কাঁসা-পিতলের শৌখিন শো-পিস

ঘরের সব আসবাব দেখলেই মনে হয় অনেক দামি; দরজা-জানালার পর্দার চেহারা বলে দেয় মাত্র কয়েক দিন আগেই শহরের কোনো অভিজাত শো-রুম থেকে কেনা হয়েছে; আর শো-পিসগুলোর কোনো কোনোটির জন্ম যে হাজার মাইল দূরে, তা বলার প্রয়োজন পড়ে না। এত দামি আর বিদেশি জিনিসের মাঝে হঠাৎ করে চোখে পড়ে দেশের কোনো অখ্যাত কারিগরের হাতে কাঁসা বা পিতলের তৈরি পুরোনো ছোট্ট একটা গ্লাস বা টেবিল ল্যাম্প অথবা একটা ফুলদানি, তখন মনে হয় সে যেন তার ঐতিহ্য আর আভিজাত্যকে আলাদাভাবেই জানান দিচ্ছে। অনেক দামি সাজসজ্জার মাঝে যখন দু-একটি কাঁসা, তামা বা পিতলের এন্টিক বা অতি সাধারণ কোনো শো-পিস চোখে পড়ে, তখন গৃহকর্তা বা গৃহকর্ত্রীর রুচির প্রশংসা না করে পারে না, এমনকি নাক উঁচু কোনো ব্যক্তিও। আগে ব্রোঞ্জ, তামা, কাঁসা বা পিতলের ঢাল, বর্শা, ছুরি, তৈজসপত্র প্রমাণ করত ব্যবহারকারীর শৌর্য-বীর্য ও বনেদিয়ানা। কিন্তু এখন এসব প্রমাণ দেয় শখ আর অভিরুচির।

কাঁসা হচ্ছে রাং বা টিন (Tin) আর তামা (Copper)-এর মিশ্রণে তৈরি এবং পিতল দস্তা (Zinc) ও তামা (Copper)-এর মিশ্রণে তৈরি মিশ্র ধাতু। এ দুটি ধাতুই গৃহস্থালির উপকরণ যেমন- থালা, বাটি, কলস, জগ, গ্লাস, বদনা, ঘটি, হাঁড়ি-পাতিলসহ বিভিন্ন ধরনের শৌখিন জিনিস যেমন- ফুলদানি, টেবিল-ল্যাম্প, ঝাড়বাতি প্রভৃতি তৈরিতে ব্যবহার করা হয়।

ইতিহাসের পাতায়
আমাদের দেশে কাঁসা-পিতলের ব্যবহার ঠিক কখন শুরু হয়েছে তার সঠিক ইতিহাস জানা নেই। নৃ-বিজ্ঞানী ও ইতিহাসবিদদের একাংশের মত, কংশ বণিকদের মাধ্যমে রাজা গৌড় গোবিন্দের সময় বাংলায় এ শিল্পের আবির্ভাব ঘটে। আবার অন্য অংশের আনুমান, আরও আগে অর্থাৎ রাজা অশোকের সময় ঠিক কাঁসা বা পিতল ব্যবহার না হলেও ব্রোঞ্জ ধাতুর ব্যবহার ছিল, যা অনেকটা কাঁসা-পিতলের মতোই। গৌড় গোবিন্দ, অশোক বা মোগল যে আমলেই বাংলায় প্রবেশ করুক না কেন, এটা একটা বনেদি ধাতু ছিল বরাবরই আর এ বিষয়ে দ্বিমত নেই করোই।

