ইতিহাস ও সংস্কৃতির মেলবন্ধন ড্রাগন ব্রিজ

ভিয়েতনামের রয়েছে সমৃদ্ধ ইতিহাস ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। দেশটির অসাধারণ প্রাকৃতিক দৃশ্যও অত্যন্ত মনোমুগ্ধকর। তবে সবকিছু ছাপিয়ে গড়ে ওঠা আধুনিক সব স্থাপত্য ভিয়েতনামকে দিচ্ছে নতুন পরিচিতি। এসব স্থাপত্যের মাধ্যমে ফুটে উঠেছে দেশটির বর্ণাঢ্য ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি। সম্প্রতি ভিয়েতনামে যোগাযোগ খাতের উন্নয়নে নির্মিত হচ্ছে ব্যতিক্রমী স্থাপত্যশৈলীর নানা সেতু। এসবের মধ্যে অন্যতম আইকনিক এক সেতু ড্রাগন ব্রিজ। এই ব্রিজটি দেখতে কাল্পনিক ড্রাগনের মতো, যা দেশটির একটি অন্যতম জনপ্রিয় পর্যটক আকর্ষণও বটে। ভিয়েতনামের সবচেয়ে আশ্চর্যজনক এই সেতুটি বিশ্ববাসীর কাছে বেশ কৌতূহলদীপ্ত।

আকর্ষণীয় ড্রাগন সেতুটির চমকপ্রদ নানা তথ্য তুলে ধরছেন মারিয়া মিম

ড্রাগন ব্রিজটি ভিয়েতনামের দা নাং নগরের হান নদীতে স্থাপিত। এটি নগুয়েন ভ্যান লিন স্ট্রিট (হাই চাউ জেলা) থেকে ভো ভ্যান কিয়েট স্ট্রিট (সন ট্রা জেলা) পর্যন্ত বিস্তৃত। এটি মাই খে বিচ থেকে মাত্র ২ কিলোমিটার ও দা নাং আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে ৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। মনোরম হান নদীতে ব্রিজটি পূর্ব এবং পশ্চিম তীরকে সংযুক্ত করে যাতায়াতকে করেছে সহজ।

ড্রাগন ব্রিজ হলো বিশ্বের বৃহত্তম ড্রাগন আকৃতির ইস্পাত সেতু। এটি নির্মাণে ব্যয় হয়েছে ৮৫ মিলিয়ন ডলার। ড্রাগন ব্রিজ দা নাং স্থাপত্যে উদ্ভাবনের এক উজ্জ্বল উদাহরণ হিসেবে বিশ্বব্যাপী মনোযোগ আকর্ষণ করেছে। এর অস্বাভাবিক আর্চ সাপোর্ট সিস্টেম ডিজাইন ইন্ডাস্ট্রি এবং গ্লোবাল মিডিয়ায় ব্যাপক সম্মান অর্জন করেছে। এটি এমন এক অসাধারণ ঝুলন্ত সেতু, যা ভিয়েতনামের রীতিনীতি এবং বিশ্বাসে শ্রদ্ধা জানায়। সেতুটির অনন্য নকশায় রয়েছে ড্রাগনের মতো আকৃতির খিলান, যা সমৃদ্ধি, বৃদ্ধি এবং কৃষির জন্য সৌভাগ্যের প্রতীক। ড্রাগন ব্রিজ দা নাং শহরের ক্রমবর্ধমান উন্নয়নের প্রতীক। সেতুটি শহরের শক্তি এবং সমৃদ্ধিরও প্রতীক, কারণ ভিয়েতনামি সংস্কৃতিতে ড্রাগনকে পবিত্র প্রাণী হিসাবে বিবেচনা করা হয়। ব্রিজে ড্রাগনের লেজটি একটি প্রস্ফুটিত পদ্মফুলের আদলে নকশা করা হয়েছে।

ড্রাগন ব্রিজে যানবাহন ও পথচারী চলাচল

দা নাং-এর ড্রাগন ব্রিজটির নির্মাণ ছিল একটি একটি উচ্চাকাক্সক্ষী প্রকল্প। ২০০৫ সালে দা নাং-এর স্থানীয় সরকার ৮টি ডিজাইন পরামর্শদাতা প্রতিষ্ঠানের অংশগ্রহণে ড্রাগন ব্রিজের জন্য একটি আর্কিটেকচার ডিজাইন প্রতিযোগিতার আয়োজন করে। অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে ৪টি ভিয়েতনামি, ২টি জাপানি, ১টি জার্মান এবং ১টি মার্কিন প্রতিষ্ঠান ছিল। এই প্রতিষ্ঠানগুলো ড্রাগন ব্রিজের জন্য ১৭টি ডিজাইন প্রস্তাব করে। এই ডিজাইনগুলোর মধ্য থেকে চূড়ান্ত করা হয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আম্মান অ্যান্ড হুইটনি কনসালটিং ইঞ্জিনিয়ার্স ও লুই বার্জার গ্রæপের করা ডিজাইন। ২০০৮ সালে দানাং সিটির পিপলস কমিটি প্রকল্পটি নির্মাণ অনুমোদন দেয়। এর নির্মাণকাজ শুরু হয়েছিল ২০০৯ এর জুলাইয়ে এবং শেষ হয় ২০১৩ সালের মার্চ মাসে। দানাং শহরের স্বাধীনতার ৩৮তম বার্ষিকীতে ২৯ মার্চ, ২০১৩ তারিখে সেতুটি আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করা হয়।

