বিশ্বের বৃহত্তম জাতীয় উদ্যান নর্থইস্ট গ্রিনল্যান্ড পার্ক

নর্থইস্ট গ্রিনল্যান্ড পার্কে পর্যটকবাহী বিশেষ জাহাজ

নৈসর্গিক প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর আমাদের এই বসুন্ধরা। পাহাড়, নদী, সমুদ্র, জঙ্গল, উদ্ভিদ ও প্রাণবৈচিত্র্য যেন মিলেমিশে একাকার। আর এ সব প্রাকৃতিক অস্তিত্বের সংরক্ষণের জন্য বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশেই রয়েছে ন্যাশনাল পার্ক বা জাতীয় উদ্যান। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের পসরা সাজিয়ে রাখা এই পার্কগুলো নিজ নিজ সৌন্দর্যে একে অপরকে যেন ছাপিয়ে যায়! পার্কগুলোর মধ্যে কোনোটি এতটাই বিশাল, যা বিশ্বের বেশির ভাগ দেশের আয়তনের চেয়েও বড়। শুনতে অবিশ্বাস্য মনে হলেও এমনই একটি উদ্যান ডেনমার্কের নর্থইস্ট গ্রিনল্যান্ড পার্ক। আর এটিই বিশ্বের সবচেয়ে বড় জাতীয় উদ্যান। প্রকৃতির বিষ্ময় এই পার্কটি বিশ্বের পরিবেশ সুরক্ষায় রেখে চলেছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। অপূর্ব সুন্দর প্রাণবৈচিত্র্যে ভরপুর এই ন্যাশনাল পার্কটির আদ্যোপান্ত জানাচ্ছেন মারিয়া মিম

নর্থইস্ট গ্রিনল্যান্ড ন্যাশনাল পার্ক ডেনমার্কের প্রথম ও গ্রিনল্যান্ডের একমাত্র জাতীয় উদ্যান। এ ছাড়া বিশ্বের বৃহত্তম জাতীয় উদ্যান এবং ১০তম বৃহত্তম সংরক্ষিত এলাকা হিসেবে স্বীকৃত। বিশ্বের সবচেয়ে উত্তরের এ জাতীয় উদ্যানটি পৃথিবীর ২৯টি দেশের আয়তনের চেয়েও বড়। গ্রিনল্যান্ড আটলান্টিক ও আর্কটিক মহাসাগরের মাঝে অবস্থিত উত্তর আমেরিকা মহাদেশের এ স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলটি ডেনমার্কের অধীনে দ্বীপটি প্রায় ২১ লাখ ৭৫ হাজার ৬০০ বর্গ কি.মি. এলাকাজুড়ে বিস্তৃত আছে, যা ফ্রান্স, ব্রিটেন, জার্মানি, স্পেন, ইতালি, অস্ট্রিয়া, সুইজারল্যান্ড এবং বেলজিয়ামের সমান।

রাজনৈতিকভাবে উদ্যানটি গ্রিনল্যান্ডের অংশ হলেও ভূতাত্ত্বিকভাবে এটি উত্তর আমেরিকার অংশ। দ্বীপটি লরেকশিয়ার একই প্রিক্যামব্রিয়ান মহাদেশের অংশ, যা কানাডায় কানাডিয়ান শিল্ড নামে পরিচিত। ১৯৭৪ সালে প্রতিষ্ঠিত জাতীয় উদ্যানটি ১৯৮৮ সালে তার বর্তমান আকারে প্রসারিত হয়। উদ্যানটি বেশির ভাগ এলাকাজুড়ে গ্রিনল্যান্ডের তুষারাচ্ছাদিত ভূমি, যা প্রায় ১৮ লাখ বর্গ কি.মি. অঞ্চল বরফে ঢাকা। তবে এখানে একটা দীর্ঘ, রুক্ষ উপকূলরেখাও আছে সমুদ্র বরাবর। এটি গ্রিনল্যান্ডের অভ্যন্তরীণ এবং নর্থইস্ট উপকূলের ৯ লাখ ৭২ হাজার কি.মি. জায়গাজুড়ে বিস্তৃত।