কাঁসার নানান তৈজসপত্র

নানামাত্রিক ব্যবহার
১৫৭৬ থেকে ১৭৫৭ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত অর্থাৎ মোগলদের শাসনামলে ভারত উপমহাদেশে ব্যাপকভাবে কাঁসা ও পিতলের যুদ্ধাস্ত্র তৈরি হতো। এর মধ্যে ঢাল, তলোয়ার, তীর-ধনুক, বন্দুক, কামান প্রভৃতি ছিল উল্লেখযোগ্য। ব্রিটিশ আমলেও এর ব্যবহার বাড়তে থাকে। জমিদার ও ভূস্বামীদের অন্যতম পছন্দ ছিল কাঁসা-পিতলের তৈজসপত্র। তাদের বৈচিত্র্যময় চাহিদা মেটাতে কর্মকাররা তৈরি করতেন নানা কারুকার্য খচিত বাসনপত্র। সেই সময় বিশেষ করে হিন্দু জমিদাররা পূজা অর্চনায় ও দৈনন্দিন ব্যবহারিক কাজে ব্যাপকভাবে এসব শৌখিন জিনিস ব্যবহার করতেন।

উপহার হিসেবেও এর কদর ছিল যথেষ্ট। ব্রিটিশরা জমিদারদের কাছ থেকে এসব উপহার পেয়ে এতই খুশি ছিল যে তারা ১৯৪২ সালে বার্মিংহামে আয়োজিত আন্তর্জাতিক হস্তশিল্প প্রদর্শনীর মাধ্যমে বাংলার কিছু শিল্পীকে শ্রেষ্ঠ পুরস্কারে পুরস্কৃতও করে। মূলত এ সময়ই কাঁসা-পিতলের কাজটি শিল্প হিসেবে স্বীকৃতি পায়। বাংলার ঘরে ঘরে কাঁসা-পিতলের ব্যবহার এতটাই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে যে চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী, টাঙ্গাইলের কাগমারী, জামালপুরের ইসলামপুর, বগুড়ার শিববাড়ী, ঢাকার ধামরাই ও শিমুলিয়া, মুন্সিগঞ্জের লৌহজংসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে গড়ে ওঠে কাঁসা-পিতলের কারখানা।

কাঁসা ও পিতল বাঙালির সংস্কৃতির সঙ্গে এমনভাবে জড়িয়ে আছে যে কোনো শ্রেণির বিয়ে, অন্নপ্রাসন, আকিকা, খতনা, জন্মদিনসহ সব সামাজিক অনুষ্ঠানের প্রধান উপহার হিসেবে এর স্থান ছিল প্রথম সারিতে। অনুষ্ঠানের ধরন অনুযায়ী গ্লাস, থালা, বাটি, চামচ, ফুলদানি, পানদানি, টব, কলসি, কড়াই, ধূপদানি, রেকাব, ট্রে ইত্যাদির জনপ্রিয়তা ছিল যথেষ্ট। উপহারদাতা ও গ্রহীতার নাম খোদাই করা এসব সামগ্রী শুধু যে লৌকিকতাই রক্ষা করত তা নয়, একজনের সঙ্গে আরেকজনের, এক পরিবারের সঙ্গে আরেক পরিবারের আন্তরিকতা ও সম্পর্কের পরিচয় বা সাক্ষী হিসেবেও এসব উপহার ছিল গুরুত্বপূর্ণ।

এখন যেমন পোর্সেলিন, পাইরেক্স, সিরামিক বা স্টেইলেস স্টিলের নিত্যব্যবহার্য জিনিস দেখলেই কোনো পরিবারের অর্থনৈতিক অবস্থা বা পারিবারিক ঐতিহ্য সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়, ঠিক তেমনি আশির দশক পর্যন্ত বাংলাদেশে কাঁসা-পিতলের তৈজস ছিল আভিজাত্যের মাপকঠি। বড় গৃহস্থ বা বনেদি ঘরে প্রত্যেক সদস্যের কাঁসা-পিতলের আলাদা আলাদা থালা, গ্লাস বা বাটি থাকত। এসবের ওপর থাকত নানা ধরনের কারুকার্য বা নকশা, কোনো কোনোটির ওপর থাকত ব্যবহারকারীর নাম খোদায় করা। গৃহকর্তার হুঁক্কাটি দেখলেই তাঁর রাসভারী চেহারা আর সামাজিক অবস্থান টের পাওয়া যেত বেশ ভালোভাবেই। এখনো অনেক পরিবারের খাবার টেবিলে কাঁসার থালা, বাটি, জগ, গ্লাস শোভা পায়।

