত্র পাঁচ শতাংশজুড়ে নির্মাণ করা যাবে।

সিটি করপোরেশনের মতো স্বায়ত্তশাসিত একটি প্রতিষ্ঠানের পক্ষে এমন আইন ভঙ্গকারী পদক্ষেপ কোনোভাবেই কাম্য নয়। সুষ্ঠ আইনের প্রয়োগ ও বাস্তবায়নের মাধ্যমে এ ধরনের ঘটনা ভবিষ্যতে পুনরাবৃত্তি না ঘটানোই যেন হয় সবার সংকল্প। 

গ্রুপ: ল্যান্ডস্কেপ ডিজাইন অব এন আরবান পার্ক

শিক্ষার্থীবৃন্দ:
মো. রবিউল ইসলাম (০৯০৬০২০)
সারাহ বিনতে হক (০৯০৬০২৬)
মাহাদি মাহমুদুল হক (০৯০৬০৩০)

রবিউল, সারাহ, মাহাদি

প্রকাশকাল: বন্ধন ৫৪ তম সংখ্যা, অক্টোবর ২০১৪

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top