নর্থইস্ট গ্রিনল্যান্ড পার্কের প্রাণীবৈচিত্র্য

জীববৈচিত্র্যের অনন্য এক লীলাভূমি এই জাতীয় উদ্যান। এটি পশুপাখিদের অভয়াশ্রম। কারণ উদ্যানটিতে মানুষের অবাধ প্রবেশ নিষিদ্ধ। এখানে প্রায় ৩১০ প্রজাতির ভাসকুলার উদ্ভিদের দেখা মেলে। যার মধ্যে ১৫ প্রজাতির উদ্ভিদ পৃথিবীর আর কোথাও নেই। এ ছাড়া প্রায় ৫০০ প্রজাতি বিশেষ উদ্ভিদ রয়েছে, যার মধ্যে ফুলের গাছ, হর্স টেইল এবং ফার্ন উল্লেখযোগ্য। এখানে প্রায় ৭০০ প্রজাতির ছত্রাক এবং প্রায় ৯৬০টি স্বতন্ত্র প্রজাতির শেওলা এবং অন্যান্য ব্রায়োফাইটও পাওয়া যায়। বিরল প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণীদের মধ্যে রয়েছে মাস্কষাঁড়, মরু ভালুক, আর্কটিক নেকড়ে, আর্কটিক খরগোশ, রেইন ডিয়ার এবং তুষার পেঁচা। জাতীয় উদ্যানটি দীর্ঘ উপকূলীয় অঞ্চলের মরুভালুক এবং ওয়ালবাসের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রজননক্ষেত্র। উত্তর পর্ব গ্রিনল্যান্ড ন্যাশনাল পার্কে পাওয়া সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রাণীগুলোর মধ্যে একটি হলো গ্রিনল্যান্ড কুকুর। গ্রিনল্যান্ডের কুকুরটিকে ইনুইট একটি গ্লেজ কুকুর হিসেবে প্রবর্তন করেছিল।

সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্য সম্পদেও গ্রিনল্যান্ড পৃথিবীখ্যাত। এখানকার সাগর উপকূলে সবচেয়ে বেশি দেখা যায় হুডেড ও গ্রে সিলদের। আছে সাদা বেলোগা তিমি। বিরল প্রজাতির জলজ স্তন্যপায়ী প্রাণী লম্বা দাঁতের ওয়ালবাস। রয়েছে পেবেগ্রিন ফ্যালকন। বড় পানকৌড়ি, গাঙচিলসহ রংবেরঙের নানা প্রজাতির পাখি। পার্কে দেখা সবচেয়ে সাধারণ পাখির মধ্যে রয়েছে গ্রেট নর্দান ডাইভার, বারনাকল গুজ, পিঙ্ক ফুটেড গুজ, কমন ইডার, কিং ইডার জিরফ্যালকন, স্নো আউল, স্যান্ডারলিং এবং বেভেন। সব মিলিয়ে পার্কটি জীববৈচিত্র্যের সত্যিকারের স্বর্গভূমি।

ডেনমার্ক ও গ্রিনল্যান্ডের জীবিকা, বাসস্থান, কৃষি, মৎস্য ও পরিবেশ সম্পর্কিত দুটি মন্ত্রণালয় পরিবেশ সংরক্ষণের দায়িত্ব ভাগ করে নিয়েছে। মন্ত্রণালয় দুটি প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ এবং এলাকার নিরাপত্তা নিশ্চিতে সহযোগিতা করে আসছে। ১৯৩০-এর দশকে ডেনমার্ক এবং নরওয়ের ‍নর্থইস্ট গ্রিনল্যান্ডের অধিকার নিয়ে মতবিরোধ ছিল। হেগের আন্তর্জাতিক বিচার আদালত ডেনমার্ককে এলাকার অধিকার দিয়েছিল কিন্তু বিনিময়ে দেশটিকে প্রমাণ করতে হয়েছিল যে তারা এলাকায় টহল বজায় রাখতে পারে। ১৯৪১ সালে ‘সিরিয়াস প্যাট্রল’ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। একটি ডেনিশ সামরিক ইউনিট, যা আর্কটিক কমান্ডের অধীন। প্রতি শীতে সিরিয়াস প্যাট্রলের সৈন্যরা কুকুরের গ্লেজসহ ১৬ হাজার কিলোমিটার উপকূলরেখায় টহল দেয় এবং গ্রীষ্মে তারা নৌকায় করে এলাকায় টহল দেয়।

গ্রিনল্যান্ড পার্কে ঈগল

গ্রিনল্যান্ডে অবস্থিত এই জাতীয় উদ্যানটি চারটি আবহাওয়া স্টেশন ও সিরিয়াল প্যাট্রল ব্যতীত জনবসতিহীন। তবু এই পার্কটিতে মানুষের উপস্থিতি লক্ষ করা যায়। এত প্রাণী ও উদ্ভিদবৈচিত্র্য থাকার কারণে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের গবেষকেরা এখানে আসেন। ফলে কিছুটা হলেও উদ্ভিদ ও প্রাণীদের ক্ষতির আশঙ্কা দেখা যায়। পার্কটি মূলত জনবসতিহীন এবং মানুষের তৈরি কাঠামো, যেমন পরিবহন রুট, তাই স্থলপথে পার্কে পৌঁছানো খুবই কঠিন। এখানে নিকটতম জনবসতি নর্থইস্ট ইত্তোককোটুরামট, যেটি গ্রিনল্যান্ডের সবচেয়ে দূরবর্তী শহর। সেখান থেকে সিল ও তিমি ব্যবসায়ীরা এখানে যাতায়াত করেন। শহরটির অর্থনীতি পরিচালিত হয় মূলত মাছ ধরা ও তিমি শিকারের ব্যবসার মাধ্যমে। তবে পার্কে শীতকাল কাটানো বেশির ভাগ লোকই সামরিক কর্মী এবং সাধারণত সিরিয়াস প্যাট্রলের সঙ্গে যুক্ত।