এন্টিকের রাজকীয় তৈজসপত্র

কাঁসা-পিতলের তৈরি বাসনের নামও ছিল বেশ চমৎকার। যেমন- বাসনের নাম ছিল রাজভোগি, কাস্তেশ্বরী, বর্গী, দরাজ, রাধাকান্তি, বেতমুড়ি, মালাথাল, রাজেশ্বরী, রত্নবিলাশ, চায়নিজ ইত্যাদি। জগের নামের মধ্যে কৃষ্ণচূড়া, বক ঠোঁট, ময়ূর আধার, ময়ুরকণ্ঠি, মল্লিকা। আবার বাটির নাম জলতরঙ্গ, গোল বাটি, কাজল বাটি, ফুলতুলি বাটি, মালা বাটি, সাদা বাটি, রাধেশ্বরী, রামগী, ঝিনাই বাটি, বোল বাটি, কাংরি বাটি, রাজভোগিসহ আরও কত নাম! নিত্যব্যবহারের চামচের নামেও রয়েছে বৈচিত্র্যের ছোঁয়া; যেমন পদ্মমুখী, চন্দ্রমুখী, বোয়ালমুখী, হাতা, কবুতর ঝুঁটি, ঝিনাইমুখী, চাপিলামুখী ইত্যাদি।

ধর্মীয় সংস্কৃতির সঙ্গেও রয়েছে এর বিশেষ সম্পর্ক। মুসলমানদের মিলাদ-মাহফিল বা এ ধরনের অনুষ্ঠানে গোলাপজল ছিটানোর পাত্রটি, আতরদানি বা আগরবাতি জ্বালানোর জন্য স্ট্যান্ডটি এখনো দেখা যায় কাঁসা বা পিতলের। মন্দির বা পূজায় ব্যবহারের জিনিসপত্রের মধ্যে অনেক জিনিসই তৈরি হয় এই সংকর ধাতু দিয়ে। যেমন ঘণ্টা, সরাই, ধূপদানি, পল্লব, ত্রিশূল, পঞ্চঘণ্টা, কোষ-কুষি, মঙ্গলপ্রদীপ, পঞ্চপ্রদীপ, মঙ্গলঘট ইত্যাদি। পিতলের বুদ্ধ বা যিশুর মূর্তি যেমন দেখা যায়, তেমনি নটরাজ, উমা মহেশ্বর, তারা, ত্রিনাথ, শিব, পার্বতী, কালিয়া কৃষ্ণ, গণেশ, দুর্গাসহ বিভিন্ন পৌরাণিক চরিত্র শোভা পায় ভক্তদের ঘরে ঘরে।

এসব ঐতিহাসিক চরিত্রদের বর্তমান সূতিকাগার হচ্ছে ধামরাইয়ের কারখানাগুলো। এখানেই শিল্পীরা তাঁদের নিপুণ হাতে তৈরি করেন বিভিন্ন মূর্তি। যদিও একসময় ধামরাইয়ে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে সংগৃহীত শত বছরের পুরোনো এন্টিকসমূহ বেচাকেনা হতো। কিন্তু এখন এত এন্টিক আর পাওয়া যায় না বলে এখানে সেসবের রেপ্লিকা তৈরি হয়।

রকমারি ও নজরকাড়া সিরামিক ও মেলামাইনের দাপটে নিত্যব্যবহার্য দ্রব্যের তালিকা থেকে কাঁসা-পিতলের নাম কাটা পড়লেও এখনো ঘর সাজাতে বা ঘরের সৌন্দর্য বাড়াতে এর চাহিদা কমেনি এতটুকুও। যদিও দেশের শত শত কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে; বেকার হয়ে অন্য পেশায় চলে গেছে হাজার হাজার কংসশিল্পী। তারপরও ঢাকা শহরের বেশ কিছু ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বেশ ভালোভাবে টিকে রয়েছে তামা, কাঁসা বা পিতলের শৌখিন পণ্য সরবরাহ করে।