এই দুর্দান্ত কাঠামোর পেছনে ছিল ইঞ্জিনিয়ারিং দক্ষতা। ড্রাগন ব্রিজটি নির্মাণে ব্যবহার করা হয়েছে স্টিল। এর দৈর্ঘ্য ৬৬৬ মিটার ও প্রস্থ ৩৭.৫ মিটার। দীর্ঘতম স্প্যান ২০০ মিটার (৬৬০ ফুট) যান চলাচলের জন্য রয়েছে ৬টি লেন। সেতুর মূল স্প্যান নির্মাণ ও সংযোজন ছিল প্রকল্পটির একটি উল্লেখযোগ্য মাইলফলক। স্থিতিশীলতা ও দীর্ঘস্থায়িত্বের জন্য এতে ৫ স্তরের আবরণ দেওয়া হয়েছে, যা সেতুটিকে ক্ষয় এবং আবহাওয়ার বিরূপ প্রভাব থেকে রক্ষা করে।

পাখির চোখে ড্রাগন ব্রিজ

আশ্চর্যজনক স্থাপত্যের পাশাপাশি এই সেতুটি তার চোখধাঁধানো পানি ও আগুনের পারফরম্যান্সের জন্যও সুপরিচিত। নিয়ন রঙের আলোর একটি সুরেলা সমন্বয় ড্রাগন সেতুর একটি বৈশিষ্ট্য। ড্রাগন ব্রিজটি রাতের বেলা যখন আলোকিত হয় এবং হঠাৎ করেই যখন আগুন বা পানি স্প্রে করে, তখন এটি হয়ে ওঠে আরও মোহনীয়। আগুন ও জলতরঙ্গের খেলা ওই পরিবেশে হয়ে ওঠে অত্যন্ত আকর্ষণীয়। ব্রিজটিতে চলাচলকারী ও আগত দর্শনার্থীরাও এই দৃশ্য দেখে স্বাভাবিকভাবেই হন মুগ্ধ। ড্রাগনের মুখ দিয়ে যখন আগুন বের হয় তখন তা দেখতে মনে হয় বাস্তবে কোনো ড্রাগন যেন নদীর তলদেশ থেকে বেরিয়ে শত্রæপক্ষের দিকে ছুড়ে মারছে আগুনের গোলা। আবার যখন পানির ফোয়ারা বের হয় তখন ছড়িয়ে পড়ে এক ধরনের স্নিগ্ধ ভাব।

ড্রাগন ব্রিজে নান্দনিক শো প্রদর্শনের জন্য সপ্তাহের শনি, রোববার ও সরকারি ছুটির দিনে রাখা হয় বিশেষ আয়োজন। ফায়ার শো শুরু হয় রাত ৯টায়। আলো, আগুন এবং জলের এই মন্ত্রমুগ্ধ প্রদর্শন সারা বিশ্বের দর্শকদের আকর্ষণ করে। উল্লেখ্য, ড্রাগন ব্রিজটির দৃশ্য ভালোভাবে উপভোগ করতে দর্শনার্থীদের কোনো টিকিট কাটতে হয় না। ড্রাগন ব্রিজ দিনের যেকোনো সময় ভ্রমণ করা যায়, তবে রাতে এর সৌন্দর্য হয়ে ওঠে অনন্য।

ড্রাগন ব্রিজের রাতের সৌন্দর্য

একনজরে ড্রাগন ব্রিজ
অবস্থান:
হান নদী, দা নাং নগর, ভিয়েতনাম
নির্মাণকাল: শুরু হয়েছিল ২০০৯ এবং শেষ হয় ২০১৩ সালে
স্থাপত্য নকশা: আম্মান অ্যান্ড হুইটনি কনসালটিং ইঞ্জিনিয়ার্স ও লুই বার্জার
নির্মাণ উপকরণ: স্টিল
মোট দৈর্ঘ্য: ৬৬৬ মিটার (২১৮৫ ফুট)
প্রস্থ: ৩৭.৫ (১২৩ ফুট)
দীর্ঘতম স্প্যান: ২০০ মিটার (৬৬০ ফুট)
ক্লিয়ারেন্স: ৭ মিটার (২৩ ফুট)
ব্রিজে ব্যবহৃত এলইডি বাল্ব: ২৫০০

প্রকাশকাল: বন্ধন ১৬৭ তম সংখ্যা, জুলাই ২০২৪

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top