নর্থইস্ট গ্রিনল্যান্ড ন্যাশনাল পার্ক স্থানীয়ভাবে ‘কালাল্লিত নুনান্নি নুনা ইককি সিসিমাটিত্যক’ এবং ডেনিশরা একে ‘গ্রোনল্যান্জস ন্যাশনাল পার্ক’ নামেই অবহিত করে থাকে। প্রাক্তন ইনুইট বসতির অনেক চিহ্ন এখানে পাওয়া গেছে। প্রাচীনতম বসতিগুলো প্রায় ৪৫০০ বছর পুরোনো বলে মনে করা হয়। ইনুইট আজকের কানাজ থেকে বিভিন্ন তরঙ্গে অভিবাসিত হয়েছে এবং যদিও বেশির ভাগ লোক পশ্চিম উপকূল বরাবর দক্ষিণে চলে গেছে। কিছু দল গ্রিনল্যান্ডের পূর্ব উপকূল বরাবর ‍উত্তর এবং দক্ষিণে চলে গেছে। ১৯৭১ সালে দ্বীপে একটি উল্কাপিন্ড আবিষ্কৃত হয়েছিল।

ভৌগোলিক অবস্থানের পরিপ্রেক্ষিতে নর্থইস্ট গ্রিনল্যান্ড ন্যাশনাল পার্ক গ্রিনল্যান্ডের সমগ্র দ্বীপের প্রায় এক-চতুর্থাংশ জুড়ে রয়েছে। পার্কের অভ্যন্তরের বেশির ভাগ অংশে গ্রিনল্যান্ড আইস শিটের অংশ রয়েছে, যা দ্বীপের বেশির ভাগ ভূখন্ডের ওপর আধিপত্য বিস্তার করে। পার্কে ১২৬টি সুউচ্চ পর্বতচূড়া রয়েছে, যার সবকটিই তুলনামূলকভাবে উপকূলের কাছাকাছি পাওয়া যায়।

জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে দ্রæত বরফ গলায় সঙ্কটাপন্ন হয়ে পড়ছে পার্কটি

গ্রিনল্যান্ডের ন্যাশনাল পার্ক সংরক্ষিত হলেও কিছু কিছু অঞ্চলে সীমিত পর্যটকদের জন্য সুযোগ দেয়। দর্শনার্থীরা নৈসর্গিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারেন। স্থানটি হাইকিংয়ের জন্য একটি দুর্দান্ত জায়গা। কারণ দর্শনার্থীরা তুন্দ্রা এবং দর্শনীয় পবর্তমালার ল্যান্ডস্কেপ দেখে মুগ্ধ হন। আগত পর্যটকেরা এখানকার ওয়ারবাস, পাকিন, সিল এবং অন্যান্য প্রাণীর সৌন্দর্য মনভরে অবলোকন করেন। তবে সবচেয়ে আকর্ষণীয় পাসিং তিমির দর্শন লাভ। এ ছাড়া গ্রীষ্মকালে বন্য ফুল এবং বিভিন্ন বেরি জাতীয় ফল ও লতাগুলো থেকে বর্ণিল রঙের আনন্দদায়ক বিস্ফোরণ ঘটে, যা সত্যিই মনোমুগ্ধকর।

পার্কটিতে সংরক্ষিত উদ্ভিদ ও প্রাণী রবফে আচ্ছাদিত এলাকা সমগ্র গ্রিনল্যান্ডকে বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে রক্ষা করে। তবু এই পার্কটির জন্য বড় হুমকি জলবায়ু পরিবর্তন। দ্রুত বরফ গলার কারণে সমুদ্রের পানি বেড়ে বিপৎসীমার কবলে পড়ছে পার্কটি। বৈশ্বিক উষ্ণতা ও পরিবেশদূষণ কমানো না গেলে অদূরভবিষ্যতে হয়তো হারিয়ে যাবে নৈসর্গিক এ উদ্যানটি।

প্রকাশকাল: বন্ধন ১৬৪ তম সংখ্যা, এপ্রিল ২০২৪

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top