এন্টিক শো-পিস

দরদাম ও প্রাপ্তিস্থান
পরিবাগ সুপার মার্কেট, গুলশান ডিসিসি মার্কেট, এলিফ্যান্ট রোড, নিউমার্কেট, পুরান ঢাকার বকশিবাজার ও জেলখানার পাশের কিছু দোকান এখনো কাঁসা-পিতলের পণ্যসামগ্রী বিক্রি করছে। পরিবাগ সুপার মার্কেট ও গুলশানের ডিসিসি মার্কেটের কয়েকটি দোকান পুরোনো ও ব্যবহৃত জিনিস বিক্রি করে বেশি। পুরোনো বা ব্যবহৃত বলে এসব দোকানে দাম কম তা ভাবার কোনো কারণ নেই, বরং নতুন জিনিসের তুলনায় কয়েক গুণ বেশি দামে কিনতে হবে এখান থেকে। এলিফ্যান্ট রোডের এক দোকানে পিতলের একটি নতুন বাজপাখির দাম যেখানে দেড় হাজার টাকা, সেখানে প্রায় একই সাইজের পুরোনো বাজপাখির দাম পরিবাগে সাড়ে পাঁচ হাজার টাকা। যদিও এটা ঠিক কতো দিনের পুরোনো সে ব্যাপারে তাদের কাছে নির্দিষ্ট কোনো তথ্য নেই। এলিফ্যান্ট রোড, নিউমার্কেট ও পুরান ঢাকার ব্যবসায়ীরা তাদের দোকানে নতুন জিনিসই বিক্রি করে বেশি।

কাঁসা, পিতল বা তামার তৈরি জিনিস বরাবরই বিক্রি হতো ওজন করে। কিন্তু এখন কাঁসার থালা বা গ্লাস-বাটির মতো অল্প কিছু জিনিস ছাড়া বেশির ভাগ জিনিস বিশেষ করে শো-পিস যেমন, সুরাই, বাঘ, হরিণ, নৌকা, তাজমহল, ঘোড়া, হাতি, রিকশা ইত্যাদি ওজন করা হয় না।

পরিবাগ সুপার মার্কেট ও গুলশানের ডিসিসি মার্কেটের যেসব দোকানে পুরোনো জিনিস বিক্রি হয়, তাদের বেশির ভাগ ক্রেতাই বিদেশি পর্যটক বা দেশের বিত্তবান শৌখিন মানুষ। এখানে আকৃতিভেদে একটি পানের বাটা ২ হাজার থেকে ৪ হাজার ৫০০ টাকা; জগ ৪০০ থেকে ১ হাজার ৮০০ টাকা, কোনো কোনো ক্ষেত্রে ৩ হাজার ৫০০ টাকা; ফুলদানি ৩০০ থেকে ১ হাজার ৮০০ টাকা; বদনা ২ হাজার থেকে ৪ হাজার টাকা; হুঁক্কা ২ হাজার ৫০০ থেকে ১০ হাজার টাকা; জাঁতি ৩০০ থেকে ১ হাজার টাকা পর্যন্ত; বাচ্চা ও মহিলাদের চুড়ি ও বালা প্রতিটি ৫০০ থেকে ৬ হাজার টাকা দামে পাওয়া যায়।

এন্টিক শো-পিস

শেষের আগে
আসলে এসব দোকানে এত বৈচিত্র্যময় জিনিস পাওয়া যায় যে এর তালিকা করা বেশ জটিল। দামও নির্ভর করে প্রাপ্যতা ও কতটা পুরোনো তার ওপর। দাম যা-ই হোক, ঘর তো সাজাতে হবে। দু-একটা ছোট্ট জিনিস যদি আপনাকে, আপনার রুচিকে সবার থেকে একটু আলাদা করে নতুন মাত্রা দেয়, তাহলে ক্ষতি কী! তা ছাড়া শখ, ইতিহাস, ঐতিহ্য আর আভিজাত্য কি টাকার অঙ্কে পরিমাপ করা যায়?
আবু সুফিয়ান

প্রকাশকাল: বন্ধন ৭৪ তম সংখ্যা, জুন ২০১৬

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top